আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২৪ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
সমসাময়িক
মণিপুর এখনও অশান্ত
দিনের পর দিন পেরিয়ে মাসের পর মাস পেরোতে পেরোতে কোত্থেকে যেন পুরো একটা বছর পেরিয়ে গেল। কিন্তু মণিপুরে থামেনি রক্তপাত। ঘরছাড়া এখনও প্রায় সত্তর হাজারেরও বেশি মানুষ। নিহতের সংখ্যা সরকারি মতে সোয়া দু’শো পার। নিখোঁজ কতজন? কেউ জানে না। অথবা এখনও হিসেব করার সুযোগ হয়নি। সরকার হোক বা পুলিশ, সেনা বা আধাসেনা, কেউ জানে না, সংঘাতের শেষ কোথায়!
তার মধ্যেই রাজ্যে লোকসভা ভোটও হয়ে গেল। ভিন রাজ্যের শরণার্থী শিবিরে থাকা পরিবারগুলির অনেকেই ভোট দিতে পরেননি। ক্ষেত্র বিশেষে ভোট বয়কট হয়েছে। কত শতাংশ ভোট পড়েছে? জাতীয় নির্বাচন কমিশন নীরব। নির্বাচন কমিশন অবশ্যি বড়ো বড়ো রাজ্যের ভোটের হিসেবই যথা সময়ে দিয়ে উঠতে পারছে না। আর এ তো মোটে দুই কেন্দ্রের ছোট্ট রাজ্য মণিপুর। সরকার গঠনের ক্ষেত্রে মাত্র দুই সাংসদের ভূমিকা কতটুকু!
জাতীয় স্তরে মণিপুরের মতো ছোটো রাজ্যের গুরুত্ব এতই কম যে কোনো ডাকসাইটে নেতা এখানে নির্বাচনের প্রচার করতেও আসেন না। অথচ তাঁরাই আবার প্রয়োজনের তাগিদে দেশের অন্যত্র একই নির্বাচনী কেন্দ্রে একাধিকবার মঞ্চ আলো করে জনসভায় নরম-গরম ভাষণ দিতে অভ্যস্ত।
নির্বাচন তো সাম্প্রতিক ঘটনা। সংঘাত-সংঘর্ষ বিধ্বস্ত রাজ্যে এক বছরের মধ্যে একটি বারের জন্যেও প্রধানমন্ত্রীর পা ফেলার সময় হয়নি। তিনি তো বিশ্বের যাবতীয় সমস্যা নিয়ে সদাব্যস্ত। অধুনা যুক্ত হয়েছে নির্বাচনের ব্যস্ততা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গত এক বছরে নমঃ নমঃ করে মাত্র আড়াই-বার মণিপুরে এসেছেন। ৩রা মে, ২০২৩ সংঘর্ষ শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর মণিপুরে এসে তিনি বলে গিয়েছিলেন যে অতি দ্রুত শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। মুখের কথাই সার। হানাহানি বেড়েছে। প্রকৃতপক্ষে রাজ্যটা মেইতেই ও কুকি-জো দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্ত হয়ে গেছে। নভেম্বরের শেষে দ্বিতীয়বার কয়েক ঘন্টার জন্য মণিপুরে এসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেইতেই জঙ্গিগোষ্ঠী, ইউনাইটেড ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (ইউএনএলএফ)-এর সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের কথা জানিয়েছিলেন। যাকে, ‘ঐতিহাসিক মাইলফলক’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি আশাপ্রকাশ করেছিলেন যে, এই শান্তিচুক্তি উপত্যকার অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে (ভিবিআইজি) শান্তি প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে উৎসাহিত করবে। বলাই বাহুল্য যে এমন কোনো চুক্তি বাস্তবে কার্যকর হয়নি। আর শেষমেষ গত মাসে ঘন্টাখানেকের জন্য নির্বাচনী প্রচার। তাও জনসভা নয়। নিতান্তই দলীয় কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা।
ইত্যবসরে সমস্যা আরও ঘনীভূত হয়েছে। কুকি-জো সম্প্রদায়ের মানুষের ইম্ফল নদীর উপত্যকার সমভূমিতে বসবাস আগেই নিষিদ্ধ হয়েছিল এখন প্রবেশ নিষেধ। এই নিষেধাজ্ঞা যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে কি না দেখার জন্য চলছে চব্বিশ ঘন্টার কড়া নজরদারি। সামান্যতম ব্যতিক্রম ঘটলেই শুরু হয় গুলিবর্ষণ। এত অস্ত্র আসছে কোত্থেকে? কুকিদের থেকে মেইতেইদের ‘রক্ষার’ নামে মেইতেই যুবকরা ‘আরাম্বাই টেঙ্গল’ নাম দিয়ে জঙ্গি বাহিনী গড়ে রাজ্য সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ঢালাও আগ্নেয়াস্ত্র হাতে কার্যত সমান্তরাল সরকার চালাচ্ছে। এমন অরাজকতা স্বাধীন ভারতে বেনজির। প্রশাসন তো অনেক দিন ধরেই লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদন করে চলেছে। তাহলে কি প্রশাসনের কথা কেউ শুনছে না? উত্তর নেই।
পক্ষান্তরে পাহাড়ে মেইতেইদের প্রবেশ নিষেধ। সেখানে রয়েছে কুকি-জো জনজাতির সদাসতর্ক নজরদারি। আপাতত কুকি ও মেইতেই এলাকার মধ্যে সেতুবন্ধন করছেন মুসলিম পাঙ্গালরা। যানবাহন চলাচলের দায়িত্ব তাঁরাই পালন করছেন।
সংঘর্ষের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ৩ মে, ২০২৪ কুকি-জো এলাকায় পালিত হয়েছে ‘কালা দিবস’। ঘোষণা হয়েছে সর্বাত্মক বন্ধ। সব কুকি-জো বাড়িতে উড়েছে কালো পতাকা। মেইতেইরা দিনটিকে চিন-কুকি মাদক সন্ত্রাসীদের মণিপুর আক্রমণের বর্ষপূর্তি হিসেবে পালন করেছে। দিল্লির যন্তর মন্তরে মেইতেই অত্যাচারের বিরুদ্ধে একটি সমাবেশ করেছেন কুকি-জো গোষ্ঠীর কিছু সদস্য।
কুকিদের হাত থেকে সংরক্ষিত অরণ্য পুনর্দখলের চেষ্টায় উত্তেজনার সূত্রপাত। পরে মেইতেইদের এসটি মর্যাদা দেওয়া প্রসঙ্গে হাইকোর্টের একটি নির্দেশকে কেন্দ্র করে ৩ মে, ২০২৩ জনজাতিদের ডাকা মিছিল থেকে সংঘর্ষ শুরু। সংঘর্ষের সূচনা পর্ব থেকেই বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। রাজ্যের তথাকথিত ডাবল ইঞ্জিনের সরকার উত্তেজনা প্রশমনের বদলে নিষ্ক্রিয়তার ভূমিকা পালন করতে থাকে। একই সঙ্গে শাসকদলের আপ্তবাক্য ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ ভুলে গিয়ে মেইতেইদের স্বার্থ রক্ষায় মরিয়া প্রচেষ্টাও অব্যাহত রাখে। ফলাফল, ষাট লক্ষ মানুষের মণিপুরের সমাজ আজ আড়াআড়িভাবে দ্বিধাবিভক্ত। কুকি-জো সম্প্রদায়ের সত্তর হাজার শরণার্থীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মায়ানমার থেকে আগত আরও প্রায় পঞ্চাশ হাজার শরণার্থী। কুকি-জো সম্প্রদায়ের অন্য শাখার এই শরণার্থীরা মায়ানমারের সামরিক জুন্টার আক্রমণের শিকার।
রাজ্যের বিধানসভায় সাত বিজেপি বিধায়ক সহ রাজ্যের ১০ জন কুকি বিধায়কের মধ্যে দুই মন্ত্রীও আছেন। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে গত এক বছর সরকার বা মন্ত্রিসভার সম্পর্ক নেই। পৃথক কেন্দ্রশাসিত কুকিল্যান্ডের দাবিতে সরব কুকিরা। প্রতিবেশী রাজ্যের কুকি-জো সম্প্রদায়ের মানুষ এই দাবিকে সমর্থন করছেন। মিজোরাম সরকারও এই দাবির সমর্থক। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও বক্তব্য শোনা যায়নি।
মণিপুর হাইকোর্টের অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি ২০২৩ সালের ২৭ মার্চের একটি আদেশে মণিপুর রাজ্যে তফসিলি জাতির তালিকায় মেইতেই সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি বিবেচনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সেই নির্দেশ সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের অবস্থানের সঙ্গে মানানসই ছিল না। ২০২৩ সালের ২৭ মার্চের সেই নির্দেশের জেরেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল দেশের পূর্ব সীমান্তের প্রান্তিক রাজ্য মণিপুর। ২০২৪-এর ২১ ফেব্রুয়ারি এক পর্যালোচনা পিটিশনের শুনানির সময় বিচারপতি গোলমেই গাইফুলশিলু-র সিঙ্গল বেঞ্চ, নির্দেশটি প্রত্যাহার করেছে। নতুন নির্দেশনামায় বিতর্কিত অনুচ্ছেদটি মুছে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারপরেও এতগুলো দিন কেটে গেল। রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার সমস্যার সমাধানে এতটুকু সময় ব্যয় করেছে বলে জানা যায়নি।
এখন তো আবার নির্বাচনের ভরা মরশুম। মণিপুর নিয়ে এখন ভাববার সময় কোথায়! নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করে নতুন কেন্দ্রীয় সরকার কাজ শুরু করতে করতে জুন মাসের অনেকদিন পেরিয়ে যাবে। সুতরাং মণিপুরের সমস্যার আশু সমাধানের কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। উপরন্তু যেভাবে মণিপুরের সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে তাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা মোটেও সহজ কাজ নয়। বিভাজন প্রক্রিয়া বন্ধ করার বদলে সারা দেশে যেভাবে সামাজিক মেরুকরণ-বিভাজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মণিপুর। কাজেই মণিপুর কীভাবে কবে যে অশান্তিমুক্ত হবে তা দেশের নতুন সরকারের নীতির উপর নির্ভর করবে।