আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২৪ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
সম্পাদকীয়
সুপ্রিম কোর্ট, নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচন
বিগত কয়েক দিনে সুপ্রিম কোর্ট দুটি মামলার রায় দিয়েছে, যা রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে এই সময়ে যখন দেশে সাধারণ নির্বাচন চলছে। ১০ই মে ২০২৪, সুপ্রিম কোর্ট দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী এবং আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে অন্তর্বর্তী জামিন দেয়। এই জামিন দেওয়ার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে ইডি তথা কেন্দ্রীয় সরকারের আইনজীবীরা জোরালো সওয়াল করেন। কিন্তু মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট কেজরিওয়ালকে মূলত সাধারণ নির্বাচনে প্রচার করার জন্য জামিন প্রদান করেন। বিচারপতিরা জানান যে নির্বাচনে প্রচার করার অধিকার কেজরিওয়ালের রয়েছে, বিশেষ করে যেখানে তিনি একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং দেশের একটি বিরোধী দলের নেতা। অর্থাৎ কথা বলার অধিকার, গণতন্ত্রের যা প্রাথমিক শর্ত তাকে মান্যতা দিল সুপ্রিম কোর্ট। বিরোধী দলের নেতারা জেল খাটবে আর শাসকদলের নেতারা দাপিয়ে প্রচার করবে, তা কখনই গণতন্ত্রের জন্য শুভ হতে পারে না। মনে রাখতে হবে যে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের অপরাধ এখনও প্রমাণিত হয়নি। কাজেই তাকে জেলে বন্দী রাখার কোনো কারণ থাকতে পারে না। অন্যদিকে, ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকেও জেলে পোরা হয়েছে। তিনি কেজরিওয়ালের মামলার উদাহরণ দেখিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন জামিনের জন্য। আমরা আশা রাখব কেজরিওয়ালের মতোই সুপ্রিম কোর্ট হেমন্ত সোরেনকেও জামিন দেবেন নির্বাচনী প্রচারের উদ্দেশ্যে। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতারা মানুষের সামনে এসে তাঁদের কথা বলুন। মানুষের হাতে ছেড়ে দেওয়া হোক তাদের পছন্দ বেছে নেওয়ার অধিকার। এই নেতারা দোষী প্রমাণিত হলে, স্বাভাবিকভাবেই তাদের শাস্তি হবে এবং সংসদীয় রাজনীতিতে তারা আর অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। যতক্ষণ না তারা দোষী সাব্যস্ত হচ্ছেন, তাদেরকে নির্দোষ বলেই মানতে হবে। অতএব তাদের জামিন দিয়ে তাদের কথা জনগণকে বলার সুযোগ দেওয়াই ন্যায়।
এই ন্যায়ের মানদণ্ডকে সুপ্রিম কোর্ট আবারও সুরক্ষিত করলেন নিউজক্লিক-এর সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থের মামলায়। সুপ্রিম কোর্ট এই মামলার শুনানিতে জানান যে প্রবীর পুরকায়স্থকে যেভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং তাকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। প্রবীরবাবু জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। কিন্তু বিগত কয়েক মাস তাঁকে যে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করে জেলে রাখা হল তার দায় কে নেবে? একজন প্রবীণ মানুষকে এইভাবে গ্রেপ্তার করার একমাত্র কারণ হল এই যে স্বাধীন গণমাধ্যমের মধ্য দিয়ে তিনি এবং তাঁর কমরেডরা দেশের মানুষের সামনে মোদী সরকার এবং তাদের রাজনীতির সঠিক চিত্র তুলে ধরছিলেন। কিন্তু মোদীর দেশে সত্য কথা বললে অথবা মোদী বিরোধিতা করলে কপালে শাস্তি জুটতে পারে, যার প্রমাণ প্রবীর পুরকায়স্থ।
মোদী বিরোধিতা করলে যে জেল হতে পারে বা সরকারি রোষের কবলে পড়তে হতে পারে তা সাধারণ মানুষও এখন বুঝে গেছেন। এনডিটিভি-র জনক প্রণয় রায়, এনডিটিভি থেকে বিতাড়িত হওয়ার পরে একটি ইউটিউব চ্যানেল খুলেছেন। তাঁকে আবার দেখা গেল ক্যামেরা ও মাইক নিয়ে তিনি রাস্তায় মানুষের সঙ্গে ভোট নিয়ে কথা বলছেন বারাণসীতে। সেখানে একজন নিম্নবিত্ত মানুষকে তিনি প্রশ্ন করছেন যে ভোটে এবার কার পাল্লা ভারি মনে হচ্ছে? তাতে সেই ব্যক্তি প্রণয়বাবুকে বলছেন যে যদি তিনি মোদীর বিরুদ্ধে কিছু বলেন তাহলে তার জেল হতে পারে কেজরিওয়ালের মতন। সেরকম কিছু যদি হয় তাহলে কি রায়বাবু তাকে এসে বাঁচাবেন? ভোটের সময় সাংবাদিকরা প্রশ্ন করবেন মানুষের কাছে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর উত্তরে যদি একজন সাধারণ গরীব মানুষ বলেন যে মোদীর বিরুদ্ধে কিছু বললে তার জেল হতে পারে, তখন বোঝাই যায় যে দেশে একটি ভয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়ে আছে। মানুষ খোলা মনে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। মিডিয়া বলছে এবারের নির্বাচনটি খুব শান্ত এবং নিঃশব্দ। মানুষ যেন কিছু বলতে চাইছে না। এর কারণ কি ভয়, যদি কোনো ক্ষতি হয় রাজনৈতিক কথা বলে? একের পর বিরোধী নেতাদের জেলে পুরে, সাংবাদিক, ছাত্র, এনজিও সমস্ত ধরনের প্রতিবাদীদের কন্ঠরোধ করার পরে মোদীজি এখন ভোটের উৎসবে মেতে উঠেছেন।
কথা অবশ্য হচ্ছে না তা নয়। কথা বলে চলেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। একের পর এক বক্তৃতায় মুসলমান সমাজের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন। তাদের সরাসরি 'অনুপ্রবেশকারী' বলে দাগিয়ে দিচ্ছেন, তাদের হাতে হিন্দু মহিলাদের মঙ্গলসূত্র দিয়ে দেওয়া হবে, এই ধরনের জঘন্য কথা বলতে তার গলা কাঁপছে না! কাঁপবেই বা কেন! তিনি তার রাজনৈতিক কেরিয়ার তৈরি করেছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক রক্তক্ষয়ী রাজনীতির মাধ্যমে। তাই তার ভোটের জন্য হিন্দু-মুসলমান বিভাজনকারী রাজনীতি করায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু নির্লজ্জতার সমস্ত সীমা অতিক্রমকারী মানুষ হিসেবে মোদীর নাম দেশের ইতিহাসে লেখা থাকবে। মনোনয়ন পেশ করার আগে একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোদী বলছেন তিনি কখনও হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদকারী রাজনীতি করেন না। বলছেন, যেদিন তিনি হিন্দু-মুসলমান রাজনীতি করবেন সেদিন নাকি তিনি গণপরিসর থেকে সরে যাবেন। কিন্তু ঠিক তার পরের দিন আরেকটি নির্বাচনী সভায় তিনি আবার সেই মিথ্যা কথা বলেন যে কংগ্রেস নাকি তার শাসনকালে বলেছিল যে, দেশের রসদের উপরে প্রথম অধিকার মুসলমানদের। এই কথা বলে তিনি আবার হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের চেষ্টা করছেন, যেখানে আগের দিন তিনি বলছেন যে এরকম কথা তিনি কখনও বলেন না, এবং বললে তিনি গণপরিসর থেকে বিদায় নেবেন! কতটা মিথ্যাবাদী ও ভণ্ড হলে, দেশের মানুষকে কতটা বোকা ভাবলে আজকের মিডিয়ার যুগে দেশের প্রধানমন্ত্রী এরকম আচরণ করতে পারেন!
আসলে এবারের নির্বাচনে মোদী তথা বিজেপি-র দেশের মানুষকে তাদের নিজেদের সাফল্য নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই। তাই গোটা সঙ্ঘ পরিবার এবং মোদী সরাসরি সাম্প্রদায়িক বিভাজনের মাধ্যমে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টা করছেন। এরকম বিষময় নির্বাচনী প্রচার ভারতে আগে আদৌ কখনও হয়েছিল কি না, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়েছে। অনেক আইনজ্ঞ মনে করছেন মোদীর বিভিন্ন ভাষণ সরাসরি নির্বাচনী আচরণবিধির বিরুদ্ধে। কিন্তু হিমালয় সদৃশ ঔদাসীন্য নিয়ে বসে আছেন দেশের নির্বাচন কমিশন। ঠুঁটো জগন্নাথ কমিশন মোদীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অপারগ। ব্যবস্থা গ্রহণ করবেনই বা কী করে। দেশের কানুনকে পরিবর্তন করে নির্বাচন কমিশনার বাছাই প্রক্রিয়ায় আপাতত সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী শেষ কথা। অতএব যারা চাকরি দিল সেই প্রভুদের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন মুখ খুলতে পারছেন না। কিন্তু মুখ যখন আছে তখন তো খুলতেই হবে। অতএব, কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে বিরোধী নেতাদের চিঠি লিখে যখন উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে নির্বাচনে ভোটগ্রহণের হার সংক্রান্ত তথ্য নির্বাচন কমিশন সঠিকভাবে প্রকাশ করছে না, তখন সেই চিঠির জবাব লিখে খড়্গেকে একহাত নেয় কমিশন। যেই চিঠি তাদের লেখাই হয়নি, তার জবাব কেন তাদের দিতে হল, সেই প্রশ্ন তুললে তার কোনো উত্তর যথারীতি পাওয়া যাবে না। দেশের নির্বাচন কমিশনের উপরে যদি মানুষের বিশ্বাস টলে যায় তাহলে তা গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক প্রমাণিত হবে।
এই দমবন্ধকর পরিস্থিতির পরিবর্তন চাই। সেই পরিবর্তন করতে পারেন একমাত্র সাধারণ মানুষ। দেশে যদিও অর্ধেক আসনে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে, তবু বাকি পর্যায়ের নির্বাচনে এটা সুনিশ্চিত করা দরকার যে বিজেপি সরকার যেন পরাজিত হয়। ইতিমধ্যেই সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক চর্চা চলছে বিজেপি-র কমতে থাকা জনপ্রিয়তা নিয়ে। এই পরিস্থিতিতে বিরোধী রাজনীতি মানুষের সামনে এক বিকল্প নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। বাম ও কংগ্রেসের ইস্তেহারে যার আভাস আমরা পেয়েছি। এই ইস্তেহারের দাবিগুলিকে প্রচারের কেন্দ্রবিন্দুতে এনে প্রগতিশীল বিরোধী শক্তিরা মানুষের সমর্থন বাড়াতে থাকুন, এই আশা আমরা রাখব।