আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ নবম সংখ্যা ● ১-১৫ মে, ২০২৩ ● ১৬-৩১ বৈশাখ, ১৪৩০
প্রবন্ধ
জন-অরণ্য, কিছু ভাবনা অন্য
অম্লানকুসুম চক্রবর্তী
হিমাদ্রি আর নবনীতার প্রথম বিবাহবার্ষিকী। ভোরবেলা, পাখি সব করে রব-এর আগেই উইশ করেছে গুগল। ফুলশয্যার রাতের সুগন্ধি ফুলের ঝালরের মতো নোটিফিকেশন মোবাইল স্ক্রিনের ছাদ থেকে নেমে এসে বলছে, “হ্যাপি ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি, হিমাদ্রি অ্যান্ড নবনীতা।” দেখিয়েছে, এক বছর আগের সেই সুখমুহূর্তের ছবির কোলাজ। সন্ধেবেলা, পাত্র-পাত্রী এবং দু'পক্ষেরই মা-বাবাসমেত গেট টুগেদার হয়েছিল এ শহরেরই এক নামজাদা রেস্তোরাঁয়। গরম চাউমিনের ধোঁয়া আর লালায়িত সাইড ডিশের সুঘ্রাণের মধ্যে উড়ে এসেছিল, “একটা বছর হয়ে গেল। সামনের বছর এমন দিনে যেন আমাদের কোলে ছোট্ট খোকা থাকে, কিংবা রাজকন্যে। আর দেরি কোরো না তোমরা।”
লাইভ মার্গসঙ্গীতের অনুষ্ঠানে সেতার কিংবা সরোদের তার কেটে যাওয়ার মতো দুম করে বেসুরো হয়ে গিয়েছিল আনন্দ সমাবেশ। ছিটকে গিয়ে হিমাদ্রি বলে উঠেছিল, “আমাদের তো তেমন ইচ্ছে নেই। বাবা হতেই হবে এমন কোনও কথা আছে কি?” তালে তাল দিয়েছিল নবনীতা। বলেছিল, “কিলবিল করা এত লোকের মধ্যে আরেকজনকে নাই বা আনলাম। তাতে কার ক্ষতি? আর যদি বাবা-মা হতেই হয়, তাহলে দত্তক নেব কোনও অনাথ বাচ্চাকে। এটাই আমাদের ডিসিশন।”
ঝটিতি তলব পড়েছিল রেস্তোরাঁর ওয়েটারের। বিল মেটানোর পরে বাড়ি ফেরার রাস্তাতে গাড়ির বাহারি স্পিকার স্তব্ধতার সুর শুনিয়েছিল। বাড়ি পৌঁছে, বেডরুমের দরজা বন্ধ করে হাতে হাত রেখেছিল ওরা। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ইচ্ছেটা প্রকাশ করার মধ্যে যে আনন্দ আছে, তা লুটেপুটে উপভোগ করেছিল দুজনে। হলই বা বাবা-মা। কিংবা শ্বশুর-শাশুড়ি। যা খুশি ওরা বলে বলুক। ওদের কথায় কি আসে যায়।
খবরের কাগজে পড়া রিপোর্টের মতো হিমাদ্রি আর নবনীতার কথা উল্লেখ করার পরে বন্ধনী দিয়ে লেখা যেতে পারত, নাম পরিবর্তিত। তবে তার আর প্রয়োজন নেই। শহর-গ্রাম-গঞ্জ-মফস্বলের অন্য কোনও হিমাদ্রি কিংবা নবনীতা হয়তো এর মধ্যেই খুঁজে পেয়েছেন তাঁদের স্ট্যাটাস আপডেট। যে আপডেট প্রতিমুহূর্তে কলার তুলে সমাজকে জানান দিচ্ছে, প্রচলিত পিতা-মাতা-সন্তানের ধারণা এবার বদলে দেওয়ার সময় এসেছে। তাঁরা বলছেন, বংশলতিকার মধ্যে যে নিম্নগামী তীরচিহ্ন থাকে, একটা সময়ের পরে সেগুলো আর নাই বা নামল নীচে। বরং সেই চিহ্নগুলো ছলাত ছল নদীর জলের মতো আনন্দ-দোল খাক। তীরচিহ্নগুলো পয়েন্ট করুক এমন সব মানুষের নামের মাথায়, যাদের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও যোগ থেকে যায় আত্মার। আর এই আত্মিক সম্পর্কের মধ্যেই জেগে থাক বংশপরিচয়ের নুপুরধ্বনি।
‘অ্যান্টিনেটালিজম’ নামক শব্দের উপর, মতাদর্শের উপর নিয়ন আলোর প্রবাহ ক্রমশ বাড়ছে। পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে অ্যানিমেশন এফেক্টের মতো এই শব্দটি জুম-ইন হচ্ছে সমাজের আয়নায়। এই মতাদর্শে বিশ্বাস করেন যে মানুষেরা, তাঁরা মনে করেন, যত মানুষ থাকা দরকার ছিল এই দুনিয়ায়, তার তুলনায় মানুষের ভার অনেক বেশি। তাই বিবাহিত জীবন মানেই বছর কয়েক পরে নতুন সন্তানের উদয় - এই ধ্যানধারণার প্রচলিত, চিরাচরিত হাইওয়ের লেন বদল করতে তাঁরা শপথ নিয়ে ফেলেছেন মনের গভীরে। প্রশ্ন তুলছেন, জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে যে শিশুরা এই পৃথিবীতে বাঁচার ছাড়পত্র নিতে আসে, তাদের উদ্দেশে কি ডালি সাজিয়ে রেখেছি আমরা? তাঁদের দাবি, শিশুদের সেই বিরক্তি মেশানো কান্নাকে রিমোট দিয়ে মিউট করার সাধ্য যখন আমাদের নেই, তাহলে সেই কান্নার জন্ম দেওয়া কেন? সাবেকি বংশবৃদ্ধির ধারণাকে এক বিরাট প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। আর জিজ্ঞাসাচিহ্নের সেই আঁকশি চিরায়ত ধারণায় বিশ্বাসী মানুষদের গলা চেপে ধরতে শুরু করেছে ইদানীং। কারণ, যে যুক্তি এই মতাদর্শে বিশ্বাসী মানুষরা, অর্থাৎ, অ্যান্টিনেটালিস্টরা পেশ করছেন, তার অধিকাংশেরই কোনও পাল্টা, যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর নেই।
খুব বেশি আগের কথা নয়। মুম্বইনিবাসী এক সাতাশ বছরের যুবক দুম করে আদালতের পথে হেঁটেছিলেন তাঁর বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে। অভিযোগ গুরুতর। বলেছিলেন, আমাকে জন্ম দেওয়ার আগে আমার পিতামাতার একবার অন্তত জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল, আমি আদৌ এই পৃথিবীতে আসতে চাইছি কি না। এই অভিযোগ কলরবের মতো ধ্বনিত হয়েছিল দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে, টেলিভিশন চ্যানেলে, সোশ্যাল মিডিয়ায়। এমন অদ্ভুত প্রশ্নের জন্য বাহবা, শাবাস যত এসেছিল, তার থেকে ঢের বেশি এসেছিল ব্যঙ্গ, কটূক্তি। তাতে অবশ্য সেই যুবকের বয়েই গিয়েছে। বাবা-মায়ের থেকে এক টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিলেন তিনি। প্রতীকী। এক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের অঙ্কের থেকে উঁচু আসন নিয়ে ফেলেছিল ক্ষোভ ও অভিমানের ইনডেক্স। সামাজিক মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে যুবকটি যা জানান দিয়েছিলেন তা হল - হবু বাবা-মায়েদের হৃদয়ের গভীরে আমি একটা ভয়ের প্রদীপ জ্বেলে দিতে চাই। এর একমাত্র কারণ, নতুন প্রাণ পৃথিবীতে আনার আগে তাঁরা ভাবেন না মোটে।
নয়া প্রাণসঞ্চারে বিশ্বাসী নন যাঁরা, তাঁদের বলার জন্য হাজারো যুক্তি আছে আজ এই দুনিয়ায়। তাঁরা সমস্বরে আওয়াজ তুলে বলছেন, ‘৮০০ কোটি মানুষের এই বিশাল গ্রহে আরেকটি প্রাণ আনার যৌক্তিকতা কি?’ স্বেচ্ছায় নিঃসন্তান আমার এক বন্ধুদম্পতি খবরের কাগজের পাতা উঁচিয়ে ধরে বলেছিলেন, “১২ পাতার এই কাগজে একটা মন ভাল করা খবর বাতলে দাও ভাই।” কাগজের সেই রাশি আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন ওঁরা। দেখেছিলাম, দেশের নামজাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার চাপ সহ্য করতে না পেরে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলে পড়েছে এক পড়ুয়া। মোবাইল ফোনে গেম খেলার অনুমতি না পেয়ে বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিয়েছে কোনও এক অষ্টাদশী। মধ্যরাতে মদ খেয়ে এসে মাকে বেধড়ক পিটিয়েছে এক গুণধর পুত্র। দেখেছিলাম, চিকিৎসকেরা বলছেন, এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স, অর্থাৎ যাকে আমরা এ.কিউ.আই. বলে থাকি, তা ক্রমশ পাড়ি দিচ্ছে তলানির দিকশূন্যপুরে। শ্বাস না নিয়ে উপায় নেই। কিন্তু, পরিস্থিতি যদি না বদলায়, দিন এগোবে যত, শুধুমাত্র বুকভরে শ্বাস নিয়েই মানুষ কাবু হয়ে পড়বেন। কৃষিবিদরা বলছেন, মানুষ বাড়ছে যত, তাল দিয়ে বাড়ছে না ফলন। খাবার বাড়ন্ত। পানীয় জলও। মনোবিদরা কপাল কুঁচকে মেলে ধরছেন অবসাদের গ্রাফ। এ বিশ্বের প্রতি ৩ জনের মধ্যে ১ জন নাকি কোনও না কোনওভাবে অবসাদের শিকার। কয়েক কোটি মানুষ গুমরে গুমরে মরছেন প্রতিদিন। অথচ তাঁদের মনের কথা শোনার জন্য পরিচিতবৃত্তে কোনও ধৈর্য্যশীল কান নেই। তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন আগামী দিনে কাজের সুযোগ নিয়েও। বেকারত্বের পরিসংখ্যান দেখে অ্যান্টিনেটালিস্টরা বলছেন, “আমাদের আগামী প্রজন্ম খাবে কী? কাজ জোটাতে এখনই যেভাবে খাবি খাচ্ছে ১৪০ কোটির দেশ, কোটির উপরে আরও কয়েক কোটি জমলে তাদের ভুখা পেট দিনের শেষে স্বস্তি পাবে তো?” এমন অস্বস্তি-প্রশ্নমালা সমাজের সামনে ক্রমাগত পেশ করে চলেছেন সন্তানে অনিচ্ছুক দম্পতিরা।
এমনই এক অ্যান্টিনেটালিস্ট বন্ধুর সঙ্গে কোনও এক পড়ন্ত বিকেলে হেঁটে যাচ্ছিলাম এ শহরেরই এক অভিজাত অঞ্চলে। অট্টালিকার মতো বাড়িগুলোর গায়ে প্রাচুর্যের সঙ্গে মাখামাখি করে ছিল হাহাকার। জানি, এমন বিরাট প্রাসাদের অধিকাংশেরই বাসিন্দা হয়তো সত্তরোর্ধ্ব কোনও দম্পতি। দুজনের মধ্যে হয়তো আজ জীবিত একজন। সাধের সন্তানেরা স্বপ্নের দূরদেশে, প্রতিষ্ঠিত। এই অঞ্চল নিয়মিত টুকরো খবর উপহার দেয় কাগজের পাতায়। পচা গন্ধ বেরনোর পরে দরজা ভেঙে উদ্ধার হয় দু-তিন দিন পুরনো হয়ে যাওয়া মৃতদেহ। কয়েকটা বাড়ির ব্যালকনিতে দেখেছি, শুন্য দৃষ্টি নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন কোনও এক বৃদ্ধ কিংবা বৃদ্ধা। একটা চেয়ারে বসেছেন কেউ। পাশের চেয়ারটা তাঁরই মতো একা। এ প্রসঙ্গে আমার ওই বন্ধুর বলা কথাগুলো কানে অনুরণিত হয়ে চলে অনর্গল। এমনই এক বাড়ির দিকে তাকিয়ে ও বলেছিল, “হায় রে আমার বুড়ো বয়সের নিশ্চয়তা। হায় রে আমার অপত্যস্নেহ। রক্তের সম্পর্ক আজ আইফেল টাওয়ারের উপরে বসে বাপ-মাকে দেখে। চোখে দূরবীন। আর সেই দূরবীনের কাঁচে ছত্রাক।” আমি জানি, এমন শূন্য ব্যালকনি আজ ছড়িয়ে রয়েছে দুনিয়াজুড়ে।
এই রক্তের সম্পর্ক নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের প্রীতিকেই চোখ কুঁচকে দেখা শুরু করেছেন অ্যান্টিনেটালিস্টরা। সমমনস্ক মানুষদের মধ্যে গড়ে উঠছে নানা গ্রুপ। তাঁরা কথা বলছেন সামনাসামনি কিংবা ভার্চুয়ালি। জনসচেতনতা বাড়াতে নিচ্ছেন নানা উদ্যোগ। আন্তর্জালে একটু খুঁজলেই এমন নানা গ্রুপের সন্ধান মেলে। শিশুদের প্রতি স্নেহ তাঁদের কোনও অংশে কম নেই। তবে তাঁরা খুঁজে নিতে চাইছেন এই স্নেহের বিকল্প রাস্তা। অনেকেই বলছেন, প্রয়োজন হলে দত্তক নেব একাধিক শিশুকে। নিজের সন্তান হলে যতটা আদর-যত্ন-মায়ার প্রলেপ থাকত, দত্তক নেওয়া শিশুটির জন্য সেটা বেশি বই কম হবে না। দেশে দত্তক নেওয়ার জন্য যে আইন-কানুন আছে, তা একটু সহজ সরল করা হলে খুশির আভা খেলে যাবে এমন বহু মানুষের মুখে। দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে বছরের পর বছর ধরে যে অপেক্ষাপর্ব চলে, তা যদি কমে, এমন অনেক শিশুরই ঠাঁই হবে অ্যান্টিনেটালিস্টদের ঘরে, ঢাকের বাদ্যি সহ।
আপনকে পর করার বিবিধ কৌশলের নিত্য জন্ম দিচ্ছি আমরা। এই আকালেও যাঁরা পরকে আপন করতে চান, তাঁদের জন্য তো আমরা হাত বাড়িয়ে দিতে পারি। ৯ই এপ্রিল পেরিয়ে এলাম 'আন্তর্জাতিক অ্যান্টিনেটালিজম ডে'। আক্ষরিক বঙ্গানুবাদে 'আন্তর্জাতিক জন্মদানবিরোধী দিবস'। এই দিনটা একদিকে যেমন এই কলুষিত এবং স্বার্থপর দুনিয়ায় নতুন প্রাণ আনার আগে দশবার ভাবার কথা বলে, একই সঙ্গে দুর্ভাগ্যক্রমে জন্ম নিয়ে হতহাগ্য যারা, তাদের গালেও চুমু খেতে চায়, জীবনভর।
প্রচলিত সামাজিক ব্যাকরণের আট লেনের রাজপথের পাশাপাশি এই মূল্যবোধের রাস্তাটি বহু প্রতিরোধে তৈরি হওয়া এক সার্ভিস লেনের মতো।
স্বযুক্তিতেই, ব্রাত্য নয়।