আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ নবম সংখ্যা ● ১-১৫ মে, ২০২৩ ● ১৬-৩১ বৈশাখ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

বারণসীর গঙ্গাদূষণ ও পরিবেশ নিয়ে অসচেতন মানুষ

গৌতম হোড়


দশাশ্বমেধ ঘাটে তখন পা ফেলার কোনও জায়গা নেই। আশেপাশে উপরে-নীচে শুধু মাথা। ঘাটের সামনে একের পর এক নৌকো। তাতেও ঠাসা মানুষ। নৌকোর পিছনে বিলাসবহুল স্টিমার অলকনন্দা, তার পাশে ভাগীরথী-সহ বেশ কয়েকটা লঞ্চ। সেখানেও ভর্তি মানুষ। ঘাটের একপাশে কয়েকটি দোতলা, তিনতলা বাড়ি। সবকটির বারান্দা, ছাদে চেয়ার পেতে মানুষ বসে আছে। সকলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন গঙ্গা আরতির জন্য। একটা নয়, দশাশ্বমেধে পাশাপাশি দুটো গঙ্গা আরতি হয়। দুই জায়গাতেই সাতজন আরতি করেন একটা প্ল্যাটফর্মের ওপরে দাঁড়িয়ে। দুই জায়গাতেই হাজার হাজার মানুষ অধীর আগ্রহে বসে থাকেন। যারা একেবারে সামনে বসেছেন, তারা বিকেল চারটে-সাড়ে চারটে থেকে অপেক্ষা করছেন। তারপরে মন্দ মন্থরে সন্ধ্যা নামল। গঙ্গার জলে চারপাশের আলো ঝিকমিক করছে - তখন শুরু হল আরতি।

আরতি শুরুর সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিল উন্মাদনা। দু-হাত উপরে তুলে গলা ফাটিয়ে ‘হর হর মহাদেব‘ বলছেন হাজারো মানুষ। বারাণসী হল বাবা বিশ্বনাথের শহর। বিশ্বাসী মানুষ ভাবেন, বিশ্বনাথ এই শহরকে রাতে পাহারা দেন। একটু পরে শুরু হল গান। ‘অচ্যুতম কেশবম‘। শুরু হল হাততালি। মানুষ দুলছে, গানের সুরে সুর মেলাচ্ছে। বিশালকায় পিতলের স্ট্যান্ডে রাখা অসংখ্য প্রদীপ নিয়ে সাতজন আরতিকার প্রথমে গঙ্গামুখি হয়ে ও তারপর চারপাশে বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে পুজো করছেন গঙ্গার। তাদের হাতে উঠে আসছে শাঁখ, কখনও চামর, পাখা, কখনও বা অন্য কিছু।

চারপাশে উন্মাদনা তৈরি হয়েছে - ভক্তির উন্মাদনা, বিশ্বাসের উন্মাদনা। হাজার হাজার মানুষ মুগ্ধ হয়ে দেখছেন। গোমুখ, গঙ্গোত্রী হয়ে পাহাড়ের পথ পাড়ি দিয়ে হরিদ্বার থেকে গঙ্গার সমতলের দিকে যাত্রা। এই নদীর কল্যানেই তো বারাণসীর বিস্তীর্ণ অববাহিকা-জুড়ে উর্বর জমি। এখানে মাটিতে কৃষক সোনা ফলায়। তাকে ভক্তি করা, পুজো করার মধ্যে তো সেই কৃতজ্ঞতাই প্রকাশ পাচ্ছে বলে ধরে নিতে হবে। গঙ্গা তো এখানে শুধু নিছক একটা নদী নয়, গঙ্গা হলো মা, গঙ্গামাইয়া। এখানকার মানুষ সবসময় বলেন গঙ্গাজি। এ সবই তো শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ।

অবশ্যই ধরে নিতে হবে, গঙ্গার প্রতি তাদের অটুট ভালোবাসা আছে। এ এমন এক নদী যা ভারতের একটা বিশাল অঞ্চলের প্রাণস্বরূপ। যতটা ভালো লাগার প্রকাশ ঘটিয়ে তারা গঙ্গা আরতি করলেন, উন্মাদনায় ভাসলেন, ঠিক ততটা আবেগ নিয়ে কি তারা এই গঙ্গাকে দূষণের হাত থেকেও বাঁচাবেন?

বাস্তবে কি তাই হচ্ছে? খুবই কষ্টের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, একেবারেই হচ্ছে না। গঙ্গা আরতির সময় বা তারপর আমরা কী দেখলাম? অনেক ভক্তই ভক্তির আতিশয্যে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন পাতার ডোঙা। তাতে রয়েছে কিছু পাতা, ফুল এবং একটা মোমবাতি বা প্রদীপ। গঙ্গায় যখন এই ডোঙা ভাসিয়ে দেওয়া হয়, তখন দেখতে ভালো লাগে। একটু ওপর থেকে দেখলে মনে হয়, গঙ্গার বুকে শয়ে শয়ে জোনাকি জ্বলছে। ঢেউয়ের স্রোতে জোনাকি দুলতে দুলতে চলছে।

কিন্তু এই ভালোলাগার হাত ধরে আসে এক বিষন্নতা। একটা ডোঙার ফুলপাতার পরিমাণ হয়ত খুব বেশি নয়, কিন্তু যখন শয়ে শয়ে ডোঙা পড়ে গঙ্গার জলে তখন তা হয় পাহাড় প্রমাণ। শুধু তো পাতার ডোঙা নয়, বারাণসীতেই গঙ্গার জলে গিয়ে পড়ছে অসংখ্য ফুলমালা, পড়ছে প্লাস্টিকের বোতল, ফেলা হচ্ছে ছাই। এখানে ফুল, পাতা, মালা জলে মিশছে। আবার মিশছে শ্মশানের ছাই-ভষ্ম। মহাশ্মশানের দিকে তাকালে দেখা যাবে, গঙ্গাতীরের একদিকে ফুল-মালা ভর্তি। সেই সঙ্গে মিশছে অশোধিত নিকাশি বর্জ্য। এ সবই গঙ্গাকে দূষিত করছে।

বারাণসীতে গঙ্গায় বিশাল বালির চর আছে। অনেকে গঙ্গার ঘাট থেকে নৌকো করে চরে গিয়ে সেখানে গঙ্গাস্নান করেন। ওই চরেই তৈরি হয়েছে টেন্ট সিটি। সারি সারি বিলাসবহুল টেন্ট, খাওয়া-দাওয়া সমেত একটি ডবল বেড টেন্টের ভাড়া কম করে ১৬ হাজার টাকা। প্রতিটি টেন্টে অ্যাটাচড বাথরুম আছে। সেসব বর্জ্য গিয়ে মিশছে গঙ্গার জলে।

চারিদিকে শয়ে শয়ে তাঁবু। তাই তো নাম দেওয়া হয়েছে টেন্ট সিটি। এখানে একাধিক টেন্ট সিটি আছে আলাদা করে ঘেরা বিশাল জায়গা নিয়ে। বর্ষায় টেন্ট গুটিয়ে ফেলা হয়। আবার সেগুলির আবির্ভাব হয় শীতকালে।

কে এই সব টেন্টের অনুমতি দিয়েছে? তারা কি পরিবেশরক্ষা বলে একটা বিষয় আছে, তার কথা জানেন? নাকি বড়লোকদের জন্য সাত খুন মাফ! এর ফলে নষ্ট হচ্ছে আমাদের প্রাণের নদী গঙ্গা।

এইসব ছবি দেখতে দেখতে সংসদে গঙ্গা বিষয়ক মন্ত্রী উমা ভারতীর ভাষণের কথা মনে পড়ছিল। তিনি বলেছিলেন, গঙ্গাশোধনের কাজ খুবই ভালোভাবে চলছে। গঙ্গার জল আগের থেকে অনেক ভালো হয়েছে। তারপরে দাবি করেছিলেন, তিনি এখানেই থামবেন না। আগে গঙ্গায় যেসব প্রাণী দেখা যেত, সেসব ফিরিয়ে আনবেন। যেমন ফিরিয়ে আনবেন শুশুক।

কিন্তু শুশুক আসা দূরস্থান, বারাণসীর গঙ্গার জলকে দূষণমুক্ত করতে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।

'টাইমস অফ ইন্ডিয়া'র রিপোর্ট বলছে, ২০১৩ সালের হিসাব ছিল, বারাণসীতে প্রতিদিন সাড়ে তিন থেকে চার টন ফুল, ধুপের অংশ, পাতা ও অন্য বস্তু জমা হচ্ছে। এই আবর্জনা কীভাবে পরিশোধন করা হবে, তা নিয়ে প্রচুর বৈঠক হয়েছে। মন্দির কর্তৃপক্ষ, পুরসভা, প্রশাসন কথা বলেছে। এত বৈঠকের পড়েও দীর্ঘদিন কোনও সিদ্ধান্তে তারা আসতে পারেননি। এর পাঁচ বছর পর একই কাগজে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট বলছে, এই আবর্জনার পরিমাণ প্রায় সাত টনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

২০১৬ সালে 'টাইমস অফ ইন্ডিয়া'র রিপোর্ট হলো, উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দির কর্তৃপক্ষ তাদের মন্দিরে ভক্তদের দেওয়া ফুল-বেলপাতা নিয়ে সমস্যার একটা সমাধান করে ফেলেছেন। সেখানে তখন দিনে ৬০০ কেজি ফুল-বেলপাতা জমা হত। তারা একটা ওয়েস্ট কনভার্টার যন্ত্র বসিয়েছেন, যা দিয়ে ওই ফুল-পাতা থেকে সার তৈরি হয়। রাসায়নিক সার নয়, একেবারে জৈব সার। প্রতিদিন ১৫০ থেকে ১৮০ কেজি জৈব সার তৈরি করেন তারা। সেই সার তারা ১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন।

অনেক আলোচনা, টালবাহানার পর ২০১৯ সালে কাশীতেও একই ধরনের প্রকল্পের উদ্বোধন করেন যোগী আদিত্যনাথ। এখন মন্দিরের ফুল দিয়ে আবির তৈরি হচ্ছে, ধুপকাঠি তৈরি হচ্ছে। কিন্তু তারপরেও গঙ্গায় ফুল-পাতা ফেলা বন্ধ হয়নি। সকাল থেকেই পাতার ডোঙায় ফুল, পাতা, মোমবাতি বা প্রদীপ নিয়ে ঘাটে হাজির হয়ে যায় বাচ্চারা। প্রতিদিন হাজার হাজার ডোঙা ভাসানো হচ্ছে গঙ্গায়। বারাণসীর দুই মহাশ্মশানের দিকে চোখ রাখুন। দেখতে পাবেন, একপাশে ফুল, মালা, পাতা পড়ে আছে গঙ্গাতীরে। সেই মহাশ্মশানের ছাই গিয়ে পড়ছে গঙ্গায়। নৌকোভ্রমণের সময় দেখতে পারেন প্লাস্টিকের বোতল বা প্লাস্টিক পড়ে আছে জলে।

এসব কারা ফেলছে? আমরাই ফেলছি। যারা কিছুক্ষণ আগে গঙ্গা আরতির সময় মুগ্ধ চোখে সব দেখেছি, সেই আরতির ঘোর কেটে গেলেই আমাদের অভ্যাস ফিরে আসছে। বিন্দু বিন্দু করে যেমন সিন্ধু হয়, তেমনই এক একটি ছোট ডোঙা যখন হাজার হাজার হয়ে ওঠে, তখন সেটাও দূষণের অন্যতম কারণ হয়ে ওঠে।

যে নদীর প্রতি কৃতজ্ঞতায় তাঁকে আরতি করা হচ্ছে, পুজো করা হচ্ছে, তাকেই নোংরা করার সময় মনে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ হচ্ছে না।

বারাণসীর অনেক ঘাটেই দেখবেন বিশাল করে হিন্দিতে লেখা রয়েছে, 'নমামি গঙ্গে'। কেন্দ্রীয় সরকারের গঙ্গাশোধন প্রকল্পের নাম হলো 'নমামি গঙ্গে'। এই প্রকল্পের অধীনে বর্জ্য শোধন করে গঙ্গায় ফেলার কথা। বারাণসীর ছয়টি জায়গা থেকে প্রধাণত এই বর্জ্য গঙ্গায় পড়ে। প্রতিটি জায়গায় শোধনাগার থাকার কথা। ২০২২ সালের মার্চে 'দ্য টেলিগ্রাফ'-এর রিপোর্ট বলছে, উত্তরপ্রদেশ জল নিগমের একজন সিনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার বলেছেন, বারাণসীতে রোজ ১০০ মিলিয়ান লিটার অপরিশোধিত বর্জ্য জলে মিশছে।

নদী শোধন বিশেষজ্ঞ সৌরভ সিং 'দ্য টেলিগ্রাফ'কে বলেছেন, রোজ ২০০ মিলিয়ন টন অপরিশোধিত বর্জ্য গঙ্গায় মিশছে। সাম্প্রতিক সময়ে গঙ্গার স্রোত কমে গেছে, পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে।

রিপোর্টে জলবিভাগের কর্মীদের উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, বারাণসীতে প্রতিদিন ৪৫০ এমএলডি (মিলিয়ান লিটার পার ডে) বর্জ্য হয়। তার মধ্যে পরিশোধন ক্ষমতা রয়েছে ২৫০ এমএলডি। বাকি ২০০ এমএলডি সরাসরি গঙ্গায় গিয়ে পড়ছে। রাজ ঘাট ও অস্সি ঘাটের নালায় এখনও ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট লাগানো হয়নি।

এদিকে উত্তরাখণ্ডে একের পর এক বাঁধ তৈরি করে গঙ্গাকে বারবার আটকে দেওয়া হয়েছে। পরিবেশবিদরা বারবার বলা সত্ত্বেও কোনও সরকারই এতে কান দেয়নি। আর তারপর উত্তরপ্রদেশের শহরগুলি থেকে গঙ্গায় সমানে ফেলা হচ্ছে অপরিশোধিত বর্জ্য।

কানপুরের কথাই ধরুন। সেখানকার ট্যানারি থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য গঙ্গায় ফেলা নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। তারপরেও ২০২২-এর সেপ্টেম্বরে পিটিআইয়ের রিপোর্ট বলছে, ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুন্যাল (এনজিটি) উত্তরপ্রদেশের দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডকে বলেছে, তারা সঠিক নজরদারি করছে না। এখনও কানপুরে ট্যানারি থেকে অপরিশোধিত বর্জ্য গঙ্গায় মিশছে।

তাহলে এত পরিকল্পনা, প্রচার, হাজার হাজার কোটি টাকা গঙ্গায় বয়ে যাওয়ার পরেও পরিস্থিতি পাল্টে গেল না। সরকার, পুরসভা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্যদ থেকে সাধারণ মানুষ, কারও কোনও হেলদোল নেই।

রাজধানী দিল্লির কথাই ধরুন। মারাত্মক দূষণ প্রতিটি মানুষের আয়ুসীমা কমিয়ে দিচ্ছে। তারপরেও কি কোনও চিন্তা আছে? দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, কণামাত্র নেই। বিয়ে, দেওয়ালিতে যথেচ্ছ বাজি পোড়ানো হয়। কৃষকরা ক্ষেতে খড় পোড়ান। গাড়ির দূষণ নিয়ন্ত্রণে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

আমরা আমাদের জীবনদায়ী নদী ধ্বংস করছি, নষ্ট করছি শহর, কমছে আয়ুসীমা। এখন সারা বিশ্বজুড়ে গ্লেসিয়ার গলছে, সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় ভয়ংকর কাণ্ড ঘটছে একের পর এক দেশে। তবু আসছে না সচেতনতা। উন্নত দেশগুলি চাপ দিচ্ছে উন্নয়নশীল দেশের ওপর। উন্নয়নশীল দেশ বলছে, আমাদের উন্নত প্রযুক্তি না দিলে আমরা এভাবেই চলব। দায় কারও নয়। সকলেই ধ্বংসের পথে চলছে। আর প্রকৃতিও তার প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে।

নিউটনের তৃতীয় সূত্রের কথা মনে রাখবেন। প্রতিটি ক্রিয়ায় সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। ফলে আপনাদের এই বোধহীন কাজের বিপরীত প্রতিক্রিয়া যখন আসবে তা সামলাবার শক্তি ব্যক্তি ছেড়ে দিন, কোনও সরকারের নেই।