আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ নবম সংখ্যা ● ১-১৫ মে, ২০২৩ ● ১৬-৩১ বৈশাখ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

ডিএ প্রসঙ্গে

শুভনীল চৌধুরী


পশ্চিমবঙ্গে সরকারী কর্মচারীরা কেন্দ্রীয় হারে ডিএ বা মহার্ঘ ভাতা পাওয়ার দাবিতে আন্দোলন করছেন। এই আন্দোলনের সমর্থনে এবং বিরুদ্ধে বিভিন্ন মত উঠে এসেছে। 'আরেক রকম' পত্রিকার আগের সংখ্যায় প্রসেনজিৎ বসুদের লেখায় এই সংক্রান্ত বহু তথ্য দিয়ে দেখানো হয়েছে যে ডিএ দেওয়ার নিরিখে এই রাজ্য ভারতের অন্যান্য রাজ্যের থেকে অনেকটাই পিছিয়ে আছে, যদিও উন্নয়নমূলক খরচ অথবা ভর্তুকির হিসেবেও পশ্চিমবঙ্গ অন্যান্য রাজ্যের থেকে পিছিয়ে।

এই বিতর্কে আরো কিছু মত উঠে এসেছে যা নিয়ে আলোচনা করা এই প্রবন্ধের প্রধান উদ্দেশ্য। প্রথমত একটি কথা বারংবার বলা হচ্ছে যে ডিএ কোনো সাংবিধানিক অধিকার নয়। কিছু উৎসাহী ব্যক্তি, যারা আমার বন্ধুও বটে, তারা এহেন কথাও বলছেন যে ডিএ বিষয়টিই অসাংবিধানিক। এই মারাত্মক উপসংহারে এসে তাঁরা পৌছচ্ছেন এই কথা বলে যে, যেখানে দেশের অধিকাংশ মানুষের ডিএ নেই অথবা তাদের আয় মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে ওঠানামা করে না, সেখানে কেন শুধুমাত্র সরকারী কর্মচারীদের জন্য এই সুবিধা থাকবে। যদি তা থাকে তবে তা সংবিধান বর্ণিত সাম্যের বিরোধী, তাই তা সংবিধান বিরোধী। অন্যদিকে, হঠাৎ বাজারে গরীব দরদীদের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। তারা বলছে যে ডিএ দেওয়া হলে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, উজ্জ্বলা যোজনা ইত্যাদির টাকা আসবে কোথা থেকে। এই টাকা গরীব মানুষকে দেওয়া হোক, তাতেই দেশের মঙ্গল। খামোকা মধ্যবিত্ত সরকারী কর্মচারীদের এই টাকা দেওয়া হবে কেন? বরং তাদের বেতন কমিয়ে যদি আরো কিছু টাকা গরীব মানুষদের মধ্যে বিতরণ করা যায়, তাহলে দেশের উন্নয়ন হবে। অতএব হে পশ্চিমবঙ্গের সরকারী কর্মচারীসমূহ, আপনাদের দাবি নেহাতই গরীব বিরোধী এবং তাই বর্জনীয়।

আমার মতে ডিএ-র বিরুদ্ধে পেশ করা এই দুটি যুক্তিই ভ্রান্ত এবং তা আপাতদৃষ্টিতে গরীব দরদী হলেও, আসলে যুক্তিগুলি দেশের মেহনতী মানুষের বিপক্ষে। কেন? তা বলার আগে একবার বুঝে নেওয়া যাক ডিএ সংক্রান্ত মৌলিক অর্থনীতিকে।

ডিএ অর্থাৎ মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার যুক্তি হচ্ছে মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে মজুরি প্রাপকের প্রকৃত মজুরিকে সুরক্ষা করা। ধরা যাক আপনার মাইনে হল ১,০০০ টাকা এবং বাজারে চালের দাম ১০ টাকা প্রতি কেজি। তাহলে আপনি একশ কেজি চাল আপনার মাইনে দিয়ে কিনতে পারবেন। কিন্তু চালের দাম বেড়ে ২০ টাকা হয়ে গেলে, আপনার মজুরি এক থাকলেও আপনি চাল কিনতে পারবেন ৫০ কেজি। অর্থাৎ, মূল্যবৃদ্ধি হলে যদি আপনার মজুরি না বাড়ে তাহলে আপনার ক্রয়ক্ষমতা কমবে। এই ক্রয়ক্ষমতা যাতে না কমে তার জন্য মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে আপনার মজুরির পরিমান বাড়তে হবে। যদি তা বাড়ে, তাহলে মূল্যবৃদ্ধি হলেও কোনো ক্ষতি নেই, অন্তত আপনার। কিন্তু তা না বাড়লে, আপনার ক্ষতি।

এইবারে প্রশ্ন পণ্যের দাম নির্ধারণ করে কে বা কারা? পাঠ্যপুস্তকের বইতে থাকে যে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পণ্যের দাম নির্ধারণ হয় যেখানে কোনো বিক্রেতা পণ্যের দাম একা পরিবর্তন করতে পারে না। এই গল্পটি বইতে সত্যি। আসলে পণ্যের দাম নির্ধারণ করে পুঁজিপতিরা। কারণ বাজারে তাদের একচেটিয়া আধিপত্য রয়েছে, প্রকৃত প্রতিযোগিতা নেই। এই দাম নির্ধারণ করার নেপথ্যে রয়েছে তাদের খরচ। মজুরি যদি বাড়ে, তাহলে পুঁজিপতিদের খরচ বাড়বে। অতএব মুনাফা বাড়াতে হলে বা তাকে যদি এক স্তরে রাখতে হয়, তাহলেও দাম বাড়াতে হবে। দাম বাড়লে প্রকৃত মজুরি কমবে, যা শ্রমজীবিদের ক্ষতি করবে। শ্রমজীবিরা যদি সংঘবদ্ধ হয়ে মজুরির জন্য লড়াই জারি রাখে তাহলে মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে এবং এই মজুরি এবং পণ্যের দামের বৃদ্ধি লাগাতার ঘটতে থাকবে। তাই হয় শ্রমজীবিদের সংঘবদ্ধ হতে দেওয়া যাবে না। অথবা, দামের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মজুরি বাড়তে দেওয়া যাবে না। তা না হলে যেই মুনাফা পুঁজিপতিরা চাইছে তারা তা পাবে না। তাই মুনাফার স্বার্থে এবং মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে মজুরি না বাড়ানোই পুঁজিপতিদের কাছে কাম্য।

অর্থাৎ, শ্রমের দাম অর্থাৎ মজুরি কত হবে এবং পণ্যের দাম কত হবে তা নির্ভর করে অর্থব্যবস্থায় শ্রেণিসংগ্রামের জোরের উপরে। আসলে শ্রম এবং পুঁজির মধ্যে লড়াইতে শ্রমিকের হাতে রয়েছে মজুরি নির্ধারণের ক্ষমতা (যদি তারা সংঘবদ্ধ থাকতে পারে) আর পুঁজির হাতে রয়েছে পণ্যের দাম নির্ধারণ করার ক্ষমতা। যদি শ্রমিকের মজুরি না বাড়িয়ে পণ্যের দাম বাড়ে তাহলে তা পুঁজিপতিদের মুনাফা বাড়াবে। তাই শ্রমিক এবং পুঁজিপতিদের শ্রেণিসংগ্রামের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে মজুরি অথবা মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা হয় না। বর্তমান দুনিয়ায় সংঘটিত ট্রেড ইউনিয়নের জোর কমেছে। প্রায় প্রত্যেকটি সংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের যেই সুবিধা প্রদান করা হত, তা কমেছে। পুঁজির বিশ্বায়নের ফলে পরিষ্কার বলা হচ্ছে যে, বেশি দাবিদাওয়া জানালে পুঁজি এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে যাবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশে প্রকৃত মজুরি এমনিতেই খুব বেশি বাড়ছে না। সংগঠিত শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার পরিধিও কমছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে একমাত্র সরকারী ক্ষেত্রে শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে সরকারকে ভাবতে হয়। কারণ চক্ষুলজ্জার খাতিরেও সরকারকে অন্তত ভান করতে হয় যে তারা একটি জনকল্যানকর রাষ্ট্রের পরিচালনা করছে। তাই ডিএ নিয়ে টাকা নেই ইত্যাদি যুক্তি দেওয়া হলেও, দাবিটি সংবিধান বিরোধী এহেন হাস্যকর দাবি সরকারের তরফে করা হয়নি।

এইকথা ঠিক যে দেশের অধিকাংশ মানুষ অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন, যেখানে মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে কোনো সুরক্ষা তারা পান না। এই অসংগঠিত ক্ষেত্র তাই এই ব্যবস্থায় মূল্যবৃদ্ধির উপরে লাগাম পরানোর একটি ব্যবস্থা। যেহেতু তারা তাদের মজুরি বাড়াতে অক্ষম তাই একবার মূল্যবৃদ্ধি হলেও তারপরে মজুরিবৃদ্ধি না হওয়ার ফলে পরের রাউন্ডে আর মূল্যবৃদ্ধি হবে না। তাই অসংগঠিত শ্রমিকের সংখ্যা যত বাড়বে তত একদিকে মূল্যবৃদ্ধি স্থিতিশীল হবে, কিন্তু শ্রমিকের প্রকৃত আয় বা ক্রয়ক্ষমতা কমবে। সরকারী কর্মচারী এবং সংগঠিত ক্ষেত্রে ডিএ ব্যবস্থা যদি বিলোপ করে দেওয়া যায়, তাহলে তা আসলে পুঁজিপতি এবং শ্রমিকদের মধ্যে আরো বেশি বৈষম্য বাড়াবে। তাই যারা সংবিধানের সাম্যের দোহাই দিয়ে ডিএ-র বিরোধিতা করছে তারা আসলে সার্বিকভাবে বৈষম্য বাড়ার পক্ষে সওয়াল করছে। তারা দেখাতে চাইছে দুই মজুরিপ্রাপ্ত শ্রেণি (সরকারী কর্মচারী এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক)-দের মধ্যে বৈষম্যকে। কিন্তু আসলে তারা পুঁজি এবং শ্রমের বৈষম্য নিয়ে সম্পূর্ণভাবে নিরব অথবা তারা এই বৈষম্যের পক্ষে।

সরকারী ক্ষেত্রে ডিএ বিলোপ করা হলে বেসরকারী ক্ষেত্রের পুঁজিপতিদের কাছে এই বার্তাই যাবে যে শ্রমিকের মজুরি আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। সরকারী ক্ষেত্রে শ্রমিকের সুরক্ষা চলে গেলে বেসরকারী ক্ষেত্রেও তা থাকবে না। ফলত, পূর্বে বর্ণিত অসাম্য আরো বাড়বে।

যদি সাম্য প্রতিষ্ঠা করতেই হয় তবে সরকারী কর্মচারীদের ডিএ-ব্যবস্থা তুলে দিয়ে সাম্য আনতে হবে কেন? কেন তারা আদানি-আম্বানি-টাটা-বিড়লাদের বিপুল সম্পদের উপর কর ধার্য করার দাবি করছেন না? কেন বলছেন না যে সেই করের টাকায় সমস্ত মানুষের জন্য সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা যাবে? বলছেন না, কারণ আসলে তারা সাম্যের পক্ষে নন। মধ্যবিত্ত মানুষকে গরীবদের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়ে তারা আসলে ধনীদের পক্ষেই অবস্থান নিচ্ছেন।

এবারে আসা যাক লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বা অন্যান্য সরকারী প্রকল্পের প্রশ্নে। ডিএ বাড়ালে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বা অন্যান্য জনকল্যানমূলক খাতে খরচ কমাতে হবে তখনই যখন আমরা ধরে নেব যে সরকারের মোট রাজস্বের পরিমাণ অপরিবর্তনশীল। অর্থাৎ সরকার মোট ১০০ কোটি টাকা খরচ করতে পারবে। যদি ডিএ-র খরচ বেড়ে যায় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই জনকল্যানমূলক খাতে খরচ কমবে। তর্কটি ভুল, কারণ সরকারের রাজস্ব অপরিবর্তনশীল থাকার কোনো কারণ নেই। একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। 'অক্সফ্যাম'-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের ধনীতম ১০ শতাংশের মানুষের হাতে রয়েছে দেশের ৭২ শতাংশ সম্পদ। ভারতের মোট সম্পদের পরিমাণ 'ক্রেডিট সুইস'-এর গণনা অনুযায়ী ১৪,০০০ বিলিয়ন ডলার। তার ৭২ শতাংশ মানে ১ শতাংশ ধনীতম মানুষের হাতে রয়েছে ১০,০৮০ বিলিয়ন ডলার। আপাতত এই সম্পদের উপরে দেশে কোনো কর ধার্য করা হয় না। তাই যদি এই ধনীদের উপর কর ধার্য করা হয় তাহলে যে পরিমাণ টাকা সরকারের কাছে আসবে তা দিয়ে দেশের অধিকাংশ জনকল্যাণমূলক খরচ করা যাবে। অবশ্যই রাজ্য সরকারের হাতে এই কর ধার্য করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু রাজ্য সরকার স্ট্যাম্প ডিউটি, গাড়ির উপর কর ইত্যাদি বাড়িয়েও রাজস্ব সংগ্রহ করতে পারে। মোদ্দা কথা হল এই যে, সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ এক থাকার কোনো কারণ নেই, তা বাড়তে পারে। তা যদি বাড়ে তাহলে ডিএ এবং লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মধ্যে কোনো বিরোধ থাকবে না।

যারা সাম্য এবং গরীব মানুষের দোহাই দিয়ে ডিএ-র বিরোধিতা করছেন তারা ভ্রান্ত যুক্তি দিচ্ছেন। তারা সমাজের সর্বাধিক যে অসাম্য, অর্থাৎ পুঁজি বনাম শ্রম, তার দিকে আঙুল না তুলে দুই ধরনের শ্রমজীবির মধ্যে বিভেদ তৈরি করার চেষ্টা করছেন।

তবে এই বিভাজন যে সমাজে রয়েছে তা স্বীকার করতেই হবে, বিশেষ করে তাদের যারা সংগঠিত বা সরকারী ক্ষেত্রে শ্রমিক আন্দোলন পরিচালনা করছেন। ডিএ সংক্রান্ত লড়াইয়ে তাদের যদি জনগণের বিপুল অংশের সমর্থন পেতে হয়, তাহলে তাদের অসংগঠিত শ্রমিকদের আন্দোলনে যোগদান করতে হবে। তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে রাস্তায় নামতে হবে। কীভাবে সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক আন্দোলনকে একসূত্রে বাধা যায় তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে হবে। তা না হলে, শ্রমজীবি মানুষদের মধ্যে এই দূরত্ব বাড়তে থাকবে, যার সুযোগ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক শক্তিরা শ্রমজীবি মানুষের আন্দোলনকে দুর্বল করতে চাইবে। অতএব, ডিএ নিয়ে লড়াই যেমন লড়তে হবে, তেমনি সার্বিকভাবে সামাজিক সুরক্ষার পক্ষে লড়াই জোরদার করার দায়িত্ব নিতে হবে শ্রমজীবি সংগঠনকে।