আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ নবম সংখ্যা ● ১-১৫ মে, ২০২৩ ● ১৬-৩১ বৈশাখ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

দারিদ্র নিয়ে বুড়োখেলা

অশোক সরকার


সাম্প্রতিককালে গরিবীর হিসেবে নিয়ে যা সব কথাবার্তা হচ্ছে, তাকে ছেলেখেলা নয়, বুড়োখেলা বলতে ইচ্ছে করে। এই তো মাস ছয়েক আগে সুরজিৎ ভাল্লা এবং অন্য দুই জন অঙ্ক কষে দেখিয়ে দিলেন ভারতে গরিবী প্রায় উবেই গেছে। সামান্য ১ কি ২ শতাংশ গরিব রয়েছে, আর কেউ গরিব নেই। তাই নিয়ে অনেক বিতর্ক হল, দেখা গেল তাঁদের যুক্তি ঠিক নেই। আবার এই দুই তিন সপ্তাহ আগে অরবিন্দ পানঘরিয়া এবং একজন অন্যরকম এক অঙ্ক কষে বললেন না না গরিবী এখনো আছে, কিন্তু অতিমারী-র পরে গরিবী প্রতি ত্রৈমাসিকে হু-হু করে কমে যাচ্ছে, ওঁদের হিসেবে অনুযায়ী আর তিন-চার বছর বাদে দেশে গরিব উবেই যাবে। দেখা যাচ্ছে, ওঁদেরও যুক্তি ঠিক নেই।

যুক্তি বুঝতে গেলে অনেকটা পিছিয়ে শুরু করতে হয়। গরিবীর হিসেব, তার অর্থনীতি ও রাজনীতি আমাদের দেশে পঞ্চাশ বছরের পুরোনো। সেই লম্বা ইতিহাসকে একটু ছোট করে পেশ করব। অর্থনীতিতে 'basic needs approach' বলে একটা তত্ত্ব '৬০-এর দশকে বেশ প্রচলিত ছিল। বিবেকবান অর্থনীতিবিদরা বলতেন কোনো সমাজ মানুষের basic needs পূরণ করতে পারছে কিনা দেখতে হবে এবং সরকারকে তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কথা হল basic needs বলতে কী বোঝায়? মানুষ কী হলে কষ্ট না করে সাধারণভাবে বেঁচে থাকবে। স্বভাবতই খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, পানীয় জল এসবের কথা ওঠে। কিন্তু এসবের সঠিক হিসেব বের করা কঠিন। যে টিউবঅয়েল থেকে জল তোলে, যে কল খুললে জল পায়, আর যে ২ কিলোমিটার হেঁটে পুকুর থেকে ঘড়া করে জল তুলে আনে, এরা সবাই কি basic needs-এর দিক থেকে একই অবস্থানে আছে? দেখা গেল এর সর্বজনগ্রাহ্য হিসেব বের করা প্রায় অসম্ভব।

১৯৭২-৭৩ সালে আমাদের দেশে দান্ডেকর আর রথ নামক দুই অর্থনীতিবিদ প্রস্তাব করলেন, গরিবীর absolute মূল্য একমাত্র শরীরে কতটা ক্যালোরি যাচ্ছে তা দিয়েই করা সম্ভব। একজন মানুষ দৈনিক একটা নির্দিষ্ট পরিমান ক্যালোরি পেলে তবেই সুস্থ এবং কর্মক্ষম থাকবে। সেই ক্যালোরি কত, তা মোটামুটি accurately বলা যায়। যদিও পরিশ্রম অনুযায়ী তার কিছুটা তারতম্য হবে। সেই সময় নানা রকম বায়ো-মেডিক্যাল গবেষণা থেকে দেখা গেল যে গ্রামে মানুষ মূলত কায়িক পরিশ্রম করে, তাই তাদের ২,৪০০ কিলো ক্যালোরি দৈনিক লাগে, আর শহরে অনেক মানুষ টেবিল চেয়ারে বসে কাজ করে, তাই তাদের ২,১৫০ কি ২,২০০ কিলো ক্যালোরি লাগে।

এই ২,৪০০ কিলো ক্যালোরি বা ২,১৫০ কিলো ক্যালোরি অবশ্য একটা ন্যূনতম গড় হিসেব, শহরে যে মানুষটি বাজারের গুদামে খালাসির কাজ করে, সারাদিন লরি থেকে মাল তোলে আর মাল নামায় তার ২,৪০০ ক্যালোরিই লাগবে। কিন্তু অর্থনীতিবিদেরা যেহেতু অঙ্ক করে হিসেবে করতে ভালোবাসেন তাই তাঁদের গড় নিয়েই কাজ করতে হয়। তাঁরা চাইছিলেন দেশে কত লোক গরিব আছে তার একটা সংখ্যা বের করতে, যাতে সরকার তাদের দিকে লক্ষ রেখে বিশেষ কর্মসূচি নিতে পারে।

এইভাবে গরিব হিসেব করার একটা সামাজিক সমস্যা আছে। সমাজ গরিব বড়লোক বোঝে, অথবা গরিব বা গরিব নয় বোঝে। ফলে সমাজে ধারণা তৈরী হল যে যারা ২,৪০০ বা ২,১৫০ কিলো ক্যালোরি-র বেশি পাচ্ছে তারা মোটেই গরিব নয়। তারা বড়লোক না হলেও মধ্যবিত্ত। তাতে কি ধরণের পরিনাম ঘটে তা নিয়ে ফিরে আসব আলোচনায়। আপাতত গরিবীর কাহিনি নিয়ে এগোনো যাক।

এই ২,৪০০ বা ২,১৫০ কিলো ক্যালোরিকে তখন বলা হল 'গরিবি রেখা'। যারা দৈনিক ওই পরিমান কিলো ক্যালোরির বেশি পায়, তারা গরিবী রেখার উপরে আছে, আর নিচে আছে বাকিরা। গরিবীর কাহিনির এটা হল প্রথম স্তর। সমাজ অবশ্য বুঝল যে ২,৪০০ কিলো ক্যালোরির বেশি খেলেই সে আর গরিব নয়। সমাজের এই ধারণা এখনো ভাঙেনি।

যাই হোক, ২'৪০০ বা ২'১৫০ কিলো ক্যালোরি বললেই তো হল না, মানুষ তো আর ক্যালোরি কিনে খায় না, মাঠে ক্যালোরিও ফলায় না। মানুষ খাবার খায়। তাহলে কত খাবারে কত ক্যালোরি হিসেবে করতে হয়। অর্থনীতিবিদেরা খাদ্যাভ্যাসের হিসেব করে দেখলেন, গ্রামে মোটামুটি ৬৫০ গ্রাম খাবার খেলেই ২,৪০০ কিলো ক্যালোরি হয়, আর শহরে ৫৭০ গ্রাম খাবার খেলেই ২,১৫০ কিলো ক্যালোরি হয়ে থাকে। সেটা হিসেবে করতে গিয়ে খাদ্য সংস্কৃতির কথা ওঠে। কেউ ভাত-ডাল খায়, কেউ আটার রুটি নয়ত বজরার রুটি খায়, কেউ দুধ খায়, কিন্তু নিরামিষাশী, কেউ বা মাছ খায় বা খাবারের পাতে মিঠাই খায়। তাদের খাবারের ওজন (কত গ্রাম) আর ক্যালোরির সম্পর্ক সমান নয়। এখানেও একটা গড়ের অবতারণা করতে হল। ওই ৬৫০ গ্রাম বা ৫৭০ গ্রাম খাবার আরেকটা গড়।

এখন তাহলে প্রশ্ন তবে যে ঐ গরিবী রেখার নিচে ক'জন আছে, আর উপরে ক'জন আছে? একদল অর্থনীতিবিদ বললেন মানুষকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করো তারা কি খাচ্ছে, তার থেকে পাবে কিলো ক্যালোরি, তা থেকে গুণে দেখ ক'জন গরিব। আর অনেকে বললেন মানুষ তো কিনেও খায়, ফসল ফলিয়েও খায়, ফসলে মজুরি পেয়েও খায়, অন্য লোকের দানেও খায় তাহলে শুধু কি খেয়েছ জানতে চাইলে সত্যিই কে গরিব তা বেরোবে না, এই খাওয়ার পরিমানকে টাকায় ফেলতে হবে। তার একটি হিসেব ১৯৭৯ সালে পাওয়া গেল গ্রামে মাসিক ৪৯.১ টাকা, শহরে ৫৬.৭ টাকা। এই টাকায় শহরে ও গ্রামে দৈনিক ৫৭০ আর ৬৫০ গ্রাম খাবার কেনা যাবে। কিন্তু একটা নতুন ঝামেলার সৃষ্টি হল।

টাকার হিসেবে বের করতে গেলে বাজারের দাম জানতে হয়। কোন বাজারের দাম, আর কিসের দাম? গরিব তো আর মলে গিয়ে বাজার করে না, আর খাবার দাবারের বাজার তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্থানীয় বাজার। এখানে অর্থনীতিবিদেরা দুটো রাস্তা ধরলেন, একদল বললেন, 'consumer price index' বলে একটা হিসেব আছে, যা সব রকম শ্রেণীর মানুষের ঘর গেরস্হালিরর খরচের ভিত্তিতে তৈরী হয়, সেই index ব্যবহার করে খাবারের দাম হিসেব করা যাবে, আরেক দল বললেন, কৃষি শ্রমিকদের জন্য আরেকটা price index, যার নাম 'agricultural labourer price index', তার ভিত্তিতে খাবারের দাম হিসেব করতে হবে।

ইতিমধ্যেই কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে গেছি দেখুন, শুরু করেছিলাম ক্যালোরি দিয়ে, সেখান থেকে খাবার, সেখান থেকে খাবারের দাম হয়ে বাজার দর! এ কাহিনির এখানেই শেষ নয়।

এর পরে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করল। কেউ বললেন, শুধু খাবার আর ক্যালোরি দেখলেই হবে? পুষ্টি দেখতে হবে না? পুষ্টির সঙ্গে কি কর্মক্ষমতার কোন সম্পর্ক নেই? অবশ্যই আছে। অন্য কেউ কেউ বললেন গরিবি কি শুধুই খাদ্য দিয়ে হিসেব হবে? গরিব কি কাপড়-জামা কিনবে না, চটি-জুতো পরবে না, তাদের মাথায় কি ছাদ থাকবে না, ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠাবে না, অসুখ করলে ডাক্তার দেখাবে না? সেসব দিকে কি গরিবের কোনো খরচা হবে না? প্রশ্নগুলো জরুরি। কারণ গরিবকে জীবনের কোন মানদন্ডে হিসেব করব? এমনকি কোন ধরনের জীবনের মানদন্ডে বিচার করব? শহর জীবনের না, গ্রাম জীবনের, না বনবাসী জীবনের? যে নিজের বাড়িতে কল খুললে জল পায়, আর যাকে দু' কিলোমিটার গিয়ে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া পুকুর থেকে জল তুলে কলসে করে বয়ে আনতে হয়, এই দুজনের মধ্যে যে তফাৎ আছে, সেই তফাৎ কি শুধুই অবস্থার তারতম্য, না কোনো পরিস্থিতিতে তা গরিবীর ফলশ্রুতি?

অন্যদিকে এই প্রশ্নও উঠল যে মানুষকে গিয়ে খাবারের কথা বা খরচার কথা যাই জিজ্ঞাসা করা হোক না কেন, সেটা কি শুধু সেইদিনের খাবার বা অন্যান্য খরচা, নাকি পিছনের সাত দিনের, নাকি পিছনের তিরিশ দিনের? উত্তর তো মানুষের স্মৃতি শক্তির উপর নির্ভরশীল। মানুষ কি ৩০ দিনের কথা ভালোভাবে মনে রাখতে পারে? নাকি সাত দিনের কথা জিজ্ঞেস করলেই যথেষ্ট? কেউ বললেন সাত দিন, কেউ বললেন তিরিশ দিন। এই বিষয়ে ভারতে পরিসংখ্যানবিদ্যার পথিকৃৎ প্রশান্তচন্দ্র মহলাননিশের ১৯৩০ সালের একটি বিখ্যাত গবেষণা আছে, যাতে তিনি দেখিয়েছিলেন পিছনের তিরিশ দিনের হিসেবটাই সঠিক।

প্রশ্ন আরও ছিল, এবং এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে নানা সময়ে বিভিন্ন কমিটি হয়েছে। অলগ কমিটি, লাকড়াওয়ালা কমিটি, তেন্ডুলকর কমিটি, রঙ্গরাজন কমিটি, নরেশ সাক্সেনা কমিটি। সম্প্রতি নীতি আয়োগ সম্পূর্ণ অন্য যুক্তি দিয়ে একটা নতুন হিসেব করেছে। এর বাইরে অর্থনীতিবিদেরা অনেকেই নিজেরা নানারকম যুক্তি সাজিয়ে গরিবীর হিসেব করার চেষ্টা করে গেছেন, সেই ট্রাডিশন এখনো চলছে।

গরিবী হিসেব করার কালপঞ্জী নির্ধারণ করলে বলব ১৯৭১ -৭২ সালে দান্ডেকর ও রথ প্রথম গরিবী রেখা নির্ধারণ করেন। তাঁরা বলেছিলেন ন্যূনতম ২,২৫০ কিলো ক্যালোরি যারা দৈনিক পায় না তারা গরিব, গ্রামাঞ্চলে মাসিক ১৫ টাকা ও শহরাঞ্চলে ২২.৫০ টাকা যারা রোজ খাওয়ার জন্য খরচা করার অবস্থায় নেই তারাই গরিব। ১৯৭৭ সালে অলগ কমিটি বললেন গ্রামাঞ্চলে গরিব তারাই যারা ২,৪০০ কিলো ক্যালোরি আর শহরাঞ্চলে ২,১৫০ কিলো ক্যালোরি রোজ পাচ্ছে না। তাঁদের হিসেব অনুযায়ী ১৯৭৯ সালে গ্রামাঞ্চলে মাসিক ৪৯.১ টাকা আর শহরাঞ্চলে ৫৬.৭ টাকা যারা খাওয়ার জন্য খরচা করতে পারছে না, তারা গরিব। তাতেও হল না, প্রশ্ন উঠল সারা ভারতের জন্য একটাই গরিবী রেখা? মানে সারা ভারতে চাল ডাল গম আলুর দাম কি সমান? ফলে রাজ্য ভিত্তিক গরিবী রেখা তৈরির দাবি উঠল। তার জন্য ১৯৯৩ সালে তৈরী হল লাকড়াওয়ালা কমিটি। তাঁরা ক্যালোরির হিসেবটা একই রাখলেন, কিন্তু রাজ্য ভিত্তিক শিল্প শ্রমিকদের consumer price index আর কৃষি শ্রমিকদের consumer price index অনুযায়ী রাজ্য ভিত্তিক আলাদা আলাদা গ্রাম ও শহরের জন্য গরিবী রেখা বাতলে দিলেন।

রাজ্য ভিত্তিক গরিবী রেখা নির্ধারণ করতে গিয়ে কিছুটা হিতে বিপরীত হয়। রাজ্যগুলো কেন্দ্রকে বলতে শুরু করলো আমাদের রাজ্য বেশি গরিব, আমাদের বেশি টাকা দিতে হবে, আবার এও শোনা গেল যে আমাদের রাজ্যকে কম গরীব দেখানো হয়েছে, হিসেবে ভুল আছে। কেউ অবশ্য বলেনি যে আমাদের রাজ্যকে বেশি গরিব দেখানো হয়েছে, আসলে তা নয়। এর মধ্যে দুই রকম price index তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠল, শেষ পর্যন্ত ওই পদ্ধতিটাই বাতিল হল।

রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের অর্থনীতিবিদেরা কিন্তু হাল ছাড়েননি। সব সরকারেরই ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল আমরা গরিবী হঠাবো এবং হঠাচ্ছি, অঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল সরকারের ইমেজ পাল্টানো। তবে একথা বলতেই হয় যে গরিবী নিয়ে মাথাব্যথা কংগ্রেস সরকারেরই বেশি ছিল। ১৯৭১-৭২, ১৯৭৭-৭৯, ১৯৯৩-৯৪, ২০০৪-২০০৯, ২০১২-১৪ - যখনই নতুন কমিটি হয়েছে, কংগ্রেস সরকার তখন ক্ষমতায়, ব্যতিক্রম জনতা সরকারের সময় অলগ কমিটি। পিছন ফিরে তাকালে দেখব, দিল্লিতে কংগ্রেস সরকার যখন ক্ষমতায়, তখন বামপন্থী ও বাম ঘেঁষা মধ্যপন্থী অর্থনীতিবিদদের রমরমা। গরিবী রেখা নিয়ে মাথাব্যথা, তাই নিয়ে আলোচনা, বিতর্ক, গবেষণা, আলাদা আলাদা হিসেব - এসবই গরিব ঘেঁষা রাজনীতির ফসল। আজ একথা বলতে দ্বিধা নেই যে ঐ রাজনীতির মধ্যে একটা এলিটিস্ট ঝোঁক প্রচ্ছন্ন ছিল। তাঁরা চাইছিলেন গরিবের সংখ্যা কমাতে, তাদের ঐ রেখার উপরে টেনে তুলতে, কিন্তু তার বেশি নয়। গরিবদের অবস্থার মৌলিক পরিবর্তন ঘটাতে গেলে লাগে শিক্ষা, স্বাস্থ্য-র প্রভূত উন্নতি ও ব্যাপক সামাজিক সংস্কার, তার সঙ্গে বড় রকমের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ। সেই কাজটা হয়েছে প্রধানত তামিলনাড়ুতে। কিছুটা কেরালায়। অন্য কোথাও নয়। বাকি সব জায়গায় সরকারের ভাঁড়ার থেকে গরিবকে কিছু দিয়ে ওই রেখার উপরে টেনে তোলার চেষ্টা ছাড়া বিশেষ কিছু হয়নি।

যাই হোক আমাদের কাহিনিতে ফেরত আসি। ২০০৪-এ সুরেশ তেন্ডুলকর কমিটি গঠন হয়। তাদের নতুন করে গরিবী মাপার পদ্ধতিটাই পর্যালোচনা করতে বলা হল! বলা হল মানুষকে ক্যালোরি সংক্রান্ত হিসেব করতে যে প্রশ্নগুলো করা হয়, সেগুলো ১৯৭৪ সালের খাদ্যাভাস অনুযায়ী রয়ে গেছে, সেটা পাল্টাতে হবে। ইতিমধ্যে খাদ্যাভাসের ধরণ কিছুটা বদলেছে, বিশেষত ডিম ও দুধের ব্যবহার গরিবদের মধ্যেও বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, বছর বছর মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব গরিবদের উপর কিভাবে পড়েছে, তা হিসেবে আনতে হবে। তাছাড়া শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত খরচকেও হিসেবে আনতে হবে।

ভালো কথা। কিন্তু ঐ কমিটি কী করলেন? তাঁরা একটা অদ্ভুত কাজ করলেন। একদিকে তাঁরা বললেন যে পুষ্টি সংক্রান্ত প্রশ্নও গরিবকে করতে হবে। কিন্তু তাঁরা শহরে আর গ্রামে খাদ্যাভাসের যে তফাৎ হয় সেই তফাৎ ভুলে শহরের খাদ্যাভাসটাকেই প্রামাণ্য বলে মেনে নিলেন। তার সঙ্গে তাঁরা স্বাস্থ্য, শিক্ষা সংক্রান্ত প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত করলেন কিন্তু তা শহরের অভ্যাসকে ভিত্তি ধরে! তেন্ডুলকরের হিসেব অনুযায়ী শহরে যদি ২৫.৭% মানুষ গরিব হয়, তার মানে তারা মাসে ৪৮৬ টাকা খরচা করতে পারে না, সেটাকেই গ্রামের উপর চাপিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, গ্রামে ৪১.৮% মানুষ মাসে ৪৮৬ খরচা করতে পারে না, কাজেই তারা গরীব। অবশ্য মুদ্রাস্ফীতি শহরে আর গ্রামে একটু আলাদা হয়, তাই শেষ বিচারে শহরে খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের জন্য যারা দৈনিক ৪৭ টাকা আর গ্রামে দৈনিক ৩২ টাকা খরচা করতে পারে না, সেই ব্যক্তি গরিব।

কমিটির পর কমিটি! ২০০৯ সালে তেন্ডুলকর কমিটি তার রিপোর্ট দিল আর তিন বছর বাদেই ২০১২ সালে সেই রিপোর্টের যুক্তি শোধরানোর জন্য রঙ্গরাজন কমিটি তৈরী হল। রঙ্গরাজন কমিটি গ্রাম ও শহরের মধ্যে খাদ্যাভাসের ও শিক্ষা, স্বাস্থ্য বিষয়ে খরচের তফাৎটা মেনে নিল সেই অনুযায়ী গরিবী রেখা শহরের জন্য আর গ্রামের জন্য আলাদা হল। ২০১৪ সালে ওই কমিটি রিপোর্ট পেশ করে, তার পরেই সরকার পাল্টে যায়, রিপোর্টও আলমারি বন্দি হয়ে যায়। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের গ্রামোন্নয়ন বিভাগও থেমে রইল না, তারা নরেশ সাক্সেনা কমিটি তৈরী করল, সেই কমিটি অন্য আরেক রকমভাবে হিসেবে করে দেশে ৫০% গরিব বলে দিল। স্বভাবতই কারুর তা পছন্দ হয়নি। কাজেই সেটাও আলমারি বন্দি হয়ে গিয়েছিল।

এতক্ষণ যা নিয়ে কথা হল তা মূলত গরিবী মাপার ভিত্তি ও সেই অনুযায়ী গরিবী রেখা মাপার পদ্ধতি নিয়ে। কিন্তু সেই পদ্ধতি অনুযায়ী সত্যিই কত জন গরিব তা তো হিসেব করতে হবে। সেই কাজটা করে National Sample Survey Organisation। ১৯৭২-৭৩ সাল থেকে নিয়মিত প্রতি পাঁচ বছর অন্তর এই সংস্থা ঘর গেরস্হালির খরচা নিয়ে বড় আকারে সার্ভে করে এসেছে, যার নাম 'Consumption Expenditure Survey'। ২০১১-২০১২ পর্যন্ত ৮ বার এই সার্ভে হয়েছে। প্রায় ১০০-র কাছাকাছি প্রশ্ন করে ঘর গেরস্হালি সংক্রান্ত সব রকমের খরচা কত হচ্ছে, এই সার্ভে থেকে তার একটা পরিমাপ পাওয়া যায়। ২০১২-র পরে ২০১৭-তেও সার্ভে হয়েছিল, কিন্তু মোদী সরকার সেই রিপোর্ট প্রকাশ করেনি। কিন্তু 'Business Standard' পত্রিকা সেই রিপোর্টের কিছুটা ফাঁস করে দেয়, যাতে দেখা গিয়েছিল ২০১২ থেকে ২০১৭ ওই পাঁচ বছরে গরিবী বেড়েছে। অবশ্য সেটা তেন্ডুলকর পদ্ধতি ব্যবহার করে। মোদী সরকারের তা পছন্দ হবে কেন!

প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সার্ভে হয়েছে, আর অর্থনীতিবিদেরা তার থেকে নিজেদের পছন্দের যুক্তি ও অঙ্ক কষে কতজন গরিব তার ফিরিস্তি দিয়েছেন। কেউ ক্যালোরি হিসাব করেছেন, কেউ এক রকম price index ব্যবহার করেছেন তো কেউ অন্য রকম। কেউ পুষ্টিকে হিসেবে এনেছেন কেউ আনেননি, কেউ তেন্ডুলকর পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন তো কেউ রঙ্গরাজন পদ্ধতি। কেউ শিক্ষা, স্বাস্থ্যের সঙ্গে বস্ত্র এবং ঘরোয়া সরঞ্জাম যেমন সাইকেল, বিদ্যুৎ হিসেবে নিয়েছেন কেউ নেননি। যত পথ, তত মত!

২০১২-র পর থেকে যেহেতু আর ওই সার্ভে হাতের কাছে নেই, তাই অর্থনীতিবিদেরা পড়েছেন মুশকিলে। বাম ডান সবাই। কিসের ভিত্তিতে হিসেব করা হবে? তাঁরা থেমে থাকার পাত্র নন। তাই হাতের কাছে যা পাচ্ছেন তাই দিয়ে হিসেব করা চলছে। সুরজিৎ ভাল্লা ও আরও দুজন বললেন, National Account Statistics তো রয়েছে। যা দিয়ে দেশের জিডিপি মাপা হয়। সেখানেও Private Final Consumption Expenditure বলে কিছু তথ্য নেওয়া হয়। তাঁরা দাবি করলেন এই তথ্যগুলি আর National Sample Survey Organisation-এর Consumption Expenditure Survey-তে করা তথ্যগুলি তুলনীয়, যদিও প্রশ্নগুলি তুলনা করলে সহজেই বোঝা যায় উত্তর এক আসার কথাই নয়। তাঁরা এখানেই থেমে থাকলেন না। তাঁরা আরেকটা অকল্পনীয় দাবি করলেন, বললেন যে ২০১২-র পর থেকে national income গড়ে যে হারে বেড়েছে, সেই হারেই সব বর্গের মানুষের রোজগার বেড়েছে। মানে আদানির রোজগার যে হারে বেড়েছে, হাসিম শেখেরও তাই! তাহলে আমরা গরিব মানুষগুলির এখন কত রোজগার অঙ্ক কষে বলে দিতে পারি। সেই হিসেব থেকে তাঁরা বলে বসলেন ভারতে আর গরিবী নেই।

যথারীতি তাই নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত বোঝা গেল, অতি উৎসাহে গাজন নষ্ট হয়েছে আর কি! এর রেশ কাটতে না কাটতেই দ্বিতীয় ঝটকা। অরবিন্দ পানঘরিয়া ও আরেকজন দাবি করলেন অতিমারীর পরে প্রতি ত্রৈমাসিকে গরিবী কমে গেছে! কোথা থেকে পেলেন তাঁরা এই সুখবর? Periodic Labour Force-এর সার্ভে থেকে। প্রতি তিন মাস অন্তর কর্মসংস্থান ও বেকারির তথ্য জানতে এই সার্ভে করা হয়। সেখানে ঘর গেরস্হালির খরচা সংক্রান্ত ৫টি প্রশ্ন করা হয়। মজা হল সরকারের যে সংস্থা ওই সার্ভে করে, তারা ওই ৫টি তথ্য বিশ্লেষণ করে না, সেই তথ্য ব্যবহার করে কোনো দাবিও করে না। এই প্রশ্নগুলিও National Sample Survey Organisation-এর সংগৃহীত তথ্যগুলির সঙ্গে তুলনীয় নয়, কিন্তু অরবিন্দ পানঘরিয়ারা সেই তথ্য নিয়ে তেন্ডুলকর পদ্ধতি - যা কিনা শোধরাতে হয়েছিল রঙ্গরাজন কমিটিকে - সেই পদ্ধতি ব্যবহার করে বলে দিলেন ২০২১ সালের চারটে ত্রৈমাসিকে গরিবী অসাধারণভাবে কমে গেছে! অবশ্য বর্তমানে ভারতের রাজনীতি এমন জায়গায় যে গরিবীর কমা বাড়া রাজনীতির বিষয়ই নয়, তাই এই সুখবর নিয়েও কেউ মাথা ঘামায়নি। অথবা এ এমন এক তথ্য যা নিয়ে বেশি কথা বললে হিতে বিপরীত হবে সেই আশঙ্কায় দরবারী মিডিয়াও এই সুখবরকে পাত্তা দেয়নি।

গরিবীর গল্পের তৃতীয় ভাগে আছে আসল কাহিনি। গরিবের নাম কি, বয়স কত, কোথায় থাকে? অর্থাৎ ২৫ না ১০% গরিব জানা এক জিনিস, আর তার জন্য কিছু করতে গেলে তাকে চিহ্নিত করতে হয়। যাকে 'বিপিএল সার্ভে' বলা হত। আজকাল এই কথাটা আর শোনা যায় না। শেষ কবে 'বিপিএল সার্ভে' নিয়ে শোরগোল শুনেছেন? সেই ২০০৯-২০১০ সালে। বিপিএল নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মাথাব্যথার অন্ত নেই, কিন্তু সব সরকারই 'বিপিএল সার্ভে' করা ছেড়ে দিয়েছে। কেন?

২০০৬-২০০৭ সাল নাগাদ কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ এবং সামাজিক অ্যাক্টিভিস্টরা বলতে শুরু করেন, 'বিপিএল সার্ভে' কোনো পেশাদারি সংস্থা করে না, করে স্কুলের মাস্টারমশাই, পঞ্চায়েতের সেক্রেটারি, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, ব্লকের কর্মী। ফলে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তা ভুলে ভরা। তার ভিত্তিতে সরকারি সহায়তা দিতে গেলে সরকারের মুখ পোড়ে। তার চেয়ে বড় কথা, একটা লাইনের উপরে যে, সে গরিব নয়, নিচে যে সে গরিব এই ধরনের বিভাজন একেবারেই বাস্তবের সঙ্গে মেলে না। ২,৪০০ কিলো ক্যালোরি-র জায়গায় যদি কেউ ২,৪৫০ কিলো ক্যালোরি রোজ খায়, সে গরিব নয়, এমন কথা বোধহয় একমাত্র অর্থনীতিবিদেরাই বলতে পারেন। যে গরিব নয়, একটা সাইক্লোনে, একটা অসুখের চিকিৎসায় বা একটা শারীরিক দুর্ঘটনায়, সে গরিব হয়ে যেতে কতক্ষণ। বহু দিক থেকে দাবি ওঠে, সরকারি সহায়তা সার্বজনীন করতে হবে। যার সেই সহায়তা দরকার সে বেছে নেবে। ১০০ দিনের কাজ তার এক বড় উদাহরণ। কাজটাই এমন যে যার দরকার নেই সে করতে আসবে না। সেই উদাহরণ অনুসরণ করে রেশন ব্যবস্থাও গরিবী রেখার শেকল থেকে মুক্তি পেল। পরবর্তীকালে 'পিএম কিষান', 'লক্ষীর ভান্ডার' সহ অনেক সহায়তাই এখন গরিবী রেখা এবং বিপিএল তালিকার যন্ত্রণা থেকে মুক্ত। সরকারগুলোও বুঝে গেছে, শুধু গরিবদের জন্য কিছু করতে গেলে ভারতীয় সমাজ তা করতে দেবে না, এমনকি ভোটের বাজারে তার খুব একটা প্রভাব পড়ে না। তার থেকে সামান্য কিছু সহায়তা গ্রামীণ ও শহুরে জনতার একটা বৃহত্তর অংশের জন্য ছড়িয়ে দিলে ভোটের বাজারে তার দাম বেশি।