আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ নবম সংখ্যা ● ১-১৫ মে, ২০২৩ ● ১৬-৩১ বৈশাখ, ১৪৩০
সমসাময়িক
সুপ্রিম কোর্ট বনাম বিজেপি
বিলকিস বানো। সাধারণ একটি নাম। ভারতে বসবাসকারী এক মুসলমান নারী। তাঁর মতন হাজারো নারী ভারতে থাকে। কিন্তু বিলকিস বানো অনন্যা কারণ হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা তাদের উন্মত্ততার চিহ্ন রেখে গেছে বিলকিসের শরীর ও মনে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় তাকে গণধর্ষণ করা হয় এবং তার পরিবারের ১৪ জন সদস্যকে হত্যা করা হয় ২০০২ সালের গুজরাত দাঙ্গার সময়। হিন্দুত্ব দাঙ্গাকারীরা ভেবেছিল বিলকিস বেঁচে নেই। কিন্তু তিনি বেঁচে যান এবং লড়াই করেন ন্যায়ের জন্য। তিনি হয়ে ওঠেন ভারতের সমস্ত অত্যাচারিত মানুষের ন্যায়ের পক্ষে লড়াইয়ের প্রতীক। সুপ্রিম কোর্ট, তদানীন্তন নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন গুজরাত সরকারের উপরে ভরসা করতে পারেনি। মামলা সরিয়ে আনা হয় মুম্বাইয়ে। সেখানে মুম্বাই হাইকোর্ট ১১ জন ব্যক্তিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় এই মামলায়।
কিন্তু বর্তমান ভারতে মুসলমান নারীকে ধর্ষণ করলে তা খুব বড় অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় না বিজেপি শাসিত সরকারের কাছে। তাই গুজরাত সরকার এই ১১ জন অপরাধীকে মুক্তি দেয়। এই খুনী এবং ধর্ষকরা ছাড়া পাওয়ার পরে তাদের মালা পরিয়ে বাড়ি নিয়ে যায় কিছু মানুষ। গুজরাতে সাম্প্রদায়িকতা কোন পর্যায় গিয়েছে তা বোঝার জন্য এর থেকে বড় উদাহরণ দেওয়ার দরকার নেই।
তবু, কিছু মানুষ শত প্রতিকূলতার মধ্যেও লড়াই জারি রাখতে জানে। বিলকিস বানো তাদের অন্যতম। গুজরাত এবং কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিলকিস বানো সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। এই মামলার শুনানি সুপ্রিম কোর্টে চলছে।
শুনানি চলাকালীন সুপ্রিম কোর্টে কিছু ঘটনা ঘটে যা দেশের বর্তমান শাসকদের ঔদ্ধত্যের পরিচয় আবারো দিচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টে শুনানির সময় মহামান্য বিচারকরা বলেন যে উক্ত অপরাধীরা ১,০০০ দিনের অধিক পে-রোলে জেলের বাইরে ছিল। একজন ১,৫০০ দিন পে-রোলে জেলের বাইরে ছিল। অর্থাৎ তিন বছর বা তার অধিক সময় প্রত্যেক প্রমাণিত অপরাধী জেলের বাইরে ছিল, যারা গণধর্ষণ এবং খুনের মতন অপরাধ করেছে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা বলেন যে গুজরাত এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে কারণ দেখাতে হবে যে তারা কেন এই অপরাধীদের মুক্তি দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয় যে এই সংক্রান্ত ফাইল সুপ্রিম কোর্টে পেশ করতে হবে।
কিন্তু মোদী জমানায় সুপ্রিম কোর্টের আদেশ মানতেও অস্বীকার করে গুজরাত এবং ভারত সরকার। তারা সেই ফাইল সুপ্রিম কোর্টে জমা করতে অস্বীকার করে। তারা বলে যে তারা সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল জমা করতে চায়, তাই তারা এখনি ফাইল সুপ্রিম কোর্টে দেখাবে না। মহামান্য বিচারপতিরা হতবাক হয়ে যান। তারা বলেন সরকার সরাসরি আদালত অবমাননা করছে। কিন্তু সরকার পক্ষ তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। আগামী ২ মে আবার শুনানি হলে তখন বোঝা যাবে সরকার এবং সুপ্রিম কোর্টের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করার প্রবণতা মোদী জমানার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক যা নিয়ে খুব বেশি চর্চা মিডিয়ায় দেখা যায় না। বিগত বেশ কিছু মাস ধরে সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে লাগাতার মুখ খুলেছেন দেশের উপরাষ্ট্রপতি এবং আইনমন্ত্রী। সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম মনোনীত বিচারপতিদের নিয়োগ করতে বেশ কিছু ক্ষেত্রে টালবাহানা করেছে সরকার। এমনও বলা হয়েছে যে বিচারপতিদের তাদের এক্তিয়ারের বাইরে যাওয়া উচিত নয়। আবার দেশের সংসদ যেহেতু মানুষের ভোটে নির্বাচিত কিন্তু বিচারপতিরা নন, অতএব সংসদে কোনো আইন পাশ করা হলে তা সুপ্রিম কোর্টের অবিলম্বে মেনে নেওয়া উচিত এই কথা বলতেও দ্বিধা করেননি বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা। বার্তা খুব স্পষ্ট। সুপ্রিম কোর্টকে সরকার নির্দেশিত লাইন মেনে চলতে হবে। আসলে বিজেপি-র যে স্বৈরাচার এবং সংবিধান বিরোধী দৃষ্টিকোণ রয়েছে তা থেকেই সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতাকে লাগাতার চ্যালেঞ্জ করার মানসিকতা উঠে আসে। তাই বিলকিস বানো কেসে গুজরাত তথা কেন্দ্রীয় সরকারের আচরণ বিজেপি-র বিচারব্যবস্থা নিয়ে সার্বিক রাজনীতির বাইরে নয়।