আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ নবম সংখ্যা ● ১-১৫ মে, ২০২৩ ● ১৬-৩১ বৈশাখ, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

দুর্নীতির পাহাড়, প্রশাসন ও পশ্চিমবঙ্গ


দুর্নীতির রোমহর্ষক ধারাবিবরণীতে কামিনী কাঞ্চনযোগ তো ছিলই, তাতে আরও একটু রসদ যেন বাকি ছিল। তাই সবিস্ময়ে রাজ্যবাসী প্রত্যক্ষ করলেন তল্লাশির সময় রাজ্যের শাসকদলের বিধায়ক সিনেমার দুর্বৃত্তের মতো বাড়ির পাঁচিল টপকে নিজের ফোনখানি পাশের পুকুরে ফেলে দিচ্ছেন। তারপর দুদিন ধরে তদন্তকারী দল এই পুকুরের জল সেঁচে সেই মহামূল্য ফোনখানি উদ্ধার করেছেন। এমন দৃশ্য দূরদর্শনের পর্দায় বা খবরের কাগজে দেখতে বা পড়তে হবে, এযাবৎকাল রাজ্যবাসী হয়ত স্বপ্নেও ভাবেননি। তবে তৃণমূলী রাজত্বে এ দৃশ্য যে খুব স্বাভাবিক ও গা সওয়া হয়ে উঠেছে তার সর্বৈব কৃতিত্ব অবশ্যই রাজ্যের শোষক (থুড়ি শাসক) দলের। প্রতিনিয়ত দুর্নীতির যে নিত্য নতুন নজির রাজ্যের শাসকদলের নেতা মন্ত্রীরা স্থাপন করেছেন তার তুলনা কেবল নাটক বা সিনেমার চিত্রনাট্যে হতে পারে। এসবের পরেও অবশ্য এই দলটির নেতা বা কর্মীদের যে ন্যূনতম লজ্জার বালাই আছে সে দোষারোপ কেউ করতে পারবেন না। বস্তুত তারা আবার যে একদিন 'বেশ করেছি চুরি করেছি' বলে রাস্তায় মিছিল করবেন না এমন আশ্বাস খোদ মুখ্যমন্ত্রী নিজেও দিতে পারবেন না।

বর্তমান রাজ্য সরকারের তত্ত্বাবধানে শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগে দুর্নীতি যে এযাবৎ স্বাধীন দেশের যে কোনো বড় দুর্নীতিকে লজ্জায় ফেলে দিতে পারে তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা। রাজ্যের মন্ত্রী থেকে তৃণমূলের ছোট বড় নেতাদের খাটের তলা বা ঘর থেকে এযাবৎ যে অঙ্কের হিসাব বহির্ভূত টাকা উদ্ধার হয়েছে তা বিস্ময়ের সীমা পেরিয়েছে। তারপর রয়েছে বিভিন্ন জায়গায় তাদের সঞ্চিত নামে ও বেনামে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি। সেই বিকট বিকট অঙ্কের হিসাব মাঝেমাঝেই রাজ্যবাসী খবরের কাগজের পাতায় পড়েন। কিন্তু সেই পরিমান হয়ত রাজ্যের শতকরা ৮০ ভাগ জনতার কল্পনারই বাইরে। লক্ষীর ভান্ডারের ৫০০ টাকা ভাতার জন্য, রেশনের নিম্নমানের সামগ্রীর জন্য লাইনে দাঁড়ানো গরীব জনতা ৫০ লক্ষ বা ১০০ কোটির তফাৎ আর কবেই বা করতে পারে। কিন্তু যারা কিছুটা হলেও ধারণায় আনতে পারেন, তারাও হয়ত হতবাক হয়ে আছেন। রাজ্যের কোষাগারে নাকি টাকার অভাব, অথচ আজ রাজ্যের শাসক দলের একজন সাধারণ পৌরপিতা অবধি বহুমূল্য গাড়ি ছাড়া চড়েন না। প্রতিনিয়ত মানুষ চোখের সামনে দেখছেন কাল যে ছিল সাধারণ, রাজ্যের শাসক দলের স্নেহছায়ায় এসে রাতারাতি সে অবস্থাপন্ন, কিভাবে হচ্ছে তাও হয়ত সবাই কমবেশী জানেন কিন্তু সবাই মুখে কুলুপ এঁটেছেন। দুর্নীতির এহেন সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা হয়ত সত্যিই এক নতুন সমাজের লক্ষণ বটে।

প্রশ্ন জাগে, এই সামাজিক অবক্ষয় কি কেবলই স্বতঃস্ফূর্ত নাকি এর পেছনে এক গভীর রাজনৈতিক অভিসন্ধি ও আয়োজন লুকিয়ে আছে? লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তৃণমূল এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই একটি নির্দিষ্ট রাজনীতির ঝান্ডা বহন করছিল। এ রাজ্যের প্রবীনেরা জানেন ২০০৮-০৯ সাল থেকেই তৃণমূলের রাজনীতির একটি নতুন ধরন প্রতিষ্ঠা হচ্ছিল যেখানে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তি ছিল মূল চালিকাশক্তি এবং তৃণমূল সেই দুর্বৃত্তিকে মান্যতা দিচ্ছিল মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ হিসাবে। তারপর রাজ্যের শাসনক্ষমতা পেতেই রাজ্যের নবনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী থানায় ছুটলেন অপরাধীদের মুক্তি দিতে। কলেজের অধ্যক্ষ পেটানো অপরাধী হয়ে গেল 'দামাল ছেলে'। দুর্নীতির অভিযোগে রাজ্য পুলিশের শীর্ষকর্তাকে সিবিআই তলব করলে তার বিরুদ্ধে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সপার্ষদ রাস্তায় ধর্ণায় বসেছেন, এও অভূতপূর্ব। আর ধীরে ধীরে পুলিশি ব্যবস্থার ভেতর ঢোকানো হল শাসকদলের অনুগত বাহিনীকে। আস্তে আস্তে পুলিশের সহায়তায় তৈরী হওয়া 'সিভিক ভলান্টিয়ার' কালক্রমে হয়ে উঠল 'সিভিক পুলিশ'। যদিও সম্প্রতি একাধিক মামলায় আদালতের কানমলা খেয়ে রাজ্য সরকার আবার 'সিভিক ভলান্টিয়ার'কে ফেরত এনেছে।

এই মুহূর্তে রাজ্যে বিভিন্ন থানার সাথে মোট ১ লাখেরও বেশী 'সিভিক ভলান্টিয়ার' যুক্ত। প্রাথমিকভাবে এই বাহিনী গড়ে তোলা হয় যান-চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও বড় উৎসব অনুষ্ঠানে পুলিশের কাজে সহায়তা করার জন্য। কিন্তু কয়েক বছরের ভেতরেই এদের দৈনন্দিন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে ব্যবহার শুরু করা হয়। এমনকি ২০১৮ সালে এই বাহিনীকে দিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন করানোরও চেষ্টা করা হয়। যদিও শেষ অবধি আদালতের হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হয়। কিন্তু সম্প্রতি মাননীয়া আবার ঘোষণা করেছেন যে এই বাহিনীর ১০%-কে পুলিশের স্থায়ী কনস্টেবল পদে নিযুক্ত করা হবে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে এদের কাজের ওপর ভিত্তি করে। বোঝাই যাচ্ছে এই অস্থায়ী বেকারদের সামনে আবার একটি গাজর ঝোলানো হচ্ছে যে রাজ্যের শাসক দলের হয়ে কাজ করলেই চাকরি পাকা হওয়ার বন্দোবস্ত। বস্তুত সারা বছরই চলে এই পারস্পরিক বোঝাপড়া। আর তার ফল হল রাজ্যে একাধিক অপরাধের ঘটনায় এই তথাকথিত সিভিক পুলিশদের যুক্ত থাকার অভিযোগ। প্রতিবাদী ছাত্র আনিস খানের মৃত্যুতে সংশ্লিষ্ট থানার সিভিক ভলান্টিয়ারদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের হয়। তোলাবাজি থেকে অপহরণ, ধর্ষণ সব ধরনের অপরাধেই এই সিভিক ভলান্টিয়ারদের নাম জড়িয়েছে। ফলে একথা পরিষ্কার যে কেবল বেকার যুবক-যুবতী নয়, বরং এক শ্রেণীর দুর্বৃত্তদের পুলিশের বাহিনীতে অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে এবং রাজ্য প্রশাসন তাদের আরও উৎসাহিত করেছে। এ এক ভয়ংকর প্রবণতা যা আদতে রাজ্যের গোটা পুলিশ বাহিনীকেই শাসকদলের জন্য কর্মরত বাহিনীতে পরিণত করেছে।

সাধারণ মানুষ, বিশেষত গ্রামাঞ্চলের মানুষ তাদের জীবনের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় জানেন রাজ্যের পুলিশ বাহিনী কীভাবে শাসকদলের তল্পিবাহক হয়ে উঠেছে। গোটা রাজ্যজুড়ে আজ যে নৈরাজ্যের পরিস্থিতি তার মূল কারণ হল তৃণমূলের নেতা বা কর্মীদের সাথে আলোচনা না করে স্থানীয় পুলিশ কোনো ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করে না। ফলে রাজ্যে রামনবমীকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা লাগলেও মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী অবলীলায় বলে যান যে খবর থাকা স্বত্ত্বেও পুলিশ ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি মৃত নাবালিকার দেহ উদ্ধার করতে গিয়েও পুলিশ চরম অমানবিক। কোথাও পুলিশ তৃণমূল কর্মীদের ভয়ে টেবিলের তলায় লুকোচ্ছে তো কোথাও থানার অফিসার গিয়ে তৃণমূলের কর্মসূচীতে ভাষণ দিচ্ছেন। অথচ এই পুলিশ প্রশাসনই আবার ঝাঁপিয়ে পড়ছে রাজ্যের অবিজেপি বিরোধী বিধায়ক ও তার অনুগামীদের গ্রেফতার করতে, চাকরি প্রার্থীদের লাঠিপেটা করতে, এমনকি দরকারে প্রতিবাদীকে খুন করতেও দ্বিধা নেই। পুলিশের ঘেরাটোপে বসে গ্রেফতার হওয়া মাফিয়া নিজের প্রতিপত্তি বজায় রাখে আর আবাস যোজনার ঘর চাইতে গিয়ে গৃহবধূ অত্যাচারিত হন সেই পুলিশেরই হাতে। আদতে রাজ্যের পুলিশ বাহিনীকে যে বর্তমান শাসকদল তাদের গুন্ডাবাহিনীতে পরিবর্তন করতে পেরেছে তা রাজ্যের গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য এক গভীর সংকট। রাজ্য প্রশাসনের বিশেষত পুলিশ বাহিনীর এহেন নির্লজ্জ রাজনীতিকরণ এর আগে কখনো হয়নি।

কিন্তু শাসক তৃণমূল কেবল পুলিশ প্রসাশনকেই কব্জা করেছে এমন নয়। আইন ব্যবস্থা বা আদালতকেও নিজেদের বাগে আনতে রাজ্য সরকার মরিয়া। ফলে কোনো বিচারপতির নির্দেশ অপছন্দ হলে রাজ্যের শাসকদলের অনুগামী আইনজীবীরা এজলাস বয়কট থেকে শুরু করে আদালত কক্ষে ঢুকে বিচারককে ঠেঙানোর তোড়জোড় করছে। কোনো বিচারক তৃণমূলের নেতার বিরুদ্ধে রায় দিলে তার বিরুদ্ধে অপরাধে যুক্ত থাকার অভিযোগ আনার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বিচারপতির বাড়ির দেওয়ালে পোস্টার লাগিয়ে দেওয়ার নজিরও শাসকদলের কর্মী বা আইনজীবীরা সৃষ্টি করেছেন। এমনকি রাতের অন্ধকারে পাঁচিল টপকে পুলিস গিয়েছে আইনজীবীকে গ্রেফতার করতে যিনি শাসকদলের অনুগামী নন। শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে মামলা চলাকালীন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী লাগাতার অসৎভাবে চাকরি পাওয়াদের হয়ে সওয়াল করে গেছেন বিচারকদের সামনেই। যারা দুর্নীতির চক্র চালিয়ে বেআইনিভাবে চাকরি দিয়েছে তারাই আবার সেই চাকরি বজায় রাখার জন্য মামলা করার নামে টাকা তুলছে, আর বড় বড় আইনজীবীদের নিযুক্ত করাও হচ্ছে। এমনকি অপছন্দের বিচারপতি যাতে মামলা থেকে অপসারিত হন তার জন্য আদালতেই মামলা করা হচ্ছে।

এথেকে বোঝা যায় যে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল আজ রাজ্যে দুর্নীতির একটা বাস্তুতন্ত্র তৈরী করে ফেলতে পেরেছে। রাজ্যের পুলিশ ও আদালতের ওপর একচ্ছত্র অধিকার কায়েম করতে তৃণমূল একরকম মরিয়া। রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থার দখলদারি তারা সম্পন্ন করেছে নির্বাচনে জয়লাভ করে। তারপর রাজ্যের পুলিশ বাহিনীর ভেতর এক দলীয় অনুগামী বাহিনীকে অন্তুর্ভুক্ত করা হয়েছে যারা একাধারে আইনের রক্ষাকবচ নিয়ে দুর্বৃত্তি করে চলবে এবং পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীর ওপর নজরদারি চালাবে যাতে পুলিশ প্রশাসন শাসকদলের নির্দেশে চলে। আর এর সাথে যুক্ত হয়েছে আদালত অধিকার করার চেষ্টা। যা সমাজের সর্বস্তরে এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারছে যে তৃণমূলের সাথে থাকলে সমস্ত অপরাধ মাফ এবং প্রশাসন তার পাশে আছে। ফলে একদিকে যেমন সমাজবিরোধীদের দাপট বাড়ছে অন্যদিকে সাধারণ মানুষ ক্রমেই এই ভয়ের পরিবেশে প্রতিবাদ করতে ভুলে যাচ্ছেন। অন্যায়ের সাথে আপোষ করে চলার এক নতুন জীবনধারা রাজ্যের সাধারণ মানুষ আত্মীকরণ করতে বাধ্য হচ্ছেন। শক্তিশালী গণআন্দোলন এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল ছাড়া এই পরিণতির বদল সম্ভব নয়। প্রশ্ন হল এই পালাবদলের ভার কি বামপন্থীদের হাতেই থাকবে নাকি আরও সংঘবদ্ধ কোন দক্ষিণপন্থী দল সেই রাশ দখলে নেবে, তা নির্ভর করছে বামপন্থীদের উপরেই। নৈরাজ্যের খাসতালুক এই রাজ্যে দুর্নীতির শিকড় আজ সর্বগামী। সামাজিক মূল্যবোধ আজ ভঙ্গুর। এই পরিস্থিতিকে যদি বদলাতে হয় তাহলে দায়িত্ব বামপন্থীদেরই নিতে হবে। কিন্তু এ রাজ্যের বামপন্থীরা কি আদৌ সেই গুরুদায়িত্ব বহনে প্রস্তুত? এই প্রশ্নের উত্তরের উপর নির্ভর করে রয়েছে রাজ্যের ভবিষ্যৎ।