আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২৩ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

হিন্দুত্ববাদী অতীতচর্চার স্বরূপঃ পাঠ্যসূচীতে মুঘল যুগ প্রসঙ্গ

উর্বী মুখোপাধ্যায়


গত কয়েক দশক ধরে ভারতে ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্র নানা বিতর্কে সরগরম। সাম্প্রতিক আমলে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে বারবার অভিযোগ উঠেছে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় আসীন কংগ্রেস তার রাজনৈতিক স্বার্থে রাষ্ট্রীয় চরিত্রের অসাম্প্রদায়িক, জাতীয়তাবাদী রূপ তুলে ধরতে অতীত ইতিহাস বিকৃত করেছে। সবচেয়ে বড় অভিযোগ এসেছে, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহাসিক ধারা অক্ষুণ্ণ রাখতে ‘কংগ্রেস-আশ্রয়ী’ মূলত বামপন্থী ইতিহাসবিদরা নাকি ইতিহাস বিকৃত করতে ধর্মীয় উপাদান, বিশেষত হিন্দু অবদানের কথা অস্বীকার করেছেন। দক্ষিণপন্থীদের অভিযোগ, এই ঐতিহাসিকেরা মূলত পাশ্চাত্য ভাবধারায় ইতিহাসচর্চা রীতি চালিয়ে যাওয়ার জন্য দেশীয় ধর্মীয় আবেগকে অনেক সময়েই লঘু করে শুধু মাত্র পাথুরে প্রমাণের উপর নির্ভর করে ইতিহাস রচনা করেছেন। এর ফলে স্থাপত্য কীর্তির নিরিখে মুঘল যুগ অনর্থকভাবে অধিক গুরুত্ব পেয়েছে, অন্যদিকে চর্চিত ইতিহাসে প্রাত্যহিক ধর্মীয় সনাতন আবেগ স্বীকৃতি পায়নি। যদিও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে হিন্দুত্ববাদী শক্তির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে এই অসাম্প্রদায়িক, তথ্যনির্ভরইতিহাসচর্চাকে নস্যাৎ করে‘হিন্দুগৌরব’ পুনরুদ্ধার প্রকল্পে একই সঙ্গে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে প্রতিদিনই কিছু ‘নতুন তথ্য ও সূত্র’ সরবারহ করে এক বিকল্প ইতিহাস গড়ে তোলার প্রচেষ্টা বেশ কিছুদিন ধরেই ক্রমশ জোরদার হয়ে এসেছে।

এই ধরনের অতীতচর্চায় লক্ষ্য করা যায় যে,আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু মূলত শিক্ষা প্রাঙ্গণে পঠিত ইতিহাস। কারণ সেখানে এক ধরনের প্রথাগত ইতিহাস চর্চার পরিবেশ থাকায় এখনও যে কোনো সম্প্রচারিত তথ্য বা সূত্রকেই আদত ইতিহাস বলে সহজে স্বীকার করে নেওয়া হয় না। যদিও ক্রমশ হিন্দুত্ববাদীদের রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্প্রসারিত হওয়ার পর থেকে এই অতীত বয়ান ইতিহাস না হলেও দেশীয় সংস্কৃতি বা জাতীয় দর্শনের নামে ক্রমশ পাঠক্রমের মধ্যেও ঢুকে পড়ছে।

সাম্প্রতিককালের প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, বিশেষত গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে তথ্য-ভিত্তিক অতীত নিয়ে আলোচনা শিক্ষা প্রাঙ্গণের বাইরেও উৎসুক জনতার বৃত্তে ক্রমশ প্রসার লাভ করেছে। ফলে মূলত অসাম্প্রদায়িক ইতিহাসচর্চার এক বিকল্প হিসেবে যে কোনো অতীতধর্মী আলেখ্যই ইতিহাস হিসেবে দক্ষিণপন্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ এক ধরনের তথ্য-বিকৃতির পথ ধরে প্রথাগত ইতিহাসচর্চাকে নাকচ করার এক পন্থা শুরু হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের বিকল্প তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা আম জনতার মধ্যে তৈরি হলেও তা ইতিহাসবেত্তাদের মধ্যে তৈরি করার কাজটা সহজ নয়। তাই গত কয়েক বছর ধরে এই ‘সচ ইতিহাস’-এর তথ্য সম্প্রচার ছাড়াও তার স্বীকৃতি শিক্ষিত সমাজে তৈরি করার এক নতুন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে।

তবে ইতিহাসচর্চায় তথ্য বিকৃতির ঘটনা নতুন নয়। শাসকের ন্যায্যতা বিধানের উদ্দেশ্যে ইতিহাসকে বাগে আনতে যে অনেক সময়েই তথ্য বিকৃত হয় সে কথা ঐতিহাসিকদের এক বড় অংশের কাছেই জানা। উপরন্তু রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের অভীপ্সার ফলে যে এই বিকৃতি আরো প্রবল হয়, সে ব্যাপারেও অনেকে ওয়াকিবহাল। তাই ঐতিহাসিক মহলে ইতিহাসকে শাসকের কুক্ষীগত করা থেকে রক্ষা করতে নিরন্তর লড়াই চলে। ইদানিং ঐতিহাসিক বিতর্কের অনেকখানি অংশ জুড়েই থাকে তথ্য বিকৃতি ও সঠিক তথ্য তুলে ধরার দাবি নিয়ে বাদানুবাদ। পোড় খাওয়া ঐতিহাসিক ও গবেষকদের কাছে সে জন্য তথ্যসূত্রের চরিত্র বা উদ্দেশ্য অনুধাবন ইতিহাচর্চার সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গী রূপে জড়িত। ঐতিহাসিকরা স্বভাবতই এই বিষয়ে ‘স্কেপ্টিক’।

সমস্যা হচ্ছে ইতিহাসের এই পদ্ধতিগত চর্চা অধিকাংশ মানুষের কাছেই খুব একটা পরিচিত নয়। তাই যাকে বলে 'হিস্টোরিয়ান্স ক্র্যাফট' বা ইতিহাস রচনা পদ্ধতি - তা থেকে গিয়েছে জ্ঞানচর্চাকারীদের সীমিত বৃত্তের মাঝে। সাধারণ মানুষের কাছে ইতিহাসের অর্থ লুকিয়ে আছে সাল-তামামি-সঙ্কুল অতীত আখ্যান রূপে। স্কুল-পর্যায়ে ইতিহাস বিষয়ে ভীতির সূত্রও এই অগুন্তি তথ্যপঞ্জী যার চরিত্র বা ব্যবহার পদ্ধতি অধিকাংশ সময়েই পাঠক্রমের বাইরে থাকায় ঐতিহাসিক তথ্য বা সূত্রকে নির্ভর করে কীভাবে ইতিহাস রচিত হয় সে যুক্তিবোধ ছাত্রদের কাছে আজকাল অজানা থেকে যায়। দুঃখের বিষয়, এই অজ্ঞানতাকে হাতিয়ার করেই ইতিহাসের নাম করে যা খুশি আখ্যান পেশ করা এক সহজ রাজনৈতিক ফায়দা লোটার উপায় হয়ে উঠেছে।

তাই আজকে ইতিহাসবিদদের প্রতিরোধ ভাঙ্গার ব্যবস্থা চলছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ পন্থা হল ইতিহাসের প্রচলিত পাঠক্রমে পরিবর্তন আনা। বেশ কিছুদিন ধরেই সে মর্মে অল্প অল্প করে অবহেলিত আঞ্চলিক ইতিহাসের গুরুত্ব বৃদ্ধির আড়ালে মারাঠা বা রাজপুত জাতির মুঘল-বিরোধী সংগ্রামকে জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধ ও হিন্দু জাতিসত্তার স্বীকৃতির জন্য আঞ্চলিক বোর্ডগুলিতে উপস্থাপিত হচ্ছে।

এই প্রসঙ্গে কোভিড অধ্যায়ের মধ্যেই পাশ হয়ে যাওয়া কেন্দ্রীয় সরকারের নিউ এডুকেশন পলিসির খসড়াটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এখানে দ্বর্থহীন ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে ইতিহাস পঠন-পাঠনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত দেশের ‘গৌরবময় অতীত-উদ্ধার’ যেখানে আমাদের প্রাচীন হিন্দু ভারতের শিক্ষা-পরিবেশকেই আদর্শ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ ইতিহাস বিষয়টি আদতে এক বিশ্লেষণী জ্ঞানচর্চার বিষয় নয়, তার একমাত্র গুরুত্ব হল অতীত ঘেঁটে বর্তমানের স্বার্থে শুধুই নির্বিকল্প (হিন্দুদের) গৌরবগাথার উপস্থাপন - সেটা এই নতুন শিক্ষানীতিতে জোর গলায় বলা হয়েছে। আসলে হিন্দুত্ববাদীরা মনে করেন, যে তাঁদের বর্তমানের অস্তিত্ব সংকটের হাত থেকে রেহাই পেতে ইতিহাসের মধ্যে শুধুমাত্র সেই গৌরবময় অতীতের আবাহনই একমাত্র প্রয়োজনীয় ইতিহাস। বাদবাকি ইতিহাস তাঁদের কাছে হয় ‘বিকৃত ইতিহাস’ নয় তো ‘দেশদ্রোহিতার সূত্রবিশেষ'। আমাদের দেশে অতীতচর্চায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব থাকায় এই মনোভাব আরো সুদৃঢ় হয়েছে। কারণ সে সময়ে জাতীয়তাবোধের স্বার্থে অনেক সময় অতীত অনুসন্ধানের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল অতীত গৌরব পুনরুদ্ধার। সেখানে অতীতের পরাভব বা বিপর্যয়কে বিশ্লেষণ না করে তাকে এড়িয়ে গিয়ে শুধু বিজয়গাথাকেই ইতিহাস রূপে প্রতিপন্ন করার তাগিদ অতীত-প্রসঙ্গ উত্থাপনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আজকের হিন্দুত্ববাদীরাও অতীতচর্চাকে মূলত নিরবিচ্ছিন্ন গৌরবগাথা রূপেই দেখতে চান। সে প্রকল্পে অবশ্যই থাকে বিজাতীয় প্রতিপক্ষ। এক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়েই এই বিজাতীয় প্রতিপক্ষ রূপে মূলত মধ্যযুগীয় মুসলিম শাসক গোষ্ঠী এবং ইংরেজরা এই আখ্যানে আলোচিত হন। এ ধরনের আখ্যান চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছে কয়েক দশক ধরে, দেশে উগ্র-হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে।

এই ধরনের প্রকল্প রূপায়নে মূর্তিমান প্রতিবন্ধক রূপে এসে দাঁড়ায় অবশ্যই মুঘল যুগ। আজকেও ভারতের সাংস্কৃতিক, আর্থিক, ধর্মীয় চরিত্রের প্রধান প্রেক্ষাপট এই শাসনকাল। মুঘলযুগ শুধুমাত্র তার চোখ ধাঁধানো স্থাপত্যকীর্তি যেমন তাজমহল, লালকেল্লার জন্য প্রাসঙ্গিক নয় - ভারতের রাজস্বনীতি থেকে শুরু করে তার আইনী বিভাগ যেমন দিওয়ানী ও ফৌজদারীরও মুঘল যুগ ব্যতীত আলোচনা সম্ভব নয়। আজকের ভারতের সংস্কৃতিতে বিশেষত ভাষায়, নকশায়, সঙ্গীতে, বেশভূষায়, খাদ্যাভ্যাসে বারবার উঠে আসে মুঘল যুগ। সে শাসনকালকে ‘অত্যাচারী’, ‘পরধর্ম-অসহিষ্ণু’, ‘লুন্ঠনকারী’, ‘বৈদেশিক জাতির পরাধীন’ রূপে নানাভাবে প্রচার করা হলেও এই ঐতিহাসিক পর্ব এতদিন পাঠ্য ইতিহাস থেকে সম্পূর্ণ মুছে দেওয়া যায়নি। বারবার তাই বলতে হয়েছে তাজমহল আদতে তেজোমহালয়। ঔরঙ্গজেবের মূল প্রকল্প ছিল ভারতবর্ষ থেকে সমস্ত বিধর্মীদের অপসারণ। কিন্তু সব প্রচার সত্ত্বেও সাক্ষ্য থেকে যায় সমকালীন ঐতিহাসিক সূত্রে যে শিবাজীর মতো হিন্দু বীরের উপস্থিতির সময়েও ঔরঙ্গজেবের দরবারে সর্বাধিক সংখ্যক হিন্দু ওমরাহ্ ছিলেন। এবং সে তথ্যের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন স্বয়ং যদুনাথ সরকার। সে কারণে ইতিহাস বিষয়টা ক্রমশই বিষ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল শাসকদলের কাছে।

এইরকম অবস্থায় গত ৪ঠা এপ্রিল 'ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর এডুকেশনাল রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং' প্রণিত ২০০৭ সালে প্রকাশিত দ্বাদশ শ্রেণীর জন্য নির্দেশিত পাঠ্যবইয়ের দ্বিতীয় ভাগ থেকে 'কিংস এন্ড ক্রনিকলসঃ মুঘল কোর্ট' নামাঙ্কিত অধ্যায়টি বাদ দেওয়া হল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে কেন্দ্রীয় শিক্ষাবোর্ড ছাড়াও আরও অনেক রাজ্যেও এন.সি.ই.আর.টি.-র এই বই পাঠ্য হিসেবে পড়ানো হয়। যেমন উত্তরপ্রদেশে। এবং এই ঘোষণার পরপরই খবরে প্রকাশ উত্তরপ্রদেশের উপ-মুখ্যমন্ত্রী ব্রজেশ পাঠক মন্তব্য করেন যে রাজ্যস্তরে কেন্দ্রীয় বোর্ডকেই অনুসরণ করে যে যে অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে তা মাথায় রেখেই উত্তরপ্রদেশে হুবহু এক পাঠক্রম পড়ানো হবে। এ ঘোষণায় স্বাভাবিকভাবেই সাম্প্রতিক মিডিয়ায় দ্বাদশ শ্রেণীর পাঠক্রম থেকে মুঘল যুগের ইতিহাস বাদ গেছে বলে খবর হয়। কিন্তু এন.সি.ই.আর.টি.-র অধিকর্তা দীনেশ প্রসাদ সাকলানি এ খবর ‘অসত্য’ বলে দাবি করে মন্তব্য করেন যে মুঘল ইতিহাস কখনোই কেন্দ্রীয় পাঠক্রম থেকে বাদ দেওয়া হয়নি। মুঘল দরবারী ইতিহাস ছাত্র-ছাত্রীরা সপ্তম শ্রেণিতেও পড়ে। তাই পুনরাবৃত্তি কাটাতেই এই পদক্ষেপ। পাশাপাশি করোনাকালের পর ছাত্রদের পাঠক্রমের ভার লাঘব করাও ছিল এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পিছনে এক উদ্দেশ্য। যেন একমাত্র মুঘল যুগের ইতিহাসই সালতামামিতে ভারাক্রান্ত।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, এ ধরনের মন্তব্য করেও তিনি ছাড় পেয়ে যান তার প্রধাণ কারণ হল, আমরা, যারা ইতিহাসচর্চার সঙ্গে সরাসরিভাবে যুক্ত, তারাও অনেকেই খবর রাখিনা, এই যে অধ্যায়টি বাদ গেল তাতে আদতে কী ছিল।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রয়াত অধ্যাপক হরি বাসুদেবনের নেতৃত্বে গঠিত নতুন উপদেষ্টা মন্ডলীর উদ্যোগে ২০০৭ সালে প্রকাশিত এই পাঠ্যবইটি রচিত হয়। স্বেচ্ছায় ইতিহাস বিষয়টি বেছে নেওয়া দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এই বই পাঠ্য হওয়ায় পাঠ্যসুচীতে প্রথাগত ঐতিহাসিক তথ্য পরিবেশনা ছাড়াও সমসাময়িক সূত্রনির্ভর করে কীভাবে ইতিহাসের আখ্যান নির্মিত হয় তার সঙ্গেও পরিচয় করানোর এক প্রচেষ্টা ছিল। সেই প্রকল্পেই এমনকি বহু পঠিত মুঘলযুগের দরবারী ইতিহাসের প্রসঙ্গও উত্থাপিত হয়েছিল এক ব্যতিক্রমী ধারায়। এখানে মুঘল বংশের ধারাবাহিক ইতিহাসের পরিচয় দেওয়ার পাশাপাশি সমকালীন তথ্যসূত্র ও তাদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিশ্লেষণের ব্যাপারেও নতুন প্রজন্মকে এক প্রাথমিক পাঠ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ফলে শুধু ঘটনাবলী নয়, আলোচিত হয়েছিল আসে দরবারী ইতিহাসলেখক বা ক্রনিক্লার যেমন আবুল ফজল ও আব্দুল হামিদ লাহোরীর অতীতচর্চা পদ্ধতি ও সেই তথ্যসূত্রকে ভিত্তি করে কীভাবে সমকালীন ইতিহাস রচনা করা যায় তা নিয়ে কিছু কথাও। বিস্তারিতভাবে বিবৃত হয় এই তথাকথিত দরবারী ইতিহাসলেখকদের উদ্দেশ্য ও বিবরণের ঐতিহাসিক উপাদানের বিশ্লেষণ। ফলে ইতিহাস যে শুধুই কিছু মনে রাখার জন্য জরুরি সাল-তারিখের মামলা বা ঘটনাবলী নয়, বরং তা বিশ্লেষণধর্মী এক জ্ঞানচর্চার ধারা তা তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু এই ধরনের আলোচনা যারা অতীতচর্চাকে কোনো বিশ্লেষণ নয়, নেহাতই বর্তমানের দিকে তাকিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে এক জয়ঢাক হিসেবে দেখতে চান তাঁদের কাছে নিঃসন্দেহে অপ্রয়োজনীয় হিসেবে বাতিল হবে। এই ধরনের ইতিহাসের পাঠ্য থাকলে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত মুঘল শাসকদের দোষী সাব্যস্তকারী বিভিন্ন অলীক তথ্য-সঙ্কুল আখ্যান নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। পাশাপাশি এই অধ্যায়ে মুঘল ইতিহাস রচনার জন্য বিকল্প সূত্র যেমন ছবি, স্থাপত্য সমকালীন সাহিত্যের কথাও বর্ণিত হয়েছিল। এই ধরনের সূত্রগুলি, বিশেষত ছবি প্রসঙ্গে সেখানে আরো কিছু কথা উঠে আসে যা হিন্দুত্ববাদী বয়ানে ইসলামি শাসকের প্রচলিত স্টিরিওটাইপের থেকে নিঃসন্দেহে স্বতন্ত্র। সেখানে আলোচিত হয়েছিল কীভাবে মুঘল যুগে আঁকা রাজকীয় মুখচিত্র আদতে ইসলামের রীতি-বিরুদ্ধ এক সর্বময় শাসকের অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রকাশ। এ প্রসঙ্গেই সেখানে উল্লেখিত হয়েছে কীভাবে এই ধরনের প্রক্ষেপ আদতে উলেমাদের সঙ্গে মুঘল শাসকদের সংঘাতের পরিস্থিতি নির্মাণ করে যা আদতে মুঘল দরবারী সংস্কৃতিকে ধর্মীয় পরিচিতির বাইরেও এক মিশ্র সংস্কৃতির পাদপীঠ রূপে পরবর্তী প্রজন্মকে চেনাতে সাহায্য করে।

ফলে শুধু তথ্যভিত্তিক কিছু ঘটনা নয়, পদ্ধতিগতভাবেও এই ধরনের ঐতিহাসিক সূত্র কীভাবে ইতিহাস রচনাকে সমৃদ্ধ করে তার এক বিশ্লেষণ পরিবেশিত হয়। সে কারণে এ অধ্যায় বাদ যাওয়া শুধুমাত্র বহু চর্চিত মুঘল যুগের ঘটনাবলী বাদ যাওয়া নয়, একধরনের ইতিহাস রচনার পদ্ধতি সম্পর্কেও পরবর্তী প্রজন্মকে অন্ধকারে রাখার চক্রান্ত।

সত্যি বলতে কি, এক দিক দিয়ে অধিকর্তা সাকলানি মিথ্যে বলেননি। মুঘল ইতিহাস পাঠক্রম থেকে সম্পূর্ণত মুছে যায়নি। থেকে গেছে ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের অর্থনৈতিক ইতিহাসের নেপথ্যে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেই অধ্যায়গুলিতে মুঘল রাজস্বব্যবস্থা বা জমিন্দারী প্রথা যেভাবে পরিবেশিত হয়েছে সেখানে সেই তথ্য উদঘাটনে ঐতিহাসিক পদ্ধতির কোনো উল্লেখ নেই। ফলে সে ধরনের অতীত আখ্যানে পরিসংখ্যানের অগুন্তি রূপরেখা গলাধঃকরণে ছাত্ররা বিরক্তই হবে, আদতে মুঘল যুগের ইতিহাস বা তার রচনার উপাদানগুলি আর নেড়েচেড়ে দেখতে আগ্রহী হবে না। সুতরাং লাভ হবে তাঁদের, যাঁরা মুঘলদের ’গাঁট-কাটা' লুটেরা’দের পর্যায় বসাতে চান, অথবা যাঁরা যে কোনো ইসলামী শাসনব্যবস্থার সঙ্গে মুঘল শাসনব্যবস্থাকেও একাকার করেই দেখতে বা দেখাতে চান, যেখানে ইতিহাসচর্চার পদ্ধতি বা বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি সংক্রান্ত আলোচনার অনুপস্থিতি আদতে মুঘলযুগকে এক বহুমাত্রিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ধারার প্রেক্ষাপট হিসেবে আর ভাবতে শেখাবে না। তাই এই অধ্যায়টি পাঠক্রম থেকে বাদ দেওয়া শুধুমাত্র শাসকের স্বার্থে তথ্যবিকৃতি নয়, আধুনিক ইতিহাসচর্চা রীতি ভোলানোর রাজনৈতিক পরিকল্পনারও নামান্তর।