আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২৩ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

সুভাষচন্দ্র ও নাৎসি জার্মানির ইহুদি নিধন যজ্ঞ

রজত রায়


ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগণ্য নেতা হলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। দেশবাসী তাঁর সাহস, আত্মত্যাগ ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াইয়ে নেতৃত্বদানের কারণে গান্ধীজি ও নেহরুর সঙ্গে এক সারিতে বসিয়ে সম্মান জানায়। প্রায় ৭৮ বছর হয়ে গেল, নেতাজি আমাদের মধ্যে নেই। তবু দেশের অগণিত মানুষের মনে এখনও নেতাজি সুভাষের স্মৃতি ভীষণভাবে জীবন্ত। তাঁর ভক্তদের মধ্যে অবশ্য শ্রেণীবিভাগ রয়েছে। বহু ভক্ত মনে করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বেরিয়ে নেতাজি আদৌ বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাননি। তিনি নির্জনে কোথাও আত্মপরিচয় গোপন করে পুনরায় শক্তিসঞ্চয়ের জন্য সাধনায় রত। এই ধারণায় বিশ্বাসী ভক্তরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নানাধরণের সাধুসন্ন্যাসীর মধ্যে নেতাজিকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে থাকেন।

আর এক দল ভক্ত মনে করেন, বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু দেশের জন্য তাঁর আত্মত্যাগ, তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ও ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী আজও ভারতের রাজনীতিতে একইরকম প্রাসঙ্গিক। ব্রিটিশদের কবল থেকে দেশকে স্বাধীন করার অভীপ্সায় যেভাবে তিনি ইংরেজ প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে কলকাতার বাসভবন থেকে একবস্ত্রে পালিয়ে বহু কষ্ট স্বীকার করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীনই আফগানিস্থান, সোভিয়েত রাশিয়া ও ইতালি হয়ে শেষে ১৯৪১ সালে জার্মানি পালিয়ে যান তা অবিস্মরণীয়। প্রথমে সেখানে ‘আইএনএ’ বাহিনী গঠন করেন, পরে সাবমেরিনে বিপদসঙ্কুল যাত্রা করে জাপানে পৌঁছান। তারপর জাপানের সামরিক সাহায্য পেয়ে দ্বিতীয়বার ‘আইএনএ’ বাহিনী গঠন করে ভারতের মাটিতে মণিপুর পর্যন্ত পৌঁছে স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেন - সবই এখন রূপকথার অলৌকিক কাহিনীর মতো মনে হয়। নেতাজির এই দেশপ্রেম ও তাঁর আত্মত্যাগ বাঙালি তথা ভারতবাসীর মনে তাঁকে এক মহান দেশনায়কের আসনে বসিয়েছে।

নেতাজির রোমাঞ্চকর জীবন নিয়ে অবশ্য একটা চাপা অস্বস্তি ভক্তকুলের মনের মধ্যে রয়ে গেছে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে হিটলারের সঙ্গে আঁতাতের প্রশ্ন নিয়ে একটা পীড়া তাঁর ভক্তদের মধ্যেও আছে। প্রথমে হিটলারের নাৎসি সরকার, সেই সঙ্গে মুসোলিনীর ফ্যাসিস্ত সরকার এবং পরে জাপানের তোজোর নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে, অর্থাৎ এক কথায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির দিকে সরে গিয়ে তিনি ব্রিটিশদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার চেষ্টা করেন। নেতাজির তরফে বলা যেতেই পারে যে তিনি “শত্রুর শত্রু, আমার মিত্র” - এই আপ্তবাক্যকে নিজের উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করেই এই কাজ করেছিলেন। গান্ধীজি অবশ্য সুভাষচন্দ্রের এই নীতির সমর্থন করতে পারেননি। 'হরিজন' পত্রিকায় ১৯৪২ সালে তিনি এই প্রসঙ্গে লেখেন, "...he is wrong... 'Liberty at any cost' has a vastly different connotation for me from what it has for him." স্পষ্টতই সুভাষচন্দ্র যেখানে রণকৌশল হিসাবে নাৎসিদের সঙ্গে হাত মেলাতে আগ্রহী, গান্ধীজি সে জায়গায় নৈতিকতার প্রশ্নে আপস করতে রাজি নন।

এই নৈতিকতা, বা উচিত-অনুচিত-এর দ্বন্দ্বকে অমীমাংসিত রেখে দিলেও একটা প্রশ্ন থেকেই যায় - হিটলার, মুসোলিনী ও জাপানের তোজোর সরকার যুদ্ধ চলাকালীন যে নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছিল অসামরিক জনসাধারণের উপর, তা নিয়ে তাঁর মনোভাব কী ছিল। হিটলারের জাতিদ্বেষ, বিশেষ করে ইহুদিদের ধনেপ্রাণে নিকেশ করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে যে নীতি (যা 'ফাইনাল সল্যুশন' নামে পরিচিত) এবং তা বাস্তবায়িত করার জন্য যে কর্মসূচি (যা 'হলোকস্ট' বা গণহত্যা যজ্ঞ নামে কুখ্যাত) নাৎসিরা নিয়েছিল, তা নিয়ে নেতাজির কী বক্তব্য ছিল? ভারতীয় ঐতিহাসিকরা এ বিষয়ে বিশেষ আলোকপাত করেননি। ফলে, প্রশ্নটি এখনও জনপরিসরে তেমনভাবে আলোচিত হয়নি।

এরই মধ্যে নেতাজি নুভাষচন্দ্রের পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের এক সদস্য শর্মিলা বসু মৌচাকে ঢিল মেরেছেন ইহুদিদের কাছে নেতাজির পরিবারের তরফে ক্ষমাপ্রার্থনা করে এক চিঠি পাঠিয়ে। শর্মিলা নিজে সুভাষচন্দ্রের অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসুর পৌত্রী, ডাঃ শিশির কুমার বসুর কন্যা। চিঠিটি তিনি পাঠিয়েছেন নিউ ইয়র্কে অবস্থিত 'Elie Wiesel Foundation for Humanity'-র Marion Wiesel-এর কাছে, যিনি ওই প্রতিষ্ঠানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট এমিরিটাস। প্রতিষ্ঠানটি যাঁর নামে, সেই এলি উইজেল নিজে হলোকস্টের শিকার। তিনি আউশভিষ্তে (Auschwitz concentration camp) বন্দী ছিলেন, চোখের সামনে নিজের মা, বাবা ও পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু দেখেছেন। তাঁর সেই মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতার কথা তিনি তাঁর 'নাইট' বইতে লিখে গেছেন, যার জন্য তিনি ১৯৮৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। সেই পুরস্কারলব্ধ অর্থ দিয়ে তিনি ও তাঁর স্ত্রী মারিওন উইজেল এই ফাউন্ডেশন গড়ে তোলেন। এই ফাউন্ডেশন প্রধানত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আশ্রয় নেওয়া ইহুদিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজে সচেষ্ট থাকলেও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের অ-ইহুদি মানুষদের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়েও তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করে। যেমন, চিনে সরকারের হাতে ক্রমাগত বৈষম্য ও অত্যাচারের শিকার উইগুর সম্প্রদায়ের মানুষজের অস্তিত্ত্বরক্ষার লড়াই।

শর্মিলা একই চিঠি আরও কয়েকটি ইহুদি প্রতিষ্ঠানকে পাঠিয়েছেন। চিঠিতে তিনি বলেছেনঃ "I would like to respectfully convey, to you and through you to Jewish people, other victims of Holocaust, and their loved ones, my sincere apology and profound remorse for the failure of my great uncle, Indian nationalist leader Subhas Chandra Bose, to acknowledge and condemn the persecution and extermination of Jews, other minority groups, disable people and political opponents, by Nazi Germany."

হিটলারের ইহুদি নিধন যজ্ঞের ব্যপ্তি কতটা ছিল তা নিয়ে যাঁদের ধারণা নেই, তাঁদের অবগতির জন্য বলছি, হিটলারের জাতিদ্বেষ এবং আগ্রাসী যুদ্ধের বলি হয়েছিল অন্তত এক কোটি মানুষ, তার মধ্যে ৬০ লক্ষ ছিল ইহুদি।

শর্মিলা অবশ্য ওই ক্ষমাপ্রার্থনার চিঠিতে এ কথা উল্লেখ করতে ভোলেননি যে এমনটা হতেই পারে যে নেতাজি বেঁচে থাকলে হয়তো পরে তিনি এই হলোকস্ট নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী স্পষ্ট করতে পারতেন। কিন্তু বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু সেই সম্ভাবনা শেষ করে দেয়। অন্যদিকে, ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সালের সময়কালে হিটলারের বার্লিনে থাকার সময়ে বা তার পরে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রণাঙ্গনে ‘আইএনএ’ বাহিনীর নেতৃত্বে ব্যস্ত থাকার সময়েও তাঁর কোনও ভাষণ, চিঠিপত্র ও অন্যান্য নথিপত্রে একবারও হলোকস্ট এবং হিটলারের ইহুদি বিদ্বেষ নিয়ে কোনও প্রতিবাদ বা মন্তব্যের উল্লেখ পাওয়া যায় না। শর্মিলা তাঁর চিঠিতে এ কথা উল্লেখ করে বলেছেন, সে জন্য তিনি যথেষ্ট লজ্জিত।

শর্মিলার যুক্তির সমর্থনে এ কথা মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে যে, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রণাঙ্গনে ব্যস্ত থাকলেও ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানির যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নিয়ে নেতাজি নিয়মিত খবর রাখছিলেন। হিটলার আত্মহত্যা করার পর ১৯৪৫ সালের মে মাসে মিত্রপক্ষের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করার পরে সুভাষচন্দ্র তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের বলেন, হিটলার দুটি রণাঙ্গনে, অর্থাৎ পশ্চিম ইউরোপে এবং পূর্বে সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েই নিজের পরাজয় ডেকে এনেছে। কিন্তু জার্মানি আত্মসমর্পণ করার কয়েক মাস আগেই ১৯৪৫ সালের জানুয়ারিতে আউশভিস্ত কনসেনট্রেশন ক্যাম্প সোভিয়েত বাহিনীর হাতে মুক্ত হয়। তখনই সরকারিভাবে প্রকাশ্যে আসে হিটলারের ইহুদিনিধন যজ্ঞের যাবতীয় প্রমাণ। সেই খবর মিত্রবাহিনীর সংবাদমাধ্যমের সুবাদে গোটা দুনিয়া জেনে যায়। কিন্তু নেতাজির এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য জানা যায়নি। অন্তত এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত নথিপত্রে সেরকম কিছু পাওয়া যায়নি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঐতিহাসিক সময়ে নেতাজির ভূমিকা নিয়ে অন্তত তিন জন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক আলোচনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য শর্মিলারই অগ্রজ, এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গার্ডিনার অধ্যাপক সুগত বসু। তাঁর লেখা নেতাজির জীবনী 'His Majesty’s Opponent'-এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ আকর গ্রন্থ। অপর দুই ইতিহাসবিদ হলেন Leonard A. Gordon (Brothers against Raj: Sarat Chandra Bose and Subhas Chandra Bose - A Biography) এবং Romain Hayes (Bose in Nazi Germany)।

অস্ট্রিয়ার ইতিহাসবিদ Hayes অনেক পুরনো নথিপত্র ঘেঁটে দেখার পর তাঁর বইয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে মন্তব্য করেন, সুভাষচন্দ্র যে হিটলারের ইহুদি বিদ্বেষ নিয়ে কোথাও প্রতিবাদ, নিন্দা বা সমালোচনা করেছিলেন, এমন একটাও প্রামাণ্য নথি পাওয়া যাচ্ছে না কেন? অথচ Hayes এবং মার্কিন ইতিহাসবিদ Gordon, দুজনেই জানিয়েছেন যে বার্লিনে থাকাকালীন সুভাষচন্দ্র গোয়েবলস-এর সংবাদপত্র 'Der Angriff'-তে প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ('Der Angriff' ১৯২৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়, এবং ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে বন্ধ হয়ে যায়। গোয়েবলস আগাগোড়া এই পত্রিকার প্রকাশক ছিলেন।) যদিও অনেক অনুসন্ধান করেও তাঁরা ওই পত্রিকায় প্রকাশিত নেতাজির ওই প্রবন্ধটি জোগাড় করতে পারেননি। তবে দুজনেই জানিয়েছেন, নেতাজির ওই প্রবন্ধটির কথা তাঁরা জেনেছেন সমসাময়িক ইহুদি সংগঠন থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রে নেতাজির লেখার কড়া সমালোচনা থেকে। গর্ডন তাঁর বইয়ে ইহুদি পত্রিকায় প্রকাশিত নেতাজির লেখার সমালোচনা থেকে এটুকু উদ্ধার করেন যে, গোয়েবলসের পত্রিকায় প্রকাশিত নেতাজির লেখায় ভারতীয়দের আর্য জাতিপরিচয়ের কথা বলা হয়েছিল এবং ইহুদিদের বিরুদ্ধে মন্তব্য করা হয়েছিল। মনে রাখতে হবে, হিটলারের জাতিদ্বেষের মূল ভিত্তি হিসাবে এই ধারণা তুলে ধরা হত যে জার্মানি এবং ইউরোপের একটা বড় অংশের মানুষ নর্ডিক বিশুদ্ধ রক্তের অধিকারী। আর ইহুদিরা অনার্য জাতি। একটা ধর্মীয় পরিচয়কে (ইহুদি) এভাবে একটা জাতি পরিচয় দিয়ে সব মিলিয়ে মিশিয়ে নাৎসিদের ওই জাতিদ্বেষের চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক তত্ব তৈরি হয়েছিল। হিটলার তাঁর 'Mein Kamph' বইয়ে এই জাতিদ্বেষ তত্বকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিষ্ঠা করার পরে সেটাই নাৎসিদের কাছে ম্যানিফেস্টোর কাজ করে। 'Mein Kamph' বইয়ে ভারতীয়দের সম্পর্কেও যথেষ্ট ঘৃণা উদ্রেককারী মন্তব্য রয়েছে। যা সুভাষচন্দ্রকে ক্ষুব্ধ করে তোলে, এবং তিনি হিটলারের কাছেই সরাসরি দাবি করেন 'Mein Kamph' থেকে ভারতীয়দের সম্পর্কে জাতিগতভাবে এই হীন মন্তব্য বাদ দিতে হবে। হিটলার অবশ্য তাতে কর্ণপাত করেনি। এটা হতেই পারে যে গোয়েবলসের পত্রিকায় ভারতীয়দের আর্যত্ব নিয়ে যুক্তিবিস্তার করার মাধ্যমে এ বিষয়ে হিটলারের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল।

কিন্তু জার্মানিতে থাকাকালীন নেতাজি কী সত্যিই হিটলারের ইহুদি বিদ্বেষের বিপজ্জনক দিকগুলি সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেননি? এ বিষয়ে সুগত বসুর বইয়ে কিন্তু অন্য ইঙ্গিত মেলে। ১৯৩২ সালের জানুয়ারিতে গান্ধীজির লবণ আন্দোলনের জেরে কংগ্রেসের শীর্ষনেতারা প্রায় সবাই কারাবন্দী হন। সুভাষচন্দ্র জেলে থাকালীনই অসুস্থ হয়ে পড়েন, কিন্তু সরকারি চিকিৎসকরা তাঁর রোগ সনাক্ত করতে না পারায় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ শর্তসাপেক্ষে সুভাষচন্দ্রকে মুক্তি দেন। কিন্তু তাঁর ভারতে থাকার অনুমতি মিলল না। নিজের খরচে তাঁকে চিকিৎসার জন্য ইউরোপে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। সেই অনুযায়ী সুভাষচন্দ্র ১৯৩৩ সালের মার্চে ভিয়েনায় এসে চিকিৎসার জন্য একটা স্যানিটোরিয়ামে ভর্তি হন।

কিছুটা সুস্থ হয়ে তিনি ভিয়েনা থেকে বেরিয়ে চেকশ্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড প্রভৃতি দেশে যান ও সেখানে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্তরে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ ও মতবিনিময় করার সুযোগ পান। ১৯৩৩ সালের ১৭ জুলাই সুভাষচন্দ্র পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ থেকে ট্রেনে বার্লিন পৌঁছান।

মনে রাখতে হবে ১৯৩৩ সালের জানুয়ারি মাসেই হিটলার জার্মানির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। হিটলারের নাৎসি বাহিনী তখন প্রকাশ্যেই ইহুদি ও কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচার করত, যা অনেক সময়ই হিংসাত্মক ঘটনায় পরিণত হত। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় থেকেই বার্লিনকে কেন্দ্র করে ভারতীয় বিপ্লবীদের একটা বড় দল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছিল। জার্মানির তখনকার রাষ্ট্রপ্রধান কাইজারের কাছ থেকে সমরাস্ত্র ও অর্থ সাহায্য নিয়ে তারা ভারতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের চেষ্টা করছিল। কিন্তু ইংরেজরা খবর পেয়ে বাটাভিয়ার (এখনকার ইন্দোনেশিয়ার অংশ) কাছে মাঝ সমুদ্রে জার্মান অস্ত্রবোঝাই জাহাজ আটক করে। এদিকে অস্ত্র সরবরাহ ও সংগ্রহের জন্য উড়িষ্যার সমুদ্র উপকূলে অপেক্ষা করতে গিয়ে বাঘা যতীন এবং তাঁর সঙ্গীরা বুড়িবালাম নদীর কাছে ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন। জার্মানির সহায়তায় ভারতে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রথম চেষ্টা এভাবেই অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। হিটলারের আমলে নেতাজি সুভাষের উদ্যোগে দ্বিতীয়বার জার্মানির সাহায্য নিয়ে ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করার চেষ্টাও কিন্তু আদৌ গতি পায়নি। সুগত বসু মনে করিয়ে দিয়েছেন, হিটলারের জাতিতত্ব অনুযায়ী ইংরেজরাও জার্মানদের মতোই উচ্চ বর্ণের আর্য। তা ছাড়া ব্রিটিশ রাজশক্তির সঙ্গে বৈরিতার সম্পর্ক থাকলেও গোড়ায় হিটলার ব্রিটিশদের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও আগ্রহ নিয়েই তাকিয়েছিল (Mein Kamph)। তার আগ্রহ ছিল জার্মানি ও ব্রিটেন নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে ইউরোপের উপর, এবং তার উপনিবেশগুলির উপর আধিপত্য বিস্তার করা। তাই ব্রিটিশদের কবল থেকে ভারতকে মুক্ত করে স্বাধীনতা পেতে সাহায্য করার ব্যাপারটা জার্মানির রণনীতিতে অগ্রাধিকার পায়নি।

অবশ্য নেতাজি যখন ১৯৩৩ সালে জার্মানি যান, তখন এসব প্রশ্ন ওঠার সম্ভাবনাই তৈরি হয়নি। কিন্তু নেতাজি তখন জার্মানি এবং মধ্য ইউরোপের কিছু দেশ ঘুরে সেইসব দেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করছিলেন। চেকশ্লোভাকিয়ায় তাঁর পরিচয় হয় ভারতীয় বিপ্লবী এ. সি. এন. নাম্বিয়ারের সঙ্গে (পরবর্তীকালে তিনি আজাদ হিন্দ সরকারে নেতাজির গুরুত্বপূর্ণ সহকারীর ভূমিকা নেন)। নাম্বিয়ারকে জার্মানি তখনই সেদেশে প্রবেশের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। এ ছাড়া বার্লিনে থেকে যাওয়া কিছু ভারতীয় বিপ্লবী ও ভারতীয় ছাত্রের সঙ্গেও তাঁর পরিচয় হয়। তাঁদের কাছ থেকে জার্মানিতে বেড়ে চলা ইহুদি বিদ্বেষ (সেই সঙ্গে ভারতীয় এবং অন্যান্য জাতির সম্পর্কেও) তিনি অনেক তথ্য জানতে পারছিলেন। সুগত বসু এই প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দেন ইহুদি এবং চেক নারী কিটি কুর্টির (Kitti Kurti) কথা। বার্লিনে একটা ঘরোয়া আসরে নেতাজির বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ কিটি তাঁর সঙ্গে আলাপ করেন, যা অচিরেই তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্বে পরিণত হয়। ইহুদি দম্পতি কিটি ও অ্যালেক্সকে (তাঁর স্বামী) সুভাষচন্দ্রের পরামর্শ দ্রুত জার্মানি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেওয়া দরকার। ১৯৩৫ সালের ডিসেম্বরে তিনি কিটি কুর্টিকে এক চিঠিতে সতর্ক করে বলেন, জার্মানির পরিবেশ ক্রমশই দমবন্ধ হয়ে উঠছে। কিটি তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেন যে তাঁরা শীঘ্রই চেকশ্লোভাকিয়া ফিরে যাবেন। কিন্তু নেতাজির বাস্তবোচিত পরামর্শ, চেকশ্লোভাকিয়া জার্মানির নাগালের মধ্যেই, এবং খুবই ছোট্ট ও দুর্বল রাষ্ট্র। তাঁদের আমেরিকা যাওয়া উচিত। নেতাজির পরামর্শ মেনে ওই চেক ইহুদি দম্পতি আমেরিকাতেই আশ্রয় নেন, এবং হিটলারের ইহুদিনিধন যজ্ঞ থেকে বেঁচে যান।

অর্থাৎ, নেতাজি ইউরোপের আকাশে ঘনিয়ে আসা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালো মেঘের মধ্যে হলোকস্ট-এর যে পূর্বাভাস ছিল, তা ভালোরকম বুঝতে পেরেছিলেন বলেই ওই ইহুদি দম্পতিকে ঠিক সময়ে সতর্ক করে প্রাণে বাঁচিয়ে দিতে পেরেছিলেন।

মার্কিন ঐতিহাসিক গর্ডন তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে ১৯৩৪ সালের এপ্রিল মাসেই নেতাজি বার্লিনে জার্মান বিদেশ মন্ত্রকের কাছে একটা দীর্ঘ স্মারকলিপি দিয়ে নাৎসিদের জাতিদ্বেষ প্রচারের বিরুদ্ধে উদ্বেগ জানিয়ে বলেন যে এর ফলে ভারত - জার্মানি মৈত্রীর সম্পর্ক দানা বাঁধতে পারছে না। মনে রাখতে হবে, ১৯৩৫ সালের সেপ্টেম্বরেই ন্যুরেমবার্গ শহরে নাৎসিদের সম্মেলনের পরেই ইহুদিদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার আইন চালু হয়। ফলে, ইহুদিদের ব্যবসা কেড়ে নেওয়া শুরু হয়। জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তাদের বিতাড়ণ পর্ব শুরু হয়। নেতাজি তখন জার্মানিতেই। তিনি সেখান থেকে ভারতে রওনা হন ১৯৩৬ সালের এপ্রিলে। ফলে, এটা মনে করলে ভুল হবে না যে হিটলারের ইহুদি নীতি কীভাবে বাস্তবে নাৎসিরা প্রয়োগ করছে, তা তিনি ততদিনে জার্মানিতে বসে ভালোই অনুভব করতে পেরেছিলেন। ১৯৩৬ সালের জানুয়ারিতে হিটলার মিউনিখে প্রকাশ্য জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে দাবি করেন যে শ্বেতকায় জাতিরাই বিশ্বের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করবে। নেতাজি হিটলারের সেই বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বিবৃতি দেন এবং বার্লিনের ভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনকে জোরাল প্রতিবাদ করতে উদ্বুদ্ধ করেন।

নেতাজি জার্মানিতে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সালে জার্মানিতে যখন আবারও ছিলেন, তখন হলোকস্ট এবং ফাইনাল সল্যুশন প্রক্রিয়া তুঙ্গে। তাই এটা বিশ্বাস করা বেশ কষ্টসাধ্য যে জার্মানিতে ওই সময় থাকাকালীন, এবং তার পরে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রণাঙ্গনে আরও দুই বছর বেঁচে থাকা সত্ত্বেও কখনই হিটলার ও নাৎসিদের গণহত্যার অপরাধ নিয়ে নেতাজির কোনও বক্তব্যের প্রামাণ্য নথি পাওয়া গেল না।

নেতাজির পরিবারের সদস্যা শর্মিলা যে চিঠি ইহুদি প্রতিষ্ঠানগুলির কাছে পাঠিয়ে সুভাষচন্দ্রের হয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন, তা অত্যন্ত সাহসিক কাজ। নেতাজির মৃত্যুর ৭৮ বছর পরে এই নৈতিক অবস্থান বাঙালি তথা ভারতীয়দের অনেকের কাছেই নেতাজির স্মৃতির অবমাননা বলে গণ্য হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। জানা নেই, শর্মিলা এ ব্যাপারে নেতাজি-কন্যা অনিতার সঙ্গে কখনও আলোচনা করেছেন কিনা। তবে নেতাজি পরিবারের একাংশের কাছেই নেতাজি প্রসঙ্গে এই বিষয়টি খুঁচিয়ে তোলা আপত্তিজনক মনে হতে পারে। শর্মিলা এ সব বিষয়ে সচেতন থেকেই তাঁর নিজের নৈতিক অবস্থান নিয়েছেন বলে মনে হয়।