আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২৩ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

মহার্ঘ বাজারে নগণ্য ভাতা

প্রসেনজিৎ বসু, সমীরণ সেনগুপ্ত ও সৌম্যদীপ বিশ্বাস


গত তিন বছরে, করোনা অতিমারি ও লকডাউন জনিত অর্থনৈতিক মন্দার থেকে পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি গোটা বিশ্বজুড়ে মাথাচাড়া দিয়েছে চড়া মূল্যবৃদ্ধি, ভারতেও যার আঁচ পড়েছে। কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রকের হিসেবে সারা ভারতে খুচরো মূল্যবৃদ্ধির বার্ষিক গড় হার ২০২০-২১ অর্থবর্ষে ছিল ৬.২ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ৫.৫ শতাংশ; ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৮ শতাংশে। জ্বালানি, জামাকাপড় এবং খাদ্যদ্রব্যের ক্রমবর্ধমান দাম সার্বিক মূল্যবৃদ্ধিকে উস্কে দিয়েছে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে।

পশ্চিমবঙ্গে খুচরো মূল্যবৃদ্ধির বার্ষিক গড় হার ২০২০-২১ অর্থবর্ষে ছিল ৮.৭ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ৫.১ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের ফেব্রুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে খুচরো মূল্যবৃদ্ধির বার্ষিক হার ছিল ৭.৩ শতাংশ। অর্থাৎ গত তিন বছরের গড় ধরলে পশ্চিমবঙ্গে মূল্যবৃদ্ধির হার জাতীয় মূল্যবৃদ্ধির হারের থেকে ১% বেশি থেকেছে।

এই মহার্ঘ বাজারে দীর্ঘদিনের বকেয়া মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) আদায় করার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মচারীরা। রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মীরা ছাড়াও প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের সরকারি স্কুলশিক্ষক, অধ্যাপক, শিক্ষাকর্মী, চিকিৎসক, নার্স, আদালত কর্মচারী, লাইব্রেরিয়ান, আধা-সরকারি কর্মচারী ও অবসরপ্রাপ্ত পেনশনভোগীদের বিভিন্ন সংগঠনের সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ কলকাতার শহীদ মিনার ময়দানে এই বছরের ২৭ জানুয়ারি থেকে ধর্না-অবস্থান করছেন। হয়েছে অনশন, কর্মবিরতি, ধর্মঘট।

বকেয়া মহার্ঘ ভাতা প্রদানের পাশাপাশি আন্দোলনকারী কর্মচারীরা সরকারি কর্মক্ষেত্রে শূন্যপদে স্বচ্ছ নিয়োগ এবং অস্থায়ী কর্মীদের নিয়মিতকরণের দাবিও তুলেছেন। রাস্তার আন্দোলনের সাথেই লড়াই চলছে আদালতেও। মাননীয় কলকাতা হাইকোর্টের রায়কে উপেক্ষা করে সেই ২০০৬-সাল থেকেই ন্যায্য হারে ডিএ আজ পর্যন্ত বকেয়া হয়ে আছে। এই নিয়ে রাজ্য সরকার সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে জানিয়েছে যে হাইকোর্টের রায় মেনে বকেয়া ডিএ মেটানোর আর্থিক সামর্থ্য রাজ্য সরকারের নেই।

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর দল এখনো পর্যন্ত সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলনের দাবিগুলির বৈধতাকেই অস্বীকার করছেন। সম্প্রতি যে ভাষায় মুখ্যমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের আক্রমণ করেছেন তা অনভিপ্রেত। নিজের সরকারের কর্মীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে, কুকথা বলে সমস্যার সমাধান হওয়ার নয়। যেটা প্রয়োজন তা হল বকেয়া মহার্ঘ ভাতা বা ডিএ, সরকারি শূন্যপদ এবং রাজ্য কোষাগারের প্রকৃত পরিস্থিতি নিয়ে তথ্যভিত্তিক, গণতান্ত্রিক আলোচনার।

পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মচারীদের প্রতি বৈষম্য

কেন্দ্রীয় সরকার সম্প্রতি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতার হার মূল বেতনের উপর ৩৮% থেকে বাড়িয়ে ৪২% করেছে। কেন্দ্রের সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ২০১৬ সাল থেকে ডিএ-র এই হার নির্ণয় করা হচ্ছে। দেশের অধিকাংশ রাজ্য সরকারই তাদের কর্মচারীদের কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দেয় - যেমন অন্ধ্রপ্রদেশ, অসম, অরুণাচলপ্রদেশ, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা, রাজস্থান, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডের রাজ্য সরকার। কিছু রাজ্য কেন্দ্রীয় হারের থেকে একটু পিছিয়ে থাকলেও বর্তমানে ৩০ শতাংশের বেশি হারে ডিএ দেয়, যেমন কেরালা, ছত্তিসগড়, গোয়া, গুজরাট, হিমাচল প্রদেশ, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র ইত্যাদি।

পশ্চিমবঙ্গে সরকারি কর্মচারীদের ডিএ-র হার দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন - মাত্র ৬ শতাংশ। ডিএ দেওয়ার হারে সবার নিচে থাকা পশ্চিমবঙ্গের ঠিক উপরে রয়েছে ত্রিপুরা, যেখানে ডিএ-র হার বর্তমানে ২০ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের আমলে ২০১৫ সালে ষষ্ঠ বেতন কমিশন গঠিত হয়েছিল, যার প্রতিবেদন আসে ২০১৯ সালে। সেই প্রতিবেদন আজ পর্যন্ত রাজ্য সরকার ধামা চাপা দিয়ে রেখেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত বেতন কমিশনের রিপোর্ট সরকারি ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়, অথচ পশ্চিমবঙ্গের বেতন কমিশনের রিপোর্ট জনপরিসরে নেই। তাই রাজ্যের বেতন কমিশন কোন তথ্য বা যুক্তির ভিত্তিতে কি সুপারিশ করেছে সেটা রাজ্য সরকার ব্যতীত কেউই জানে না।

কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের মধ্যে সর্বনিম্ন স্কেলে মাসিক বেতন ১৮ হাজার টাকা, তার উপর ৪২ শতাংশ ডিএ ধরে বেতন দাঁড়ায় ২৫,৫৬০ টাকা। পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মীদের মধ্যে সর্বনিম্ন স্কেলে বেতন ১৭ হাজার টাকা, ৬ শতাংশ ডিএ ধরে মাসিক বেতন হয় ১৮,০২০ টাকা। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের সর্বনিম্ন স্কেলে বেতন পাওয়া একজন সরকারি কর্মচারী কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের থেকে মাসে অন্তত ৭,৫৪০ টাকা কম বেতন পান। অন্যান্য ভাতা ধরলে পার্থক্য আরও বেশি হবে। উপরের স্কেলগুলিতে কেন্দ্র-রাজ্য বেতনের পার্থক্য আরও বেশি। এই রাজ্যের কর্মচারীরা অন্যান্য রাজ্যের সরকারি কর্মীদের থেকেও গড়ে মাসিক ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা কম বেতন পাচ্ছেন।

এই রাজ্যের কর্মচারীরা কোন অপরাধটা করেছেন যে তাদের এই বৈষম্যের শিকার হতে হবে? দেশের সব রাজ্যের থেকে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি কর্মচারীদের এতটা কম হারে ডিএ দেওয়ার ফলে কর্মীমহলে স্বাভাবিকভাবেই অসন্তোষ ছড়িয়েছে। এতে সরকারি পরিষেবার যে অবনতি ঘটছে, তাতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তিও বাড়ছে।

পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় ঋণের বোঝা অনেক রাজ্যেই বেশি

মুখ্যমন্ত্রী বলছেন রাজ্য কোষাগারের যা অবস্থা তাতে কেন্দ্রের সমতুল্য হারে ডিএ দেওয়ার সম্ভব নয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রাজস্ব ঘাটতি (রেভেন্যু ডেফিসিট) ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের শেষে ছিল ১০,৩৯৮ কোটি টাকা, যা ওই বছর রাজ্যের জিএসডিপি-র ১ শতাংশের কম ছিল। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের শেষে রাজস্ব ঘাটতি প্রায় চারগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯,৬৬৩ কোটি টাকা, যা জিএসডিপি-র ২.৫৫ শতাংশ। রাজস্ব ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার ফলে রাজ্যের আর্থিক ঘাটতিও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মোট ঋণের বোঝা মার্চ ২০১৯-এ ৪ লক্ষ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০২৩-এর মার্চের শেষে ৬ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

গত চার বছরে রাজ্যের সরকারি কোষাগারের এই অবনতি কিন্তু শুধু পশ্চিমবঙ্গেই ঘটেনি, অতিমারি এবং মন্দার পর কেন্দ্র এবং অনেকগুলি রাজ্যেই রাজস্ব ঘাটতি, সরকারি ঋণ এবং সুদের বোঝা বেড়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী তামিলনাড়ু এবং উত্তরপ্রদেশের সরকারের মোট ঋণের বোঝা ২০২৩-এর মার্চের শেষে ৭ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, মহারাষ্ট্র সরকারের ঋণ ৬.৮ লক্ষ কোটি। রাজ্যের মোট উৎপাদনের (জিএসডিপি-র) অনুপাতে মোট সরকারি ঋণ ২০২৩ মার্চের শেষে পশ্চিমবঙ্গে ৩৫ শতাংশ, বিহার আর কেরালায় ৩৯ শতাংশ, রাজস্থানে ৪০ শতাংশ আর পাঞ্জাবে দেশের সর্বোচ্চ ৪৭.৬ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গের থেকে অধিক ঋণের বোঝা থাকা রাজ্যগুলির কোনটিতেই কিন্তু কর্মচারীদের ডিএ কেটে রাজস্ব ঘাটতি কমানোর চেষ্টা হচ্ছে না।

উন্নয়ন খাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কি অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় বেশি খরচ করে?

রাজ্য সরকার কোষাগারের বেহাল অবস্থার কারণ হিসেবে তিনটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেঃ
(১) উন্নয়ন খাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তুলনামূলক বেশি খরচ,
(২) পেনশন ও ভর্তুকি খাতে রাজ্য সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় এবং
(৩) রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনা।

সারণী ১ - রাজ্য সরকারের বিভিন্ন খাতে ব্যয়, ২০২১-২২ (সংশোধিত) [জিএসডিপি-র শতাংশে]

  উন্নয়ন খাতে ব্যয় পেনশন খাতে ব্যয় ভর্তুকি খাতে ব্যয়
১৭টি বড় রাজ্যের গড় ১৩.৬ ১.৯ ১.৯
পশ্চিমবঙ্গ ১১.১ ১.৭ ১.৪

তথ্যসূত্রঃ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া এবং পরিসংখ্যান দপ্তর, ভারত সরকার।

রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ ব্যতীত ভারতের ১৭টি বড় রাজ্যের - যার মধ্যে আছে অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার, ছত্তিসগড়, গোয়া, গুজরাট, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড, কর্ণাটক, কেরালা, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা এবং উত্তরপ্রদেশ - উন্নয়ন খাতে গড় খরচ ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ছিল মোট অভ্যন্তরীন উৎপাদনের বা জিএসডিপি-র ১৩.৬ শতাংশ, পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন খাতে খরচ সেখানে ১১.১ শতাংশ (সারণী ১)। পেনশন এবং ভর্তুকি খাতেও পশ্চিমবঙ্গে বড় রাজ্যগুলোর গড়ের তুলনায় কম খরচ হয়। ডিএ দিতে অপারগ বলে হাত তুলে নেওয়া রাজ্য সরকারের উন্নয়ন খাতে অধিক খরচের যুক্তিটা যে অচল তা এই তথ্য থেকেই স্পষ্ট।

কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগ প্রসঙ্গে

মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগ তুলে ধর্নায় বসেছিলেন। তাঁর অভিযোগ, রাজ্য সরকারের প্রাপ্য ১ লক্ষ কোটি টাকার বেশি নাকি কেন্দ্রীয় সরকার আটকে রেখেছে। এই বিপুল পরিমাণ টাকা কোন কোন খাতে রাজ্যের প্রাপ্য, এবং কিভাবে কেন্দ্র সেটা আটকে রেখেছে, তার কোন স্বচ্ছ হিসেব কিন্তু রাজ্য সরকার এখনো দিতে পারেনি।

রাজ্য সরকারের বাজেটের এফআরবিএম রিপোর্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বামফ্রন্ট সরকারের শেষ বছর, ২০১০-১১-এ, কেন্দ্রীয় করের ভাগ এবং অনুদান মিলিয়ে কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গকে দিয়েছিল ২৩,৭৫৪ কোটি টাকা, যা ছিল পশ্চিমবঙ্গের জিএসডিপি-র ৫ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে কেন্দ্রীয় করের ভাগ এবং অনুদান মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গ পেয়েছে ১.১৩ লক্ষ কোটি টাকা, যেটা পশ্চিমবঙ্গের জিএসডিপি-র ৭.৩ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে দেশের সমস্ত রাজ্যের কেন্দ্রের থেকে করের ভাগ এবং অনুদান মিলিয়ে গড় প্রাপ্তি ভারতের জিডিপি-র ৬.৩ শতাংশ। অর্থাৎ কেন্দ্রের থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজস্ব প্রাপ্তি গত ১২ বছরে তাৎপর্যপূর্ণভাবে রাজ্যের জিএসডিপি-র ২.৩ শতাংশ বিন্দু বেড়েছে, মূলত চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশের ফলে। পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রীয় করের ভাগ এবং অনুদান মিলিয়ে সমস্ত রাজ্যের গড়ের তুলনায় বেশি টাকা পাচ্ছে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগ বস্তুনিষ্ঠ নয়।

১০০ দিনের কাজের স্কিমে ৭ হাজার কোটি টাকা এবং আবাস যোজনায় ৮,২০০ কোটি টাকা পশ্চিমবঙ্গের কেন্দ্রের থেকে বকেয়া আছে সেটা জানা গেছে। কেন্দ্রের সেই টাকা ছেড়ে দেওয়াই কাম্য। কিন্তু সেই কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা ছাড়া হলে পশ্চিমবঙ্গে ওই প্রকল্পের সুবিধাভোগীরা সেটা পাবেন, ওই টাকা দিয়ে তো আর রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ডিএ দেওয়া যাবে না।

নিজস্ব রাজস্ব আয় বাড়াতে রাজ্য সরকারের ব্যর্থতা

রাজ্য সরকার কর্মীদের মাইনে দেয় তার রাজস্ব আয় থেকে; সেই রাজস্ব আয়ের উৎস মূলত চার রকমের - কেন্দ্রীয় করের ভাগ, কেন্দ্রীয় অনুদান, রাজ্যের নিজস্ব কর রাজস্ব এবং রাজ্যের নিজস্ব কর-ব্যতীত রাজস্ব। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ১৭টি বড় রাজ্যের নিজস্ব কর থেকে প্রাপ্ত মোট রাজস্বের গড় যেখানে ছিল জিএসডিপি-র ৬.৬ শতা়ংশ এবং কর-ব্যতীত রাজস্ব আদায়ের গড় ১.৯ শতাংশ, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব কর আদায় থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব আটকে ছিল জিএসডিপি-র ৫.৪ শতাংশে, কর-ব্যতীত রাজস্ব আদায় জিএসডিপি-র মাত্র ০.২ শতাংশ (সারণী ২)। এই তথ্য থেকে স্পষ্ট যে পশ্চিমবঙ্গের রাজস্ব ঘাটতি বা ঋণ বৃদ্ধির জন্য কেন্দ্রের বঞ্চনা নয়, আসলে দায়ী রাজ্যের নিজস্ব কর এবং কর-ব্যতীত রাজস্ব আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ব্যর্থতা। নিজস্ব কর আদায়ে পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ যেমন সংগঠিত শিল্প-প্রসারের অভাব, অন্যদিকে স্ট্যাম্প ডিউটি এবং গাড়ির উপর কর আদায়ের ক্ষেত্রেও দেশের বড় রাজ্যগুলির গড়ের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে আছে।

সারণী ২ - রাজ্য সরকারের নিজস্ব রাজস্ব আয়, ২০২১-২২ (সংশোধিত) [জিএসডিপি-র শতাংশে]

  নিজস্ব কর থেকে প্রাপ্ত মোট রাজস্ব নিজস্ব কর থেকে প্রাপ্ত মোট রাজস্বের মধ্যে কর-ব্যতীত রাজস্ব আয়
স্ট্যাম্প ডিউটি ও রেজিস্ট্রেশন ফী গাড়ির উপর কর
১৭টি বড় রাজ্যের গড় ৬.৬ ০.৭ ০.৪ ১.৯
পশ্চিমবঙ্গ ৫.৪ ০.৫ ০.২ ০.২

তথ্যসূত্রঃ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া।

নিজস্ব কর-ব্যতীত রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের সাথে বড় রাজ্যগুলির গড়ের ব্যবধান আরও প্রকট। কর-ব্যতীত রাজস্ব আয়ে রাজ্যের করুণ অবস্থার জন্য যেমন বেশ কিছু ক্ষেত্রে 'বিনামূল্যে' নিম্নমানের সরকারি পরিষেবা দেওয়ার সংস্কৃতি দায়ী, অন্যদিকে রাজ্য সরকার পরিচালিত ৭৩টি চালু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর বেহাল দশার অবদানও কম নয়।

পঞ্চদশ কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তার অধীনে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির অডিট রিপোর্ট সময়মতো বিধানসভায় পেশ করে না। বড় রাজ্যগুলির মধ্যে শুধু মহারাষ্ট্র বা তামিলনাড়ু নয়, ওড়িশা এবং বিহারের মতন প্রতিবেশী রাজ্যগুলিও তাদের পরিচালিত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো থেকে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় বহুগুন বেশি লভ্যাংশ পায়। পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর সম্পদ যে নয়-ছয় হচ্ছে তা বোঝাই যায় বিধানসভায় সময়মতন হিসেব না দিতে পারায়।

পশ্চিমবঙ্গে বালি, পাথর, মাটি, কয়লা ইত্যাদির মতন প্রাকৃতিক সম্পদের খনন থেকে যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা, তার সিকিভাগও সরকারি কোষাগারে ঢোকে না, মূলত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চলতে থাকা শাসকদলের বেলাগাম দুর্নীতি, লুঠপাটের কারণে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, লোহা ব্যতীত খনিজ সম্পদ উত্তোলন, ধাতু-শিল্প ইত্যাদি থেকে রাজস্ব আদায়ে দেশের ১৮টি বড় রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ১৭ নম্বরে। দুর্নীতির ফলে রাজ্য কোষাগারের যে ক্ষতি হচ্ছে তা স্পষ্ট হয় সিএজির প্রতিবেদনে। সিএজির ২০২১-এর ২ নম্বর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে রাজ্যের ২৯টি ক্ষুদ্র খনিজ ইউনিটের মধ্যে ১১টি ইউনিটের অডিট হয়। ৩৮ শতাংশ ইউনিটের অডিট করেই প্রায় ১০০ কোটি টাকার গরমিল ধরা পড়ে।

রাজ্যের নিজস্ব কর থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব এবং কর-ব্যাতীত রাজস্ব বৃদ্ধি না করতে পারলে পশ্চিমবঙ্গের কোষাগারের পরিস্থিতির উন্নতিসাধন করা দুষ্কর। হালে কমানো স্ট্যাম্প ডিউটি এবং সার্কেল রেটের হার বৃদ্ধি করে, বিলাসবহুল গাড়ির উপর কর বৃদ্ধি করে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির হাল ফিরিয়ে লাভজনক বানিয়ে, কিছু ক্ষেত্রে সরকারি পরিষেবার মান উন্নত করার বিনিময়ে মাশুলবৃদ্ধি করে এবং সর্বোপরি প্রাকৃতিক সম্পদের খননে চুরি-তোলাবাজি বন্ধ করে রাজ্যের রাজস্ব আদায় বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ আছে। রাজ্যের নিজস্ব কর এবং কর-ব্যতীত রাজস্ব আয় জিএসডিপি-র ১ শতাংশ বিন্দু করে বাড়াতে পারলেই রাজ্যের ৩৫ হাজার কোটি টাকা বাড়তি আয় বৃদ্ধি হতে পারে। সেই টাকা দিয়ে রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের বকেয়া ডিএ মিটিয়ে দেওয়া সম্ভব।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ষষ্ট বেতন কমিশনের রিপোর্ট বা রাজ্য সরকারের স্টাফ সেন্সাসের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন জনপরিসরে নেই কেন?

রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ-দুর্নীতির যে কদর্য এবং ভয়াবহ রূপ আদালতের হস্তক্ষেপে গত এক বছরে উন্মোচিত হয়েছে, সেই প্রেক্ষিতে সরকারি কর্মক্ষেত্রে শূন্যপদে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগের প্রশ্নটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়ে রাজ্য সরকারের তথ্যের কোন স্বচ্ছতা নেই। সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকারের দায়ের করা মামলায় বলা হয়েছে রাজ্য সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা ৩.১৯ লক্ষ। এই সংখ্যা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।

২০০৯ সালে প্রকাশিত পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চম বেতন কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীদের অনুমোদিত পদ ছিল ৯.৬১ লক্ষ; শূন্যপদ বাদ দিয়ে কর্মচারীদের আসল সংখ্যা ছিল ৮.৫৯ লক্ষ। ২০১৪-১৫-র সরকারি স্টাফ সেন্সাস অনুযায়ী সরকারি দপ্তরের কর্মীসংখ্যা ছিল ৩.৩১ লক্ষ; সরকারি স্কুলে প্রাইমারি থেকে হায়ার সেকেন্ডারি মিলিয়ে স্কুলশিক্ষকের সংখ্যা ছিল ৪.১৪ লক্ষ। অর্থাৎ ২০১৫ সালে সরকারি স্কুলশিক্ষক জুড়ে কর্মচারীদের সংখ্যা ছিল ৭.৪৫ লক্ষ।

২০২৩-এ এসে রাজ্য সরকার যে ৩.১৯ লক্ষ সরকারি কর্মচারীর হিসেব দিচ্ছে, সেটা শূন্যপদ জুড়ে না বাদ দিয়ে সেটাই বোঝা দায়। ৩.১৯ লক্ষের মোট সংখ্যায় স্কুলশিক্ষকদের ধরা আছে নাকি রাজ্য সরকার ডিএ-র হিসেব স্কুলশিক্ষকদের বাদ রেখেই কষছে, সেটাও পরিষ্কার নয়।

২০১৫ সালের স্টাফ সেন্সাস অনুযায়ী সরকারি কর্মীদের মধ্যে তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং ওবিসি কর্মীসংখ্যা ছিল মাত্র ২৭%, অথচ এই সমস্ত অংশের জন্য সরকারিভাবে সংরক্ষিত আসন মোট ৪৫%। ২০২৩ সালে এসে রাজ্য সরকারি ক্ষেত্রে তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে কি? সাচার কমিটির রিপোর্টে বর্ণিত পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বের করুণ চিত্রের কোন পরিবর্তন এসেছে কি?

বাবাসাহেব আম্বেদকরের মূর্তির পাদদেশে বসে ধর্না দেওয়ার সময় রাজ্যে সরকারি কর্মীপদে সামাজিকভাবে দুর্বল অংশের জন্য আসন সংরক্ষণ সুনিশ্চিত হচ্ছে কিনা, এই বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট করতে পারলে ভালো হতো। সরকারি কর্মীর মোট সংখ্যা, শূন্যপদ, নিয়োগ এবং সংরক্ষণ সংক্রান্ত তথ্যের ব্যাপারে সরকারের স্বচ্ছতার অভাব স্পষ্ট। রাজ্য সরকারের উচিৎ ষষ্ঠ বেতন কমিশনের রিপোর্ট এবং সরকারি স্টাফ সেন্সাসের রিপোর্ট যথাশীঘ্র জনসমক্ষে নিয়ে আসা।

আজকের মহার্ঘ বাজারে সরকারি কর্মচারীদের নগণ্য ভাতা (ডিএ) দিয়ে যে বঞ্চনা চলছে তার অবসান ঘটানো প্রয়োজন।