আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২৩ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪৩০

সমসাময়িক

নতুন বছরে নতুন আশঙ্কা


নতুন বঙ্গাব্দ ১৪৩০-কে স্বাগত জানানোর মুহূর্তে এক নতুন আতঙ্কর আবহ তৈরির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। ভারত সরকারের সাম্প্রতিক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে যে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত তথ্য-সংবাদের সততা যাচাইয়ের জন্য সরকারি স্তরে একটি সংস্থা (ফ্যাক্ট চেক ইউনিট) গড়ে তোলা হবে। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত সকলেই এই খবরে আশঙ্কাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁদের পর্যবেক্ষণ - এই সিদ্ধান্ত সংবিধানের চতুর্থ স্তম্ভ বলে স্বীকৃত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় সরাসরি হস্তক্ষেপ। ৬ এপ্রিল, ২০২৩ এই বিষয়ে জারি করা সরকারি বিজ্ঞপ্তির বিরুদ্ধে দেশের এডিটর্স গিল্ড, ইন্ডিয়ান নিউজপেপার সোসাইটি প্রমুখ প্রতিবাদ জানিয়েছে। সরকারের উদ্যোগ প্রত্যাহারের দাবিও জানানো হয়েছে। তাঁদের মতে এ এক অলিখিত সেন্সরশিপ।

কেন্দ্রীয় ইলেকট্রনিকস ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, একটি ফ্যাক্ট চেক ইউনিট তৈরি করবে সরকার। ইলেকট্রনিক্স এবং আইটি মন্ত্রক প্রস্তাবটি রূপায়ণের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি বিধি ২০২১-এ সংশোধনীর বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। এই সংশোধনীটি মন্ত্রককে একটি ফ্যাক্ট চেক ইউনিট স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে যা কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সম্পর্কিত অনলাইন তথ্য সঠিক কিনা তা যাচাই করবে। ওই সংশোধনী অনুযায়ী, দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা (এক্ষেত্রে, ফ্যাক্ট চেক ইউনিট) যদি কোনও তথ্য/সংবাদকে (কনটেন্ট) 'ভুয়ো' বলে চিহ্নিত করে দেয়, তাহলে টুইটার, ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাকে নিশ্চিত করতে হবে যে তাদের প্ল্যাটফর্মে সেই তথ্য যেন কেউ পোস্ট না করেন। সরকারের বক্তব্য, ইন্টারনেটের যুগে ভুয়ো খবর এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, তাতে লাগাম টানতেই এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইলেকট্রনিক্স ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রীর মতে যে সমস্ত সংবাদমাধ্যম বিভ্রান্তিকর খবর প্রচার করতে চাইবে, তাদের আইনের সম্মুখীন হতে হবে।

তিনি আরও বলেছেন যে ভুয়ো খবর বাছাই করার পর সেগুলি মেনে চলার বা অবজ্ঞা করার সুযোগ থাকবে সোশ্যাল মিডিয়া মধ্যস্থতাকারীগুলির কাছে। যদি সেই বিষয়টি অবজ্ঞা করা হয়, তাহলে যে কোনও সোশ্যাল মিডিয়া মধ্যস্থতাকারীর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করতে পারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক। ইলেকট্রনিক্স এবং তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছেন যে সরকার গঠিত ফ্যাক্ট চেক ইউনিট উদ্বেগের সমাধান করার জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে কাজ করবে।

সমালোচনা এবং উদ্বেগের বাধা সত্ত্বেও, কেন্দ্র এই নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা ফ্যাক্ট চেক ইউনিটকে অনুমতি দেবে যে এটি ফেসবুক এবং টুইটারের মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলিতে সরকার সম্পর্কিত বিষয়বস্তুকে 'ভুয়ো' বা 'বিভ্রান্তিকর' হিসাবে দাগিয়ে দেওয়ার অনুমতি দেবে। অনলাইন মধ্যস্থতাকারীরা তাদের ‘নিরাপদ আশ্রয়’ ধরে রাখতে চাইলে ফ্যাক্ট চেকিং ইউনিট দ্বারা চিহ্নিত বিষয়বস্তু সরিয়ে নিতে হবে।

একই আইনে বিভিন্ন ধারায় সরকারের গতিপথ পরিবর্তন নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। এই বছরের শুরুর দিকে, ইলেকট্রনিক্স ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক তিনটি কমিটি গঠন করে যারা সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানির ব্যবহারকারীদের দ্বারা দায়ের করা আপিল শুনবে, যদি তারা মনে করে যে তাদের অভিযোগ কোম্পানির কর্মকর্তারা সন্তোষজনকভাবে বিবেচনা করেনি। ধারণা ছিল, প্ল্যাটফর্মগুলির দ্বারা গৃহীত বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্তগুলিকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য প্রত্যেকেরই আদালতে যাওয়ার বিকল্প নাও থাকতে পারে, এবং তাই এমন একটি ফোরাম থাকা দরকার যা ব্যবহারকারীদের জন্য একটি অতিরিক্ত উপায় সরবরাহ করতে পারে। কিন্তু নতুন নিয়ম এ বিষয়ে স্বচ্ছ নির্দেশ দিতে পারেনি। যদি একটি চ্যালেঞ্জ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলির জন্য উপলব্ধ একমাত্র অবলম্বন হয়, তবে এই সংশোধনীর সামগ্রিক ফলাফল হল যে এটি সরকারকে বিষয়বস্তু সরিয়ে নেওয়ার জন্য একটি শর্টকাট দিয়েছে, যখন সম্ভাব্য বিবাদী পক্ষগুলির উপর বোঝা বাড়ানো হচ্ছে।

নতুন নিয়মের বিষয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল সরকার একই সঙ্গে - অভিযোগকারী, বিচারক, জুরি এবং শাস্তি প্রয়োগকারীর ভূমিকা পালন করতে চলেছে। সরকারের যুক্তি হল যে যেহেতু নিয়মগুলি কেন্দ্রের 'সিদ্ধান্ত' সম্পর্কে ভুল তথ্যের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে, তাই তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়বস্তুর উপর অভিযোগ নেওয়ার জন্য এটিই সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা। কারণ তথ্যপ্রযুক্তির মামলা প্রমাণ করার জন্য শুধুমাত্র মন্ত্রকের কাছেই সঠিক তথ্য রয়েছে।

সমালোচকরা প্রস্তাবিত আইনের একটি সম্ভাব্য দ্বন্দ্বের দিকে ইঙ্গিত করেছেন যেটি হতে পারে যখন সরকার-নিযুক্ত সংস্থা সরাসরি সরকারের সাথে সম্পর্কিত তথ্যের চূড়ান্ত বক্তব্য প্রকাশ করে। কাজেই সংস্থাটির স্বাধীনতা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়।

তথ্য যাচাই ব্যবস্থা বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার জন্য তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ন্ত্রককে অবশ্যই স্বাধীন হতে হবে। নিয়ন্ত্রক অর্থাৎ ফ্যাক্ট চেক ইউনিটের তথ্য যাচাই করার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা (প্রযুক্তিগত, সাংবাদিকতা ইত্যাদি) এবং এই বিষয়ে একটি উজ্জ্বল অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকা উচিত নয়। ফ্যাক্ট চেক ইউনিটের সদস্য হিসেবে যাঁদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে তাঁরা সরকারের প্রশিক্ষিত ও প্রবীণ আমলা। তথ্যপ্রযুক্তি এবং তথ্য/সংবাদ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির ফ্যাক্ট চেক ইউনিটে ঠাঁই হয়নি।

জরুরি অবস্থার সময় বিভিন্ন রাজ্যে ও কেন্দ্রে গঠিত হয়েছিল সেন্সর বোর্ড। প্রশিক্ষিত ও প্রবীণ আমলাকে নিয়ে গঠিত সেন্সর বোর্ড একইসঙ্গে অভিযোগকারী হিসেবে অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে সংবাদ প্রকাশের অনুমতি দিত অথবা বাতিল করে দিত। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক বা সংবাদসংস্থাকে শাস্তির ব্যবস্থা করত। প্রস্তাবিত 'ফ্যাক্ট চেক ইউনিট' অলিখিতভাবে সেই দায়িত্ব পালনের জন্য গঠিত হয়েছে বলেই সন্দেহ প্রকাশ করলে আপত্তির কারণ আছে কি? অবিলম্বে এই ভয়াবহ প্রস্তাব প্রত্যাহার না করলে আগামীদিনে ফেসবুক/টুইটার জাতীয় সংবাদমাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অন্তর্হিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে।