আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২৩ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

রামনবমীর রাজনীতি


পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির রাজনৈতিক উত্থানের সঙ্গে একটি প্রবণতা দেখা দিয়েছে যা এই রাজ্যে বিজেপির উত্থানের আগে কখনও দেখা দেয়নি। প্রবণতাটি হল রামনবমীকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও দাঙ্গা। এই বছরের রামনবমী এই ধারার ব্যতিক্রম হল না। রামনবমীর মিছিল, হনুমান জয়ন্তীর মিছিলকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, দাঙ্গা, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটল হাওড়ার শিবপুর এবং হুগলী জেলার রিষড়ায়।

রামনবমী হিন্দুদের উৎসব ঠিকই। কিন্তু এই উৎসব পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে কখনই খুব বড় আকারে পালন করা হয়নি। বিজেপির নেতা এবং কর্মীরা উত্তর ভারতের আদলে এই উৎসবটিকে রাজ্যে তাদের দলীয় কর্মসূচীর মতন পালন করতে শুরু করল। তাতেও কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। কোনো ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠী যদি মনে করেন যে তারা রামনবমী পালন করবেন তাতে বাধা দেওয়া যায় না। কিন্তু বিজেপি তথা আরএসএস-এর নেতারা শুধুমাত্র রামনবমীর শোভাযাত্রা করবেন, এইটুকুতে তারা শান্তি পেলেন না। তাদের দাবি যে তারা রামনবমীর দিন অস্ত্র হাতে মিছিল করবেন। দিলীপ ঘোষের মতন বিজেপির নেতাদের দেখা গিয়েছে অস্ত্র হাতে রামনবমীর মিছিলে অংশগ্রহণ করতে। মিডিয়া যখন জিজ্ঞাসা করেছে অস্ত্র নিয়ে কেন মিছিল হচ্ছে, তাতে বলা হয়েছে রামের হাতেও তো অস্ত্র রয়েছে! অর্থাৎ বিজেপি-র নেতা-কর্মীরা মনে করছেন তারা নিজেরাই রামের অবতার হয়ে গিয়েছেন অতএব রামের হাতে অস্ত্র থাকলে তাদের হাতেও থাকবে।

দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে খবর এসেছে, ছবি এসেছে যে রামনবমীর মিছিল অত্যন্ত হিংস্র এবং কদর্যভাবে মসজিদের সামনে গিয়ে হল্লা করছে, গালিগালাজ করছে। রামনবমীর মিছিল কেন মসজিদের সামনে যাবে? কেন রামনবমীর ‘উৎসব’-এ আগত ব্যক্তিরা অন্য ধর্মের প্রার্থনাস্থলের সামনে গিয়ে অভব্য আচরণ করবেন? কেন হাওড়ার রামনবমীর মিছিলে জনৈক যুবকের হাতে রিভলভর থাকবে্? কেন অন্যান্য জায়গায় বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে মিছিল হবে? কেন পুলিশ এই ধরনের বিপজ্জনক মিছিলের অনুমতি দেবে? কেন দোষীদের গ্রেপ্তার করা হবে না?

উপরোক্ত প্রশ্নের তালিকা আরো দীর্ঘায়িত করার প্রয়োজন নেই। আসলে রামনবমীকে কেন্দ্র আরএসএস তথা বিজেপি ধর্মীয় উৎসব নয়, তাদের শক্তিপ্রদর্শনের কর্মসূচী হিসেবে পালন করার চেষ্টা করছে রাজ্যে তথা গোটা দেশে। আমাদের রাজ্যে সমস্ত ধর্মের মানুষ তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান সানন্দে বিনা বাধায় পালন করেন। কখনও তাকে কেন্দ্র করে প্রত্যেক বছর গন্ডগোলের কথা শোনা যায়নি। কিন্তু রামনবমীকে কেন্দ্র করে প্রায় প্রতি বছর কোথাও না কোথাও গন্ডগোল হয়েছে। এর কারণ খুব স্পষ্ট। রামনবমীকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করা আরএসএস-বিজেপির প্রধান লক্ষ্য। তাই গন্ডোগোল হয়েছে।

কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে বিজেপি লাগাতার এই কথাই বলে আসার চেষ্টা করছে তাদের নীতি এবং রাজনীতির মাধ্যমে যে দেশটা আসলে হিন্দু রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছে। তাই হিন্দুদের নাম নিয়ে দেশে যা কিছুই করা হোক না কেন, তা অন্যায় হতে পারে না। তবু, রাম পশ্চিমবঙ্গে উত্তর ভারতের মতন জনপ্রিয় দেবতা নন। কিন্তু বিজেপি-র রাজনীতির কেন্দ্রে রয়েছে রাম। অতএব পশ্চিমবঙ্গে রামকে জনপ্রিয় দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাই বিজেপির একটি লক্ষ্য। রামনবমীকে কেন্দ্র করে বিজেপির নেতা-কর্মীদের উৎসাহ এবং অস্ত্র হাতে রামনবমীর মিছিলে অংশগ্রহণ এই প্রক্রিয়ারই একটি অঙ্গ।

তবু, একটা মুশকিল থেকেই যায়। রামকে দেবতা মানতে সাধারণ বাঙালির খুব আপত্তি অথবা সমর্থন কোনোটাই নেই। তাহলে শুধুমাত্র বিজেপি চাইছে বলেই তো আর বাঙালি হিন্দু রামকে উত্তর ভারতের মানুষের মতন পুজো করতে শুরু করবে না। তাই শুধুমাত্র ‘জয় শ্রীরাম’ অথবা ‘রাম রাম’ বলে রামের কীর্তন করা যথেষ্ট নয়। সাম্প্রদায়িকতার মোড়কে রামনবমীকে দেখাতে পারলে, তবেই বিজেপির কর্মী-সমর্থকরা উদ্দীপনা পাবে এই ‘উৎসবে’ অংশগ্রহণ করতে। তাই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-র উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে রামনবমীর মিছিল এবং তাকে ঘিরে গন্ডোগোল উভয়ই ক্রমবর্ধমান।

পৃথিবীর ইতিহাস শিক্ষা দেয় যে ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি মেশালে তার ফল ভয়ঙ্কর হয়। আমাদের দেশে বিজেপি ধর্মের নামে রাজনীতি করে। একটি ধর্মের মানুষকে অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলে ভোটে ফায়দা পাওয়ার জন্য। এই ভয়াবহ রাজনীতির একটি রূপ রামনবমীকে ঘিরে রাজ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা।

পশ্চিমবঙ্গের সরকার তথা শাসক দলের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার কোনো ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি নেই। কখনও তৃণমূল রামনবমীর পালটা হিসেবে হনুমান জয়ন্তী পালন করে, কখনও মাননীয়া দুর্গা পুজোর সময় উদ্বোধনে ব্যস্ত আবার কখনও ইদের নামাজের সময় তিনি হিজাব পরে সেখানে হাজির। এহেন সুবিধাবাদী রাজনৈতিক অবস্থান মানুষের কাছে ধর্ম ও রাজনীতিকে পৃথক রাখার বার্তা দিচ্ছে না, বরং ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলার রাজনীতিকেই শক্তিশালী করছে। তদুপরি, রামনবমীর মিছিলের অনুমতি প্রদান, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সময় পুলিশের ভূমিকা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে প্রশ্ন রয়েছে। তৃণমূলের ভুল রাজনীতির সুযোগ নিয়ে বিজেপি এই ধরনের কর্মসূচীকে বাস্তবায়িত করার সুযোগ পাচ্ছে।