আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২৩ ● ১৬-৩০ চৈত্র, ১৪২৯
প্রবন্ধ
ব্যক্তিগত কয়েক টুকরো
অমিয় দেব
১) যখন যতীন দাশ রোডের ছাতের ফ্ল্যাটে ছিলাম, তখন খবরকাগজ আসত উৎক্ষিপ্ত হয়ে। না, যে বিলি করত সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে তা দরজার সামনে রেখে যেত না - গোল পাকিয়ে ছুঁড়ে দিত নীচ থেকে। প্রশস্ত ছাত, এ-প্রান্তে বা ও-প্রান্তে রোজই পাওয়া যেত দড়িবাঁধা খবর। ভরা গ্রীষ্মে কখনো ছাতে শুলে ভয় হতো ঢিলের মতো না খবর এসে গায়ে পড়ে (বৃষ্টিতে অবশ্য একতলার ডাকবাক্সে রেখে যেত)। এক ভিনদেশী বন্ধু একরাত ওই ফ্ল্যাটে কাটিয়ে অবাক! এ-শহরে তাহলে খবর পৌঁছয় নিক্ষিপ্ত হয়ে! সম্প্রতি বেশ কিছুদিন লক্ষ করছি, টিভিতে খবরবলিয়ে কেউ কেউ খবর ছুঁড়ে মারেন। যেন তা ক্রিকেট-বল, আমাদের স্ট্যাম্প আউট না করলে চলছে না। আর তা খবরবিশেষে নয়, প্রায় সব খবরের বেলাই।
২) হঠাৎ শিশিরকুমার ঘোষের কথা মনে পড়ে গেল। শান্তিনিকেতনে ইংরেজির অধ্যাপক। অমায়িক মানুষ। রতনপল্লীতে যখনই তাঁর বাড়ি গেছি, একটা কিছু হাতে তুলে দিয়েছেন - টফি বা ছবিওলা কার্ড। স্মিতভাষী। আদৌ উচ্চৈঃস্বর নয়। ঢের লিখেছেন - ইংরেজিতে। বইয়ের পর বই মাঝে মাঝে 'স্টেটসম্যান' পত্রিকায়ও। আবার, বলেছেনও ভারতের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবং এতটাই হৃদ্যতা অর্জন করেছেন যে বহির্বঙ্গে তিনি প্রায় সকলেরই ‘শিশিরদা’। মস্কো তাঁকে টানেনি, টেনেছিল পন্ডিচেরি। বস্তুত, তাঁর ছিল দুই বাসস্থান, যেমন শান্তিনিকেতন (রতনপল্লীর পরে বোধকরি ‘অরবিন্দ নিলয়’) তেমনি শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমও। দেহান্ত সেই আশ্রমে। অরবিন্দ-রবীন্দ্রের যুগ্মতাই কি ছিল না তাঁর ভাবজগৎ? আর, যে-মরমীয়াবাদের তিনি ব্যখ্যাতা তাতে কি হাক্সলিও তাঁকে ঘুরপথে কিঞ্চিৎ টানেননি?
৩) রাজা চট্টোপাধ্যায়ই বোধহয় তাকে নিয়ে এসেছিল। যতীন দাশ রোডে। নাম রথীন শিকদার। বোহিমীয়। আঁকে। খানিক গানপাগলও। দীপালি নাগের ভক্ত। অনেক কথা ছিল তার ঝুলিতে। প্রায় রোজই আসছে। আর যতীন দাশ রোডের খোলামেলা ধরনে সে খাপ খেয়েও গিয়েছিল। ইন্দ্রজিৎ তখন ছবি আঁকছে। সেই রং-তুলি চেয়ে নিয়ে একদিন হঠাৎ ফ্রিজের দরজায় এক ছবি ফেঁদে বসল রথীন। পুরোনো ফ্রিজ, মলিন হয়ে এলেও শক্তপোক্ত, তুলির আঁচড় কি সইতে পারবে না? তাছাড়া কোনো আবোল তাবোল নয়, একটা আকৃতি ফুটে উঠল ধীরে ধীরে। তার সংজ্ঞা দেওয়া সহজ নয়, তবে অঙ্গে কেমন এক উড়াল আছে। ফ্রিজের গায়ে এই ছাপ রাখার কিছুদিন পর আর পাত্তা নেই রথীনের। শোনা গেল নেশায় মজেছে।
8) পয়লা ফেব্রুয়ারি হঠাৎ দাউদের টেলিফোন। দাউদ হায়দার। ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ'-এর কবি দাউদ হায়দার। আমার ছাত্র ছিল একদা। আমি যখন এনসেফেলাইটিস-এ একবার মরণাপন্ন, তখন বাড়ির লোক হিসেবে (মৌ-কণিকা-ইন্দ্রজিতের) কণিকার সঙ্গে আমার যে-চার ছাত্র পিজি-তে রাত জাগত, তাদের মধ্যে দাউদ ছিল (অন্যেরা রঞ্জিত, প্রশান্ত ও বিশ্বনাথ)। কতদিন হয়ে গেল সে তার মাতৃভূমি থেকে ‘নির্বাসিত’। অথচ এখন খ্যাতির শীর্ষে। সেই যে গ্যুন্টার গ্রাস্-এর সহমর্মিতায় জর্মানি পাড়ি দিল, সেখানেই আছে। ঠিকানা বার্লিন। পৃথিবীর কত জায়গায় আহূত হয়ে যাচ্ছে, কবিতা পড়ছে, কত ভাষার কত কবি-লেখকের সে সুহৃদ্, কিন্তু তার নিজের দেশের দ্বার তার কাছে রুদ্ধ।
ফোন শুনে ভাবলাম বার্লিন থেকে করছে, যেমন হঠাৎ হঠাৎ করে। না, এ তো কলকাতায়, আমার বাড়ির উদ্দেশ্যে ধাবমান ট্যাক্সি থেকে, কোথায় মোড় নিয়ে কীভাবে পৌঁছবে তা জিজ্ঞেস করছে। দেখা করতে আসছে। সত্যি, কতকাল দেখিনি দাউদকে! ২০১২-তে যখন ওর বন্ধুরা ওকে নিয়ে ‘নির্বাসিত' বইটা বার করে, হাজির ছিলাম সেই গ্রন্থপ্রকাশে। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তও ছিলেন সেখানে, জার্মানিতে তার অনতিদূর প্রতিবেশী - কবিতা লিখেছেন তাকে নিয়ে। আবার, বছরখানেক আগে তার কলকাতার প্রকাশক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন - অনুরোধ যদি দাউদের আশু প্রকাশিতব্য প্রেমের কবিতা সংকলন নিয়ে দু-তিন ছত্র মন্তব্য করি। দাউদই নাকি তাঁকে আমার নাম দিয়েছে।
এলো দাউদ। উবের দাঁড় করিয়ে রেখে উপরে উঠে এলো। সঙ্গে তার ছোটো ভাই জাহিদ হায়দার। সেও কবি (মনে পড়ল যখন 'রবীন্দ্রনাথ ১৫০'-এ সুরের ধারার উৎসবে [আরও অনেকের সঙ্গে] ঢাকা গিয়েছিলাম, তখন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমার পাশে পেয়েছিলাম তার বড়ো ভাই জিয়া হায়দারকে। কবি ও নাট্যকার)। দেখলাম চুল পেকেছে দাউদের। পাকবে না? বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি জন্মে মাতৃভাষাকে ভালোবেসে কি কম দিন কাটল এই আন্তর্জাতিক বাংলাদেশীর? তাঁর নতুন বই হাতে তুলে দিল, সেই ‘প্রেমের কবিতা’, তবে ছাপা ঢাকার ‘অনার্য’ থেকে, প্রচ্ছদ এঁকেছেন তার বন্ধু শাহাবুদ্দিন আহমেদ। সঙ্গে কলকাতার ‘এম. সি. সরকার’ প্রকাশিত আরও দুটো পুরোনো বই, ‘নাম দিয়েছি কুসুমমঞ্জরী’ (১৯৯৮) ও ‘নদীর উৎস ছিল এখানে’ (২০০৯)। কথা হল একটু, শুনলাম বইমেলা যাবার সময় নেই। বেজায় তাড়া। রাত্তিরেই ফিরতি প্লেন ধরবে।
৫) ‘হঠাৎ’-এর ফেরে পড়ে গেছি কি এই ফেব্রুয়ারিতে? কারণ দুই বিকেল আগে হঠাৎই মনে পড়ে গেল নীহারকে। আমার কৈশোর শেষের বন্ধু নীহার বন্দ্যোপাধ্যায়, গল্প লিখত। পাঁচ জন আমরা একটা সুতোয় বাঁধা ছিলাম, তার নাম ‘রেখা’। হাতে-লেখা পত্রিকা - একটা সংখ্যাই বোধহয় লিখে উঠেছিলাম। অন্য তিন জন শোভন সোম, বিকাশ চক্রবর্তী, রঞ্জিত দত্ত (ছবি আঁকা শিখেও শোভনের কবিতা লিখে যাওয়ার কথা অন্যত্র বলেছি, বিকাশ এখনকার নাট্যশিরোমণি বিভাস চক্রবর্তীর দাদা, দিল্লি গিয়ে থিতু হয়েছিল, এবং অমন ধীরস্থির রঞ্জিত যে কবে কোথায় হারিয়ে গেল তা আর মনে নেই)। একহারা চেহারা নীহারের, সিলেটি বুলিতে তেমন অভ্যস্ত নয়, একসময় তার ঠিকানাও বদল হল শিলং-এ। ‘রেখা’-র লেখকদের মধ্যে প্রথম কোনো নামী পত্রিকায় লেখা ছাপা হয়েছিল নীহারেরই। ‘পরিচয়’-এ গল্প। নাম 'ইমারত'। এখনো চোখে ভাসছে, একটা ডানদিকের পৃষ্ঠায় শুরু হয়েছিল। প্রথম বাক্যঃ ‘লাবান পাহাড়কে ভুলতে পারেনি কারিয়ান'। গর্ব হয়েছিল, কাউকে ডেকে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, বয়সে একটু বড়ো হলেও, এই নীহার বন্দ্যোপাধ্যায় আমার বন্ধু। নীহার পড়েছিল এঞ্জিনীয়ারিং, বোধহয় যাদবপুরেই। এঞ্জিনীয়ারও হয়েছিল বোধহয় কোথাও। আমি যখন সিটি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্স পড়ছি, তখন ওর দাদাকে সেখানে অধ্যাপনা করতে দেখি। অবশ্য আমাকে তিনি চিনতেন না। আমি যখন যাদবপুরে এম.এ. পড়ছি, এবং নবজীবন লাভ করছি, তখন একবার আমার খোঁজে যাদবপুর এসেছিল নীহার। মনে আছে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে খানিক কথা হয়েছিল। ভবিষ্যতের না বর্তমানের, তা মনে নেই। আর দেখা হয়নি।