আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২৩ ● ১৬-৩০ চৈত্র, ১৪২৯
প্রবন্ধ
নমনশীলতা ও সরলীকরণ যখন জনপ্রিয়তার কারণ
শ্রীদীপ
ডিজিটাল মেধা-বিমুখতা আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অনেকেই কাকের-পিঠে-বক বসানো প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে অবমাননা করতে পছন্দ করেন। ডিজিটাল প্রযুক্তি যেভাবে কনটেন্টকে টুকরো ক'রে সেই ক্ষুদ্রাংশগুলিকে নিয়ে খেলার অবাধ স্বাধীনতা আমজনতাকে প্রদান করেছে, গত দু-দশকে - অনেকেই, সেই নব প্রথার ঘোর বিরোধী। অবশ্য প্রযুক্তির প্রত্যাখ্যানের মধ্যে মানুষ এক অদ্ভুত মানবিক গৌরব খুঁজে পেয়েছে আধুনিকতার গোঁড়া থেকেই। প্রযুক্তিকে তাচ্ছিল্য ক'রে, তাকে কৃত্রিম ঠাওরে, যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে দার্শনিক জেহাদ ঘোষণা করেছেন বহু তাত্ত্বিক, পণ্ডিত ও কবি। ডিজিটাল-এর আগমনের পর, কাটা-ছেড়া-ক্রপ বা বিদ্যমান রূপ-রং আলো-ছায়া-বিন্যাস পাল্টাবার কেরামতি যে শিল্পকৌশলের অন্তর্গত - এটা এখনও মেনে নিতে অনেকেরই আপত্তি আছে। ডিজিটাল সম্পাদনার জনপ্রিয়তা দেখলেই সংস্কৃতির রণক্ষণশীল রক্ষকদের অপসংস্কৃতি ব'লে মনে হয়। সমস্বরে তারা গেল-গেল রব গাইতে শুরু করেন। উচ্ছন্নে যাওয়ার এই ভীতির উৎপত্তির কারণ কিন্তু কোনো ডিজিটাল-শয়তান নয়, বরং উদারমনস্কতার অভাব এবং উত্তরাধুনিকতাকে সৃজনশীল ও সক্রিয়ভাবে গ্রহণ করতে পারার ব্যর্থতা।
যে কোনো মাধ্যমেরই একটা নির্দিষ্ট চরিত্র থাকে। ডিজিটালের ক্ষেত্রে, যা স্বভাবসিদ্ধ তা হ'লো তার গতিময়তা, ওজনহীনতা, তাৎক্ষণিকতা, আদান-প্রদানের সহজসাধ্যতা এবং গুণগত মান অবক্ষয় না হওয়ার নিশ্চয়তা। নিমেষে পৃথিবীর এ প্রান্তের তথ্য, চিত্র, আবেগের বহিঃপ্রকাশ আঙুলের ছোঁয়ায়, অন্য প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। রাজনৈতিক উত্থান-পতন, প্রতিরোধ বা ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া - সবই বিস্তৃত হচ্ছে অবিলম্বে। ছবি হোক বা ভিডিও; হাজার খানেক ই-বই হোক বা কোনো গায়কের সমস্ত গান, বা কোনো নায়কের সব ছায়াছবি - ক্লাউড বা ড্রাইভ স্পেসে নিহিত এইসব ডিজিটাইজড কন্টেন্ট প্রায় ওজনশূন্য। এই মুহূর্তের সুখ-দুঃখ-চিন্তা-অভিযোগ ও তার আপডেটের প্রবাহে মুছে যাচ্ছে আগেরগুলো। ইন্টারনেট দ্বারা সংযুক্ত পৃথিবী। সবার হাতেই সম্প্রসারণ ও সম্পাদনার স্মার্ট যন্ত্র ও জোগাড়। নিজেকে বা নিজের অবদান, কীর্তি ও সাফল্যের খবর সরবরাহ করার অধিকার ও হাতিয়ার নিজের হাতেই। নির্মাতা, সম্প্রসারক, দর্শকের মধ্যে যে শক্ত বিভাজন ছিল, ডিজিটাল ঢেউ তার অবলুপ্তি ঘটিয়েছে। ডিজিটাল এও নিশ্চিত করেছে, লক্ষ্য-কোটি বার অনুকরণ হ'লেও ডিজিটাল প্রণালীতে লিপিবদ্ধ কোনো কিছুরই অবক্ষয় নেই। এই কারণগুলির জন্যই ডিজিটালের অভূতপূর্ব ব্যাপ্তি ও জনপ্রিয়তা দেখা গেছে বিশ্বময়।
এই ডিজিটাল জোয়ারের পিছনে শুধুই যে এই কারণগুলি দায়ী তা নয়। আরো দুটি স্তম্ভ আছে। প্রথমত, একটি স্বল্পকায় স্মার্ট-যন্ত্রে অনেক কিছু খুব দ্রুত কেন্দ্রীভূত হওয়ার বিরল বর্তমান। আলাদা আলাদা কাজ করার জন্য, এই ক-বছর আগেও, একগাদা যন্ত্রের প্রয়োজন হতো। আজ সেখানে মুঠোফোন একাই একশো। কে ভেবেছিলো এতো কিছু অতি অনায়াসে এসে যাবে এক হাতে বা এক পকেটে। পাঁচ রকম ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা, ঘড়ি, ডায়েরি, ক্যালেন্ডার, ক্যালকুলেটার, মানচিত্র, তথ্য, অভিধান, বৈদ্যুতিন চিঠিপত্র, স্মৃতিকোষ, ক্রীড়া, বিনোদন, আমোদ, ভ্রমণ, বুকিং, শপিং, মুদিখানা, মাসকাবারি, ভাত কাপড়ের ফরমায়েশ, টাকার লেনদেন, বিনিয়োগ, প্রণয় সম্ভাবনা, সংগীত সম্ভার, জনসংযোগ ও যোগাযোগ - ও আরো কতো কিছু একা সামলাবে একটা ছ-ইঞ্চির স্ক্রিন - এমনটা বোধহয় এ শতাব্দীর গোড়াতেও শুধুমাত্র কল্পবিজ্ঞানেই ভাবা যেত। মাত্র এক দশকের মধ্যে তা শুধু বাস্তবায়িত হলো তা নয়, মানুষ সে যন্ত্রে মুগ্ধ হয়ে তার মনোযোগের অনেকটাই দিয়ে ফেললো। নোটিফিকেশনের তাড়নায় ঘুমোনো যাচ্ছে না আবার নোটিফিকেশনের শব্দেই ঘুম ভাঙছে। সত্যিই অভাবনীয়।
আর দ্বিতীয়ত, নজিরবিহীন এক ক্ষমতা প্রদানের প্রয়াস যা আদতে সার্বজনীন - যেখানে কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণীর একচেটিয়া আধিপত্য নেই। তা আপাদমস্তক গণতান্ত্রিক। খুব সহজে, সস্তায় বা বিনামূল্যে, অবলীলায়, যে কেউ, কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই, অনেক কাজ, অ্যাপ বা সফ্টওয়্যার-এর মাধ্যমে সেরে ফেলতে পারছে। যে সব কাজের জন্য আগে প্রচুর অর্থ ও সময় ব্যয় ক'রে পেশাগত কুশলী ডাকতে হ'তো। সেই সমস্ত ধরণের কনটেন্ট-এর নির্মাণ, পরিবেশনা, প্রচার - আজ জনসাধারণের হাতের মুঠোয়। পাঠকও এখন লেখক। ফটোগ্রাফার তো সবাই। শ্রোতাও গায়ক। দর্শকও পরিচালক। ছবি তোলা থেকে শব্দ-গ্রহণ বা সম্পাদনা - এসবের সরঞ্জাম প্রায় সবার হাতে। জানান দেওয়া বা জনসংযোগ করার মঞ্চ সোশ্যাল-মিডিয়া - যা সবার ফোনে-ফোনে। সর্ববিদিত এই সাংস্কৃতিক আয়োজনে সামিল হওয়া বা অংশগ্রহন করার অধিকার সকলের।
কল, কলা আর কৌশলের এই ব্যাপক সরলীকরণের পর কোনটা মৌলিক আর কোনটা মেকি - এই বিভাজন এখন বড়ই অপ্ৰাসংগিক ও অবাঞ্ছনীয়। হাই-আর্টকে সমীহ ক'রে জনগণের তৈরী দৈনন্দিন কন্টেন্টের প্রতি অবজ্ঞা - বড়ই সেকেলে। সেটা এখন আর সাজে না, কারণ প্রবেশাধিকার পেলে মানুষ তার ব্যবহার করবেই। আত্মমগ্ন হ'য়ে নিজেকে বা নিজের প্রতিচ্ছবি ও ভাবমূর্তি নিয়ে খেলবেই। ক্যামেরাতে অজস্র ছবি তুলবে সকল মুহূর্তের। ইন্সটা-তে ইচ্ছেমতো রিল বানাবে। রান্না, নাচ, সমাগম, সঙ্গম ও উদযাপনের ভিডিও ছাড়বে অনবরত। অনুভূতি বা মতামত নিয়ে দু'দশ বাক্যের পোস্ট দেবে দিনে যতবার খুশি। সেই সহজ নির্মাণ ও সম্পাদনা ও প্রকাশনা-প্রণালী প্রয়োগ ক'রে জনগণের এই উপচে পরা প্রয়াস, সব সময় শৈল্পিক না হ'লেও - তা তাদের জীবনের, তাদের সময়ের, তাদের পছন্দের এবং তাদের প্রতিদিনের সৎ ও স্বচ্ছ প্রতিনিধিত্ব করে। আর সেখানে তুচ্ছ, অকিঞ্চিৎকর এবং মামুলীরই জয়জয়কার।
যাদের ডিজিটাল সামর্থ্য আছে, তারা কে কোন মাস্ক-টুল ব্যবহার ক'রে পটভূমি পাল্টে দেবে; কে ক্রপ-টুল দিয়ে পারিপার্শ্বিক বা পাশে দাঁড়ানো অপছন্দের মানুষটাকে ছেঁটে বাদ দেবে; কে ইরেজার-টুল দিয়ে মুখের ব্রণ বা পেটের মেদ মুছে দেবে; কে টেক্সট-টুল দিয়ে নিজের ওপর বিজ্ঞপ্তি জারি করবে; কে সিলেক্ট-টুলের সাহায্যে শূন্য আকাশে, পাখি মেঘ ধোয়া বা উড়ন্ত জিরাফ ছেড়ে দেবে; কে ক্লোন-টুল ব্যবহার ক'রে অন্যের ট্যাটু নিজের স্তনে এনে ফেলবে; কে কোন ফিল্টার চাপিয়ে ছবির কেমন মেজাজ নির্ধারণ করবে; কে নিজের গলার ওপর তারকার মুখ বসাবে; আর কে আলোর মাত্রা বাড়িয়ে ছায়া থেকে হারিয়ে যাওয়া ডিটেল বার করে আনবে - সেটা একান্তই যার যার ব্যক্তি স্বাধীনতার ব্যাপার। এবং সেটা অ্যাপ বা সফ্টওয়্যারে অভ্যস্ত মানুষের ইচ্ছে খুশি ও মৌলিক ডিজিটাল অধিকার। কোমরের বাঁক, চুলের ঘনত্ব, ত্বকের ঔজ্জ্বল্য, নাকের দৈর্ঘ্য, চোয়ালের তীক্ষ্ণতা সব কিছুই ডিজিট্যালি বদলানো যায় খেলার ছলে। আর সেটা অপরাধ নয়। আর সেই খেলাটা খেললে অস্তিত্বও তুচ্ছ হয়ে যায় না। অস্তিত্ব এতটা পলকা ও ফেলনা নয়।
মোদ্দাকথা, মানুষের হাতে নিজের প্রতিমূর্তি নিয়ে খেলার সরঞ্জাম তুলে দিলে, মানুষ খেলবেই। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতায় বুঁদ হ'য়ে থাকবে। রীতিমতো খেলায় মগ্ন হ'য়ে এমনই মেতে যাবে যে মুঠোফোন থেকে চোখ, মন, স্পর্শ - কিছুই সরবে না। সামাজিকতার ওপর তার কী প্রভাব সেটা অবশ্যই জরুরি প্রশ্ন কিন্তু এখানে সাংস্কৃতিক অভিভাবকদের চোখ রাঙানির কোনো ভূমিকা বা গুরুত্ব নেই। তাদের চাকরি অনেকদিন আগেই গেছে যবে থেকে ব্যক্তি-উৎপাদিত-কনটেন্ট-এর ধারণা বাজারে এসেছে। নিজেকে নিয়ে ডিজিট্যালি খেলার ঘোর ও তার নান্দনিক যুক্তি - নীতিপুলিশের বোধশক্তি ও সময়কালের বাইরে। এ্যাটেনশন-ইকোনমি (অর্থাৎ দৃষ্টি-আকর্ষণ-প্রবণতা) ও মাইক্রো-সেলেব্রিটি (অর্থাৎ নিজ নিজ স্বল্প পরিসরে তারকা হওয়ার বাসনা) - এই দুই ধারার নিরপেক্ষ সামাজিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রয়োজন, নীতিগত নয়।
ক্রপ বা ক্লোন নিয়ে যাদের এতো ছুৎমার্গ, তারা কি আদৌ বোঝেন যে মধ্যস্থতাবিহীন, অসম্পাদিত ছবি বলে কিছু হয় না শুধু নয়, তা কোনোদিনই হ'তো না। ডিজিট্যাল যুগের আগেও না। ফ্রেমিং-তত্ত্বের মূলেই আছে অগুনতি ও অফুরন্ত স্থান-কাল-পাত্র থেকে একটা ক্ষুদ্র খন্ড বাছাই করা - বাকি অনেক কিছুকে বাদ দিয়েই। পছন্দসই দৃষ্টিকোণের সূক্ষ্ম সন্ধান - বহু উপাদান বাদ দিয়েই। মনঃপুত না হ'লে ছিল শুধরে নেওয়ার অগুনতি ডার্ক-রুম প্রণালী, যার যোগ্য উত্তরসূরি ফটোশপ, লাইটরুম, স্ন্যাপসীড ইত্যাদি। কাজেই কেটেছেঁটে ক্ষুদ্রকে নিয়ে খেলা করার ক্রিয়া ও স্বভাব আজকের নয়। ডিজিট্যাল তার সরলীকরণ ক'রেছে মাত্র। ডিজিট্যাল দিকগজদের কবল থেকে তাকে মুক্ত ক'রে জনসাধারণের হাতে উপহার দিয়েছে, সবাই যাতে নিজের ক্ষুদ্রাংশ বা বৃহদাংশ নিয়ে এলোমেলো খেলায় সামিল হতে পারেন। যে খেলার নান্দনিক দর্শনই হলো নমনশীলতা, সম্পাদনার ও পরিবেশনার হরেক সুযোগ ও সহজ সুবিধা, ও অফুরন্ত শৈল্পিক স্বাধীনতা। আর এই মুক্ত প্রাঙ্গনে আরো আরো বেশি শব্দ-দৃশ্যময় আমাদের অভিব্যক্তি। উত্তরাধুনিক সামাজিকতায় শব্দ-দৃশ্যের অনবরত যোগান ও আদানপ্রদান অব্যাহত থাকবে।