আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২৩ ● ১৬-৩০ চৈত্র, ১৪২৯

প্রবন্ধ

যদি না পড়ে ধরা

মালবী গুপ্ত


আবহমানকাল ধরেই আমাদের জীবনযাপনের সঙ্গে ‘চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা, যদি না পড়ে ধরা’, এই প্রাচীন প্রবাদটি যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ প্রকৃতিতে যেমন অনেক প্রজাতি এর ওর খাবার চুরি করেই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। মানব সমাজেও ওই টিকে থাকার লড়াইয়ে চুরি ডাকাতি আদিমতম পেশা সন্দেহ নেই। তবে আগের মতো শুধু খাদ্য শস্য ও ধন-সম্পদই চুরি যায় না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চুরির করণ কৌশল বদলেছে, বিষয়বস্তুও বদলেছে। পুরাতাত্বিক বা অ্যান্টিক জিনিস থেকে ছবি চুরি, বিগ্রহ চুরি (দেবতারাও ছাড় পান না), বই চুরি থেকে গবেষণাপত্র চুরি, ডিগ্রি চুরি এমনকি দেখছি এখন চাকরিও চুরি হয়ে যাচ্ছে। মোটকথা এই চৌর্যবৃত্তির নিরবচ্ছিন্ন বহমান ধারায় কখনো কোনো ছেদ পড়েনি।

তবে আমি কোনো ছিঁচকে বা নিরীহ চোরেদের কথা বলছি না, জীবনধারণের জন্য যাদের ওই বিদ্যার কাছে নিয়ত হাত পাততে হয়। বলছি দেশে দেশে সেই চোরেদের কথা, যারা আকাশছোঁয়া লোভের পিঠে সওয়ার হয়ে, চুরির নেশায় মেতে ওঠে। মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে বিপুল সম্পদ ও সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। ক্ষমতার ছড়ি হাতে সমাজের বুকে দাপিয়ে বেড়ায় এবং পদে পদে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে কীভাবে তাকে নিঙড়ে দুর্বল করে তোলে, ইতিহাসে তার অসংখ্য সাক্ষ্য ছড়িয়ে আছে।

সে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট মহম্মদ সুহার্তো, ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মারকোস হোক, কিম্বা কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট মবুতু বা মালায়েশিয়ার নাজিব রাজাক-ই হোক। অথবা, আফ্রিকার রবার্ট মুগাবে, যিনি আবার দেশের প্রধান মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বীরের সম্মানও পেয়েছিলেন, বা সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট স্লোবোদান মিলোসভিচ। এঁদের মতো বিশ্বের বহু রাষ্ট্রনেতাই চৌর্যবৃত্তি ও নানা ধরনের দুর্নীতির সাহায্যে কয়েক দশক ধরে বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়ে উঠেছিলেন। যাঁরা সরকারি কোষাগারকে শুধু নিজের কোষাগারই মনে করেননি। নানান ক্ষেত্র থেকে নানাভাবে অর্থ আত্মস্যাৎ করেন এবং সাধারণ মানুষেরও পকেট কাটতে কাটতে চুরির কাজে তারা হয়তো এতোটাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন যে, কখনো না কখনো কারো না কারো হাতে তাঁরাও যে ধরা পড়তে পারেন, সেই সম্ভাবনাটিকে একেবারে বিস্মৃত হয়েছিলেন। তাই ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও ওই যদি না পড়ে ধরা’র ‘মহাবিদ্যা’ শেষাবধি তাঁদেরও বাঁচাতে পারেনি।

হ্যাঁ সত্য যে, এই বিদ্যার এমনই মাহাত্ম্য যে একবার এই বিদ্যার করণকৌশল আয়ত্ব করতে পারলে, এমনকি একদা ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে থাকা ব্যক্তিও ৪/৫ কিম্বা ৭/৮ বছরে বিপুল সম্পদ ও বিশাল সাম্রাজ্যের মালিক হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে সেই চুরির উষ্ণ মৌতাতে চোরেরা যতই নিমগ্ন থাকার সুযোগ পেয়ে যাক, মানুষের দুর্দশার ওপর গড়ে তোলা সেই সাম্রাজ্যেরও যে পতন এক দিন অনিবার্য হয়ে ওঠে। সারা বিশ্বে সেই নজিরেরও কোনো অভাব নেই।

চোর ও চরম দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র প্রধানদের ক্ষেত্রে কখনো নিজের দল, কখনো বিরোধী দল, কখনো বা গণঅভ্যুত্থান তাদের মসনদ থেকে টেনে নামায়। ছুঁড়ে ফেলে দেয় জেলের অন্ধকারে। নচেৎ তাঁদের দেশ ছেড়ে কখনো পালাতে হয়। ঠিক যেমন ওপরে উল্লেখিত রাষ্টপ্রধানদের ক্ষেত্রে হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশেও বেশ কিছু রাষ্ট্রপ্রধানের চুরির ঝাঁপি হাজার হাজার কোটি টাকার অঙ্ক ছাড়িয়ে গেছে। ভারতে অন্তত রাষ্ট্র প্রধানদের বিরুদ্ধে সরাসরি এখনও তেমন অভিযোগ ওঠেনি।

তবে দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সহ অন্যান্য মন্ত্রী, নেতাদের বিরুদ্ধে বিপুল সম্পদ চুরি বা জোর করে আত্মস্যাতের অভিযোগ ইতিমধ্যেই উঠছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ডটকম ও দ্য প্রিন্ট ডটইন, ডেইলিহান্ট ডটইন’র প্রতিবেদন অনুযায়ী কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির (চুরি) অভিযোগে লালুপ্রসাদ যাদব, জয়ললিতা, এ. রাজা, বি. এস. ইয়েদুরাপ্পা থেকে মায়াবতী, বাঙ্গারু লক্ষ্মণ, শিবরাজ সিং চৌহ্বান, বেলারির রেড্ডি ব্রাদার্স, জগন মোহন রেড্ডি, মধু কোড়া, শরদ পাওয়ার, সুরেশ কালমাদি’র মতো অসংখ্য ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে। যাঁদের কেউ কেউ অভিযোগে, কেউ আবার অভিযুক্ত হয়ে হাজতবাস করেছেন।

আর পশ্চিমবঙ্গের দিকে দৃষ্টি ফেরালে দেখতে পাচ্ছি গত এক বছর ধরে শুধুমাত্র শিক্ষা দফতরেই মন্ত্রী থেকে আমলা এবং শাসকদলের বড় মাঝারি ছোট নেতাদের যে পাহাড় প্রমাণ চুরির ভুরি ভুরি প্রমাণ মিলছে এবং গণমাধ্যমে এক নাগাড়ে তার যে ধারাবিবরণী চলেছে, তাতে রাজ্যবাসীর চক্ষু একেবারে চড়কগাছ। আসলে যতই ওই ‘না পড়ে ধরা’র ‘মহাবিদ্যাতে’ চোর দক্ষ হয়ে উঠুক না কেন, সে যতই আত্মবিশ্বাসী হোক না কেন এবং যতই ক্ষমতার শীর্ষে বসে থাকুক না কেন - সর্বত্রই দেখা গেছে কখনো না কখনো তার পর্দাফাঁস হয়েই যায়। এবং তার থেকে ঘটা বিপুল ক্ষয়ক্ষতির বোঝা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের মাথায় চেপে বসে।

তাই এই পেশাটিকে মানব সমাজের পক্ষে অহিতকরই মনে করা হয় এবং সমস্ত দেশেই অন্যায় অপকর্ম বলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্যও করা হয় তাকে। আর সেই কারণেই চোর ধরা পড়লে রাষ্ট্র তথা প্রশাসনে তার যথোপযুক্ত শাস্তির বিধান সব দেশে, সব সমাজেই রয়েছে। অবশ্য পেটের দায়ে চুরি করা সেই নিতান্ত নিরীহ চোরদের নিয়ে কারো তেমন মাথাব্যথা থাকে না। পাড়া প্রতিবেশিদের হাতে ধরা পড়লে তাদের উত্তম মধ্যম মার বা কখনো দু’চার মাস শ্রীঘর বাসের সাজা মেলে।

তবে কেউ যদি ওই চৌর্যবৃত্তিরই হাত ধরে অনন্ত লোভের কাছে নতজানু হয়। কোটি কোটি মূল্যের একের পর এক সম্পত্তি গড়ে তোলার নেশায় মেতে ওঠে, তবে অসংখ্য নাগরিকের জীবন দুর্বিসহ হয়ে যায়। কত না নিরুপায় ঘটিবাটি বিক্রি করা মানুষ যে শেষ পর্যন্ত জীবনান্ত ঘটায়।পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষা ব্যবসার নির্লজ্জ কারিগররা তা আমাদের এখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন। তা না হলে পরীক্ষায় পাস না করে, সাদা খাতা জমা দিয়েও কীভাবে পরীক্ষার্থীরা ৩০/৩৫ হাজারের সরকারি চাকরি পেয়ে যায়? আর প্রার্থিত নম্বর পেয়েও চাকরি না পাওয়া চাকরি প্রার্থীদের বছরের পর বছর খোলা আকাশের নীচে অপার কষ্ট সয়ে ধর্ণায় বসে থাকতে হয়।

আসলে ক্ষমতার জাদুদন্ড কীভাবে যে দিনকে রাত, রাতকে দিন করে দিতে পারে। শুধু শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীদের পকেটে লক্ষ লক্ষ টাকার প্রণামী গুঁজে দিতে পারলে তারাই কীভাবে চাকরির তালিকাতে সিঁদ কাটতে পারে এবং ‘মানুষ গড়ার কারিগর’-এর আসনে বসিয়ে দিতে পারে সম্পূর্ণ অযোগ্য ব্যক্তিদের। যাদের হাতে কিনা দেশের বেশির ভাগ ভবিষ্যত নাগরিক, তথা আম জনতার সন্তানদের শিক্ষার ভার ন্যস্ত থাকে, তার দুখদ চিত্র প্রত্যহ গণমাধ্যমে ভেসে উঠছে।

বস্তুত রাজনৈতিক পদ বা সরকারি পদকে কাজে লাগিয়ে চুরিকে প্রায় এক শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করা হচ্ছে এবং যতক্ষণ না ওই ‘মহাবিদ্যা’র উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ঘটে চলেছে, ততক্ষণ যেন তা সমাজে এক রকম মান্যতা পেয়েই যাচ্ছে।এবং অনেকটা জেনেশুনেই সেই সমাজের নানা স্তরের মানুষও এমনকি তথাকথিত সেলিব্রিটিরাও (যাঁরা আবার অনেকেই না জানার ভান করেন), সেই মহাবিদ্যার প্রসাদলাভের আশায় একের পর এক কীভাবে লাইনে গিয়ে দাঁড়ান। ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত চুঁইয়ে পড়া সেই ক্ষমতার এক একটি ইউনিট হয়ে উঠতে পারে কতটা দূরপ্রসারী। যার কীটদুষ্ট শিকড় সমাজে কীভাবে ঘুন ধরিয়ে দিতে পারে, আমরা রাজ্যবাসী এখন তা অহরহ প্রত্যক্ষ করছি।

কারণ এই চুরি বিদ্যায় শুধু যে ধন-লাভ হয় তাই নয়। যশ- পদ, ক্ষমতা আর অনিঃশেষ ভোগ - এক কথায় যাবতীয় জাগতিক প্রাপ্তির ইশারা যা কিছুতে থাকে, তার সবেরই যে নাগাল পাওয়া যায় ওই চুরি বিদ্যায় পাকানো হাতে, সংবাদমাধ্যম প্রতিনিয়ত তার নানাবিধ তালিকা আমাদের দৃষ্টিগোচরে আনছে। তবে সবই ঘটছে অবশ্য আদালতের নির্দেশ মেনে। কারণ শেষ আশ্রয় হিসেবে অসহায় মানুষ তো বিচারের আশায় এক সময় আদালতের দুয়ারে গিয়েই দাঁড়ায়। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই বিচার ব্যবস্থা তাকে নিরাশ করে না। রাজ্যে এই চাকরি চুরির ক্ষেত্রেও বর্তমানে তেমনটাই ঘটছে।

সত্য যে, আমাদের রাজ্যে চুরির অভিযোগে মন্ত্রী, আামলা থেকে শাসকদলের নেতারা এখন একের পর এক লাইন দিয়ে যেভাবে হাজতে ঢুকছে, তেমন অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা আগে কখনও ঘটেনি। পশ্চিমবঙ্গবাসী এখন প্রতিদিনই সেই কুনাট্য দেখে চলেছে। রাজ্যে শুধু শিক্ষা দফতরেরই এখন পর্যন্ত প্রকাশিত চুরির পরিমাণকে অনেকেই হিমশৈলের চুড়ার সঙ্গে তুলনা করছেন। কারণ শিক্ষার দড়িতে টান পড়তেই তার দু’একটি তরঙ্গের অভিঘাত যে পুরসভাগুলির চৌকাঠে গিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে, তাতেই তার অন্দর থেকে চুরির আঁশটে গন্ধ যেন ভেসে আসছে। তাকে বুঝি আর শাক দিয়ে ঢাকা যাবে না। তার ওপর এখনো পর্যন্ত স্বাস্থ্য, খাদ্য, রাস্তা, সেচ, বিল্ডিং, নির্মাণ ইত্যাদির মতো দফতরের তো তালাই খোলা হয়নি। সেখানেও যে হিমালয় সদৃশ লুকোনো কোন মধুভান্ড, থুড়ি চুরির অর্থ-পাহাড়ের চিত্র কখন ক্যানভাসে ফুটে উঠবে, তা বোধহয় স্বয়ং দেবতাদেরও অজানা।

দেবতাদের কথা থাক। আমরা রাজ্যবাসীরা অন্তত এই আশায় এখন বুক বাঁধি যে, বর্তমান শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীরা যতই গত জমানার দুর্নীতি খুঁড়ে বার করার চেষ্টা করুন না কেন, তাতে তাঁদের অপকর্মের ভার কিছুমাত্র লাঘব হবে না। এক সময় যিনি বা যাঁরা কথায় কথায় ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ বলে বিরোধীদের দিকে বিদ্রুপ ছুঁড়ে দিতেন, সেই লজ্জা ও ভয়হীন তাঁরা, আজ যতই মিডিয়ার চ্যানেলে বসে গলার শিরা ফুলিয়ে চিল চিৎকারে সব গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্ট করুন না কেন, সেই ঘোলা জলে আর কেউ মাছ ধরতে নামবে না। কারণ যে চুরি ধরার কথা ছিল রাজ্য পরিচালকদের, প্রশাসনের, তারা তো তা করেইনি। বরং নিজেরাই সেই চৌর্যবৃত্তিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে অংশ নিয়ে গেছে। তবে আমাদের মতো আমজনতার ওইটুকুই ভরসা যে, আদালত এখনও জেগে আছে।