আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২৩ ● ১৬-৩০ চৈত্র, ১৪২৯

প্রবন্ধ

ত্রিপুরার নির্বাচনঃ অন্য কথা

শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার


কী অদ্ভুত পরিহাস! বিগত শতকের তিরিশের দশকের শেষে যে রাজবংশকে বাঙালি প্রভুত্ব কায়েমের প্রধান কারিগর ভাবত ত্রিপুরার জনজাতি গোষ্ঠী, শতাব্দী পেরিয়ে সেই পরিবারের সন্তানই আত্মপ্রকাশ করল জনজাতি চেতনার মুখ হিসেবে। 

তিরিশের দশকের শেষে, ত্রিপুরায় তখন আধুনিক রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটছে। সেখানকার জনজাতি গোষ্ঠীর মধ্য থেকে নবোত্থিত একটি ক্ষুদ্র মধ্যবিত্ত সমাজের চোখে ত্রিপুরার রাজ পরিবার প্রতিভাত হল অবাঞ্ছিত বাঙালি প্রভুত্বের প্রতিভূ হিসেবে, কারণ তাদের জন্যেই জনজাতি জুমিয়ারা নিজেদের জমি থেকে উৎখাত হচ্ছে, তাদের জন্যেই বাংলা ত্রিপুরার সরকারি ভাষা হয়ে গেছে অষ্টাদশ শতকে, তাদেরই প্রত্যক্ষ উদ্যোগে স্থানীয় শিক্ষিত জনজাতিদের বঞ্চিত করে বাইরে থেকে বাঙালিদের ডেকে এনে রাজ প্রশাসনের মন্ত্রী অমাত্য আমলা হিসেবে নিযুক্ত করেছেন রাজা। রাজ পরিবারের সদস্যরা ত্রিপুরার ভাষায় কথা বলে না, পরিধান হিসেবে পরে না ত্রিপুরার পরম্পরাগত পোশাক, স্থানীয় খাদ্যরুচি থেকে সচেতনভাবে দূরত্বে অবস্থান করে। ব্রিটিশ শাসনের যখন অবসান হল, তখন জনরোষ থেকে বাঁচতে আগরতলা থেকে প্রাণভয়ে শিলংয়ে আশ্রয় নিলেন ত্রিপুরার রাণী। অন্যদিকে কমিউনিস্টরা ছিল স্থানীয় জনজাতিদের আত্মার আত্মীয়। তাদের নেতৃত্বেই দাদন প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে তারা। আওয়াজ তুলেছে 'দেবো না তিতুন'। দাবি তুলেছে জনজাতিদের মাতৃভাষার অধিকারের স্বীকৃতির। লড়াই করেছে শিক্ষার বিস্তারের। পঁচাত্তর বছর পর ঘড়ির কাঁটা সম্পূর্ণ উল্টে গেছে এখন। রাত হল দিন, দিন হয়ে গেল রাত। আজ রাজ পরিবারের বংশধরকে নেতার আসনে বসিয়ে ত্রিপুরার জনজাতি সমাজ কমিউনিস্টদের প্রত্যাখান করে দিল জনজাতিদের সবক'টি আসনে।

২০২৩-এর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ত্রিপুরার জনজাতি গোষ্ঠীর নতুন ত্রাণকর্তা হিসেবে প্রতিভাত হয়ে প্রবল সমর্থন আদায় করে নিলেন ত্রিপুরার রাজবংশের সন্তান প্রদ্যোৎ বিক্রম মাণিক্য দেববর্মা। অপরদিকে জনজাতি আসনে বামপন্থীরা শূন্যে পরিণত হল। ২০২৩ সালের ত্রিপুরা বিধানসভার নির্বাচনী ফলাফলের মূল বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে এটাই। এটা না ঘটলে বিজেপি ক্ষমতায় ফিরত না। এই মুহূর্তে ত্রিপুরায় যা যা ঘটছে তার কোনোটাই হত না। বামপন্থী সমর্থক ও কর্মীদের একটি বড় অংশের অভিমত, ১৭টি সাধারণ আসন ও ২টি সংরক্ষিত আসনে বামপন্থীদের পরাজয়ের ব্যবধানের চেয়েও বেশি ভোট পেয়েছে প্রদ্যোৎ বিক্রমের দল তিপ্রা মথা। অর্থাৎ এই দলটি নির্বাচনী আসরে হাজির হয়েছে বলেই বামপন্থীদের এই বিপর্যয়। এই প্রশ্নটি যখন একটি সর্বভারতীয় সংবাদপত্র তিপ্রা মথা প্রধান প্রদ্যোৎ বিক্রমের সামনে রাখে তখন তিনি পাল্টা যুক্তি দেন, বাম-কংগ্রেস প্রার্থীরা লড়াইয়ে না থাকলে তার দল আরো ৭টি আসনে জয়ী হত। বলা বাহুল্য, এই বিশ্লেষণগুলি সম্পূর্ণতই পাটিগণিত নির্ভর। পাটিগণিতে রাজনীতির সমগ্র ছবি ধরা পড়ে না। রাজনৈতিক বাস্তবতার অনুপুঙ্খ বিবেচনা আর তার সাথে বৃহত্তর প্রেক্ষিতের মধ্যে তাকে প্রতিস্থাপন করে তার বিশ্লেষণ, এই দুইয়ের সংশ্লেষ ব্যতিরেকে একটি অঞ্চলের রাজনীতির উত্থান পতনকে ধরতে পারা যায় না। অর্থাৎ ত্রিপুরার সমাজকে যেমন চিনতে হবে, তেমনি জানতে হবে ত্রিপুরা ঘিরে বৃহত্তর রাজনৈতিক ঘটনাক্রমকে। 

শুধুমাত্র জনসংখ্যা, আয়তন ও লোকসভার আসন সংখ্যার নিরিখে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে ত্রিপুরার গুরুত্ব বিচার করলে ভুল হবে। এমনিতে দেখতে গেলে ১৪০ কোটি জনসংখ্যার ভারতবর্ষে ত্রিপুরা একপ্রান্তে পড়ে থাকা ছোট্ট একটি রাজ্য। ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী জনসংখ্যা মোটে ৩৬ লক্ষ। লোকসভার মোট আসন ৫৪৫টির মধ্যে ত্রিপুরার আসন সংখ্যা মোটে ২টি। শতাংশের বিচারে ০.৩৬ শতাংশ। ভারতের মোট জনসংখ্যার ০.২৫ শতাংশ ত্রিপুরার মানুষ। লোকসভা নির্বাচনে এই রাজ্যের নির্বাচনের ফলাফলে কেন্দ্রীয় স্তরে সরকারের ভাঙাগড়া কখনোই নির্ভর করেনি। কিন্তু তারপরও ত্রিপুরার নির্বাচন নিয়ে সর্বোচ্চ তৎপরতা ছিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা, বিজেপি তথা আরএসএস-এর । 

২০১৪ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের বেশ কিছু বড় রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি বা তাদের নেতৃত্বাধীন জোট জয়লাভ করেছে। কিন্তু ২০১৮ সালে ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের পর বিজেপির নেতৃত্ব উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করে যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল তা ছিল অভূতপূর্ব। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী খোলাখুলিই বলেছিলেন, অন্য রাজ্যের নির্বাচনী বিজয় ও ত্রিপুরার নির্বাচনী বিজয় আমাদের কাছে এক নয়। এর তাৎপর্য অনেক বেশি। মোদীর মতে, অন্য রাজ্যের জয় শুধু নির্বাচনী বিজয়। কিন্তু ত্রিপুরার নির্বাচনী বিজয় হচ্ছে আদর্শগত বিজয়। কমিউনিস্টদের সাথে আমাদের লড়াইটা আদর্শগত লড়াই, শুধু দলগত বিষয় নয়। 

২০১৮-র নির্বাচনকে সামনে রেখে বামপন্থীদের ক্ষমতাচ্যুত করতে যে রণকৌশল গ্রহণ করেছিল বিজেপি, সেই একই কৌশল নেওয়া হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের ২০১১ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখেও। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা যে সমর্থনভিত্তির উপর নির্ভর করে ক্ষমতায় এসেছিল তা ছিল গরিব কৃষক ও দেশভাগের সুবাদে তৈরি হওয়া বাস্তুহারা জনগোষ্ঠী। স্বাধীনতার পর বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন আন্দোলন এবং অন্যদিকে তেভাগার উত্তরাধিকার বহন করে ছ'য়ের দশকে যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময়ের খাস ও বেনামী জমি দখলের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাস্তুহারা জনগোষ্ঠী ও রাজ্যের গরিব কৃষকদের মধ্যে এক শক্ত ভিতের জন্ম হয়েছিল বামপন্থীদের। সাতাত্তরে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসেছিল মূলত এই গণভিত্তির উপর নির্ভর করে। ২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে রাজনৈতিক বিরোধীরা বামপন্থীদের মূল গণভিত্তির এই দু’টি অংশকেই নিশানা করে। ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি ঘিরে বাস্তুহারাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা এবং নয়া উদারবাদের আবির্ভাবে কৃষিক্ষেত্রে যে সংকট দেখা দিয়েছিল, সেগুলিকে ব্যবহার করে এই দু’টি অংশ থেকে বামপন্থীদের জনবিচ্ছিন্ন করার চক্রান্ত রচনা করা হয়েছিল। বামপন্থীরা সময়মত এই নীল নকশাকে অনুধাবন করে যথার্থ রণকৌশল ও পাল্টা আগুয়ান রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ না করে অনেকটাই রক্ষণাত্মক অবস্থানে চলে যায়। আর এই সবকিছুর মিলিত ফলাফলেই ঘটে ২০১১ সালে বিপর্যয়। ত্রিপুরার ক্ষেত্রে রাজনীতির নানা 'ওঠোন-নামোন' পর্বের পর বাম বিরোধী রাজনীতির মূল চালকের আসনে বসে বিজেপি। বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার আগে থেকেই নিশানা করেছিল ত্রিপুরার জনজাতি সমাজকে। কারণ জনজাতি সমাজই ত্রিপুরায় বামপন্থীদের মূল গণভিত্তি। 

বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবারের তরফে ত্রিপুরা দখল কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বোঝা যায়, ত্রিপুরাকে ঘিরে সঙ্ঘ পরিবার ও বিজেপির সর্বাত্মক সাংগঠনিক তৎপরতায়। উচ্চবর্ণ হিন্দুত্বের প্রতিভূ হিসেবে প্রতিভাত বিজেপির জন্যে উত্তর-পূর্ব ভারতে সাংগঠনিক বিস্তৃতি একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল। খ্রিস্টান জনসংখ্যার পাহাড়ি রাজ্যগুলিতে একটা সহজাত বিকর্ষণ ছিল বিজেপির প্রতি। ত্রিপুরার পাহাড়ি জনজাতিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অ-খ্রিস্টান। ফলে বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবারের নজর বহুদিন ধরেই ছিল ত্রিপুরার পাহাড়ের দিকে। খ্রিস্টান পাদ্রীদের প্রতি বিরূপতাকে কাজে লাগিয়ে সঙ্ঘ পরিবারের 'বনবাসী কল্যাণ আশ্রম' কর্মতৎপরতা শুরু করে সন্তর্পণে। ২০১৪ সালে মহারাষ্ট্রে সিপিআই(এম)-এর দখলে দীর্ঘদিন থাকা পালঘর আসন ছিনিয়ে নেয় বিজেপি। ওই বিজয়ের মূল সংগঠক সুনীল দেওধরকে ত্রিপুরায় পাঠায় বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। ত্রিপুরায় নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে উত্তর-পূর্বের জনজাতিদের খাদ্যাভ্যাসের অঙ্গ শুয়োরের মাংসভোজনও রপ্ত করে ফেলেন এই নেতা। দ্রুততার সাথেই শিখে নেন জনজাতিদের ভাষা ককবরক। ত্রিপুরার জলবায়ু সংস্কৃতির সাথে মানিয়ে নিতে মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন আড়াই বছর ধরে। নিখুঁত পরিকল্পনা সাজিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার গোটা বাহিনী। সুচিন্তিত ভাবেই তারা সমস্ত শক্তি কেন্দ্রীভূত করে প্রথাবহির্ভূত পথে সংগঠন বিস্তারে। প্রথাগত সভা সমিতিতে ঝোঁক দেওয়ার মত সাংগঠনিক শক্তি তখন বিজেপির ছিল না। 

২০১৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ভোট ছিল মাত্র ১.৫৪ শতাংশ। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ৫০টি আসনের মধ্যে ৪৯টিতেই তাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে ত্রিপুরায় নরেন্দ্র মোদীর জনসভায় জনসমাগম হয়েছিল সাকুল্যে ৬,০০০। এমন একটি ক্ষুদ্র অস্তিত্ব থেকে ২০১৮ সালে ৪৬টি আসনে জয়লাভ করা একটি বিরাট উল্লম্ফন। এর প্রকৃত কারণ অনুধাবন করতে না পারলে ২০২৩ সালের নির্বাচনের ফলাফলের বিশ্লেষণও যথার্থ হবে না। কারণ বিগত পাঁচ বছরে ত্রিপুরায় দুর্নীতি দুঃশাসন চরমে উঠেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে হতাশা ও ক্ষোভও কম জন্মায়নি। আবার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির উপর সহিংস আক্রমণের ঘটনাও ঘটেছে অভূতপূর্বভাবে পাঁচটি বছর ধরে। বিগত পাঁচ বছরে রাজ্যে অনুষ্ঠিত একটি নির্বাচনও অবাধ হয়নি। তবে বামপন্থীদের লড়াই আন্দোলনে বিগত দুই আড়াই বছরে যথেষ্টই জোয়ার এসেছিল। ভয়ভীতি কাটিয়ে হাজার হাজার মানুষ পথে নেমেছিল সাম্প্রতিক সময়ে। তুলনায় ২০২৩-এর বিধানসভা নির্বাচনও অনেকটাই অবাধ হয়েছে। ফলাফলে বিজেপির আসন ও প্রাপ্ত ভোট কমেছে যদিও। তবু তারা সরকারে ফিরে এসেছে, সামান্য গরিষ্ঠতা হলেও, নিজেদের শক্তিতেই। 

এর অন্যতম কারণ, বিগত পাঁচ বছরে সরকার পরিচালনায় বিজেপি যতই ব্যর্থ হোক, সঙ্ঘ পরিবারের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন সর্বক্ষণ সক্রিয় থেকে ত্রিপুরার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি এই সময়পর্বে অনেকটাই মজবুত করতে পেরেছে। এই সাংগঠনিক শক্তি এবং বিরোধী ভোটের বিভাজন এই দুইয়ের মিলিত ফলাফলেই সরকার বিরোধী জনমতকে তারা ভোটের বাক্সে রুখে দিতে সমর্থ হয়েছে। আগেই বলা হয়েছে, বামফ্রন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বিজেপি নিশানা করেছিল রাজ্যের জনজাতি গোষ্ঠী ও অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায়ের মানুষকে। জনজাতি গোষ্ঠীর পর বামপন্থীদের অন্যতম সমর্থন ভিত্তি ছিল এই অংশের মানুষ। যেহেতু প্রথাগত সভা সমিতি মিছিল গণজমায়েতের শক্তিতে এই কাজ করা সম্ভব ছিল না, তাই তারা প্রথাবহির্ভূত পথে হেঁটে সদ্য চালু হওয়া আগরতলা-ধর্মনগর রেলপথের নিত্যযাত্রীদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মোদী সরকারের কর্মসূচি জনপ্রিয় করার প্রচারের আড়ালে অভূতপূর্ব গণসংযোগের শাখাপ্রশাখা গড়ে তোলে তারা রেলযাত্রীদের মধ্যে। এই প্রক্রিয়ায় প্রতিদিন গড়ে ৭০০/৭৫০ ফোন নম্বর সংগ্রহ করত স্বেচ্ছাসেবকরা যাদের মধ্যে গড়ে ২০০/২৫০ মানুষের হোয়াটসঅ্যাপ সংযোগ থাকত। আগরতলা শহরের অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে সুসজ্জিত রণকেন্দ্রের এক্সেল তালিকায় সকলের নাম যুক্ত করা হত। এভাবে সামাজিক গণমাধ্যমে রাজনৈতিক প্রচার ও সংযোগের এক বিশাল ডালপালা গড়ে ওঠে। এছাড়া ভোটার তালিকার পৃষ্ঠা প্রতি একজন সমন্বয়কের মাধ্যমে ভোটারদের সাথে ব্যক্তিগত স্তরে সামাজিক গণমাধ্যমে যোগসূত্র গড়ে তোলে। 

ত্রিপুরায় বিজেপি এভাবে যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারের মাধ্যমে রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করছে, তখনও বামপন্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রচার বা সাংগঠনিক যোগাযোগে সামাজিক গণমাধ্যমের ব্যবহার ততটা গতি পায়নি। প্রথাগত রাজনীতির পরিসরের শক্তির ঘাটতি মেটাতে রাজনৈতিক শক্তির একটা মিথ্যে প্রদর্শনীর জন্যে নানা ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে বিজেপি। যেমন প্রতি ১৫ দিনে একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ত্রিপুরা সফর এবং সাথে করে প্রচার মাধ্যমে আকাশকুসুম প্রতিশ্রুতির বন্যা। ত্রিপুরার আপাত স্থিতাবস্থার রাজনীতিতে এক বড় ঝাঁকুনি দেয় এই প্রবল ঢাকঢোল পেটানো কর্মতৎপরতা। এর প্রভাবে বাম বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি থেকে বিজেপির দিকে নেতা কর্মী সমর্থকদের ঢল নামতে শুরু করে। সবকিছুর মিলিত ফলাফলে বাস্তবতা বিবর্জিত এক কল্পিত স্বর্গের স্বপ্ন দেখতে শুরু করল ত্রিপুরার সাধারণ মানুষ। ভেবে নিল ২৫ বছরের বাম শাসনে যা কিছু অপ্রাপ্তি সবই এবার হয়ত হস্তগত হবে একবার বিজেপি এলেই। সব যুবকের হাতে স্মার্ট ফোন, মিসড কলে কর্মসংস্থান, ক্ষমতায় আসার পরদিনই কর্মচারীদের জন্যে সপ্তম বেতন কমিশন - এমন সব প্রতিশ্রুতিকে চোখ বুজে বিশ্বাস করে নিল ত্রিপুরার জনগনের এক বিরাট অংশ। 

এখন প্রশ্ন উঠবে, পঁচাত্তর বছরের অগণিত লড়াই সংগ্রাম আত্মত্যাগ, অসংখ্য শহিদের রক্তদানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বামপন্থী আন্দোলন এভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়ল কী করে? সবটাই কি আক্রমণ, ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত আর মিথ্যা প্রচারের ফল? বামপন্থীদের নিজেদের তরফে কি কোথাও কোনও খামতি ছিল না যার ফলে অলক্ষ্যে জনসাধারণের সাথে এক অনতিক্রম্য দূরত্ব রচিত হচ্ছিল অনেকদিন ধরে এবং অজ্ঞাতসারে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আরো অনেক দিক থেকে এবং অনেকটা পেছন থেকে দেখতে হবে ত্রিপুরার রাজনীতিকে।

উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্য রাজ্যগুলির মতই ত্রিপুরার রাজনীতিরও একটি অন্যতম প্রধান বিষয় সমতলবাসী ও পাহাড়বাসী জনগোষ্ঠী বা জনজাতিদের আন্তঃসম্পর্ক। আরও স্পষ্ট করে বললে, এই বিষয়টি কোনো কোনো রাজ্যে সব সমতলবাসীর সাথে সম্পর্কিত হলেও আসাম বা ত্রিপুরার ক্ষেত্রে এর কেন্দ্রস্থলে রয়েছে বঙ্গভাষী জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কের বিষয়টি। এই আন্তঃসম্পর্কের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিকটি এড়িয়ে গিয়ে আসামের মতই ত্রিপুরার রাজনীতি বোঝা অসম্ভব। আসাম ও ত্রিপুরা, দু'টি রাজ্যেই, স্বাধীনতাপূর্ব সময় থেকেই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিতে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে বহিরাগত এবং আগ্রাসনকারী হিসেবে দেখা হয়েছে। তবে দু'টি রাজ্যের ক্ষেত্রেই প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে যুগপৎ স্থানীয় এবং বহিরাগত বলা যায়। ব্রিটিশ শাসিত আসাম প্রদেশে অবিভক্ত বঙ্গদেশের সিলেট, কাছাড় ও গোয়ালপাড়ার সংযুক্তির মধ্য দিয়ে যে ভূমিপুত্র বাঙালিরা আসামের জনসংখ্যার অংশ হন, তারা সর্ব অর্থেই স্থানীয়। আবার আসামে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানকার চা বাগান, সরকারি চাকরি, ব্যবসা বাণিজ্যতে ভাগ্যান্বেষণে যে বাঙালিরা যান তারা বহিরাগত। পরবর্তী সময়ে এর সাথে যুক্ত হয় ব্রিটিশ প্রশাসনের উদ্যোগে ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে আসামের অনাবাদী জমিতে চাষবাসের জন্যে নিয়ে যাওয়া বাঙালি মুসলিম কৃষকরা। তারা অবশ্য স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সরকারি উদ্যোগে সাড়া দিয়ে মাতৃভাষা পরিবর্তন করে সাংস্কৃতিকভাবে আসামের জনসমাজের অঙ্গীভূত হওয়ার প্রয়াসী হয়েছিল। আসামেও একসময়ে শিক্ষার মাধ্যম ও সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার প্রবর্তন করেছিল সরকার যার জেরে আসামের অসমীয়া জনগোষ্ঠীর মনে বাঙালি ও বাংলা ভাষার দিক থেকে নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি হারানোর আতঙ্ক এখনও তাড়া করে বেড়ায়। একইভাবে, স্বাধীনতাপূর্ব রাজন্যশাসিত ত্রিপুরার সীমার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল পার্বত্য ত্রিপুরার বাইরেও বাংলার এক বিস্তীর্ণ জনপদ যা পরিচিত ছিল চাকলা রোশনাবাদ নামে। নোয়াখালী ও সিলেটের অংশ ও তৎকালীন টিপরা জেলা (আজকের বাংলাদেশের কুমিল্লা) নিয়ে ছিল সেই অঞ্চল। ফলে রাজন্য শাসিত ত্রিপুরায় সব বাঙালিকে বহিরাগত বা শোষক হিসেবে চিহ্নিত করার অবকাশ ছিল না। আবার ত্রিপুরা রাজপরিবারই উদ্যোগ নিয়ে বাইরে থেকে বাঙালি কর্মচারীদের এনে নিযুক্তি দিয়েছিল রাজপ্রশাসনের নানা স্তরে। ফলে মন্ত্রী আমাত্য আমলাদের প্রায় সবাই ছিল বহিরাগত বাঙালি যারা ছিল অত্যাচারী শোষণ যন্ত্রের মূল চালিকাশক্তি। এছাড়া রাজন্য শাসনে প্রশাসনের উদ্যোগে জনজাতিদের জমি থেকে উচ্ছেদ করে সেই জমিতে পার্বত্য ত্রিপুরার বাইরে থেকে বাঙালি কৃষকদের এনে বসতি দেওয়া হত। উদ্দেশ্য ছিল জনজাতিদের প্রাচীন জুম চাষ পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক স্থির চাষের প্রবর্তন। এছাড়া ত্রিপুরায় সরকারি ভাষাও ছিল বাংলাই। জনজাতিদের নিজস্ব ভাষা ত্রিপুরী বা ককবরক রাজবংশের সদস্যরা চর্চা করতেন না। ভুলেই গিয়েছিলেন। রাজপরিবারের যে সন্তান এখন জনজাতি রাজনীতির মুখ হিসেবে সামনে উঠে এসেছে সে নিজেও ককবরক জানে না। ত্রিপুরার রাজ পরিবারের ককবরক ভুলে যাওয়া নিয়ে কমিউনিস্ট নেতা দশরথ দেব বলেছিলেন, রাজবাড়িতে শুধু কক-বরক (ভাষা) নয়, চা-বরক (খাদ্য) বা কান-বরক (পোষাক) কোনো কিছুরই চর্চা ছিল না। সময়ের পরিহাস, এখন সেই রাজ পরিবারের বর্তমান বংশধরই ত্রিপুরার সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের কথা বলছেন। 

শতাংশের বিচারে বাঙালি জনসংখ্যার বৃদ্ধি এবং জনজাতি জনসংখ্যার সংকোচন নিয়ে নিয়ে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লাগাতার অপপ্রচার করা হয়ে থাকে। অথচ ভূমিহীন ও ভূমিসন্ধানী বাঙালি কৃষকদের ব্যাপকহারে ত্রিপুরায় নিয়ে আসা হয়েছিল রাজার উদ্যোগেই। ১৮৭২ সালে রাজার উদ্যোগে যে প্রথম জনগণনার কাজ হয় তাতেই দেখা যায় যে জনজাতি জনসংখ্যা ৬৪ শতাংশে নেমে এসেছে। নতুন শতকে এসে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৪ শতাংশে। ১৯৪০ সালে তা আরো কমে দাঁড়ায় ৫০ শতাংশে। জনজাতি জনসংখ্যার এই সংকোচনের জন্যে সম্পূর্ণ দায়ী ছিল রাজন্য প্রশাসনের বিভিন্ন নীতি। এই সময়পর্বে ত্রিপুরায় সাক্ষরতার সামান্য বৃদ্ধির ফলে স্থানীয় জনজাতি সমাজ থেকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর অভ্যুদয় হয়। যাঁদের মধ্য থেকে আধুনিক পেশায় কর্মসংস্থান লাভের একটি আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়। রাজশাসনের অভ্যন্তরেই সীমিত সাংবিধানিক সংস্কারের আবহে আধুনিক রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ হয় ১৯৩৮ সালে 'জনমঙ্গল সমিতি' গঠনের মধ্য দিয়ে। এই পর্ব থেকে ১৯৪৮ সালে 'গণমুক্তি পরিষদ'-এর গঠন অবধি বামপন্থীদের নেতৃত্বে ত্রিপুরার রাজনীতি একইসাথে জনজাতি সমাজের জমির অধিকার, সামন্ততান্ত্রিক শোষণের অবসান এবং বাঙালি জনজাতি ঐক্য সম্প্রীতির ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিকশিত করার পথে সুদৃঢ়ভাবে এগিয়ে যায়। ত্রিপুরার রাজ পরিবারের শাসন আমলে যেমন জনজাতি সমাজ ছিল সবচেয়ে নিপীড়িত ও শোষিত, একইভাবে স্বাধীনতার পর রাজ পরিবার যে দলের রাজনৈতিক নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হয় সেই কংগ্রেসের রাজত্বকালেও জনজাতি কৃষকদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া একইভাবে অব্যাহত থাকে। জনজাতিদের মাতৃভাষার অধিকারকেও স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে কংগ্রেস সরকার। 

ত্রিপুরার কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস নানা দিক থেকেই গৌরবময়। এই গৌরবময় ইতিহাসই ত্রিপুরার রাজনীতিকে একটা স্বাতন্ত্র্য প্রদান করেছে যা আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট রাজনীতির নিরিখেও অনন্য। এখানে যেমন উত্তর-পূর্বের সহজাত আত্মপরিচয় ও জনজাতি চেতনার রাজনীতির অস্তিত্ব রয়েছে, একইসঙ্গে রয়েছে সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদের রাজনীতির এক স্পন্দমান ধারা। ক্ষুদ্র জাতিচেতনা ও সর্বহারার আন্তর্জাতিক চেতনার মেলবন্ধনে সচেতন ও সার্থক রাজনৈতিক চর্চার এমন দৃষ্টান্ত গোটা বিশ্বে বিরল। সোভিয়েত-উত্তর বিশ্বে বামপন্থীরা হাল আমলে শ্রেণিচেতনা ও আত্মপরিচয়ের রাজনীতির সংশ্লেষের মাধ্যমে যে নতুন ধরনের বামপন্থার অনুসন্ধান করছে। ত্রিপুরার বামপন্থীরা ১৯৩৮ সাল থেকেই 'জনমঙ্গল সমিতি' থেকে 'জনশিক্ষা সমিতি', সেখান থেকে 'ত্রিপুরা প্রজা মণ্ডল' হয়ে 'গণমুক্তি পরিষদ', আবার সেখান থেকে ১৯৭৮ সালের 'বামফ্রন্ট' ও ১৯৮২ সালের ত্রিপুরা 'স্বশাসিত উপজাতি জেলা পরিষদ' অবধি সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তাত্ত্বিক স্তরে ও হাতেকলমে সেই নিরীক্ষার প্রয়োগ করেছে। এই কাজ ছিল অত্যন্ত সুকঠিন। জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সংক্রান্ত মার্কসবাদী তত্ত্বের বাইরে হাতের কাছে কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না। একদিকে বাঙালি ও জনজাতি উগ্রতার বিরুদ্ধে লড়াই, আবার অপরদিকে জনজাতি সমাজের অধিকারের দাবি ও জাতি-জনজাতি সমাজের ঐক্য সম্প্রীতির লড়াইয়ের মেলবন্ধন - অত্যন্ত কঠিন এর তাত্ত্বিক অবস্থান নির্মাণ ও বাস্তব প্রয়োগ। বিশেষ করে যে রাজ্যে স্বাধীনতাপূর্ব সময় থেকেই বাঙালি আধিপত্যবাদ ও জনজাতি সমাজের পৃথকত্বের রাজনীতি শাসকশ্রেণির প্রত্যক্ষ মদত পেয়েছে, সেখানে বাঙালি ও জনজাতি স্বার্থের যুগপৎ রক্ষার মাধ্যমে নীতিগত অবস্থান গ্রহণ একটি ঐতিহাসিক অর্জন। এ বিষয়ে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হরিহর ভট্টাচার্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্র রয়েছে একাধিক। ওই গবেষণাপত্রে অধ্যাপক ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন কতটা কুশলতার সাথে কমিউনিস্টরা ত্রিপুরায় এই কাজটি করতে পেরেছিল।

ত্রিপুরার জনজাতিদের ভাষা, সংস্কৃতি ও আত্মশাসনের অধিকার প্রথম স্বীকৃত এবং বাস্তবায়িত হয় ১৯৭৮ সালে বামফ্রন্ট সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে। ২০০০ সালে ত্রিপুরা স্বশাসিত জেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রথমবার বামপন্থীরা পরাস্ত হয়। যদিও ২০০৫ সালেই এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে আইএনপিটি ভেঙে বেরিয়ে আসা একটি অংশের সাথে মৈত্রীবদ্ধ হয়ে বামপন্থীরা বিপুলভাবে জয়ী হয়। ২০০৩ সাল থেকে ২০১৩ সালের বিধানসভা নির্বাচন অবধি জনজাতিদের জন্যে সংরক্ষিত আসনের সিংহভাগে বামপন্থীরা বিপুলভাবে জয়ী হয়ে এসেছে। ১৯৭৭ সালের পর ২০১৩ সালের নির্বাচনেই বামপন্থীদের জয় ছিল বৃহত্তম। ২০১৮ সালের পরাজয় ছিল এক অভূতপূর্ব পটপরিবর্তন যা ১৯৮৮ সালের কংগ্রেসের বিজয়ের চেয়ে গুণগতভাবেও ছিল অনেকটাই আলাদা। এই ফলাফলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল জনজাতিদের সংরক্ষিত ২০টি আসনের মধ্যে ১৮টি আসনে বিজেপি জোটের জয়। ১৯৮৮ সালে সন্তোষ মোহন দেবের নেতৃত্বে যে রিগিং-সর্বস্ব নির্বাচনের মাধ্যমে বামপন্থীরা ক্ষমতাচ্যুত করা হয় সেই নির্বাচনেও জনজাতিদের সংরক্ষিত আসনের ৮টিতে জয় পেয়েছিল বামপন্থীরাই। এখন, প্রথমে ২০২১ সালের স্বশাসিত জেলা পরিষদ ও তারপর ২০২৩ সালের বিধানসভার নির্বাচনে জনজাতি গোষ্ঠীর জন্যে সংরক্ষিত আসনের একটিতেও জয়লাভ করতে পারেনি বামপন্থীরা। পূর্ণাঙ্গ রাজ্য হিসেবে গঠিত হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রথম নির্বাচনের পর থেকে এখন অবধি এতটা শোচনীয় ফলাফল বামপন্থীদের কখনোই হয়নি। এর কারণ কী? 

প্রকৃতপক্ষে উত্তরপূর্বের প্রতিটি রাজ্যের রাজনীতিরই একটি বাড়তি সাংস্কৃতিক মাত্রা রয়েছে। এই সাংস্কৃতিক মাত্রাটি সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের। হয়ত রাজনীতির এই বাড়তি দিকটি উত্তরপূর্বের একার নয়, সমস্ত জনজাতি গোষ্ঠীর রাজনীতিতেই রয়েছ। আবার এক অর্থে হয়তো সব রাজনীতিরই একটি সাংস্কৃতিক মাত্রা রয়েছে যা শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের রাজনীতির বিবেচনার দ্বারা স্পর্শ করা যায় না। তারপরও বলতে হয়, উত্তরপূর্বের রাজনীতির এই সাংস্কৃতিক মাত্রাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর। উত্তরপূর্বের এই বৈশিষ্ট্যটির কারণ হয়তো অবশিষ্ট ভারতের সাথে এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও মনস্তাস্ত্বিক দূরত্ব। ভারতের সামগ্রিক রাজনৈতিক ইতিহাসের মূলস্রোত থেকে তার ঐতিহাসিক বিচ্ছিন্নতাও হয়তো একটি কারণ। ফলে শুধু জনজাতি রাজনীতির পরিমণ্ডলেই নয়, উত্তর-পূর্বের সমস্ত স্থানীয় জনগোষ্ঠীর রাজনীতিতেই এই বাড়তি সাংস্কৃতিক মাত্রাটি রয়েছে। এই মাত্রাটিকে উপেক্ষা করে রাজনীতির ক্ষেত্রে সঠিক অবস্থান গ্রহণ করা অসম্ভব। শুধুমাত্র আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন বা যথার্থ স্বশাসন সুনিশ্চিত করার মাধ্যমেও সবক্ষেত্রে রাজনীতির এই সাংস্কৃতিক মাত্রাকে যথাযথভাবে স্পর্শ করা সম্ভব হয় না। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন তার শৈশবে এই অঞ্চলে ডালপালা বিস্তার করার সময়ে সচেতনভাবে না হলেও পরিস্থিতির বাধ্যতায়ও, এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠী সমূহের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের দিকটিকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করেছিল। এর ফলশ্রুতিতে শুধু ত্রিপুরার জনশিক্ষা আন্দোলন বা গণমুক্তি পরিষদের রাজনৈতিক লড়াই-ই নয়, উত্তরপূর্বের অন্যান্য রাজ্যেও মনিপুরী, ডিমাসা, বোড়ো, জয়ন্তিয়া, হাজং ইত্যাদি নানা জনজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে সীমিত পরিসরে হলেও একটি রাজনৈতিক উপস্থিতি তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিল কমিউনিস্টরা। মনিপুরের জননেতা ইরাবত সিংহ, এই প্রক্রিয়াতেই কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে সম্পৃত্ত হয়েছিলেন। উত্তর-পূর্বের অন্যত্র ১৯৪৮ পরবর্তী রণদিভে পর্বের পর এই পরিসর ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ত্রিপুরায় জনজাতি সমাজ কমিউনিস্ট আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। বামফ্রন্টের শাসনে জনজাতি সমাজের জন্যে রাজ্যের শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকেও স্বশাসনের যে আদর্শ কাঠামো তৈরি করা হয় তা সারাদেশের ক্ষেত্রেই ছিল দৃষ্টান্তমূলক। ভাষার স্বীকৃতি ও শিক্ষার বিস্তারের সাথে সাথে জনজাতিদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের ধারণায়ও পরিবর্তন আসে। এর নানা কারণ। অতীতে বাংলা মাধ্যমে শিক্ষালাভ করা জনজাতি সমাজের মধ্যবিত্ত অংশ উত্তর-পূর্বের অন্যান্য জনজাতি সমাজের চেয়ে বঙ্গভাষীদের সাথেই বেশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নৈকট্য অনুভব করত। সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চাও হত অভিন্ন পরিসরে। বাঙালি সমাজের সাথে ছিল সহজাত মৈত্রী ও আদান-প্রদানের সম্পর্ক। মাতৃভাষার অধিকার প্রাপ্তির সাথে সাথে শিক্ষালাভের অভিন্ন পরিসরটি দু’ভাগ হয়ে গেল। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে এভাবে একটি দূরত্ব নির্মিত হতে শুরু করল। এই দূরত্ব কাছে নিয়ে এল উত্তর-পূর্বের অন্যান্য জনজাতি জনগোষ্ঠীকে। নতুন ঘনিষ্ঠতায় বাঙালি বিরূপতার রাজনীতির এক ভিন্ন চেহারাও আমদানি হল সেখান থেকে। বামফ্রন্ট ত্রিপুরার সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলা ও ককবরক দু'টির সমস্বীকৃতি দিলেও বাস্তবে সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলারই আধিপত্যই রয়েছে। এর কারণ হয়ত রাজ্যের বাঙালিদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ফলে সরকারি ভাষা হিসেবে ককবরক সীমিত থেকে যায় জনজাতিদের মধ্যেই শুধু। এ ছাড়া ভাষা হিসেবে ককবরক স্বীকৃতি লাভ করে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর অবধি স্বতন্ত্র ভাষা শিক্ষার বিষয় হয়ে উঠলেও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ককবরক বিকশিত হয়নি। একটা সময়ে বিদ্যালয়ের স্তরে একে বিকশিত করার প্রক্রিয়া শুরু হলেও ককবরক বর্ণমালা নিয়ে বিতর্কের মুখে তা স্তব্ধ হয়ে যায়। ককবরক প্রধানত বাংলা হরফে লেখা হলেও একটা পর্যায়ে রোমান হরফ ও বাংলা হরফকে কেন্দ্র করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। প্রথম অবস্থায় এই বর্ণমালা সংক্রান্ত বিতর্কের একটি সাম্প্রদায়িক মাত্রা ছিল। জনজাতিদের মধ্যেকার খ্রিস্টধর্মাবলম্বী অংশ ছিল রোমান হরফের স্বপক্ষে প্রধানত। এখন সাম্প্রদায়িক মাত্রাটি চলে গেছে। ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে নতুন প্রজন্মের জনজাতি সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই রোমান হরফ ব্যবহারের স্বপক্ষে। প্রবীণ এবং প্রধানত বামপন্থী আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্টরাই বাংলা হরফে ককবরক লেখার দিকে ঝুঁকে আছেন। উল্টোদিক থেকে এটাও সত্য উত্তর-পূর্বের জনজাতি রাজনীতির বাঙালি বিদ্বেষের দিকটির প্রভাবেই জনজাতি সমাজের বাম বিরোধী রাজনৈতিক অংশটি তীব্রভাবে রোমান হরফপন্থী। এই বিতর্কে বাঙালি বিদ্বেষ ও বামপন্থা বিরোধিতা যেভাবে একইসঙ্গে ত্রিপুরার জনজাতি সমাজের মধ্যে গেড়ে বসেছে, শিক্ষার মাধ্যম ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ককবরক ভাষার বিকাশও রুদ্ধ হয়েছে। অন্যদিকে দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনেই বাংলার ব্যবহার সমস্ত ভাষাগোষ্ঠীকেই করতে হয় ত্রিপুরায়। রাজ্যপালের বাজেট বক্তৃতা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলির সম্মেলন, রাজ্য ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েও ককবরক ব্রাত্য। এ সমস্ত কিছুর ফলে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাঙালিদের অনায়াস আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় তা ‘নিজ দেশে পরবাসী’ মনোভাবের পুনর্জন্ম দিয়েছে জনজাতিদের মধ্যে। এই মনোভাব খুঁচিয়ে তোলায় বিরোধী রাজনীতির একটি প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকলেও একে সময়মত অনুধাবন করে সঠিকভাবে মোকাবিলা করার মত যথাযথ সাংস্কৃতিক রাজনীতির প্রয়োগ ঘটেনি বামপন্থী আন্দোলনের তরফে। প্রয়োজন ছিল সাংস্কৃতিক আত্মপরিচিতি ও আকাঙ্ক্ষার যথার্থ মূল্যায়ন। 

প্রকৃতপক্ষে সার্বিকভাবেই ভাষা-রাজনীতি নিয়ে নতুনভাবে ভাবার সময় হয়তো এসেছে। একটি ভাষার ভিত্তিতে একটি জাতি এবং তার ভিত্তিতে জাতিরাষ্ট্রের ধারণা ইউরোপ থেকে সম্ভূত। বহুজাতিক বহুভাষিক ভারতে একটি ভাষাকে প্রাধান্যে রেখে জাতি নির্মাণের উদ্যোগ থেকেই ভারতে হিন্দি আগ্রাসন, হিন্দি বিরোধিতা, ক্ষুদ্র ভাষার অবলুপ্তি ঘটেছে। একে কেন্দ্র করে হওয়া রাজনীতি থেকে এসেছে সরকারের ত্রি-ভাষা সূত্র যা ঘোষিত নীতি থেকে সরে কার্যত হিন্দি বলয়ের বাইরে হিন্দি সম্প্রসারণের বাহনে পরিণত হয়েছে। যেভাবে জাতীয় স্তরে দেশের বহুভাষিক বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে হিন্দি ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেভাবেই প্রতিটি রাজ্যে সেখানকার বহুভাষিক বৈশিষ্ট্যকে স্বীকৃতি না দিয়ে একটি বা দু'টি ভাষাকে সকলের উপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষের প্রতিটি রাজ্যই বহুভাষী। এই বহুভাষী বাস্তবতায় জনসংখ্যার বিচারে ভাষার অধিকারের ক্ষেত্রে তারতম্য করা কখনোই গণতান্ত্রিক নীতি হতে পারে না। জনসংখ্যা নির্বিশেষে প্রতিটি ভাষাগোষ্ঠীর সম অধিকার থাকতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সরকার গঠন হতে পারে, কিন্তু ব্যক্তি নাগরিকের অধিকারের ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুর মধ্যে ফারাক থাকতে পারে না। ভাষার অধিকার প্রাথমিকভাবে একজন ব্যক্তি মানুষের নাগরিক অধিকার। সেই মানুষটির ভাষাগোষ্ঠী সমাজে সংখ্যাগুরু না সংখ্যালঘু তা দিয়ে অন্য ব্যক্তি নাগরিকের সাথে তার অধিকারের তারতম্য হতে পারে না। জাতীয়তাবাদের কোনো ধারাতেই ভাষা-রাজনীতি সঠিকভাবে নিরূপিত হয় না। আজকের লাতিন আমেরিকায় তাই বিকল্প হিসেবে প্লুরিন্যাশনালিজম বা বহুজাতীয়তাবাদের ধারণা তৈরি হয়েছে যেখানে সংখ্যা নির্বিশেষে সমঅধিকারই শুধু নয়, সংখ্যাগত বা অন্য বিবেচনায় যারা দুর্বল তাদের অধিকতর অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। বলিভিয়া ইতিমধ্যেই 'প্লুরিন্যাশনাল রাষ্ট্র' হিসেবে নিজেদেরকে ঘোষণা করে সেখানকার আদিবাসী ও জনজাতিদের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় ও রাজনৈতিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করেছে। চিলিতে গণভোটে প্লুরিন্যাশনালিজমের প্রস্তাবিত সংশোধনী আপাতত পরাস্ত হলেও গোটা লাতিন আমেরিকা এখন সেই পথেই পা বাড়াচ্ছে। বহুভাষিক ভারতকেও ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের পথ পরিত্যাগ করে লাতিন আমেরিকার প্লুরিন্যাশনালিজমের বিষয়ে বিবেচনা করতে হবে।

সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় ভাষা একটি হলে ঐক্যের পথ সহজ হয়। বিপরীতে ভাষার সংখ্যা একাধিক হলে অনৈক্য উৎসাহিত হয়। ভারতের সংবিধান প্রণেতারাও এমনই ভেবেছিলেন হিন্দিকে জাতীয় ভাষা করতে গিয়ে। একবিংশ শতাব্দীতে এই ধারণা বাতিল হয়ে গেছে। বর্ণবৈষম্যবাদের শাসনের অবসানের পর দক্ষিণ আফ্রিকায় ১১টি ভাষা জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্রের ধারণার আঁতুড়ঘর ইউরোপও এখন বহুভাষিকতা ও বহুসাংস্কৃতিকতার পথে হাঁটছে। 

আবার ফিরে আসি ত্রিপুরার প্রসঙ্গে। জাতি জনজাতির মৈত্রী সম্প্রীতির স্বার্থেই দ্বিভাষী রাজ্য ত্রিপুরায় ভাষা-বিনিময়ের সংস্কৃতির উন্মেষের হয়ত প্রয়োজন ছিল। রাজ্যের বামপন্থী নেতাকর্মীদের মধ্যে যারা জনজাতি সমাজের মানুষ তারা সাধারণভাবে বাংলা জানেন, কিন্তু বাঙালিদের নেতাদের হাতে গোনা ব্যতিক্রমী দু'এক জন ছাড়া কেউই ককবরক জানেন না। জনজাতি অঞ্চলে সভাসমিতিতে বাঙালি বক্তা ককবরক ভাষায় বক্তৃতা দিচ্ছেন এমন দৃষ্টান্ত সম্ভবত নেই। থাকলেও খুবই কম। ভাষা-রাজনীতির এই দিকটি নীতিগতভাবেই বামপন্থী রাজনীতিতে সেভাবে কখনো আসেনি। রাজ্যের প্রধান দু'টি ভাষাগোষ্ঠীর জনগনকে আরো কাছাকাছি আনার জন্যে এই সময় এক সচেতন বহুভাষিকতার চর্চার দাবি করে। রাজ্যের প্রথম জন দ্বিতীয় জনের ভাষায় কথা বলতে সক্ষম, অথচ দ্বিতীয় জন প্রথম জনের ভাষা বোঝেই না, এমন একটি বাস্তবতায় পৃথকত্বের রাজনীতিতে সার পানি জোগানো কায়েমী স্বার্থবাদীদের জন্যে সহজতর হয়। রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক স্থাপনার নামকরণের সময় বাঙালি ও জনজাতি সমাজের সাংস্কৃতিক দাবিদাওয়ার প্রতি সমভাবে নজর দেওয়া হয়নি বলেও অভিমান রয়েছে জনজাতি সমাজে। এই ধারণার বাস্তবতা রয়েছে কিনা তা নিরুপণ করা সবসময সম্ভব নয়। কারণ স্পর্শকাতর এমন বিষয়ের সঠিকভাবে সামাল দেওয়ার জন্যে কখনো প্রতীকী অবস্থানেরও রাজনৈতিক গুরুত্ব থাকে। এই দূরত্বগুলিই ত্রিপুরার ক্ষেত্রে সম্ভবত জনজাতি সমাজকে জাতি জনজাতির মৈত্রীর রাজনীতি থেকে সরিয়ে এনেছে। এখান থেকেই আত্মপ্রকাশ করেছে কখনো আইএনপিটি, কখনো আইপিএফটি, কখনো বিজেপি এবং এবার তিপ্রা মথা। ফলে বামপন্থীরা তাদের চিরাচরিত সমর্থনভিত্তি জনজাতি সমাজ থেকে ভোটের অঙ্কে হলেও নির্বাসিত হয়েছে। এবারের নির্বাচনে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ ছিল এ সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই জনরোষ সরকার বদলে পরিণত হয়নি। কারণ প্রথমত, জনমত ত্রিধাবিভক্ত ছিল। দ্বিতীয়ত, বিগত পাঁচ বছরে বিজেপি তাদের সাংগঠনিক শক্তি অনেকটাই বৃদ্ধি করেছে। এবং তৃতীয়ত, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বামপন্থীদের পরম্পরাগত গণভিত্তি দুর্বল হযে পড়েছে ব্যাপকভাবে।

বামপন্থা ত্রিপুরায় ফিরে আসবেই ভবিষ্যতে এ সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তার জন্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জনজাতি রাজনীতি ও বামপন্থার নতুন করে সংজ্ঞায়ন। সবচেয়ে বড় কথা, এখনও ত্রিপুরার বামপন্থী রাজনীতির পরিভাষায় জনজাতি সমাজকে ‘উপজাতি’ হিসেবে অভিহিত করা হয় যা অবশিষ্ট ভারতে ইতিমধ্যেই বর্জিত হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এটা নিতান্তই প্রতীকী বিষয়। কিন্তু সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের রাজনীতিতে প্রতীকী বিষয়গুলির রাজনৈতিক গুরুত্বও অপরিসীম। পরিশেষে, বামপন্থী রাজনীতিকে সামগ্রিকভাবেই বিশ্বজুড়েই এই প্রশ্নটির সুরাহা করা প্রয়োজন। কেন বিপুল সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসীন হয়েও একটা সময়পর্বের পর জনগণ ও বামপন্থী দলের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। একি শুধুই বিরোধীদের চক্রান্ত বা জনগণের রাজনৈতিক চেতনার দুর্বলতা? নাকি বামপন্থার অভ্যন্তরেই এমন কিছু কৃষ্ণগহ্বর রয়েছে যেখান থেকেই জন্ম নেয় এ ধরনের বিচ্যুতি বা দূরত্ব। এই বিষয়গুলিতে আলো ফেলা এখন সময়ের সর্বোচ্চ চাহিদায় পরিণত হয়েছে? এমনকি কোন স্থবিরতা অলক্ষ্যে গ্রাস করছে যেখানে একটি সচেতন ঝড়ের হাওয়া বইয়ে দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই?