আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২৩ ● ১৬-৩০ চৈত্র, ১৪২৯

প্রবন্ধ

মহার্ঘ ভাতা তরজা

সুখবিলাস বর্মা


এই মুহূর্তে মহার্ঘ ভাতা (Dearness Allowance) নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ তোলপাড় হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রদত্ত হারে মহার্ঘ ভাতার দাবি নিয়ে রাজ্য কর্মচারী সংগঠনগুলোর আন্দোলন ধর্না/অনশন পর্যায়ে পৌঁছেছে। রাজ্য সরকারও অবশ্য এবিষয়ে কড়া মনোভাব দেখিয়ে চলেছে। মহার্ঘ ভাতা নিয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা, ছোটো বড়ো নানা পত্র-পত্রিকায় লেখালেখিও কম হয়নি। SAT, উচ্চ আদালতের রায় কর্মচারীদের পক্ষেই রয়েছে। কিন্তু রাজ্য সরকার সেই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছে। কর্মচারী সংগঠনগুলোর ধর্না চলছে। রাজ্যের অর্থ বিভাগে (বাজেট ব্রাঞ্চে) দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে একটু আলোচনা করতে চাই।

শুরু করা যাক মহার্ঘ ভাতা বিষয়ে সংবিধানের ধারা দিয়ে। আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় নির্দেশমূলক নীতি (Directive Principles of State Policy) বিষয়ক চতুর্থ ভাগে অন্তর্ভুক্ত অনুচ্ছেদ (আর্টিকেল) ৪৩ হল রাষ্ট্রের শ্রমিক ও কর্মচারীদের জন্য মজদুরি সংক্রান্ত ধারা। কী বলছে আর্টিকেল ৪৩?

Article 43

Living wage, etc., for workers - The State shall endeavour to secure, by suitable legislation or economic organization or in any other way, to all workers, agricultural, industrial or otherwise, work, a living wage, conditions of work, ensuring a decent standard of life and full enjoyment of leisure and social and cultural opportunities and in particular, the State shall endeavour to promote cottage industries on an individual or cooperative basis in rural areas.

অনুচ্ছেদ (আর্টিকেল) ৪৩

 

শ্রমিকদের জন্য জীবিকার মজুরি, ইত্যাদি - রাষ্ট্র উপযুক্ত আইন বা অর্থনৈতিক সংস্থার মাধ্যমে বা অন্য কোন উপায়ে, সমস্ত শ্রমিক, কৃষক, শিল্প সংস্থায় বা অন্য জায়গায় কাজে মজুরি, কাজের শর্তাবলী নিশ্চিত করার চেষ্টা করবে। একটি শালীন জীবনযাত্রা, অবসর এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সুযোগের পূর্ণ উপভোগ এবং বিশেষ করে, রাজ্য গ্রামীণ এলাকায় ব্যক্তিগত বা সমবায় ভিত্তিতে কুটির শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রচেষ্টা চালাবে। [অনুবাদ সম্পাদকের]

সংবিধানের ৪৩ ধারা অনুসারে কর্মচারীদের জীবনের একটি শালীন মানের (a decent standard of life) জন্য বেতন/মজুরী ইত্যাদি দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্র/রাজ্যকে নিতে হবে। এবং এই বেতন ইত্যাদির কাঠামো কী হবে তা নির্ধারণ করার জন্যই  কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে (মোটামুটি দশ বছর অন্তর) পে কমিশন বসিয়ে তার অভিমুখ অনুযায়ী চলে। দেশের অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ ইত্যাদি কাজের জন্য প্ল্যানিং কমিশনের (নীতি আয়োগ) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, কিন্তু ফাইনান্স কমিশনের (অনুচ্ছেদ ২৮০) মতো প্ল্যানিং কমিশনের সংবিধানগত স্থান ও মর্যাদা নেই - যেমনটি নেই পে কমিশনেরও। তিনটিই সুপারিশকারী সংস্থা (recommendatory body)। এদের সুপারিশ সরকার কতটা গ্রহণ করবে তা একান্তই সরকারের সিদ্ধান্ত। তবে সাধারণভাবে দেখা যায় যে ফাইনান্স কমিশন ও পে কমিশনের অধিকাংশ সুপারিশ সরকার গ্রহণ করেছে।

মনে রাখা প্রয়োজন যে আমাদের সংবিধান চালু হওয়ার আগেই ১৯৪৬ সালের জানুয়ারি মাসে গঠিত হয় প্রথম পে কমিশন, এবং সরকারের সিভিলিয়ান কর্মচারীদের জন্য বেতনক্রম সুপারিশ সহ তার রিপোর্ট ১৯৪৭ সালের মে মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের বিবেচনার জন্য পেশ করা হয়। দ্বিতীয় পে কমিশন গঠিত হয় ১৯৫৭-এ এবং তার রিপোর্ট পেশ হয় দুই বছর পরে। পে কমিশনের এই ঐতিহ্য (কনভেনশন) ভারতীয় সমাজ অর্থনীতি রাজনীতির অঙ্গ রূপে নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করছে। জীবনযাত্রার মান অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে, এর মধ্যে প্রধান অবশ্যই মুল্যস্তর। পে কমিশনের বিচার্য বিষয়গুলির মধ্যে মূল্যস্তরের এই ভূমিকা থেকেই উদ্ভুত হয়েছে মহার্ঘ ভাতার ধারণা।

আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের বিশেষত্ব হল মুদ্রাস্ফীতি - প্রতি বছর মূল্যস্তরের বৃদ্ধি। এই পরিপ্রেক্ষিতকে মাথায় রেখেই পে কমিশন কোনো একটি নির্দিষ্ট দিন থেকে প্রযোজ্য বেতন কাঠামো নির্ধারণ করে। উক্ত নির্দিষ্ট দিনে বর্তমানে চালু (অসংশোধিত) বেতন কাঠামোতে যে পরিমাণ মহার্ঘ ভাতা প্রাপ্য তাকে যুক্ত করে বেতনক্রম নির্ধারিত হয়। যেমন, কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারীদের জন্য গঠিত সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ মেনে উক্ত বেতন কমিশন কার্যকরী হয় ১-১-২০১৬ থেকে। ঐ দিনে কেন্দ্রীয় কর্মচারীদের প্রাপ্য ১২৫ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা মূল বেতনের সঙ্গে যুক্ত করে সপ্তম বেতন কমিশন সংশোধিত বেতনক্রম নির্ধারণ করেছে। ১-১-২০১৬ তারিখে মূল্যস্তর থেমে থাকবে না, থাকেনি। তাই কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে এই বেতন কমিশন সুপারিশকৃত বেতনক্রম কার্যকরী থাকাকালে সরকার প্রতি বছর দু'বার (১লা জানুয়ারী ও ১লা জুলাই) তৎকালীন মূল্যস্তর বিবেচনা করে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে ১-১-২০১৬ তারিখে কার্যকর বেতনক্রমে কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষিত মহার্ঘ ভাতা শতাংশে নিম্নরূপঃ ১-৭-১৬-তে ২ শতাংশ, ১-১-১৭-তে ২ শতাংশ, ১-৭-১৭-তে ১ শতাংশ, ১-১-১৮-তে ২ শতাংশ, ১-৭-১৮-তে ২ শতাংশ, ১-১-১৯-এ ৩ শতাংশ, ১-৭-১৯-এ ৫ শতাংশ, ১-১-২১-এ ১১ শতাংশ, ১-৭-২১-এ ৩ শতাংশ, ১-১-২২-এ ৩ শতাংশ। করোনা সঙ্কটের জন্য ২০২০ সালে মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হয়নি। ১-১-১৬ থেকে নতুন বেতনক্রম চালু হওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকার ২০২২ পর্যন্ত মূল বেতনের ওপর ৩৮ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দিয়েছে। ইতিমধ্যে ২০২৩-এ আরও ৪ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে।

রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের জন্য ষষ্ঠ বেতন কমিশন কার্যকরী হয় ১-১-২০২০ থেকে। এই বেতন কমিশনের সুপারিশগুলি ওয়েবসাইটে নেই, যা আছে তা হল Notification on ROPA 19।

“The State Government of West Bengal accepted and implemented the recommendations of 6th Pay Commission including the Pay Matrix Table.

The Finance Department of WB issued notification on 25.9.2019 regarding the West Bengal Services (Revision of Pay and Allowance) Rules 2019 in detail.

WB ROPA Pay Scale 2019

WB Govt implemented the new pay scale structure called ‘Pay Matrix Table’ to its employees at par with Central Government employees. But the pay matrix level 1 has been fixed as Rs. 17,000 only, whereas in Central Govt Services fixed as Rs. 18,000.”

বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, রাজ্য সরকার ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশগুলি গ্রহণ করে ‘implemented the new pay scale structure called ‘Pay Matrix Table’ to its employees at par with Central Government employees…’। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের জন্য সপ্তম বেতন কমিশনের বেতন কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত মহার্ঘ ভাতা অংশ, যা মূল্যস্তর বৃদ্ধিনির্ভর, বছরে দু'বার দেয়। যেহেতু রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের বেতন কাঠামো কার্যকরী হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের সাথে সমহারে, উক্ত বেতনক্রমে মহার্ঘ ভাতা দেয় রূপে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিবেচনাভুক্ত হয়েছে। রাজ্য সরকারের পক্ষে মহার্ঘ ভাতা দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। এইসব কারণেই কোর্টের রায় মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পক্ষে গিয়েছে।

এমনিতেই এই রাজ্য সরকার তার কর্মচারীদেরকে দু'দিক থেকে বঞ্চিত করেছে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষেত্রে এই বেতনক্রম চালু হয়েছে ১২৫ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা যুক্ত করে ১-১-১৬ থেকে কিন্তু রাজ্য সরকার চালু করেছে ওই ১২৫ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা যুক্ত করে একই বেতনক্রমে তবে ১-১-২০২০ থেকে। বেতনক্রম নির্ধারণের সময় ষষ্ঠ কমিশন ২০১৬ থেকে ২০২০ সময়ে অসংশোধিত বেতন ক্রমে রাজ্যের কর্মচারীদের প্রাপ্য ৪৯ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা বিবচনায় আনেনি। এবং সংশোধিত বেতন ক্রমে প্রাপ্য (৩৪% - ২০২১-এর জানুয়ারিতে প্রদত্ত ৩%) ৩১% মহার্ঘ ভাতা না দিয়ে টালবাহানা চালিয়ে যাচ্ছে। রাজ্যের মা মাটি মানুষের সরকার ভুলে যাচ্ছে যে কেন্দ্রীয় সরকারী ও রাজ্য সরকারী কর্মচারীকে একই বাজার দরে কেনাকাটা করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়।

এই প্রসঙ্গে একটি বিতর্কের উল্লেখ না করে পারছি না। রাজ্য কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতার টাকা কি কেন্দ্রীয় সরকার দেয়? না, দেয় না। তবে কেন্দ্রীয় ফাইনান্স কমিশনের সুপারিশে রাজ্যকে দেওয়া অনুদান-সহায়তা মহার্ঘ ভাতা অন্তর্নির্মিত থাকে। কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশন কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়ে তা বিবেচনা করে রাজ্যের প্রাপ্য ঠিক করে। সরকারের মোট ব্যয়ের হিসাবে তাই মহার্ঘ ভাতা অন্তর্নিহিত রয়েছে এবং কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশন এভাবে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ধরে নিয়েই রাজ্যগুলির প্রাপ্য ঠিক করে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার বেশ কয়েক বছর কেন্দ্রীয় সরকার থেকে ভাল অঙ্কের ডেফিসিট গ্রান্ট পেয়েছে, এবং সেটা কিন্তু মহার্ঘ ভাতা বাধ্যবাধকতা ধরে নিয়েই। অর্থাৎ প্রত্যক্ষভাবে না হলেও, ডিএ-র দায় মেটাতে পরোক্ষভাবে কেন্দ্রীয় সাহায্য আসছে। ডিএ দেওয়ার নীতিগত দায়ও রাজ্য সরকার এড়াতে পারছে না।

প্রশ্ন তোলা হচ্ছে রাজ্য সরকারের অর্থনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে। কিন্তু এটাও ধোপে টেঁকার কথা নয়। যে সরকার দুর্গাপূজার কমিটিগুলিকে ঢালাও সাহায্য করে, কাটমানির প্রয়োজন মেটাতে নানা নামের 'সাথী' প্রকল্পে অকাতরে খরচ চালিয়ে যায়, পুরোহিত-মোয়াজ্জাম ভাতায়, অকারণ কোর্ট কেসে, মেলা, খেলা, জমজমাট প্রদর্শনীতে জলের মতো খরচ করে, তার পক্ষে আইনমাফিক ডিএ মেটানোর অক্ষমতা প্রমাণ করা কঠিন। খরচের বড়ো অংশ তো বাজেটেই ধরা থাকার কথা। ন্যায্য দাবি না মিটিয়ে ডিএ-র জন্য কর্মচারীদের আন্দোলনকে ‘ঘেউ ঘেউ’ বলে অভিহিত করার অসভ্যতার চরম মূল্য সরকারকে দিতে হবে।