আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২৩ ● ১৬-৩০ চৈত্র, ১৪২৯
প্রবন্ধ
মহার্ঘ্য ভাতা, দুষ্প্রাপ্য ভাতা
অর্ধেন্দু সেন
রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ডিএ সংক্রান্ত মামলার স্যাট-এ শুনানি হয় ২০১৭ সালে। কর্মচারীরা চায় পঞ্চম বেতন কমিশনের ২০০৯ সালের সুপারিশ অনুযায়ী সরকারের স্বীকৃত হারে ডিএ। ট্রাইব্যুনাল কর্মচারীদের আবেদন খারিজ করে বলে ডিএ পাওয়া কর্মচারীদের অধিকারের মধ্যে পড়ে না। মালকিন না দিলে কিছু করার নেই। একই কথা হয়তো বলা যেত বেতন সম্বন্ধেও। ভাগ্যিস কর্মচারীদের তরফে সে প্রশ্ন তোলা হয়নি।
তাঁর তো সবদিক দেখতে হয়। উন্নয়ন আছে। পুজো আছে। পারলে নিজেই দেবেন। কিন্তু তাঁকে কি বাধ্য করা যায় দিতে? কেন্দ্র দিচ্ছে বটে ৩৬ শতাংশ। রাজ্য দিচ্ছে ৩ শতাংশ। তফাত অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু কেন্দ্র দরকার হলে নোট ছাপাতে পারে। রাজ্য কি পারে?
সরকারি কর্মচারী কত মাইনে পাবেন, কত ভাতা পাবেন তা ঠিক করার অধিকার অবশ্যই মন্ত্রীসভার। মুখ্যমন্ত্রী মন্ত্রীসভার নেত্রী। মন্ত্রীসভার অধিকার প্রয়োগ করতে হয় তাঁকেই - কিন্তু কিছু নিয়ম মেনে, কিছু প্রথা মেনে। যেহেতু টাকাপয়সার ব্যাপার তাই অর্থমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া কোনও পদক্ষেপ করার প্রশ্ন ওঠেনা। আমরা যখন দেখি মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া চিরকুট পড়ে অর্থমন্ত্রী ৩ শতাংশ ডিএ বাড়িয়ে দিলেন তখন বুঝতে অসুবিধা হয়না এটা সাজানো ঘটনা। ইদানীং প্রশাসন খুব ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। সিস্টেম টিস্টেম কিছুই নয়। মুখ্যমন্ত্রীই সব। জনসাধারণকে এই সহজ সত্যটি বোঝাতে মাঝেমধ্যে নাটকীয় এবং নির্লজ্জ প্রচার দরকার হয়ে পড়ে।
চিরকাল কিন্তু এমন ছিল না। পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়ে প্রথম গবেষণা করেন জার্মান মনিষী ম্যাক্স ওয়েবার। তিনি বলেন ব্যুরোক্রেসির যত দোষই থাকুক না কেন তার বৈশিষ্ট্য হল যৌক্তিকতা। প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত কোনও ব্যক্তির মর্জিমাফিক হয় না। সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নিয়েই হয় সিদ্ধান্ত। সবার মতামত নিতে সময় লাগে। তাই দীর্ঘসূত্রিতা ব্যুরোক্রেসির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। তাতে বদনাম কম হয়নি কিন্তু লাভও যে হয়েছে তা আজ রাজ্যে ও কেন্দ্রে 'কর্তার ইচ্ছায় কর্ম'দেখলে পরিষ্কার বোঝা যায়।
ব্যুরোক্র্যাট সাধারণত একজন জেনেরালিস্ট। তিনি কোনও বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন। অথচ আজকের দিনে বিশেষজ্ঞদের মতামত ছাড়া কম প্রশ্নেই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়। ব্যুরোক্রেসিতে তাই বিশেষজ্ঞের মতামত নেবার পাকা বন্দোবস্ত আছে। কর্মচারীদের বেতনক্রম ঠিক করতে প্রতি ক্ষেত্রেই পরামর্শ নেওয়া হয় 'বেতন কমিশনের'। এমন নয় যে কমিশন যা বলবে তাই কার্যকর করতে হবে। কমিশনের অনেক সুপারিশ গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। কিন্তু কোনও সরকার কমিশনকে বাদ দিয়ে বেতনকাঠামো ঠিক করবে না। কমিশনের কোনও বক্তব্য না মানতে হলে কেন মানা যাচ্ছে না সেই যুক্তিসহ বিষয়টি ক্যাবিনেটে নিয়ে যেতে হবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য।
কর্মচারীদের ডিএ-র প্রশ্ন খতিয়ে দেখা হয়েছিল পঞ্চম বেতন কমিশনে। কমিশন ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সুপারিশ করে ডিএ-র হারে কেন্দ্র-রাজ্যের তফাত রাজ্য সরকার পূর্ণ করুক এবং তারপর কেন্দ্রের মতো বছরে দুইবার মূল্যসূচক দেখে বাড়তি ডিএ-র অনুমোদন দিক। এভাবে কর্মচারীদের বহুদিনের ন্যায্য দাবি পূর্ণ হবে। কমিশন কি সরকারের সামর্থ্য না দেখে এই সুপারিশ করে? না। সব দিক দেখেই করা হয় সুপারিশ। সরকার কি বিবেচনা করে এই সুপারিশ নাকচ করেছে? ক্যাবিনেট কি সেই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে? তা তো করেইনি উল্টে ক্যাবিনেট এই সুপারিশ মেনে নিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী হয়তো ভাবছেন সে তো আমার ক্যাবিনেট ছিল না। আমার বেতন কমিশন ছিল না। তাদের সিদ্ধান্ত বা সুপারিশ আমি মানব কেন? প্রশাসনের ধারাবাহিকতা বোধহয় উনি এখনও মেনে নিতে পারেননি।
প্রশাসনের এক্তিয়ার
প্রশাসনে এক্তিয়ারের ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পঞ্চায়েত নির্বাচনে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। কমিশন ঠিক করে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বুথে এবং বাইরে কত পুলিশ মোতায়েন করা দরকার। রাজ্য পুলিশ হলেই চলবে, না-কী কেন্দ্রীয় বাহিনী আনতে হবে? এ প্রশ্নও কমিশনের এক্তিয়ারভুক্ত। সাধারণ মানুষ আদালতে গিয়ে হাজার মাথা খুঁড়লেও কাজ হবে না। কিন্তু কমিশন নিজে যদি কোর্টে বলে কেন্দ্রীয় বাহিনী দরকার, আদালত সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা করে দেবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কয়েক বছর হল পুজোয় মোটা টাকার অনুদান দেওয়া শুরু করেছেন। গত বছর ৪৩,০০০ পুজোয় ৬০,০০০ টাকা করে মোট ২৫০ কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। আদালতে এ সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করা হয়।
আদালতের এক্তিয়ার
শিক্ষিত মানুষ মাত্রেই বুঝবেন এ হল জনসাধারণের টাকার অপচয়। আদালত কিন্তু হস্তক্ষেপ করেনি। তার কারণ এই নয় যে উচ্চ আদালত এ ধরনের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে। কিন্তু কোনও সংস্থা নিজের অধিকারের মধ্যে থেকে সিদ্ধান্ত নিলে আদালত হস্তক্ষেপ করে না। নাহলে আদালতকেই সরকার চালাতে হয়। ডিএ মামলা উচ্চ আদালতের দুটো বেঞ্চ শুনেছে। আদালত মনে করেছে বেতন কমিশনের মতো বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ মেনে যে সিদ্ধান্ত তাতে আদালত হস্তক্ষেপ করবে না। উচ্চ আদালত মনে করেছে আইন অনুযায়ী নেওয়া এই সিদ্ধান্তের ফলে পঞ্চম বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বেতন পাওয়া কর্মচারীদের অধিকার।
রাজ্য সরকারের সামর্থ্য অবশ্যই দেখতে হবে এবং আমরা ধরে নেব পঞ্চম বেতন কমিশন তা দেখেই সুপারিশ করেছে। পরিস্থিতি জটিল করেছেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। একদিকে নিজের জন-দরদী ইমেজ উজ্জলতর করতে একের পর এক প্রকল্প হাতে নিয়েছেন খরচের হিসেব না করে। এর মধ্যে এসেছে পুজো কমিটিদের ঢালাও অনুদান। স্রেফ ভোট কেনার জন্য বছরে ২৫০ কোটি টাকা খরচ! ভাবা যায়! যে মুখ্যমন্ত্রী এভাবে টাকার নয়ছয় করছেন তিনি ডিএ দেবার বেলায় অর্থাভাবের কথা বলেন কী করে? সরকারের বোঝা কমাবার জন্য অনেক ফরমুলা দেওয়া যেতে পারে। আমরা আগে দেখেছি বকেয়া টাকা প্রভিডেন্ট ফান্ডে ঢুকে গেছে। অবসর নেবার সময়ে দেওয়া হয়েছে। একদিকে মোহনবাগানকে মিষ্টি খাবার জন্য ৫০ লাখ টাকা দেব, অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী অবলীলায় বলেন তাঁর নিজের কর্মচারীদের ডিএ দেব না। একথা শোনার পর মনে হয় না মন্ত্রিসভা বা প্রশাসনের এই বিষয়ে সমাধান সূত্র খোঁজবার কোনো আগ্রহ আছে।
সরকারের অর্থাভাব
সরকারের অর্থের অভাব হল কেন? সরকারি বিবৃতি অনুযায়ী বাম সরকার যে টাকা ধার করেছিল বর্তমান সরকারকে তা ফেরত দিতে হচ্ছে। তার সুদ গুণতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, সরকার উন্নয়নমূলক প্রকল্পে বহু টাকা খরচ করছে।
যুক্তি দুটো ধোপে টেকেনা। কারণ দেশের যেসব রাজ্যে উন্নয়নে খরচ বেশি সে রাজ্যগুলিতে ডিএ-র হারও বেশি। একই পরিস্থিতি সেইসব রাজ্যে যেখানে সরকারি ঋণের পরিমাণ বেশি। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে, ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষমতা থাকলে, এগুলি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় না।
তৃতীয় যে কারণ মাঝে মধ্যে শোনা যাচ্ছে তা হাস্যকর। বলা হচ্ছে কেন্দ্র বিপুল পরিমাণ টাকা বাকি রাখাতে সরকার ডিএ দিতে পারছে না। কিন্তু কেন্দ্র বিভিন্ন কারণে - বিশেষ করে দুর্নীতির অভিযোগে - যে টাকা আটকে রেখেছে তা নির্দিষ্ট স্কিমের টাকা। সেই টাকায় ডিএ হবে একথা সজোরে বললে, সেই টাকা কোনোদিন পাওয়া যাবে!
আজ পর্যন্ত বিভিন্ন আদালত ছ'বার নির্দেশ দিয়েছে কর্মচারীদের প্রাপ্য ডিএ মিটিয়ে দিতে। সরকার সে নির্দেশ কার্যকর করেনি। মুখ্যসচিব ও অর্থসচিবের নামে আদালত অবমাননার নোটিস হয়েছে। সরকার নিজস্থানে অটল রয়েছে। একবারই ট্রাইব্যুনালের রায় সরকারের পক্ষে গিয়েছিল কিন্তু উচ্চ আদালত বিস্তারিত আলোচনায় দেখিয়েছে সে রায় ভুল ছিল। শুধুমাত্র বেতন কমিশনের সুপারিশ হলে কর্মচারীদের কোনও অধিকার জন্মায় না সেকথা ঠিক। কিন্তু সেই সুপারিশ মেনে নেবার পরে সরকার তা কার্যকর করতে বাধ্য। উচ্চ আদালতের এই ব্যাখ্যার পরে এই বিষয়ে তর্ক শেষ হয়ে যাবার কথা।
এখন শেষ কথা বলবে সুপ্রিম কোর্ট।