আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২৩ ● ১৬-৩০ চৈত্র, ১৪২৯

সমসাময়িক

কৃষক মহাযাত্রা - কিছু কথা


মহারাষ্ট্র এবং দেশ আবারও সাক্ষী হল একটি কৃষক মহাযাত্রার। বিগত ১২ই মার্চ মহারাষ্ট্রের নাসিক জেলার দিনদরি থেকে প্রায় ১০ হাজারের মত আদিবাসী, মহিলা ও অন্যান্য কৃষকদের নিয়ে সর্বভারতীয় কৃষক সভার নেতৃত্বে শুরু হয় এই মহাযাত্রা মুম্বই শহরের উদ্দেশ্যে। লাগাতার ৬ দিন যাত্রা চলার পর যাত্রা যখন মুম্বই-এর উপকন্ঠে এসে পৌঁছায় তখন রাজ্যের শিবসেনা-বিজেপি সরকার তড়িঘড়ি কৃষক নেতাদের সাথে আলোচনায় বসেন ও কৃষকদের ১৫ দফা দাবির সবকটিই মেনে নিতে বাধ্য হয়। তবে সংগ্রামী কৃষকরা সরকারের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসে বিভ্রান্ত হননি। তারা লাগাতার থানে জেলার ভাসিন্দে অবস্থান চালিয়ে যান এবং বিধানসভায় সরকার প্রস্তাবনা করে লিখিতভাবে দাবিগুলি মেনে নেওয়ার পরেই তারা আন্দোলন প্রত্যাহার করেন। মহারাষ্ট্রের সংগ্রামী কৃষকেরা তাদের দাবি আদায় করেই ছেড়েছেন। নয়া কৃষি আইন বাতিলের সফল আন্দোলনের পর আরও একবার দেশের কৃষকরা লড়াই করে নিজেদের দাবি আদায় করেছেন বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে। নিঃসন্দেহে এ এক আশার আলো।

যদিও এবারের কৃষক যাত্রা শুরু হয়েছিল ন্যূনতম প্রস্তুতিতে। এর আগে মহারাষ্ট্রে কৃষক সভার নেতৃত্বে আরও দুটি এরূপ মহাযাত্রা হয় ২০১৮ ও '১৯ সালে। ২০১৮-র কৃষক মহাযাত্রা তো গোটা দেশজুড়ে আলোড়ন তৈরী করে। সে'বার প্রায় ৭০ হাজার কৃষক অংশ নিয়েছিলেন সেই যাত্রায়। কিন্তু এবারের যাত্রার প্রস্তুতি ছিল এক সপ্তাহেরও কম। মূলত তাৎক্ষণিকভাবে যাত্রা শুরু হয় কারণ হঠাৎ করেই মহারাষ্ট্র জুড়ে পেঁয়াজের দামে পতন দেখা দেয়। পেঁয়াজের অভাবী বিক্রি ঠেকাতে এবং কৃষকরা যাতে ক্ষতির সম্মুখীন না হন তাই তৎক্ষণাৎই কৃষক সভার নেতৃত্বে শুরু হয় এই যাত্রা। যাত্রার মূল জমায়েত করেন আদিবাসী যুবক ও মহিলারা। সংগ্রামী কৃষকরা লাগাতার ৬ দিন হেঁটেছেন নিজেদের দাবিতে। চলতে চলতে রাস্তায় যুক্ত করেছেন আরও দাবি। শুধু কৃষকদের দাবিই নয়, সমাজের অন্য অংশের মানুষের অধিকারের দাবিও উঠে এসেছে কৃষকদের দাবি সনদে। বাজপেয়ী জমানার লাগু করা নয়া পেনশন প্রকল্প বাতিল করে পুরনো পেনশন প্রকল্প চালু করার মত দাবিও তারা তুলেছেন। হয়ত এ দাবি তাদের নিজেদের দুঃখ দুর্দশার বোঝা কমাবে না কিন্তু সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে তারা সরকারি কর্মচারীদের ন্যায্য দাবির জন্য আওয়াজ তুলেছেন। তাদের সেই দৃপ্ত মিছিল চকিত করেছে দেশের তাবড় সংবাদমাধ্যমকে। মোদি ভজনা থেকে সাময়িক হলেও দেশের কৃষকদের দিকে সংবাদমাধ্যমের নজর ঘোরাতে বাধ্য করেছে। মারাঠি সংবাদমাধ্যম শিরোনাম করেছে 'লাল বাদল' (লাল ঝড়)। আর এটাই এই কৃষক যাত্রার অন্যতম সাফল্য। মেহনতী মানুষের সাথী যে কেবল লাল ঝান্ডা - এই কৃষক যাত্রা আবারও তা মনে করিয়ে দিল।

যে দাবিগুলি কৃষকরা আদায় করতে পারলেন তার মধ্যে প্রধান দাবিটি ছিল পেঁয়াজের অভাবী বিক্রি বন্ধ করতে সরকারের হস্তক্ষেপ। তারা সরকারকে বাধ্য করতে পেরেছেন কৃষককে কুইন্টাল পিছু ৩৫০ টাকার ভর্তুকি দিতে। শুধু তাই নয়, যেহেতু এই দাম বছরভর বাড়া কমা হতেই থাকে তাই রাজ্যের সরকার যাতে কেন্দ্রের সাথে আলোচনা করে একটি স্থায়ী নীতি গ্রহণ করে সেই আশ্বাসও তারা আদায় করে ছেড়েছেন। এর পাশাপাশি বনের অধিকার আইনের যথাযথ প্রয়োগ যাতে হয়, আদিবাসী কৃষকরা যাতে বনাঞ্চলে আইন মোতাবেক কৃষিজমি পান এবং তা যেন কৃষকের নামে নথিভুক্ত হয় সেই দাবিও আদায় করা গিয়েছে। এমনকি দেবোত্তর জমিতেও চাষের অধিকার ও পাট্টার দাবি আদায় করেছেন কৃষকরা। ১২ ঘন্টার অবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, বকেয়া বিদ্যুৎ বিল মকুব, কৃষিঋণ মকুব সহ প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার বরাদ্দ যাতে বাড়িয়ে ৫ লক্ষ টাকা অবধি করা যায় সেই দাবিও আদায় হয়েছে। এর পাশে কৃষকরা অঙ্গনওয়ারী কর্মীদেরও সরকারি বেতনক্রমের আওতায় আনার দাবি পূরণ করতে পেরেছেন। ফসলবিমা থেকে সেচ, পেনশন থেকে বার্ধক্যভাতা সহ মোট ১৫টি দাবি এই সংগ্রামী কৃষকরা আদায় করে তবেই বাড়ি ফিরেছেন। নিঃসন্দেহে এ এক বিরাট জয়। পাশাপাশি অন্য রাজ্যের কৃষকদের কাছেও এক উদাহরণ হয়ে উঠবে এই মহাযাত্রা। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যে যেখানে অভাবী বিক্রি এখন প্রায় রোজনামচা, ঋণের দায়ে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা হামেশাই ঘটছে এবং এক উদাসীন রাজ্য সরকার শুধু মেলা, খেলা আর তোলা নিয়ে ব্যস্ত সেই রাজ্যের কৃষকদের কাছে এই মহাযাত্রা এক দৃষ্টান্ত তো বটেই।

মহারাষ্ট্রের কৃষকদের এই মহাযাত্রা এ রাজ্যের কৃষকদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহাযাত্রার দাবিসনদগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে এই দাবিগুলোর অনেকগুলোই এ রাজ্যের কৃষকদের দাবিও বটে। এ রাজ্যে আদিবাসীদের বনাঞ্চল অধিকার আইনের সুবিধা মেলে না। দেউচা পাঁচামির জমি অধিগ্রহণের সময়েই এই আইন যে মানা হয়নি তা প্রকাশ হয়েছে। এ রাজ্যের কৃষকরা প্রায় প্রতিটি মরশুমেই কিছু ফসলের অভাবী বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। স্থানীয় স্তরে রাস্তায় ফসল ফেলে দিয়ে কৃষকরা প্রতিবাদও করেছেন কিন্তু তা সংগঠিত আকার নেয়নি। রাজ্যের সরকার ফসল কেনা থেকে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে, গ্রামাঞ্চলে বার্ধক্যভাতা, পেনশন কতটা গরীব মানুষ পান আর তার কত অংশ তৃণমূলের নেতা কর্মীদের ভাগে যায় প্রতিটি ভুক্তভোগী মানুষই জানেন। যে রাজ্যে বিগত ১ বছরে ১ কোটির ওপর রেশন কার্ড বাতিল হয়েছে। কিন্তু তা নিয়ে বড় কোন আন্দোলন দানা বাঁধেনি। এ রাজ্যে অঙ্গনওয়ারী কর্মীদের কোন বেতনক্রম নেই। এরকম আরও ভুড়ি ভুড়ি উদাহরণ দেওয়া যায় গরীব কৃষিজীবী ও মেহনতী মানুষের বঞ্চনার। কিন্তু সেই বঞ্চনার দাবি নিয়ে সদর্থক আন্দোলন কোথায়?

এই কৃষক আন্দোলন এ রাজ্যের বামপন্থীদের কাছেও এক দৃষ্টান্ত হওয়া উচিত। একথা ঠিক যে সংবাদমাধ্যম রাজ্যের রাজনীতিকে তৃণমূল ও বিজেপির লড়াই হিসাবেই তুলে ধরতে চায়। এ রাজ্যের বামপন্থীদের তা নিয়ে ক্ষোভ আছে। কিন্তু একথা তাঁদেরও বুঝতে হবে বামপন্থাকে প্রচার করার দায় সংবাদমাধ্যমের নেই। যদি রাজ্যের রাজনীতিতে বামপন্থীদের প্রাসঙ্গিক হতে হয় তবে লড়াইয়ের ময়দানে তাঁদের প্রাসঙ্গিক হতে হবে। আন্দোলন কোন কর্মসূচী নয়, বরং তা বামপন্থীদের পরিচয়। রাজ্যের গরীব মেহনতীর দাবি আদায় করে আনা বামপন্থীদের দায় এবং কর্তব্যও বটে। কিন্তু তার বদলে যদি তাঁরা আন্দোলনকে তাদের একটি সাংগঠনিক ক্রিয়া হিসাবে গন্য করতে থাকেন তাহলে রাজনীতির ময়দানে তারা কেবল নিজেদের কবরই খুঁড়বেন না, বরং গরীব মানুষের বিশ্বাসও হারাবেন। এ রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন আসন্ন। অথচ এখনো এ রাজ্যের বামপন্থীরা গ্রামের মানুষের দাবি আদায় তো দূর, একটি ব্যাপক আন্দোলন অবধি গড়ে তোলার প্ৰয়োজনীয়তা বোধ করলেন না। বিজেপি তৃণমূলের বাইরে যদি রাজ্যের রাজনীতিতে কোন শক্তিকে প্রাসঙ্গিক হতে হয় তবে রাজ্যের কৃষক ও গ্রামীণ শ্রমজীবীদের দাবি নিয়ে একটি ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলতেই হবে। কেবল অর্থনৈতিক দাবি নয়, সামাজিক ন্যায়ের দাবিও যুক্ত করতে হবে। গ্রামীণ সমাজের প্রান্তিক অংশের সাথে যুক্ত হয়ে এই কৃষক মহাযাত্রার মত আন্দোলন যদি গড়ে তোলা যায় তবেই এর জোরে রাজনীতিতে বামপন্থীরা আবার জায়গা খুঁজে পাবেন। প্রচারের আলো আপনিই তাঁদের ওপর এসে পড়বে। দরকার শুধু সদিচ্ছা ও লড়াই করার জেদ।