আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২৩ ● ১৬-৩০ চৈত্র, ১৪২৯

সমসাময়িক

উচ্চশিক্ষার নয়া ফরমান


রাজ্যে শিক্ষা দুর্নীতির আবহে আর একটি সংবাদ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। গত ১৭ই মার্চ রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দপ্তর হঠাৎই এক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জানায় যে আগামী শিক্ষাবর্ষে, যা কিনা আগস্ট মাসে শুরু হবে, রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ৪ বছরের স্নাতক পাঠক্রম চালু করতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে কেবল নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনুদান ও অনুপ্রেরণায় বিশ্বাসী রাজ্য সরকার তথা তৃণমূলের শিক্ষামন্ত্রী ও দপ্তর হঠাৎ শিক্ষাদানে বিপ্লব আনতে কেন উদ্যোগী হয়েছে তা এক ভাবনার বিষয় বটে। তবে যা বোঝা যাচ্ছে তা হল এই নির্দেশিকা বিগত ডিসেম্বর মাসে ইউজিসি কর্তৃক প্রকাশিত এক খসড়া শিক্ষানীতির প্রয়োগ। ডিসেম্বর মাসের ওই খসড়ায় ইউজিসি দেশের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ৪ বছরের স্নাতক পাঠক্রম চালু করার সুপারিশ করে।

বলা বাহুল্য এই নির্দেশ ২০২০ সালের নয়া শিক্ষানীতির নির্দেশ ও সুপারিশ অনুযায়ী তৈরী করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল নিজেকে বিজেপি বিরোধী প্রমাণে মরিয়া মাননীয়া হঠাৎ আগ বাড়িয়ে রাজ্য সরকার পোষিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কেন নয়া শিক্ষানীতি প্রয়োগ করতে তৎপর হয়ে উঠল। ঘনঘন সিবিআই-ইডি হানা আর তৃণমূলের নেতাদের জেলে ঢোকার সাথে এই তৎপরতার কোন যোগাযোগ আছে কিনা তা তর্কসাপেক্ষ, তবে একথা নিশ্চিত যে রাজ্যের মন্ত্রী বা আমলারা এই নির্দেশিকা পালনে কি সর্বনাশ ডেকে আনছেন তা প্রকাশ হওয়া দরকার। যদিও শিক্ষকমহল প্রতিবাদ করায় সরকার খানিক ঢোক গিলে একটি কমিটি খাড়া করেছেন এবং সেই কমিটিকে এই নির্দেশিকা পালনের বাস্তবতা বিচার করার ভার দিয়েছেন। যদিও সেই গঠিত কমিটি নিয়েও একাধিক প্রশ্ন ওঠে গিয়েছে। যেমন এই কমিটির একাধিক সদস্য রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য কেন? রাজ্যের অন্যতম বৃহৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন প্রতিনিধি সেই কমিটিতে নেই কেন ইত্যাদি। যদি ধরেও নেওয়া যায় যে রাজ্যের সরকারের সদিচ্ছার প্রকাশ এই কমিটি তাহলেও একটি প্রশ্ন জাগে যে রাজ্য সরকার কি আদৌ বুঝছেন কি সর্বনাশ তারা ডাকতে চলেছেন?

ইউজিসি-র নয়া নির্দেশিকা বলছে যে এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ৪ বছরের স্নাতক পাঠক্রম চালু করতে হবে যেখানে একজন ছাত্র বা ছাত্রী একাধিকবার পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্তি বা ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে। অর্থাৎ তারা বলছেন যে যদি কোন ছাত্র ১ বছর পড়ে ছেড়ে যায় তাহলে তাকে একটি শংসাপত্র দিতে হবে। যদি সে দ্বিতীয় বছরে ছেড়ে যায় তাহলে তাকে 'ডিপ্লোমা' শংসাপত্র দিতে হবে। ৩ বছরের পূর্ণ করার পর ছেড়ে দিলে তাকে 'স্নাতক পাশ' স্বীকৃতি দেওয়া হবে। কেউ যদি ৪ বছর সম্পূর্ণ করে তাহলে তাকে 'সাম্মানিক স্নাতক' স্বীকৃতি দেওয়া হবে। যে সব ছাত্রছাত্রী পাঠক্রমের শেষ বছরে কোন গবেষণার কাজ শেষ করবে তাদের 'গবেষক স্নাতক' স্বীকৃতি প্রদান করা হবে। স্নাতকোত্তর-এর পড়াশোনা ২ বছরের হবে যেখানে দ্বিতীয় বছরটি সম্পূর্ণভাবে গবেষণামূলক কাজের জন্য বরাদ্দ হবে তাদের জন্য যারা স্নাতক স্তরে ৩ বছর পড়ে আসবেন। যারা ৪ বছর গবেষণাসহ স্নাতক করে আসবেন তারা ১ বছর পড়লেই স্নাতকোত্তর ডিগ্রী পাবেন। পুরোদস্তুর গবেষণা পাঠক্রমে আসতে গেলে হয় ২ বছরের স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অথবা ৪ বছরের গবেষণাসহ স্নাতক ডিগ্রী থাকতে হবে। এর সাথেই ছাত্রছাত্রীদের বিশ্ব নাগরিক হয়ে ওঠার, আন্তঃবিষয়ক গবেষণা করার, অন্য প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষানবিশির কাজ করার মত আরও গালভরা উপদেশও দেওয়া হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পারদর্শী হওয়ার পাশাপাশি, ভারতের ঐতিহ্য, শিক্ষাধারা, চারুকলা থেকে বাণিজ্য সবেতেই যাতে দেশের ছাত্রছাত্রীরা পারদর্শী হয়ে উঠতে পারে সেই লক্ষ্যেই এই নির্দেশিকা বলে ইউজিসি দাবি করেছেন।

প্রশ্ন হল এই সংস্কার কি একেবারেই নতুন? নতুন নির্দেশিকা অনুযায়ী স্নাতক ডিগ্রী পেতে ন্যূনতম ৩ বছর সময় লাগছে। বর্তমানে চালু পাঠক্রমেও একজনকে স্নাতক (সাম্মানিক বা সাধারণ) ডিগ্রী পেতে গেলে ৩ বছরই লাগে। তাহলে প্রথম ৩ বছরে নয়া নির্দেশিকা অনুযায়ী ছাত্রছাত্রীদের সময়গত দিক থেকে কোন লাভ নেই। চতুর্থ বছরে যে গবেষণামূলক কাজের কথা বলা হয়েছে সেটা সংযোজন হলেও সেই ছাত্র বা ছাত্রীকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী সম্পুর্ণ করতে হলে আরও ১ বছর স্নাতকোত্তর পাঠক্রমে পড়তে হবে। তাহলে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী পেতে নতুন নির্দেশিকা অনুযায়ী ৫ বছরই লাগবে। এক্ষেত্রেও আলাদা কোন সুবিধা নয়া নির্দেশিকা হাজির করছে না। চালু শিক্ষাধারাতেও স্নাতকোত্তর স্তরের শেষ বছর সাধারণত প্রজেক্ট বা গবেষণামূলক কাজের জন্যই বরাদ্দ থাকে। গবেষণামূলক কাজ একজন স্নাতকস্তরের ছাত্রের চেয়ে স্নাতকোত্তর স্তরের ছাত্রের পক্ষে করা অপেক্ষাকৃত সহজ কারণ স্নাতকোত্তর স্তরে ১ বছর ছাত্রছাত্রীরা একটি বিষয়ে আর একটু বিশদে শেখার সুযোগ পায়। তাহলে এই নতুন নির্দেশিকার তফাৎটা কোথায়?

আসলে এই নয়া নির্দেশিকার আড়ম্বরের মাঝে যে সারবত্তাটি গুঁজে দেওয়া গেছে তা হল ড্রপআউট বা শিক্ষার আঙিনা থেকে বেরিয়ে যাওয়াকে স্বীকৃতি দিয়ে ভারমুক্ত হওয়ার চেষ্টা। ১ বা ২ বছরের মাথায় যদি ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা ছাড়তে বাধ্য হয় তাহলে তাকে চালু ব্যবস্থায় ড্রপআউট হিসাবে গন্য করা হয়। কিন্তু নতুন ব্যবস্থায় তার হাতে একটা শংসাপত্র ধরিয়ে সরকার দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। এটা সাধারণ বুদ্ধিতে বোঝা যায় যে কোন পড়ুয়া স্নাতক স্তরে ভর্তি হয়ই সেই পাঠক্রম শেষ করার মনোবাসনা নিয়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা পড়াশোনা ছাড়তে বাধ্য হয় আর্থিক কারণে। সরকারের এটা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে একজন পড়ুয়ার পাঠক্রম যাতে শেষ হয় তার ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তা দান করা। কিন্তু তার বদলে যদি তার অসহায়তাকে স্বীকৃতি দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তাতে পড়ুয়ার কোন লাভ হয়না, বরং সরকারের দায় খালাস হয়। আর সেটাই এই নয়া নির্দেশিকার মূল উদ্দেশ্য। 

এছাড়াও এ প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক যে খসড়া নির্দেশিকাতে যে বৈচিত্র্য গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে তার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়ে তোলার সদিচ্ছা কোথায়? দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র শিক্ষক অনুপাত জাতীয় স্তরে ২৪:১ আর এ রাজ্যে তা প্রায় ৩০:১। ফলে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সংখ্যা অপ্রতুল। এ রাজ্যের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্থায়ী শিক্ষকের সংখ্যা বহু ক্ষেত্রেই নগন্য, এমনকি বেশ কিছু কলেজে কোনো কোনো বিভাগে মাত্র একজন স্থায়ী শিক্ষক আছেন। রাজ্যের সরকার যদিও কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কতগুলি শিক্ষক পদ শূন্য আছে তার স্পষ্ট পরিসংখ্যান প্রকাশ করে না, কিন্তু কর্মরত সমস্ত অধ্যাপকরাই এই বিষয় সম্পর্কে অবগত। তাহলে প্রশ্ন আসে যে ইউজিসির এই নয়া ফরমান অনুযায়ী এক একটি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাত্রছাত্রীদের পছন্দমত একাধিক বিষয় পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে যা কার্যত অসম্ভব বর্তমান পরিকাঠামোয়। পাশাপাশি বিজ্ঞানের বিষয়গুলিতে ল্যাবরেটরির সংস্থানও করতে হবে। আগামী শিক্ষাবর্ষে, যা কিনা মাত্র কয়েক মাস পরেই শুরু হবে, কিভাবে এই নির্দেশিকা বাস্তবায়িত করা সম্ভব? রাজ্যের শিক্ষা দপ্তরের মন্ত্রী বা আমলারা কি আদৌ এসব ভেবেছেন? 

এই ব্যবহারিক অসুবিধার পরেও যে আশঙ্কা থেকে যায় তা হল দেশের সরকার যেখানে প্রতিনিয়ত শিক্ষার ব্যয়ভার কমাতে চাইছে সেখানে এরকম বিশদ, বৈচিত্র্যময় ব্যবস্থা সরকারি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পক্ষে রক্ষা করা কি আদৌ সম্ভব? কীভাবে স্বল্পসংখ্যক শিক্ষকদের নিয়ে এই বহুমুখী প্রকল্প রূপায়ন হবে? নাকি এ একটা চক্রান্ত সরকারি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে লুপ্ত করে দেওয়ার? এটা খুব সহজেই বোঝা যায় যে এই নির্দেশিকাকে পাকাপাকি একটা মাপকাঠি করে দেওয়া হলে আর্থিকভাবে দুর্বল রাজ্যের কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিছিয়ে পড়তে থাকবে। আর তারপর সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে যে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হবে না কে বলতে পারে। ফলে এই নির্দেশিকার নির্যাস হল শিক্ষা কেবল বিত্তবানদের হাতে কুক্ষিগত হবে এবং দেশের গরীব ছেলেমেয়েরা ক্রমেই উচ্চশিক্ষার থেকে দূরে সরতে থাকবে। শিক্ষার অধিকার সংকুচিত হবে। এ রাজ্যের সরকারও এই একই পথের শরিক হতে চাইছে। এ রাজ্যের শিক্ষক সমাজ প্রতিবাদ করেছেন। রাজ্যের সাধারণ মানুষের আজ কর্তব্য এই লড়াইয়ে পাশে থাকা।