আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২৩ ● ১৬-৩০ চৈত্র, ১৪২৯
সম্পাদকীয়
চোপ! গণতন্ত্র চলছে!
গণতন্ত্র শব্দটির নানা পরিভাষা আছে। ভোট দিয়ে দেশের প্রধানকে নির্বাচিত করা গণতন্ত্রের একটি শর্ত, একমাত্র শর্ত নয়। অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের মতে গণতন্ত্রের অর্থ হল মতবিনিময় ও আলোচনার মাধ্যমে সরকার পরিচালনা করা - Government by discussion। অর্থাৎ পাঁচ বছর পর পর ভোট দেওয়ার মানেই গণতন্ত্র সুরক্ষিত রয়েছে এমন নয়। প্রশ্ন হল, দেশের মানুষ কি নিজেদের মনের কথা বলতে পারছে? বিরোধী দলগুলি কি বিনা বাধায় তাদের মত প্রকাশ করতে পারছে? সংবাদমাধ্যম কি নিরপেক্ষ এবং নির্ভীকভাবে মানুষের কাছে খবর পৌঁছিয়ে দিতে পারছে? নাগরিক সমাজ কি মুক্তভাবে সরকারের সমালোচনা করতে পারছে? সংসদে বিরোধী দলগুলি তাদের কথা কি নির্দ্বিধায় বলতে পারছে?
প্রিয় পাঠক, চোখ বন্ধ করে উপরের প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজুন। বর্তমান ভারতের ক্ষেত্রে এই প্রত্যেকটি প্রশ্নের জবাবে যেকোনো সুস্থ মানুষের উত্তর হবে - না। এই সম্পাদকীয় কলামে বহুবার আমরা ভারতের গণতন্ত্রের নিম্নগামী মান নিয়ে আলোচনা করেছি। কাজেই প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর নতুন করে আমরা খুঁজব না। এই সম্পাদকীয় লেখার মূল উদ্দেশ্য আবার নতুন করে পাঠকদের ভারতের গণতন্ত্রের দুর্বল অবস্থা মনে করানো নয়। এই সম্পাদকীয় ভারতের গণতান্ত্রিক নিয়মনীতির অন্তর্জালি যাত্রার সময় ঘনিয়ে এসেছে কি না এই প্রশ্ন তুলতে চায়।
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী লন্ডনের একটি সভায় ভারতের গণতন্ত্রের সামনে যে বিপদ রয়েছে সেই কথা বলেছিলেন। বিগত কয়েক বছরে ভারতের অধিকাংশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, বিদেশের বিভিন্ন সংস্থা বারংবার গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছে যে ভারতের গণতন্ত্রের মান নিম্নগামী। অতএব রাহুল গান্ধী লন্ডনে নতুন কোনো কথা বলেননি। অথচ বিজেপি লন্ডনে রাহুল গান্ধীর বক্তব্যকে সামনে রেখে তাকে 'দেশদ্রোহী' প্রমাণ করার চেষ্টা করতে কোনো কসুর করল না। বিজেপি-র সভাপতির নেতৃত্বে ছোট-বড়-মাঝারি নেতারা রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে লাগাতার বিষোদ্গার করতে লাগল।
কিন্তু আসল কাহিনি সেখানে নয়। গুজরাটের একটি আদালতে বছর কয়েক আগে রাহুল গান্ধীর একটি ভাষণের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা রুজু করা হয়। মামলাটির নেপথ্যে রয়েছে রাহুল গান্ধীর একটি উক্তি। ২০১৯ সালের নির্বাচনী প্রচারে রাহুল গান্ধী কর্নাটকের একটি সভায় বলেন, “কী করে এই তিনজন চোর সবার নাম মোদী মোদী মোদী - নীরব মোদী, ললিত মোদী ও নরেন্দ্র মোদী”। জনৈক ব্যক্তি যার নামেও মোদী পদবী রয়েছে তিনি আদালতে মামলা করে দাবি করেন যে মোদী পদবী হওয়ার দরুণ তিনি রাহুল গান্ধীর বক্তব্যের জন্য মানহানির শিকার হয়েছেন। মামলাটির এই ভিত্তিটি আইনসিদ্ধ নয়। মানহানির আইন অনুযায়ী যদি কোনো বিশিষ্ট ‘শ্রেণি’-র মানুষের বিরুদ্ধে কোনো অপমানজনক উক্তি করা হয়, তাহলে একজন ব্যক্তি সেই উক্তিকে তার মানহানির জন্য দায়ি বলে দাবি করতে পারেন না। ধরা যাক, কেউ বলল, "সব ডাক্তার রোগীদের ঠকায়”। এই উক্তির ভিত্তিতে কোনো ডাক্তার আদালতে গিয়ে যদি বলেন যে আমি ডাক্তার তাই উপরোক্ত উক্তির ফলে তার মানহানি হয়েছে, তাহলে আদালতে সেই মানহানি গ্রাহ্য হওয়ার কথা নয়।
কিন্তু মোদীর ভারতে সবই সম্ভব। অতএব আদালত শুধু যে মামলাটি রুজু করতে অনুমতি দেয় তা নয়, এক বছর শুনানি বন্ধ থাকার পরে, নতুন বিচারপতি আসার পরে, শুনানি ত্বরাণ্বিত করে, রাহুল গান্ধীকে দোষী ঘোষণা করা হয়। এই ধরনের মানহানি মামলায় সর্বোচ্চ সাজার পরিমাণ ২ বছর। আবার সাংসদ পদ বাতিল হওয়ার জন্য কোনো সাংসদের দুই-বছর বা তার অধিক সময়ের জন্য জেলের সাজা হওয়া আবশ্যিক। এবং কী আশ্চর্য! রাহুল গান্ধীর সাজার পরিমাণ ঠিক দুই বছর! মানহানি যেহেতু সরাসরি হিংসা নয়, তাই সর্বোচ্চ সাজা সাধারণত মানহানির মামলায় হয় না। কিন্তু রাহুল গান্ধীর ক্ষেত্রে তাই হল।
যেহেতু মোদী নতুন ভারত গড়ে ফেলেছেন, যেখানে অমৃতকাল ইতিমধ্যেই এসে গিয়েছে, অতএব সময়ের অপচয় নতুন ভারতে হয় না। সাজা ঘোষণা হওয়ার একদিন পরেই রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ বাতিল হয়ে যায়। সাধারণত এই ধরনের মামলায় অভিযুক্তকে ৩০ দিন সময় দেওয়া হয় উচ্চ আদালতে আবেদন করে জামিন মঞ্জুর করার জন্য। কিন্তু রাহুল গান্ধীকে সেই সময়ও দেওয়া হল না। অবিলম্বে তাঁর সাংসদ পদ খারিজ করা হল। ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাস উজ্জ্বল। তবু, চাঁদের গায়েও যেমন দাগ থাকে, তেমনি ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসেও কালো দাগের উদাহরণ রয়েছে। রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ বাতিল সেই কালো দাগকে আরো গাঢ় করল, সংসদীয় গণতন্ত্রের আলো কিছুটা নিষ্প্রভ হল।
এই প্রসঙ্গে দুটি প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। প্রথম, রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে এই চরম পদক্ষেপ কেন নিল মোদী সরকার? এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে দুটি ঘটনায়। প্রথমটি অবশ্যই রাহুল গান্ধীর 'ভারত জোড়ো যাত্রা'। এই যাত্রার মাধ্যমে রাহুল গান্ধী নিজেকে নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। যাত্রার রুট, তার রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। তবু বলতেই হবে এই যাত্রার মাধ্যমে রাহুল সরাসরি আরএসএস-এর ঘৃণার রাজনীতিকে প্রশ্ন করেছেন, ধর্মনিরপেক্ষতা, একতা এবং সৌভ্রাতৃত্বের কথা তিনি জনগণের সামনে তুলে ধরেছেন। স্বাভাবিকভাবেই বিজেপি-র রাহুলের এই রাজনৈতিক পদক্ষেপ পছন্দ হয়নি।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ভারতের সংসদে। আদানি কেলেঙ্কারির পরিপ্রেক্ষিতে রাহুল গান্ধী সংসদে কিছু গুরুতর প্রশ্ন তোলেন। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আদানির সম্পর্ক কী, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। প্রধানমন্ত্রী রাহুলের একটি প্রশ্নেরও জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেননি। নিজেকে মহান এবং বিরোধীদের ষড়যন্ত্রকারী প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, আদানি নামটিও উচ্চারণ করেননি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে করা রাহুলের প্রশ্ন এবং কিছু মন্তব্যকে সংসদের লিখিত প্রতিবেদন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গণতন্ত্রের এর থেকে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে, যেখানে সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা হলে তা সংসদীয় বিবরণী থেকেই বাদ দিয়ে দেওয়া হয়।
তবু, বলতেই হয় যে ভারত জোড়ো যাত্রা অথবা আদানি নিয়ে রাহুলের বক্তব্য বিজেপির কাছে অস্বস্তিকর হলেও, তা এত বড় কোনো প্রশ্ন হয়ে দেখা যায়নি, যার ফলে বিজেপির অবিলম্বে কোনো রাজনৈতিক সংকট ঘনিয়ে আসবে। তাহলে রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ বাতিল করার সিদ্ধান্ত সরকার নিল কেন?
এর উত্তর নিহিত রয়েছে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং ক্ষমতার প্রতি বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদীর দৃষ্টিভঙ্গিতে। রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ বাতিল হওয়া বিগত কিছু বছর ধরে পরীক্ষিত স্বৈরতন্ত্রের সাম্প্রতিকতম পদক্ষেপ। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যারা মুখ খুলেছেন, তাদের অনেককে জেলে পোরা হয়েছে। মিডিয়াকে বশংবদ কুকুরে পরিণত করা হয়েছে। যারা লেজ নাড়াতে রাজি হননি তাদের বিরুদ্ধে ইডি-সিবিআইকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই স্বৈরাচার এবং ক্ষমতার দম্ভ এমন জায়গায় পৌঁছিয়েছে যেখানে দেশের একজন প্রধান বিরোধী সাংসদের পদ বাতিল করতেও দুইবার ভাবছে না মোদী সরকার!
ক্ষমতার এই প্রবল আস্ফালনের নেপথ্যে রয়েছে সরকারের প্রতি এক বিপুল সংখ্যক মানুষের সমর্থন। হিন্দু জাতীয়তাবাদের মতাদর্শ এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শক্তিতে ভর করে বিজেপি দেশে যেই আখ্যানকে মান্যতা দিয়েছে তা হল এই যে হিন্দু ধর্মের বা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের নামে সরকার তথা বিজেপি যাই করবে তার প্রতি সমর্থন তৈরি হবে। আগে যাকে স্বৈরাচার বলা হত, বিজেপি ক্ষমতার মাধ্যমে তাকে পরিণত করেছে আবশ্যিক কর্তব্যে - শক্তিশালী নেতা এবং দৃঢ় পদক্ষেপ ছাড়া দেশের মঙ্গল সম্ভব নয়। কতবার আমরা এই বাণী শুনেছি। উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই - বক্তব্য হল এই যে ক্ষমতা এখন ভারতে যেই আখ্যান সৃষ্টি করেছে সেখানে বিরোধী মাত্রেই দেশদ্রোহী - অতএব তার কন্ঠস্বর রুদ্ধ করাই দেশকল্যাণ বলে প্রতিভাত করা হয়েছে। তাই দেশের একজন প্রধান বিরোধী নেতার সাংসদ পদ কেড়ে নিতে মোদী সরকারের কোনো সমস্যা হয় না।
এই প্রবণতা জন্ম দেয় আরো কিছু গুরুতর প্রশ্নের। রাহুল গান্ধীকে সংসদ থেকে বিতাড়িত করার মধ্যে নিহিত রয়েছে বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করার বিজেপি-র সংকল্প। বিরোধীরা নিশ্চিহ্ন হলে গণতন্ত্রের আর কীই বা বাকি থাকে! এই নিশ্চিহ্ন করার মানসিকতার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে সর্বাধিক বিপজ্জনক একটি সম্ভাবনা। যেই রাজনৈতিক দল নির্দ্বিধায় বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করার স্বপ্ন দেখে, যারা বিরোধী নেতাদের লাগাতার দেশদ্রোহী হিসেবে প্রতিভাত করতে চায়, যারা ক্ষমতাসীন থাকার লালসায় যেকোনো পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত তারা কি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে?
শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বশর্ত হল একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হওয়া। কিন্তু বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করা হলে নির্বাচনের ফল তো পূর্বনির্ধারিত। আবার, যারা ক্ষমতার দম্ভে এতটাই স্বেচ্ছাচারী হয়েছেন, তারা কি নিজেদেরকে আর কখনও মানসচক্ষেও বিরোধী আসনে দেখতে পান? এর উত্তর সম্ভবত না! অতএব, রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজ এক ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক বার্তা দিচ্ছে।
ভারতের গণতন্ত্রের সামনে প্রধান বিপদ বিজেপি তথা মোদী সরকারের লাগামহীন স্বৈরাচার। ভরসা একটাই স্বৈরাচার কখনও চিরস্থায়ী হয় না। কিন্তু তার স্থায়িত্ব কতদিন হতে পারে? এই প্রশ্নই আপাতত ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের আঙিনায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।