আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২৩ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪২৯

প্রবন্ধ

অন্য এক পথের পাঁচালীঃ এক নারীর পথচলার আখ্যান

রঞ্জন রায়


যদি কোনো বইয়ের পাতা ওল্টালেই চোখে পড়ে বইটিকে সুপারিশ করেছেন আমাদের দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের নামকরা উজ্বল জ্যোতিষ্ক তাহলে আমার মতো সাধারণ পাঠকের ঔৎসুক্য আসে বৈকী!

দেশের প্রধান বিচারপতি রমন্না, দলিত তাত্ত্বিক কাঞ্চা ইলাইয়া, অভিনেতা সুহাসিনী মুলে এবং নাসিরুদ্দিন শাহ, প্রতিবাদী চরিত্র টি. এম. কৃষ্ণ, জনস্বাস্থ্য কর্মী ডঃ শ্রীনাথ রেড্ডি, সম্পাদক রামমনোহর রেড্ডি, কংগ্রেসের সাংসদ জয়রাম রমেশ, সাফাই কর্মচারী আন্দোলনের পরিচিত মুখ বেজওয়াড়া উইলসন এবং মনমোহন সিংয়ের প্রাক্তন মিডিয়া উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ সঞ্জয় বারু সকলেই বইটির প্রশংসা করেছেন।

আবার এই তারকামণ্ডলীর মাঝে চোখে পড়বে দুটো নাম শংকরাইয়া ও বচাম্মা - অন্ধ্রের ছোট্ট গাঁয়ের দুই কৃষিশ্রমিক ও সংগঠক।

বইয়ের নাম 'ল্যান্ড গানস্ কাস্ট ওম্যান' - জনৈক পথ হারানো বিপ্লবীর স্মৃতিচারণ। লেখক গীতা রামস্বামী।

এইটুকু দেখে বইটি বন্ধ করে তাকে তুলে রাখবেন না। এটি কোনো প্রাক্তন বিপ্লবীর আত্মগর্বী ফাঁপানো ফোলানো কাহিনী নয়, যেখানে তিনি কোনো ভুল করেননি, শুধু জনগণ তাঁকে বুঝতে ভুল করে ছেড়ে গেছে।

বরং এটি এক বিনম্র নারীর অন্তরঙ্গ আলাপন, যিনি হাতড়ে হাতড়ে পথ খুঁজে চলেন। তাঁর কাহিনীতে সাফল্যের চেয়ে বিফলতার খতিয়ান বেশি। তিনি অকপটে নিজের ভুল স্বীকার করেন এবং জীবনের একটি বাঁকে এসে মনে করেন এবার ঘরে ফেরার সময়।

এটা ঠিক পরাজয়ের সালতামামি নয়, এর মূল সংগ্রাম রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে নয়। তাঁর লড়াই নিজের ভেতরের সংস্কারের জন্য এবং চারপাশের পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে, জাতপাতের বিরুদ্ধে। তিনি উপলব্ধি করেন যে পিতৃতন্ত্র এবং জাতপাতের মূল দর্শন এক।

অবশ্য এই লড়াই তাঁকে টেনে নিয়ে যায় ভুমিহীন দলিত মানুষদের আঙিনায় এবং তিনি দেখলেন যে সবচেয়ে অবহেলিত ও পীড়িত মানুষেরা অধিকাংশই দলিত সম্প্রদায়ের। তাদের জমির অধিকারের জন্য মাথা উঁচু করে কথা বলতে গিয়ে মুখোমুখি হতে হল ল্যান্ড রেভিনিউ বিভাগ, পুলিশ এবং আদালতের - অর্থাৎ রাষ্ট্রশক্তির।

কিন্তু তাঁর পথচলার ভূগোল অসাধারণ। নারীবাদ, নকশালবাদ, আম্বেদকরপন্থা এবং ভূমিহীনদের জমির অধিকারের জন্য আইনি এবং অহিংস পথে আন্দোলন।

সর্বভারতীয় এক নকশাল নেতাকে খুব কাছ থেকে দেখে, তাঁর নারীদের প্রতি তাচ্ছিল্য এবং সাধারণ ক্যাডারদের প্রতি একনায়কসুলভ আচরণে গীতার মোহমুক্তি ঘটে।

এরপর দিল্লির কাছে গাজিয়াবাদের দলিত বস্তিতে থেকে বস্তির ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব নেন, কয়েক বছর পরে অন্ধ্রে ফিরে শহরের অ্যাকাডেমিক জীবনের হাতছানি এড়িয়ে জীবনসঙ্গীর সঙ্গে অন্ধ্রের প্রান্তিক গাঁয়ে গিয়ে কৃষিশ্রমিকদের মজুরি আন্দোলনের সংগঠন গড়তে সাহায্য করেন। এ ছিল জমিদারদের সরকারি ও দেবোত্তর জমি গাপ করার তথ্য বের করে সরকারি আইন অনুযায়ী তা ভূমিহীনদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার লড়াই। বছরের পর বছর।

একটা সময় ক্লান্তি আসে, ঘরে ফিরে ‘হায়দ্রাবাদ বুক ট্রাস্ট’ খুলে সুলভ মূল্যে তেলুগুতে বিশ্বসাহিত্য এবং দলিত সাহিত্যের প্রায় চারশো বই প্রকাশ করেন। তিনি যুক্তভাবে লিখেছেন 'টেকিং চার্জ অফ আওয়ার বডিজ' (২০০৫), সম্পাদনা করেছেন 'দ্য অক্সফোর্ড ইন্ডিয়া অফ তেলুগু দলিত রাইটিং' (২০১৬), নিজে বেশ কিছু বই তেলুগু থেকে ইংরেজিতে অনুবাদও করেছেন। এরই মধ্যে তিনি তাঁর জীবনসাথী সিরিল রেড্ডিকে দুরারোগ্য অসুখে হারিয়ে ফেলেছেন।

সবমিলিয়ে এই বইপড়া একটি আকর্ষণীয় অভিজ্ঞতা।

এবারে একটু গোড়ার কথায় আসি।

জন্মেছিলেন তামিল ব্রাহ্মণ পরিবারে। বাবা ছিলেন সরকারি আধিকারিক। পুত্রহীন পিতা চেয়েছিলেন ছোট মেয়েকে ছেলের মতো করে মানুষ করতে। তাই তাকে পড়তে পাঠালেন ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।

সত্তরের দশকের হায়দ্রাবাদের ওসমানিয়া আর আজকের দিল্লির জেএনইউ একেবারে তুল্যমূল্য। ছোটবেলা থেকে কী এবং কেন প্রশ্ন করা গীতার গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের অন্ধকূপে দম আটকিয়ে আসছিল। অকপটে লিখেছেন যে, "তখন পাশ্চাত্যে নারীদের অন্তর্বাস জ্বালিয়ে দেওয়া ছিল বিদ্রোহের পরিচায়ক, আমাদের বাড়ির সংস্কৃতিতে অন্তর্বাস পরাই ছিল বিদ্রোহ।" মা এবং ঠাকুমা তাদের তিন বোনকে শিক্ষা দিতেন - অন্তর্বাস পরে ছেনালরা। বুক ঢাকতে হয় ঘরে সেলাই করা কাপড়ের টুকরো দিয়ে।

ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে তার মনের মুক্তি হল। মেয়ে বলে নিজেকে গুটিয়ে রাখার বদলে সে গর্বিত হতে শিখল। বন্ধুবান্ধব এবং ক্যাম্পাসের বিতর্ক এবং সাহিত্য তাঁকে ধীরে ধীরে চেনালো বর্ণব্যবস্থাকে, তার বর্বর রূপকে। ইউনিভার্সিটির প্রগতিবাদী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন ছাত্র নেতা জর্জ রেড্ডি। বিজেপি গুণ্ডার আক্রমণে তিনি নিহত হলেন। জর্জের ভাই সিরিল (পরে নামকরা মানবাধিকার আইনজীবি) এবং কয়েকজন মিলে গড়ে তুললেন নতুন সংগঠন।

অন্ধ্রে তখন নকশাল আন্দোলনের জোয়ার এসেছে। এঁরা সবাই যুক্ত হলেন চারু মজুমদারের মূল এম-এল পার্টিতে নয়, বরং অন্ধ্রের সিপিএম থেকে সদ্য বেরিয়ে আসা চন্দ্রপুল্লা রেড্ডির দলে। পার্টি সেলে বিয়ে করলেন সিরিল রেড্ডিকে।

বাড়িতে খবর যাওয়ায় মায়ের অসুখের মিথ্যে খবর দিয়ে গীতাকে ডেকে এনে ঘরে বন্দী করে তালা লাগিয়ে দেওয়া হল। বাবা-মা ডাক্তারকে বল্লেন - নকশালরা ওর ব্রেন ওয়াশ করেছে। ফলে মানসিক হাসপাতালে ইলেক্ট্রিক শক দেওয়া হল। এর ক্ষতিকর ফল পরবর্তী জীবনে টের পেয়েছেন। পরে পরিণত বয়সে বাবা-মা এবং বিবাহিত দিদিদের সঙ্গে যোগাযোগ হল, কিন্তু ভাঙা সম্পর্ক আর জোড়া লাগল না।

তখন ইন্দিরা গান্ধীর এমার্জেন্সি! এনকাউন্টারে মারা যাচ্ছে সাথীরা। চারদিকে পালাও! পালাও!

আর স্পয়লার দেব না।

তাঁর প্রথম জীবনে গ্রামে কৃষিশ্রমিক ও দলিতদের মধ্যে থাকার অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছিলেন যে অন্ধ্রের গ্রামাঞ্চলে সবচেয়ে বড় জমির মালিক ও বর্বর অত্যাচারী হলো রেড্ডিরা। কিন্তু কয়েক দশক ধরে ওখানকার ক্ষমতা দখল করে মসনদে বসে থাকা সবাই রেড্ডি, কংগ্রেস হোক কি বিজেপি।

এই জাল ভেদ করে গরীবের জন্যে লড়াই কঠিন। হঠাৎ তিনি খেয়াল করলেন যে তাঁর জীবনসঙ্গী এবং লড়াইয়ের সাথী সিরিলও রেড্ডি! অনেক বন্ধুবান্ধব এবং ঘনিষ্ঠরাও তাই।

বাইরে থেকে এসে গরীবের লড়াই লড়তে যাওয়া গীতা রামস্বামীর মতো আদর্শবাদীরা অনেক সময় বিশুদ্ধ বইয়ের ফর্মূলা থেকে অনেক ভুল নির্দেশ দেয়। কিন্তু গরীবেরা জানে, তাদের সেখানে থাকতে হবে। পুরনো বন্ধন এমনভাবে ছিঁড়ে ফেলা যায় না।

একবার গীতাকে প্রাণ বাঁচাতে একটা শুকনো কুয়োয় লাফিয়ে পড়ে মাথা গুঁজে থাকতে হয়। কিন্তু কুয়োর বাইরে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ দলিত খেতমজুর কমরেড নিহত হন।

বইটি পড়লে বুঝতে পারা যায় জীবন ঠিক জয়-পরাজয়ের ব্যালান্স শীট নয়, বরং পথ চলাটাই আসল। পথের বাঁকে যে কত বিস্ময় লুকিয়ে থাকে, কত নাম না জানা ফুল গোপনে ফোটে। এই পথের পাঁচালীর শেষ বাক্যটিতে ভৈরবীর সুর বাজে - “After all this time, after a quarter of a century, there was still so much love. Only love”.

বইটি প্রকাশ করেছেন হায়দ্রাবাদের নবায়ন, পাওয়া যাচ্ছে হার্ড কভার এডিশনে, দাম ৫৯৯ টাকা।