আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২৩ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪২৯
প্রবন্ধ
‘অতিমারি যুদ্ধ’, বামপন্থা ইত্যাদি...
স্থবির দাশগুপ্ত
ইদানীং অতিমারির বিরুদ্ধে যুদ্ধের গৌরবগাথা রচিত হইতেছে। সেই যুদ্ধে চিকিৎসক মহল 'বীর' বলিয়া চিহ্নিত হইয়াছেন। বীরত্বের নমুনা কী ও কেমন তাহা লইয়া তর্ক আছে, কেননা কর্তব্য এবং বীরত্ব একই বস্তু নহে। তা ভিন্ন, ওইরূপ মহিমা বিতরণের অবসরে একটি সংক্রমণ বা ব্যাধির আঙিনায় 'যুদ্ধ' শব্দটির ব্যবহার লইয়াও ধন্দ থাকিয়া যায়। কিন্তু যাহা লইয়া ধন্দের অবকাশ নাই তাহা এই যে, কথিত অতিমারির ন্যায় দুর্বিপাকের প্রায় সমান্তরালে অপর একটি চমৎকার আমাদের দেশে ঘটিয়াছিল, একই সময়কালে। তাহা উত্তর ভারতের কৃষক আন্দোলন - কুৎসিত আইনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের এক গৌরবগাথা বটে। দেশের প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমগুলি অতিমারি লইয়া অতিকাতর ছিল, কিন্তু ওই আন্দোলন লইয়া তেমন রা কাড়ে নাই। কিন্তু ওই আন্দোলন কি যুদ্ধ ছিল? প্রতিরোধ আন্দোলন ও যুদ্ধ কি সমার্থক?
যুদ্ধ শব্দটি নিরীহ নহে। লোককথায় আছে, যাহারা যুদ্ধে যায় না তাহারা যুদ্ধ চায়, আর যাহারা যুদ্ধে যায় তাহারা কদাপি যুদ্ধ চায় না। বিশদ ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। আমাদের দেশে বোধ করি, যুদ্ধ শব্দটি তেমন লোকপ্রিয় নহে, তবে কোনও কোনও লোকনেতার নিকট তাহা প্রিয়। তাই সময়ে-অসময়ে খানিক যুদ্ধ-যুদ্ধ রব তুলিয়া তাঁহারা শান্তি পান। শান্তি এই কারণে নহে যে, যুদ্ধের পরিণতি সুখের হইবে, বরং এই কারণে যে, মানুষজনকে কিছুকাল মাতাইয়া রাখা যাইবে। তাই ক্ষণভঙ্গুর স্বাস্থ্য পরিষেবা হউক অথবা বেচাল অর্থনীতি, যখন বেসামাল হইয়া পড়ে তখন যুদ্ধ শব্দটি আমদানি করিলে অন্তত মুখরক্ষা হয়। কোনও বিশিষ্ট সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ‘হর হর মহাদেও’ রবে যুদ্ধোন্মাদনাও এক্ষণে আর নূতন নহে। এইরূপে ক্যানসার, মধুমেহ, ভাইরাস, পৃথুলতা বা এমনকী, গরিবির বিরুদ্ধেও যুদ্ধ নামক ধ্বংসাত্মক শব্দকল্পদ্রুম, ক্রমশ লোকমনে প্রোথিত হয়। অথচ সকলেই জানেন যে, ভয়াবহতা ও মৃত্যুলীলার কথা ভাবিলে, যুদ্ধের পরিণতি সকলের পক্ষেই ভয়ংকর, কেননা দুই পক্ষের পরাজয়ই যুদ্ধের চরম পরিণতি।
অনেকে অবশ্য ন্যায় যুদ্ধ ও অন্যায় যুদ্ধ বলিয়া যুদ্ধের শ্রেণিচরিত্র নিরূপণ করিবেন। তাহা মিথ্যা নহে, তবে এইস্থলে শত্রু কে বা কাহারা, কোন শত্রুর উদ্দেশ্য-বিধেয় কী ইত্যাদি বিচার বিশ্লেষণ করা আবশ্যক। জাপ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে চিনা জনগণের যুদ্ধ ন্যায় যুদ্ধ ছিল বটে, যেমন চিনা জনগণের বিরুদ্ধে কুয়োমিনটাঙের যুদ্ধটি ছিল অন্যায় যুদ্ধ। তেমনই, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আমাদের লোকনেতাগণ যুদ্ধের আবাহন করিলে তাহা ন্যায় যুদ্ধই হইত। কিন্তু তেমন আহ্বান শোনা যায় নাই। আজাদ হিন্দ ফৌজকে ব্যতিক্রম মানিয়া বলিতেই হয় যে, যুদ্ধ সম্পর্কে বিন্দুবৎ অভিজ্ঞতা আমাদের লোকনেতাদের নাই। ওই অনভিজ্ঞ, বাকসর্বস্ব নেতাদের ওষ্ঠে যখন যুদ্ধ শব্দটি লেপটাইয়া থাকে তখন তাহা প্রশ্নের উদ্রেক করিবে বৈকী। অর্থাৎ, সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করিবার লক্ষ্যে যে-যুদ্ধ তাহা ন্যায় যুদ্ধই; তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ন্যায় যুদ্ধ। কিন্তু এইসকল যুদ্ধের সহিত সংক্রমণ বা ব্যাধির বিরুদ্ধে অথবা গরিবির বিরুদ্ধে যুদ্ধকে একাসনে স্থান দেওয়া যায় না। উহা ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নহে, অন্য কোনও মতলবের লক্ষ্যে বটে।
মতলবটি সহসা বুঝা যায় না। স্থলযুদ্ধ বা অন্তরীক্ষ অথবা নৌযুদ্ধে গোলাবারুদের বন্দোবস্ত থাকে, আর ‘স্বাস্থ্যযুদ্ধে’ থাকে নানাবিধ ঔষধ, যাপনের বিধিনিষেধ ও টিকার বন্দোবস্ত। উভয় প্রকার যুদ্ধেই কিছু অংশীদারও যুক্ত থাকে, কেননা গোলাবারুদ ও বন্দুকের ন্যায় ঔষধ ও টিকাও বিক্রয়যোগ্য/মুনাফাপ্রবণ। বাস্তবযুদ্ধ লইয়া রোমাঞ্চকর চলচ্চিত্র হয়, কিন্তু ‘স্বাস্থ্যযুদ্ধে’ অমন রোমহর্ষক গল্পকাহিনির অধিষ্ঠান ছিল না। সম্প্রতি তাহাও ঘটিয়াছে। ইহার সর্বোত্তম উদাহরণ, ‘কনটাজিয়ন’ নামক একটি চলচ্চিত্র - ২০১১ সালের ৯-ই সেপ্টেম্বর ইহার মুক্তি ঘটিয়াছিল। যে-কোনও বস্তুকে স্পর্শমাত্র একটি অজানা অচেনা ভাইরাস কীভাবে একটি অঞ্চলে ছড়াইয়া পড়িল এবং স্পর্শসুখী মানুষজন কীভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হইল, তাহার রোমহর্ষক কল্পকাহিনি লইয়া ইহার চিত্রনাট্য। লক্ষ্যনীয়, এই কাহিনির হন্তারক ভাইরাসটির জন্মবৃত্তান্তেও চিনের কোনও এক জঙ্গলের বাদুড়ের ভূমিকা ছিল। উহান প্রদেশের পশুবাজারের কথা মনে করাইয়া দেয়। এমনকী, এই কাল্পনিক ভাইরাস সংক্রমণ হইতে নিষ্কৃতির লক্ষ্যে যে-সকল নির্দেশিকা ছিল তাহাও সাম্প্রতিক অতিমারির অনুরূপ, হুবহু - অল্প কথায়, স্পর্শ হইতে দূরত্ব রচনা। এই সাদৃশ্যগুলি মারাত্মক বটে।
বাস্তবযুদ্ধ লইয়া চলচ্চিত্রেও কল্পকাহিনি সুপ্রচুর, তবে ‘কনটাজিয়ন’-এর কাহিনি চলচ্চিত্র নির্মাতাদের অতুলনীয় সৃজনশীল প্রতিভার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। কিন্তু এই প্রতিভার উন্মেষ ঘটিল কোন সুবাদে? দুনিয়াব্যাপী যে-দুর্ঘটনা ২০২০ সালে ঘটিবে তাহার পূর্বাভাষ রচনাই কি ইহার উদ্দেশ্য ছিল? নহিলে ২০১১ সালের কল্পকাহিনির সহিত ২০২০ সালের বাস্তব ঘটনাবলীর অমন সাদৃশ্য ঘটে কী করিয়া! এই ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকাও দর্শনীয়। একসময় সংবাদমাধ্যমের দায় ছিল, মিথ্যা হইতে সত্যকে আবিষ্কার করা। আজিকে জনমানুষের দায়, সংবাদমাধ্যম রচিত মিথ্যা হইতে সত্যকে উদ্ধার করা। সেই উদ্ধারকার্যে স্পষ্ট হয় যে, জনজীবনের কর্মচঞ্চলতাকে মুলতবি রাখিয়া, ‘কোভিডসুলভ আচরণবিধি’ রচনা করিয়া ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামিবার চিত্রনাট্য ২০২০ সালে নহে, বরং ২০১১ সালেই রচিত হইয়াছে। ‘কনটাজিয়ন’ চলচ্চিত্রে অজানা ভাইরাসের দংশনে মৃত্যুর হার ছিল ২৫ বা ৩০ শতাংশ। উল্লেখ্য, ২০২০ সালের অতিমারির প্রারম্ভিক পর্বে ‘ল্যান্সেট’ নামক বিশ্ববন্দিত ডাক্তারি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রাথমিক গবেষণাপত্রেও ‘কোভিড’-জনিত মৃত্যুর হার ২০ শতাংশ পর্যন্ত অনুমান ছিল।
ইহাকে কাকতালীয় বলিলে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানজগতের মানরক্ষা হইতে পারে, তবে চলচ্চিত্র এবং বাস্তব, উভয় ক্ষেত্রেই অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ‘অনবদ্য’ টিকা নির্মাণের কাহিনি অপর কোনও আশঙ্কার প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করে। কেহ উপযুক্ত প্রমাণ চাহিলে ‘ইভেন্ট ২০১’ সম্পর্কে অবহিত হইতে পারেন। ইহা ছিল অতিমারির বিরুদ্ধে যুদ্ধের একটি মহড়া - ঘটিয়াছিল ২০২০ সালের অতিমারির মাত্র কিয়ৎ মাস পূর্বে। ২০২০ সালের অতিমারি-যুদ্ধ যেন ইহারই বাস্তব মঞ্চাভিনয়, প্রায়! ইহাতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিল প্রবল বলশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সংস্থা; যেমন 'বিশ্বব্যাংক', ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’, ‘সিডিসি’, বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা, ভ্যাকসিন নির্মাতাগণ ইত্যাদি। ব্যবস্থাপক ও তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বিশ্বজনতার সাম্প্রতিকতম পরিত্রাতা, বিল গেটস। কৌতূহলের কথা এই যে, কিছুকাল পরে গেটস মহাশয় এই মহড়ার ঘটনা অস্বীকার করেন। সত্যের প্রতি তাঁহার অনুরাগের কথা আমাদের জানা নাই, উপরন্তু প্রমাণ হিসাবে ‘ভিডিও’র সাক্ষ্যও রহিয়াছে; তাই ‘ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকদের’ যতই গালিগালাজ করা হউক, প্রাক-কোভিড ওই ঘটনাবলীকে কাকতালীয় বলা অসম্ভব।
ফলকথা এই যে, অতি মুনাফালোভী কর্পোরেট শক্তির ক্রীড়নকরূপী রাষ্ট্রের তুমুল তাণ্ডবনৃত্যের পর ভাইরাসের কপালে কী ঘটিল, জনমানষের কপালেই বা কী জুটিল তাহা এক্ষণে দিবালোকের ন্যায় উদ্ভাসিত। ‘ইভেন্ট ২০১’ এবং তদ্রূপ বিচিত্র ঘটনা, যেমন ২৩-শে অক্টোবর, ২০২২-এ বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত ‘ক্যাটাস্ট্রফিক কনটেজিয়ন’ সম্পর্কে গেটস এবং ‘জন হপকিন্স সেন্টার’-এর কষ্টকর কিন্তু দুর্বল যুক্তিজাল আমরা শুনিয়াছি। এবং পুনরায় বুঝিয়াছি, দুরাত্মার ছলের অভাব নাই। অতএব, কোভিড যুদ্ধকে ‘ন্যায়যুদ্ধ’ বলিয়া যে-সকল বিজ্ঞানকাতর, ‘মননশীল’ ব্যক্তিগণ প্রাণপণ প্রচার চালাইয়াছেন তাঁহারা বস্তুত পীড়নকারী রাষ্ট্রশক্তির বাহুবল বৃদ্ধি করিলেন। সত্যই মননশীল হইলে বুঝিতেন, প্রত্যেক বাস্তব যুদ্ধের ন্যায় প্রতিটি অতিমারিও পূর্ববর্তীগুলি হইতে পৃথক। কিন্তু বিশ্ব বৈশ্য সম্প্রদায়ের নিকট তাহা পৃথক নহে, যদি তাহাতে অর্থের অনর্গল আগমণ ঘটে। বর্তমান যুগ আর্থিক ও রাজনৈতিক একাধিপত্যের যুগ, যুদ্ধবাদের যুগ। যুদ্ধবাদ, জঙ্গিপনা যাঁহাদের আধুনিক বিলাস কেবল তাঁহারাই মনে করেন, সকল সমস্যার সমাধান রহিয়াছে যুদ্ধে, সন্ত্রাসবাদ হউক অথবা জীবাণু বা অণুজীব।
প্রকৃত যুদ্ধ যে কীরূপ ধ্বংসাত্মক তাহা অভিজ্ঞ মানুষজন জানেন। প্রসিদ্ধ সামরিক-রাজনৈতিক বিশ্লেষক জেমস ডানিগান বিরচিত ‘হাউ টু মেক ওয়ার’ গ্রন্থে তাহার ঐতিহাসিক বর্ণনা মিলিবে। সেই বর্ণনা বিমর্ষতা প্রসবিনী। কেহ বলিবেন, বিমর্ষ হইলেও ইহা তো সত্য যে, মানবজাতির ইতিহাস হইল যুদ্ধের ইতিহাস। অথচ মানবজাতির ইতিহাস যে যৌথতারও ইতিহাস, ইহা অধিকতর সত্য; নহিলে এই ধরাধাম মরুভূমি হইত। তাই প্রজ্ঞাবানগণ কখনও যুদ্ধের স্বপ্ন দেখেন না, তাঁহাদের স্বপ্ন শান্তির। সাম্প্রতিক গবেষণায় ইহাও প্রমাণিত যে, যুদ্ধ বা সামরিক সংঘাতগুলিতে অস্ত্রধারী সৈন্যসামন্তের তুলনায় নিরস্ত্র নাগরিকদিগের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক অধিক - সামগ্রিক মৃত্যুর প্রায় ৬০ হইতে ৯০ শতাংশ। ইহা ব্যতীত অন্যান্য দুর্ভোগ-দুর্ভাগ্যের কথা না-বলিলেও চলে। অর্থাৎ, যুদ্ধকে গণহত্যার অপর এক প্রকরণ হিসাবেও দেখা যায়। কে, কীভাবে দেখিতে পারেন, চিন্তাশক্তি কীরূপে আমাদের মস্তিষ্কে অবস্থান করে এবং তাহা ব্যবহারের পরিণতি কী, তাহা লইয়াও একটি উপাদেয় গ্রন্থ আছে, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতি ও মনস্তত্ববিদ ডেনিয়েল ক্যানেম্যান বিরচিত, ‘থিঙ্কিং, ফাস্ট এন্ড স্লো’।
যুদ্ধ ব্যবসায়ীদের ধারণায় উজ্জীবিত ও আবেগমথিত হইয়া অনেকেই তাৎক্ষণিক, অনিয়ন্ত্রিত, ‘দ্রুতগামী’ চিন্তায় ভাইরাসের বিরুদ্ধেও যুদ্ধাভিলাসে বিভোর হইয়াছেন। এই কথা ঠিক যে, সময়বিশেষে ‘দ্রুতগামী’ চিন্তার প্রয়োজন আছে। কিন্তু ভাবাবেগের আতিশয্য অতিক্রম করিয়া, মনস্থির করিয়া, বৈশ্য-প্রচারিত বিজ্ঞানের সারমর্মের কথা, নিগূঢ় উদ্দেশ্যের কথা, কার্যকারণের কথা উঠিলে ‘ধীরগতি’ চিন্তারই প্রয়োজন ছিল অধিকতর, কেননা এই ক্ষেত্রে উহাই সুফলদায়ী। দেশের মননশীল মানুষজনের নিকট হইতে ইহাই প্রত্যাশা ছিল, তাহা পূরণ হয় নাই। অবশ্য ইহাও সত্য যে, আমাদের মস্তিষ্কে ‘দ্রুতগামী’ চিন্তার তুলনায় ‘ধীরগতি’ চিন্তার উপাদানটি বয়সে নবীন - মাত্র কয়েক সহস্র বৎসর পূর্বে উহার উদ্ভব। বোধহয় সেই কারণেই সকলের মস্তিষ্কে সমানভাবে প্রস্ফুটিত হয় নাই। হইলে তাঁহারা পুরাতন কথাগুলি নূতন করিয়া ভাবিতেন যে, জনজীবনে ব্যাধির সমারোহ আছে, চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যাধির প্রকারভেদও আছে। সকল ব্যাধি পরিহারযোগ্য নহে, কিছু ব্যাধি নিরাময়যোগ্য, পরিত্রাণযোগ্য, কিছু প্রতিরোধযোগ্য। যে-ব্যাধি বা তাহার উপাদান জনজীবনকে উদব্যস্ত করিয়া তুলে তাহা প্রতিরোধযোগ্য হইতে পারে; কিন্তু তাহা নাৎসিদল বিরোধী স্তালিনগ্রাদের প্রতিরোধ নহে।
কারণ, জীবাণু এবং অণুজীবের জগত লইয়াই প্রকৃতির ভারসাম্য (‘ইকোলজি’) রচিত হয়। তাই যাহা অদৃশ্য, অধরা, সতত চলমান তাহার বিরুদ্ধে ‘জনস্বাস্থ্য যুদ্ধ’ অর্থহীন; বরং বোঝাপড়া বা আপসমীমাংসার পথই গ্রহণযোগ্য হইয়া উঠে। তাহার মূল কারণ, কোটি কোটি বৎসরের প্রাচীন জীবাণুর রাজ্যে আমরা উপনিবেশ তৈয়ার করিয়াছি; অতঃপর তাহাদের বিরুদ্ধে মারণযজ্ঞ আমাদেরই সংযোজন। তাহাতে জীবাণুকুল বরং আরও প্রতিস্পর্ধী হইয়াছে, এবং আমরা হারাইয়াছি আমাদের জৈবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা। পরিবেশ-পরিস্থিতি পরিবর্তনশীল, তাই বাঁচিয়া থাকিবার প্রবল আকাঙ্ক্ষায় ভাইরাসও আপনাকে বারংবার নতুন করিয়া সাজাইয়া লয়। তাহারা যুদ্ধ করে না, বংশানুক্রম রক্ষা করিতে আমাদের কোষরাজ্যের সহিত আপসমীমাংসা করে। অথচ আমরা জঙ্গি ঘোষণা শুনিলাম, ভাইরাসের বিরুদ্ধে নাকি ‘মরণপণ যুদ্ধ’ করিতে হইবে। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের আঙিনায় যুদ্ধকে রূপকালংকার ভাবিলেও সুজান জোন্ট্যাগ-এর সাবধানবাণী স্মরণে রাখিতে হয়; কেননা ব্যাধির শরীরে অনাবশ্যক, উৎকট অলংকারের সন্নিবেশ ঘটাইলে ব্যাধিগ্রস্ত ও তাহার পরিচর্যাকারী পথিকের দিগভ্রান্তি ঘটে। আধুনিক, মননশীল মানুষজন এই জঙ্গিবাদ পরিহার করিবেন, ইহাই কাম্য।
কিন্তু মননশীল কাহারা? নানান কার্যকারণ ও ঘটনাক্রম উপলক্ষে আমরা ‘বামপন্থী’ মনোভাবাপন্ন মানুষজনকে মননশীল বলিয়া ভাবিতাম। কিন্তু এক্ষণে, এই ‘কোভিডকালে’ সম্ভবত, সর্বাপেক্ষা পরিতাপের বিষয়, ‘বামপন্থী’ দলগুলির আচরণ। কী ভাবিয়া, কেমন করিয়া তাহারা একযোগে রাষ্ট্রীয় বৃত্তান্তের সহিত সহমত হইল, রাষ্ট্রীয় অনাচারকে স্পর্শ করে এমন একটি বাক্যও উচ্চারণ হইতে বিরত থাকিল, বিশ্ব বৈশ্য সম্প্রদায়ের পক্ষে নিশ্চুপ দণ্ডায়মান রহিল তাহা আগামী প্রজন্মের নিকট পৃথক গবেষণার বিষয় হইয়া রহিবে। উপর্যুপরি অনৃতভাষণ, সামান্যকে অসামান্য এবং স্বাভাবিক শারীরিক ব্যত্যয়কে অস্বাভাবিক বলিয়া প্রচার, ‘যুদ্ধই’ সকল সমস্যার সমাধান করিবে এমন অপবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠা করাই কর্পোরেট জগতের নির্দ্বিধ লক্ষ্য। ‘বামপন্থী’ দলগুলি ইহা উপলব্ধি করে নাই। যশোলোভী, মননে দেউলিয়া বিদ্যাভিমানীগণ ‘দ্রুতগামী’ চিন্তার শরণাপন্ন হইয়া অধীত তত্ত্বাবলী খুঁজিয়া নিউট্রন বোমা বুঝিলেন, মানুষ বুঝিলেন না। চিকিৎসাবিজ্ঞানে যে ড্যানিয়েল ডেনেট বর্ণিত ‘লোভী খণ্ডবাদ’ (‘গ্রিডি রিডাকশনিজম’) প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি (‘হোলিজম’) আপাতত পরাজিতপ্রায়, ইহাও বুঝিলেন না।
অথচ উত্তর ভারতের কৃষক সম্প্রদায় অক্লেশে যাবতীয় মিথ্যাচারের স্বরূপ বুঝিয়াছিলেন, ‘কোভিড’-এর নিষেধবিধি তাঁহাদের টলাইতে পারে নাই, সংক্রমণের ‘আতংকসংবাদে’ তাঁহারা ভ্রুক্ষেপও করেন নাই, বরং পরস্পরের স্পর্শে মুখর হইয়াছেন। কর্মিষ্ঠ কৃষকের ন্যায় আন্দোলনের একনিষ্ঠ পরিচর্যাই তাঁহাদের ব্রত ছিল। ‘উহাদের মশা লাগে না’! ‘বামপন্থী’ দলগুলিও শরিক ছিল বটে, তবে কেন ছিল, কী উদ্দেশ্যে তাহা রহস্যাবৃত। কারণ, আমাদের দেশে ‘বাম’ আন্দোলনের চরম পরিণতির অভিজ্ঞতা মধুর নহে। বরং যখনই বারংবার জনমানুষ বিজয়বিক্রমে অগ্রসর হইতে চাহিয়াছে, রাষ্ট্রশক্তি প্রায় পলায়নপর, তখনই সামাল সামাল রব উঠিয়াছে, নেতৃগোষ্ঠীও পলায়নপর হইয়াছে। অবর্ণনীয় শুশ্রূষাহীন কষ্টে যখন জনমানুষ কোনওক্রমে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে উঠিয়া দাঁড়ায় তখন ধারাপাতের খোঁজ পড়ে, কোন সূত্রানুযায়ী কোন পথে গমণ ব্যাকরণশুদ্ধ হইবে! তাই বাম নেতৃত্বে জনমানুষের যুগল-স্নান আর দৃশ্যমান হইল না। তাহাদের গোষ্ঠীগর্বও চমৎকার, অথচ কোনও গোষ্ঠীই জনমানসের সহজ বুদ্ধির জটিল অংক বুঝিতে নারাজ; তাই যুগল আনন্দে মনোরম আশ্রম রচনা হইয়া উঠিল না। উপরন্তু, তাহাদের ‘ঈর্ষার আকাশে ভাসে ব্যর্থতার কিচির-মিচির’!
এমনকী, দুনিয়ার যাবতীয় অঞ্চলের বৈচিত্র্য উপেক্ষা করিয়া, সার্বভৌমত্ব খণ্ডন করিয়া, কর্পোরেটের প্রখর নির্দেশে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ যখন ‘এক বিশ্ব এক স্বাস্থ্য’ নামক তাজ্জব কর্মসূচি প্রণয়ন করে, তখনও ‘বাম’ দলগুলি ভোট যুদ্ধের সরল সমীকরণে ব্যস্ত থাকে। লোকসাধারণের উপকার-নিমিত্ত এই ঔপনিবেশিক কর্মকাণ্ডে আমাদের চিকিৎসা জগতের সদবংশজাত, কুলীন এবং ঔষধ সাম্রাজ্যের মাতব্বরদিগের সম্মিলিত স্তবগান এবং বর্ণাঢ্য মিছিলে বামেরাও সামিল হইয়া যায়। বিস্ফোরক বিদ্যার গরিমা লইয়া কেতাদুরস্ত ‘বাম’ বিদ্বানগণ আপনাপন বিদ্যা জাহির করিতে উন্মুখ থাকেন। অপরদিকে, লোকস্বাস্থ্যের উন্মুক্ত আকাশটি যাঁহাদের দৃষ্টিতে যথাযথ ধরা দেয় সেই আরামকেদারাহীন লোকস্বাস্থ্যের গবেষকগণ বলিতে থাকেন, অতিমারী লইয়া ভ্রান্তিবিলাসে মগ্ন না-থাকিয়া প্রাকৃতিক শক্তিগুলোর প্রতি নজর রাখুন। যে-শক্তিগুলি প্রকৃতির দান তাহা অনেক বেশি ক্ষমতাশালী, ভাইরাস সংক্রমণ হইতে অর্জিত কবচকুণ্ডল - যেকোনও কারিগরি কৌশল হইতে অনেক গুণ বেশি টেকসই। লোকস্বাস্থ্যের শাসনপদ্ধতি লোকেরাই রচনা করিয়া লয়, বিশ্বের নানা অংশের উদ্ভিন্ন পরিবেশ, প্রয়োজন, রুচি আর ইচ্ছা অনুযায়ী। ‘বাম’ দলগুলি এইসকল কথায় মনোনিবেশ করেন না।
পরিতাপের কথাগুলিই বলিলাম। অতএব, আধুনিক বণিকবুদ্ধির সম্মুখে প্রচলিত অর্থে দক্ষিণ ও বাম যখন অসহায়, আভূমিপ্রণত তখন আমরাই বা বিজ্ঞান ও সমাজচর্চাকে বাম-দক্ষিণে ভাগ করিব কেন? বরং যাহা যুক্তিগ্রাহ্য, জনমানষের পক্ষে সমীচীন ও উপকারী তাহাতেই আস্থা রাখিব। কৃষক সম্প্রদায় মনে করাইয়া দিয়াছে, মানুষের ঘুম নাই। প্রাণহীন, প্রণয়বিহীন সভ্যতার নষ্টকালে তাই প্রখ্যাত কবি হেলাল হাফিজ-এর ভাষায় বলিতে হয়,
‘চতুর বণিক তুমি আঁধারে নেমেছো এই বাণিজ্য ভ্রমণে,
কে জানে কী আছে পাড়া-পড়শীর মনে।
লোভে আর লালসায় অবশেষে আগন্তুক সর্বস্ব হারাবে,
কেননা প্রভাত হলে চারদিকে মানুষের ঢল নেমে যাবে।
______________________________
দোহাই -
● Of Armchair Generals and Ameteur Docs. Dr Amitav Banerjee.
● http://epaper.nationalheraldindia.com (এই রচনাটি বর্তমান নিবন্ধের প্রধান রসদ)
● How to Make War: A Comprehensive Guide to Modern Warfare in the Twenty-first Century. James F Dunnigan. William Morrow Paperbacks; 4th ed. Edition. Apr, 2003.
● World report on violence and health. Ed. Krug EG, Dahlberg LL, Mercy JA, Zwi AB, Lozano R. World Health Organization: Geneva; 2002.
● War and public health. 2nd ed. Levy BS, Sidel VW. New York: Oxford University Press; 2007.
● Thinking, Fast and Slow. Kahneman, Daniel. Farrar, Straus and Giroux. 2011.
● Susan Sontag. Illness as Metaphor. Farrar, Straus & Giroux, US, 1978.
● ‘Greedy Reductionism’. In Darwin’s Dangerous Idea, Daniel C Dennett. Simon & Schuster, 1995.
● যে জলে আগুন জ্বলে; হেলাল হাফিজ। প্রথম প্রকাশ, ১৯৮৬। একত্রিংশ মুদ্রণ, ২০১৮, ঢাকা।