আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ● ১-১৫ ফাল্গুন, ১৪২৯
প্রবন্ধ
বেড়ে চলা ছাত্র-আত্মহত্যা ও সামাজিক উদাসীনতা
পারভেজ খান
নিওলিবারেলিজম বা নব্য উদারবাদ কী, তা নিয়ে যখন কারো সাথে আলোচনা করি আমি একটা কথা খুব বলি - এই যে ধরুন আমি বিষ খেয়ে মরে যাচ্ছি, কিন্তু তারপরও বলছি যে বিষটা ঠিকই ছিলো, আমার বিষ গ্রহণ করার ক্ষমতা কম তাই মরে যাচ্ছি, আমারই কিছু অক্ষমতা আছে, বিষ সে তো দারুণ, ভেজাল কম, শুদ্ধ, সক্ষম। তবে এই লেখাটা সে নিয়ে নয়, হতে পারে তার একটা বড়ো ফসল নিয়ে। একটা প্রশ্ন নিয়ে - "এভাবে একে একে ম'রে যাবে নিজে নিজে?" আমরা চুপচাপ দেখে যাবো, শুনে যাবো, ভুলে যাবো, এড়িয়ে যাবো আর বলে দেবো অক্ষম। এতো সুন্দর সহজ সমীকরণ?
আত্মহত্যা। নিজেকে শেষ করে দেওয়া। সাম্প্রতিক অতীতের খবরের কাগজগুলো ওল্টালে তা নিয়ে ভুরি ভুরি রিপোর্ট পাওয়া যাবে। ভারতবর্ষের কিশোর ও যুবক যাদের বয়স ২৫ বছরের কম তারা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৪ শতাংশ দখল করে আছে। এনসিআরবি-র ২০২০ একটা তথ্য অনুযায়ী এদেশে প্রত্যেক ৪২ মিনিটে একজন ছাত্র আত্মহত্যা করে, মানে দিনে ৩৪ জনেরও বেশি। কিন্তু তারপরও এইটাকে সমস্যা বলে স্বীকার করার কোনো লক্ষ্মণই দেখা যায় না, না সরকারিভাবে না সামাজিকভাবে, বরং সবার চোখে এরা ব্যর্থ, হেরে যাওয়া মানুষ হিসেবেই ঠাঁই পায়।
আরও কিছু তথ্যে আসা যাক, ভারত সরকারেরই ২০২০-র একটা রিপোর্ট বলছে, যেখানে কর্মক্ষেত্র বা জীবিকা অনুসারে আত্মহত্যার শতাংশ ভাগ করা হয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে - দিনমজুর বা ডেইলি ওয়েজ লেবার বা দৈনিক মজুরিপ্রাপ্ত শ্রমিকদের মধ্যে এই আত্মহত্যার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, প্রায় ২৫%, তারপরই গৃহবধূ - প্রায় ১৫%, আনএমপ্লয়েড বা বেকার জনসংখ্যা, এর ১১% জুড়ে আছে আর ছাত্রদের সংখ্যা ৮%, অবসরপ্রাপ্তদের ১% আত্মহত্যা করেন। ফলে এটা বোঝাই যাচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের নিজেদেরকে শেষ করে ফেলার সংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণ। দূর্ঘটনার দরুন মৃত্যু ও আত্মহত্যা নিয়ে NCRB ও ADSI-এর ২০২০-র রিপোর্ট জানাচ্ছে দেশের ৮.২% ছাত্রর আত্মহত্যায় মৃত্যু হয়। ওই বছরই, মানে ২০২০-তে দেশে ৬৪,১১৪ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছেন, যাদের প্রত্যেকেরই বয়স ৩০ বছরের কম। এবার, এক জনের আত্মহত্যার প্রভাব শুধু সেই মানুষটির উপর সীমাবদ্ধ থাকতে পারেনা, তার কাছের প্রত্যেকটি মানুষ এরকম ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হবেন, সেটাই স্বাভাবিক - এবং সে বিষয়ের একটি রিপোর্ট বলছে ভারতবর্ষে প্রতি ৬০ জনে এক জন এরকমভাবে প্রভাবিত। এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না, যে আমরা যতটাই মুখ ঘুরিয়ে থাকিনা কেন, এটি একটি সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক স্বাস্থ্য-জনিত গভীর সমস্যা, যেটাকে আমরা সমস্যা বলে স্বীকার করতেই চাই না - গুরুত্বও দিইনা। আরও একটা কথা বলা দরকার, যে পরিসংখ্যান NCRB দিচ্ছে, তাতে যে তথ্য দেওয়া আছে সেটা নাকি আবার আসল সংখ্যার থেকে প্রায় ৩৭% কম, এমনটাই দাবি করছে বিখ্যাত জার্নাল 'ল্যান্সেট'-এর একটি আর্টিকেল। মানে আসল সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়ায় আরও বেশি। ADSI, GoI-এর ছাত্রদের আত্মহত্যার সাল অনুযায়ী গ্রাফ আঁকলে সেটা সবসময়ই ঊর্ধ্বগামী। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০২০-তে আত্মহত্যার দরুন ছাত্রছাত্রীদের মৃত্যুর সংখ্যা ২২৫ শতাংশ বেড়েছে।
যাই হোক তথ্যের কচকচানি ছেড়ে কিছু অন্য কথা বলা যাক। এতো সংখ্যক ছাত্রছাত্রী যখন নিজেদেরকে শেষ করে দিচ্ছে, তখন গোটা শিক্ষা-ব্যবস্থায়, সমাজ-ব্যবস্থায়, এবং পরিমন্ডলের সম্মিলিত কিছু কিছু সমস্যা তো আছেই। '৯৭ সাল মানে আমি বেশ ছোটো তখন, খুব সম্ভবত ক্লাস টু। তার ছ'বছর আগে এদেশে মুক্ত অর্থনীতির সূচনা হয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন পরিষেবা থেকে হাত গোটাতে শুরু করে দিয়েছে সরকার। আর ২০২৩ যে সময়ে দাঁড়িয়ে আমি এই লেখা লিখছি তখন সেই হাত গুটিয়ে ফেলা এক চুড়ান্ত আকার নিয়ে নিয়েছে। এবার মাঝের ১০ বছর, মানে ২০১০ থেকে ২০২০ অবধি সময়কাল যদি দেখি - ঠিক তার আগে ২০০৭-এ একটা বিশ্বব্যাপী মন্দা এসেছে, যদিও ভারত তাতে খুব বেশি আক্রান্ত হয়নি। ২০১০ থেকে ২০২০-র দশকে শিক্ষা-ব্যবস্থায় সবচেয়ে যে পরিবর্তনগুলো চোখে পড়েছে তা এক এক করে বলি। হঠাৎ করেই চারিদিকে গজিয়ে উঠেছে বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, আর তার জন্য কোচিং সেন্টার। মোড়ে মোড়ে তার বিজ্ঞাপন। তার হাত ধরে সমস্ত চাকরির পরীক্ষার জন্য মুড়ি মুড়কির মতো কোচিং সেন্টার। শিক্ষার একটা মূল উদ্দেশ্য মানুষ হওয়া থেকে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য শিফট হয়ে গেলো চাকরিতে। সবাইকে লেলিয়ে দেওয়া হলো ranking-এর পিছনে। আকাশছোঁয়া আশা বাড়তে লাগলো সমাজে, তার সাথে সাথে হতাশা। সবাইকে সব বিষয়ে এগিয়ে থাকতে হবে, পিছিয়ে পড়লেই তোমার দোষ শিখিয়ে দিতে থাকলো নব্য উদারবাদ। দশ বছরে আরও একটা জিনিস হ'ল এই সবেরই হাত ধরে - মানুষ যন্ত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়াতে লাগলো, কিন্তু যার প্রাণ আছে সে তো হাপাবেই। ধৈর্য বলে কিছু রইলো না মানুষের। তৎক্ষনাৎ চাই, নইলে চাইনা। রিলস-এর যুগে সেটা সহজবোধ্য। দু'দন্ড বসার সময় নেই - নব্য উদারবাদ সেটাকে বলে দিলো অপচয় বা সময় নষ্ট। এই পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠা ছাত্রই তার না পাওয়াগুলোকে তার নিজের ব্যর্থতা মনে করে সমাজ থেকে হারিয়ে যাওয়া সহজ করে নিলো। আমরাও দায় ঝেড়ে নিলাম।
আরও অনেক ছোটো বড়ো কারণ থাকবে, কিন্তু কারণগুলি এই প্রধান ছাতার তলায় আসতে বাধ্য। কিন্তু সবাই মিলে কবে ভাববো আমরা? এই দৌড়ের শেষ কোথায়! না কি এরকমভাবেই অগ্রাহ্য করতে থাকবো, আমরা তো বেশ আছি বলতে বলতে।
(তথ্যসূত্রঃ দ্য ওয়ার)