আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ● ১-১৫ ফাল্গুন, ১৪২৯
প্রবন্ধ
শান্তিনিকেতনী তরজা
কানাইলাল মুখোপাধ্যায়
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী অধ্যাপক অমর্ত্য সেন-এর শান্তিনিকেতনের পারিবারিক বাসস্থান নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। তাঁর প্রতিটি বক্তব্যর জবাব দেওয়ার আগে বিষয়টি আরও একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক, নইলে অনেকেই খেই হারিয়ে ফেলবেন।
তামাদি বিষয় নিয়ে তরজায় নেমেছেন উপাচার্য
সিভিল তথা দেওয়ানি বিষয়ে বিবাদ তোলার একটা সময়সীমা বেঁধে দেওয়া থাকে। সময়সীমা পেরিয়ে গেলে সেই বিবাদ তোলার অধিকারটা তামাদি হয়ে যায়, অর্থাৎ সে বিবাদ আর তোলা যায় না। যে আইনে এই কথা বলা আছে তার নাম ‘ল অব লিমিটেশন’। বাংলায় যে যে আইনে ম্যাপ ও রেকর্ড তৈরি হয়েছে সেই সেই আইনেই বলে দেওয়া আছে কতদিন পর্যন্ত ম্যাপ ও রেকর্ডের বিরুদ্ধে আপত্তি জানানো যায়। সেই সময়সীমা পেরিয়ে গেলে আর কোনও আপত্তি জানানো যায় না। রেকর্ডের তথ্যকেই সত্য বলে মান্যতা দিতে হবে। যেমন বর্তমানে প্রাসঙ্গিক আইন হচ্ছে ‘ল্যান্ড রিফরমস অ্যাক্ট’। সেই আইনে বলা আছে যে, রেকর্ডের চূড়ান্ত প্রকাশের দিন থেকে এক বছরের মধ্যে আপত্তি জানাতে হবে। শান্তিনিকেতনের জমির রেকর্ডের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে ১৯৮৪ সালে। তাহলে আজ যে আর তার বিরুদ্ধে আপত্তি জানানোর কোনও অবকাশ নেই তা যে কোনো মানুষ অঙ্ক না কষেও বলে দেবেন।
উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি ও তা নিয়ে হেনস্তা
আরও একটি বিষয় আছে। এলআর রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে যে, উত্তরাধিকারের বিষয় ছাড়া আর কোনও বিষয়ে রেকর্ডের কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। অর্থাৎ, আরএস-এর সময়ে যা তথ্য লিপিবদ্ধ হয়েছিল তা একই আছে। আরএস রেকর্ড হয়েছিল পঞ্চাশ দশকের শেষার্ধ থেকে ষাটের দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত। সুতরাং, রেকর্ডের তথ্য প্রায় ষাট বছরের পুরনো।
অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের খতিয়ানের নম্বর ১৯০০/২৪৮৭। সেটেলমেন্টের ভাষায় একে বলে বাই নম্বর বা বাটা দাগ। অর্থাৎ ১৯০০ নম্বর দাগ থেকে ২৪৮৭ দাগের উৎপত্তি হয়েছে। ১৯০০ নম্বর দাগটি বিশ্বভারতীর জমির দাগ নম্বর যা সিএস রেকর্ডে নির্ধারিত হয় তিরিশের দশকে। বিশ্বভারতী ১৯০০ দাগ থেকে জমির লিজ দিতে শুরু করে সিএস রেকর্ড তৈরি হবার পর থেকে। অধ্যাপক সেনের দাগ নম্বর যখন ২৪৮৭ তখন অনুমান করা যেতে পারে যে, আরও বেশি সংখ্যক জমিতে লিজ দেওয়া হয়েছিল। অতএব জমি লিজ দেওয়ার ঘটনা ঘটে সেটেলমেন্টের ভাষায় সিএস ও আরএস-এর মধ্যিখানে।
সুতরাং, আরএস রেকর্ড যখন তৈরি হয় তখনই এইসব লিজ দেওয়া জমির বিস্তারিত তথ্য আহরণ করা হয়। প্রতিটি দাগের মাপজোক করে ম্যাপ তৈরি হয়। কোন লেসির দখলে কত জমি আছে তা লিপিবদ্ধ করা হয়। অর্থাৎ বিস্তারিতভাবে সার্ভে ও সেটেলমেন্টের কাজ করে এসটেটস অ্যাকুজিশন অ্যাক্টের ৪৪(২) ধারা মতে রেকর্ডের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে ষাটের দশকের প্রথম দিকে। পরে এলআর অ্যাক্টের সংশোধনের সময় দেখা যায় তথ্যের বিশেষ কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। আরএস এবং এলআর রেকর্ড - দুটি ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে আশুতোষ সেনের দখলে ১.৩৮ একর জমি রেকর্ড করা হয়েছে। সুতরাং, ওটাই লিজ এরিয়া। ২০০৬ সালে আশুতোষ সেনের একমাত্র ওয়ারিশ হিসেবে শ্রী অমর্ত্য সেনের নামে মিউটেশন হয়।
উপাচার্যের এক্তিয়ার বনাম দেশের কানুন
উপাচার্য কী চাইছেন? ষাট বছরের পুরনো রেকর্ডের তথ্য এবং ৩৮ বছর পেরিয়ে যাওয়া এলআর রেকর্ডকে চ্যালেঞ্জ করছেন। তেমন ক্ষমতা কোনও আইন তাঁকে দেয়নি। যদি তিনি সরকারকে পার্টি করে কোনও উপযুক্ত আদালত থেকে এমন কোনও আদেশ আনতে পারেন যে, রেকর্ড ভুল তাহলেই সরকার তাঁর কথা শুনতে পারেন। নাহলে সরকারের কারুর ক্ষমতা নেই আইনের বাইরে গিয়ে তাঁর কথা শোনার। আর শোনারও কিছু নেই। আরএস রেকর্ডেই আশুতোষ সেনকে ১.৩৮ একরের লেসি হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছিল।
উপাচার্য বলছেন সরকারি ম্যাপ ও রেকর্ড অপ্রাসঙ্গিক। এ ধরনের কান্ডজ্ঞানহীন কথাবার্তা আমরা বিশ্বভারতীর উপাচার্যের কাছে আশা করি না। সর্বোপরি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যুক্ত ছিলেন। জমির রেকর্ডই হল জমি দখলের একমাত্র প্রামাণ্য নথি।
উপাচার্য আরও বলেছেন যে, অনেকেই বিশ্বভারতীর জমি বাড়তি দখল করেছেন, অমর্ত্য সেন তাঁদের মধ্যে একজন। রেকর্ড বলছে অমর্ত্য সেনের দখলে লেসি হিসেবে ১.৩৮ জমি আছে। অবশ্য উপাচার্য তো রেকর্ডই অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করেন এবং মানেন না।
উপাচার্য এখন হঠাৎ করে ২০০৬ সালের নথির কথা বলছেন। ২০০৬ সালে কোনও নথি তৈরি হয়নি। ১৯৮৪ সালের চূড়ান্ত রেকর্ডে আশুতোষ সেনের নাম কেটে অমর্ত্য সেনের নামে মিউটেশন দেওয়া হয়েছে। উপাচার্য বলছেন বকেয়া খাজনা হিসেবে সরকার যে টাকা আদায় করেছে তার থেকে নাকি লিজ জমির হিসেব পেয়েছেন। লেসর হিসেবে লিজ জমির কপি তো উপাচার্যর কাছে থাকার কথা, অন্তত হিসেব থাকার কথা। সেটা তিনি দেখতে পারেন। সেটা দেখার আশায় রইলাম।
উপাচার্য বলেছেন যে, স্বয়ং ভগবান বিশ্বভারতীর জমি দখল করতে চাইলে তিনি রুখে দাঁড়াবেন। ভাল কথা। ১৯৪৩ সাল থেকে আশুতোষ সেন ১.৩৮ একর জমি দখল করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে তস্য পুত্র অমর্ত্য সেন তা দখল করছে। অর্থাৎ জমি দখলের মোট সময় হল ৮০ বছর। তাহলে উপাচার্য তাঁর ভগবানকে বলুন যে দেশের কোন আইনে ৮০ বছর দখলে থাকা কোনও জমি থেকে কাউকে উচ্ছেদ করা যায় তার হদিস দিতে।