আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ● ১-১৫ ফাল্গুন, ১৪২৯

প্রবন্ধ

পশ্চিমবঙ্গের কৃষি ও বামফ্রন্টের কৃষিনীতি - একটি পর্যালোচনা

মৈত্রীশ ঘটক


।। ১ ।।

ষাটের দশকের শুরু থেকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ধারাবাহিক এবং তুলনাযোগ্য পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। তখন থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত সারা দেশের পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি একটা ছবি যদি দেখি, তাতে দুটো প্রবণতা চোখে পড়তে বাধ্য।

প্রথমত, মাথাপিছু গড় আয়ের দিক থেকে ষাটের দশকে সমস্ত রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ একদম প্রথম সারিতে ছিল, তারপর তার আপেক্ষিক অবস্থার ক্রমাবনতি হয়েছে, যে প্রবণতা গত এক দশকে অব্যাহত আছে। জনসংখ্যার দিক থেকে বৃহত্তম পনেরটি রাজ্যের মধ্যে ষাটের দশকের গোড়ায় পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল একদম ওপরে, তামিলনাড়ুর ঠিক পরেই (এবং তাদের মধ্যে তফাৎ ছিল নেহাতই সামান্য), তার পরে ছিল মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, গুজরাট ইত্যাদি। ষাটের দশকের শেষ থেকেই পিছিয়ে পড়া শুরু হয়। ষাটের দশকে গড় হিসেব করলে রাজ্যের তালিকায় মাথাপিছু গড় আয়ে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান ছিল তিন, সত্তরের দশকে তা নেমে হয় ছয়, আশি ও নব্বইয়ের দশকে তা হয়ে দাঁড়ায় সাত ও আট। গত এক দশকে তা দাঁড়িয়েছে এগারোয়।

বৃদ্ধির হারও একই কথা বলে (সারণী ১ দ্রষ্টব্য)। যখন রাজ্যের অবস্থান ওপরের দিকে ছিল, তখন দেশের তুলনায় বৃদ্ধির হার কম হওয়ায় আপেক্ষিক অবস্থানে অধোগতি শুরু হয়। কিন্তু বৃদ্ধির হারের সাথে মাথাপিছু গড় আয়ের সম্পর্ক বিপরীতমুখী - ঠিক যেমন পরীক্ষার নম্বর আর সেই নম্বরের বৃদ্ধির হারের মধ্যে সম্পর্ক। যখন নম্বর বেশি, তখন আরো বেশি নম্বর তোলা মুশকিল, কিন্তু নম্বর অল্প হলে উন্নতি বা বৃদ্ধির হার বেশি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সেরকম একবার পিছিয়ে পড়লে বৃদ্ধির হার ভালো হওয়া খুব শক্ত নয়, কিন্তু আগের জায়গা ফিরে পাওয়া অনেক বেশি শক্ত।

সারণী ১: পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের গড় মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধির হার

বছর মাথাপিছু আয়ের গড় বৃদ্ধির হার
পশ্চিমবঙ্গ ভারত
১৯৬১-১৯৭১ -০.২% ১.৭%
১৯৭১-১৯৮১ ১.১% ০.৭%
১৯৮১-১৯৯১ ২.০% ৩.৪%
১৯৯১-২০০১ ৪.৭% ৩.৫%
২০০১-২০১১ ৫.১% ৪.৯%
২০১১-২০২০ ৩.৮% ৪.৮%
১৯৬১-২০২০ ২.৮% ৩.১%

টিকাঃ নীট দেশজ উৎপাদন (net domestic product) ২০১১-১২ সালের মূল্যে। বাৎসরিক বৃদ্ধির হারের দশকব্যাপী গড় নেওয়া হয়েছে। বছর বলতে আর্থিক বছর (যেমন, ১৯৬১ হলো ১৯৬১-৬২), বোঝানো হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, রাজ্যের আয়ে যদি কৃষি, শিল্প এবং পরিষেবার অনুপাত দেখি (সারণী ২), তাহলে যেটা উল্লেখযোগ্য তা হলো ষাটের দশকের পরের তিন দশকে সারা ভারতে কৃষির আপেক্ষিক গুরুত্ব কমেছে, কিন্তু রাজ্যে কৃষির আপেক্ষিক গুরুত্ব কমেনি। বিভিন্ন দেশ ও কাল জুড়ে উন্নয়নের প্রক্রিয়ার একটা পরিচিত ছবি হলো কৃষির আপেক্ষিক গুরুত্ব কমা, এবং তার জায়গায় প্রথমে শিল্প ও তারপরে পরিষেবার আপেক্ষিক গুরুত্ব বাড়া। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের একটা বড়ো সময় জুড়ে এই প্রবণতা খানিকটা পরিচিত ছকভাঙা।

সারণী ২: পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের আয়ে কৃষি, শিল্প এবং পরিষেবার অনুপাত

বছর কৃষি ও সম্পর্কিত ক্ষেত্র শিল্প পরিষেবা
পশ্চিমবঙ্গ ভারত পশ্চিমবঙ্গ ভারত পশ্চিমবঙ্গ ভারত
১৯৬১-১৯৭১ ৪০.১% ৫৩.১% ৩৪.০% ২১.৬% ২৫.৯% ২৫.৪%
১৯৭১-১৯৮১ ৪১.২% ৪৮.১% ৩১.২% ২৪.৭% ২৭.৬% ২৭.২%
১৯৮১-১৯৯১ ৪২.৭% ৪১.৬% ২৬.৯% ২৭.২% ৩০.৪% ৩১.৩%
১৯৯১-২০০১ ৪০.৯% ৩৩.৭% ২৫.৫% ৩০.১% ৩৩.৬% ৩৬.২%
২০০১-২০১১ ৩০.৪% ২৪.৪% ২৭.৮% ৩১.৮% ৪১.৮% ৪৩.৮%
২০১১-২০২০ ২২.৮% ১৭.৮% ২৬.০% ৩১.৫% ৫১.২% ৫০.৭%
১৯৬১-২০২০ ৩৬.৩% ৩৬.৫% ২৮.৬% ২৭.৮% ৩৫.১% ৩৫.৮%

টিকাঃ বিভিন্ন ক্ষেত্রের অবদান বাৎসরিক ভিত্তিতে গণনা করা হয়েছে, এবং তারপর সারা দশকের গড় নেওয়া হয়েছে। রাজ্যের নীট দেশজ উৎপাদন (net state domestic product) ২০১১-১২ সালের মূল্যের ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে, দেশের ক্ষেত্রে সমস্ত রাজ্যের মোট নীট দেশজ উৎপাদন হিসেব করে গড় নেওয়া হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে শিল্প ও কৃষির আপেক্ষিক অনুপাতের এই ভিন্নতর চিত্রের কারণ কী? এর একটা উত্তর অবশ্যই শিল্পক্ষেত্রে রাজ্যের পিছিয়ে পড়া। ষাটের দশক থেকে শুরু করে উদারীকরণের নীতি চালু হবার সময় অবধি রাজ্যে শিল্পক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার সারা দেশের থেকে লক্ষণীয়ভাবে কম ছিল। উদারীকরণের পরের তিন দশকে রাজ্যে এবং দেশে দু' জায়গাতেই শিল্পে বৃদ্ধির হার বাড়ে, কিন্তু দেশের তুলনায় রাজ্যের বৃদ্ধির হার অল্প হলেও কম থেকে যাওয়ায়, তার আগের তিন দশকের হারানো জমি উদ্ধার করা যায়নি। এর সমস্ত দায় রাজ্যের নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু নীতিও (যেমন, মাসুল সমীকরণ) অবশ্যই দায়ী। রাজ্যের শিল্পক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার কার্যকারণ এই প্রবন্ধের আলোচনার বিষয় নয় - তা আলাদা বিশ্লেষণ দাবি করে। কিন্তু যে সময় ধরে রাজ্যে শিল্পের অবনতি হয়েছে, তার পাশাপাশি কৃষিতে রাজ্যে সারা দেশের তুলনায় আপেক্ষিক সাফল্য না দেখলে ছবিটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সত্তর, আশি, ও নব্বইয়ের দশকে রাজ্যে কৃষি উৎপাদনের হার সারা দেশের গড় বৃদ্ধির হারের থেকে বেশি ছিল (সারণী ৩ দ্রষ্টব্য)।

সারণী ৩: পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতে বিভিন্ন ক্ষেত্রের উৎপাদনের বৃদ্ধির হার

বছর কৃষি ও সম্পর্কিত ক্ষেত্র শিল্প পরিষেবা
পশ্চিমবঙ্গ ভারত পশ্চিমবঙ্গ ভারত পশ্চিমবঙ্গ ভারত
১৯৬১-১৯৭১ ১.৮% ৪.২% ২.৬% ৭.০% ২.৭% ৫.৩%
১৯৭১-১৯৮১ ৩.৫% ১.৯% ২.১% ৪.৫% ৪.০% ৪.৬%
১৯৮১-১৯৯১ ৪.৩% ৩.৫% ৩.৩% ৬.৩% ৫.১% ৬.৪%
১৯৯১-২০০১ ৪.৭% ২.৭% ৬.০% ৫.৬% ৮.২% ৭.৬%
২০০১-২০১১ ২.২% ৩.৯% ৬.৫% ৮.৭% ৮.১% ৯.৩%
২০১২-২০১৯ ২.৫% ৩.৪% ৭.২% ৭.১% ৫.৪% ৭.৩%
১৯৬১-২০১৯ ৩.২% ৩.২% ৪.৬% ৬.৬% ৫.৬% ৬.৮%

টিকাঃ বাৎসরিক বৃদ্ধির হারের দশকব্যাপী গড় নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রের অবদান বাৎসরিক ভিত্তিতে গণনা করা হয়েছে, এবং তারপর সারা দশকের গড় নেওয়া হয়েছে। রাজ্যের নীট দেশজ উৎপাদন (net state domestic product) ২০১১-১২ সালের মূল্যের ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে, দেশের ক্ষেত্রে সমস্ত রাজ্যের মোট নীট দেশজ উৎপাদন হিসেবে করে গড় নেওয়া হয়েছে। বাৎসরিক পরিসংখ্যানের তুলনার সমস্যার কারণে ২০১১-১২ সালকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের সাথে পরিবেশ ও ভৌগলিক দিক থেকে মিল থাকায় পশ্চিমবঙ্গের কৃষিক্ষেত্রের তুলনা করা যেতে পারে। তা যদি করি (সারণী ৪) তাহলে উল্লেখযোগ্য যে সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গে বৃদ্ধির হার বেশি ছিল।

সারণী ৪: পশ্চিমবঙ্গ, ভারত, ও বাংলাদেশে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনের বৃদ্ধির হার

বছর কৃষি ও সম্পর্কিত ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার
পশ্চিমবঙ্গ ভারত বাংলাদেশ
১৯৬১-১৯৭১ ১.৮% ৪.২% ৩.২%
১৯৭১-১৯৮১ ৩.৫% ১.৯% -০.৩%
১৯৮১-১৯৯১ ৪.৩% ৩.৫% ২.৫%
১৯৯১-২০০১ ৪.৭% ২.৭% ৩.০%
২০০১-২০১১ ২.২% ৩.৯% ৪.২%
২০১২-২০১৯ ২.৫% ৩.৪% ৩.৩%
১৯৬১-২০১৯ ৩.২% ৩.২% ২.৭%

শুধু উৎপাদন নয়, আমরা যদি উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধির হারও দেখি, তাহলে আশি ও নব্বইয়ের দশকে রাজ্যের বৃদ্ধির হার সারা দেশের গড় বৃদ্ধির হারের থেকে বেশি। অথচ আমরা যদি ধানচাষ বা খাদ্যশস্যের উৎপাদনশীলতার মানের স্তর দেখি, তা কিন্তু ষাটের দশকের গোড়া থেকে শুরু করে এখন অবধি দেশের গড় উৎপাদনশীলতার মানের থেকে বেশি। দেশের গড়ের থেকে এগিয়ে থেকেও রাজ্যে কৃষির উৎপাদনশীলতার দ্রুততর গতিতে বৃদ্ধি হয়েছে, এটা উল্লেখযোগ্য। যদি উল্টোটা হত, অর্থাৎ পিছিয়ে থাকা অবস্থায় শুরু করে দ্রুততর গতিতে বৃদ্ধি হত, তা হলে বলা যেত নেহাতই পিছিয়ে ছিল বলেই উন্নতির অবকাশ ছিল।

রাজ্যের গ্রামীণ অর্থনীতিতে সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকে উন্নয়নের প্রমাণ শুধু উৎপাদনশীলতাতেই নয়, অন্যান্য নানা মাপকাঠিতেও ধরা পড়েছে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার (ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে বা এনএসএস) পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যে দারিদ্রসীমার নিচের গ্রামীণ জনসংখ্যা দেশের গড়ের তুলনায় অধিকতর হারে হ্রাস পেয়েছে (সারণী ৫) সত্তরের দশকের গোড়া থেকে নব্বইয়ের দশকের শেষ অবধি।

সারণী ৫: দারিদ্ররেখার তলায় গ্রামীণ জনসংখ্যার অনুপাত

বছর পশ্চিমবঙ্গ ভারত
১৯৭৩-১৯৭৪ ৭৩.২ ৫৬.৪
১৯৭৭-১৯৭৮ ৬৮.৩ ৫৩.১
১৯৮৩-১৯৮৪ ৬৩.১ ৪৫.৬
১৯৮৭-১৯৮৮ ৪৮.৩ ৩৯.১
১৯৯৩-১৯৯৪ ৪০.৮ ৩৭.৩
১৯৯৯-২০০০ ৩১.৯ ২৭.১
২০০৪-২০০৫ ২৮.৬ ২৮.৩

টিকাঃ লাকড়াওয়ালা কমিটির প্রস্তাবিত দারিদ্ররেখা ব্যবহার করা হয়েছে।

তাই রাজ্যের অর্থনৈতিক যাত্রাপথে শিল্পের ক্ষেত্রে হতাশাজনক রেকর্ডের পাশাপাশি কৃষিতে আপেক্ষিক সাফল্য মনোযোগ দাবি করে।

।। ২ ।।

পশ্চিমবঙ্গে কৃষিতে আপেক্ষিক সাফল্যের কারণ কী? একটা মত হল আশি ও নব্বইয়ের দশকের পশ্চিমবঙ্গে কৃষির উৎপাদনশীলতা যেটুকু বেড়েছে তা মূলত সবুজ বিপ্লবের বিলম্বিত আগমনের ফল (উচ্চফলনশীল বীজ বা সেচের প্রসার) যার মূলে আছে ব্যক্তিগত উদ্যোগ। কিন্তু এই যুক্তির সমস্যা হল, এটি সারা পূর্বাঞ্চলের এবং প্রতিবেশী বাংলাদেশের (যা আবহাওয়া, প্রকৃতি, কৃষিপ্রযুক্তি বা ভূমিব্যবস্থার দিক দিয়ে অনেকটাই এই রাজ্যের সাথে তুলনীয়) ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে ধান চাষে উচ্চফলনশীল বীজের প্রসার পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে তুলনীয় হারেই হয়েছিল। অথচ পশ্চিমবঙ্গে কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হার বাকি সারা ভারত এবং বাংলাদেশের থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।

কিছু সমালোচক মনে করেন পশ্চিমবঙ্গে কৃষিতে উৎপাদনশীলতার এই অতিরিক্ত বৃদ্ধির হার বামফ্রন্ট সরকারের আমলে কৃষি পরিসংখ্যান নিয়ে কিছু বিতর্কিত পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে পরিসংখ্যানগত অতিরঞ্জনের কারণে হতে পারে। সৌভাগ্যক্রমে নতুন ও পুরনো সিরিজের পরিসংখ্যান ব্যবহার করে এবং গণনার সময়সীমা এগিয়ে ও পিছিয়ে বিভিন্নভাবে বৃদ্ধির হার গণনা করে এই বিতর্কের খানিকটা নিষ্পত্তি করা সম্ভব। আমরা সেটা করে দেখছি যে ১৯৭৭-এর পর থেকে আশির দশক এবং নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গে কৃষির উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধির হার তার আগের ও পরের পর্যায়ের তুলনায় বেশি। শুধু তাই নয়, তা একই সময়সীমার মধ্যে সারা ভারতের বৃদ্ধির হার, এবং প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের বৃদ্ধির হারের তুলনায়ও বেশি, যদিও কতটা বেশি সেটা কীভাবে হিসেবে করা হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করছে।

আরেকটি সম্ভাব্য কারণ হল বামফ্রন্ট সরকারের কৃষিনীতি। বামফ্রন্ট আমলের সার্বিক অর্থনৈতিক সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও কৃষিক্ষেত্রে সাফল্য নিয়ে মতভেদ কম, কিন্তু তার কার্যকারণ নিয়ে বিতর্ক আছে, যেমন এই সাফল্যের কতটা সত্যি আর কতটা সরকারি পরিসংখ্যানের অতিরঞ্জনের ফল; আর যেটুকু সাফল্যই সত্যি ঘটেছে তাতে বামফ্রন্টের কৃষিনীতি, বিশেষত অপারেশন বর্গা ও সীমিত ভূমি বন্টনের আদৌ কোন ভূমিকা আছে নাকি ঐ সময়ে পূর্বভারতে (এবং বাংলাদেশে) কৃষিতে কিছু প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আসে এই সাফল্য মূলত তারই ফল?

দুই দশক আগে এই নিয়ে আমার একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জি এবং পল গার্টলারের সাথে, যা ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো থেকে প্রকাশিত 'জার্নাল অফ পলিটিকাল ইকনমি' নামক অর্থনীতির গবেষণাপত্রে। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সরকারি পরিসংখ্যান এবং পশ্চিমবঙ্গের ৪৮টি গ্রামে করা একটি সমীক্ষার ফলাফল ব্যবহার করে আমাদের বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছিল এই প্রবন্ধ। সেই গবেষণা নিয়ে সেই সময়ে কিছু বিতর্ক হয়। পরেও এর সূত্র ধরে এই বিষয়ে কিছু গবেষণা হয়েছে। এখানে তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করছি। তিনটি মূল প্রশ্ন ধরে নিচের আলোচনাটা ভাগ করা হয়েছে।

২.১ পশ্চিমবঙ্গের কৃষিতে উৎপাদনশীলতা কি সত্যিই বেড়েছে, নাকি তা কেবলই পরিসংখ্যানের অতিরঞ্জন?

কেউই অস্বীকার করেন না যে আশির দশকের মাঝ থেকে পশ্চিমবঙ্গের কৃষিতে উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধির হরে বেড়েছে। এই রাজ্যের আগের অবস্থা বা পরিবেশে অঞ্চলগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে, অন্তত সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই বৃদ্ধির হার বেশ চোখে পড়ার মতো। ধরা যাক ধান চাষের উৎপাদনশীলতার কথা। ১৯৬৯ ও ১৯৭৮ সালের মধ্যে মোট বৃদ্ধির হার হল ৯%-এর কিছু বেশি। ১৯৭৯ ও ১৯৯৩ সালের মধ্যে মোট বৃদ্ধির হার ৬৮% প্রতিবেশী বাংলাদেশে ১৯৬৯ ও ১৯৭৮-এর মধ্যে বৃদ্ধির হার হল ১১%, ১৯৭৯ ও ১৯৯৩-এর মধ্যে ৪৮%।

দুটি বছরের মধ্যে তুলনা না করে যদি ১৯৭৯ ও ১৯৯৩-এর মধ্যে প্রতিটি বছরের পরিসংখ্যান নিয়ে বাৎসরিক চক্রবৃদ্ধির হার গণনা করা যায়, তুলনামূলক ছবিটা প্রায় একই রকম দাঁড়ায়। পশ্চিমবঙ্গে এই সময়ের মধ্যে বাৎসরিক চক্রবৃদ্ধির হার হল ৮.১% আর বাংলাদেশের ২.৮%। কোনও কোনও গবেষকের হিসাব অনুযায়ী (যেমন, অভিজিৎ সেন ও রঞ্জা সেনগুপ্ত, ১৯৯৫) আশির দশকে বাৎসরিক চক্রবৃদ্ধির হার এর থেকে অনেক বেশি, কেননা তাঁরা ১৯৮১ সাল থেকে বৃদ্ধির হার গণনা করেছেন এবং ওই বিশেষ বছরটিতে খরার জন্যে পশ্চিমবঙ্গে উৎপাদনশীলতা ছিল অনেকটা কম। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৯ ও ১৯৯৩ সালের মধ্যে বাৎসরিক চক্রবৃদ্ধির হার আমাদের গণনায় যা ধরা পড়েছে সরকারি পরিসংখ্যানের অতিরঞ্জনের সম্ভাবনায় চিন্তিত গবেষকদের (যেমন, জেমস বয়েস, হরিশ গজদার ও সুনীল সেনগুপ্ত) হিসেবও তার খুব কাছাকাছি।

অভিজিৎ সেন ও রঞ্জা সেনগুপ্ত দেখিয়েছেন যে তিনটি বছর (১৯৮১, ১৯৮৩, ১৯৮৪) কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি মন্ত্রকের থেকে ধান চাষের উৎপাদনশীলতার যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায় তার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি পরিসংখ্যানের প্রায় কোন তফাত নেই। ব্যতিক্রমী ওই তিনটি বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের ধানের উৎপাদনশীলতা রাজ্য সরকারের পরিসংখ্যানের থেকে বেশি ছিল।

কিছু সমালোচক মনে করেন পশ্চিমবঙ্গে কৃষিতে উৎপাদনশীলতার এই অতিরিক্ত বৃদ্ধির হার বামফ্রন্ট সরকারের আমলে কৃষি পরিসংখ্যান নিয়ে কিছু বিতর্কিত পদক্ষেপ পরিসংখ্যানগত অতিরঞ্জনের কারণ হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের ফলিত অর্থনীতি ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাক্তন ডিরেক্টর শ্রীসচ্চিদানন্দ দত্ত রায় ১৯৮৬-৮৭ এবং ১৯৯৪-৯৫ সালের মধ্যে কৃষির উৎপাদনশীলতা বিষয়ক পরিসংখ্যানের গুণগত মান নিয়ে ন্যায্য কিছু প্রশ্ন তুলেছেন (দত্ত রায়, ২০০২)। এই সময়ে ফলিত অর্থনীতি ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রথাগত যে পরিসংখ্যান সংগ্রহের পদ্ধতি তা বাতিল করে কৃষি বিভাগের হাতে পরিসংখ্যান সংগ্রহের সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৯৫-৯৬-এর পরে আবার পরিসংখ্যান সংগ্রহের পদ্ধতি পুরনো ব্যবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। যে সময়সীমার মধ্যে পরিসংখ্যান নিয়ে বিতর্ক আছে, তার পুরোটা না হলেও একটা পর্যায় (১৯৮৬-৮৭ এবং ১৯৮৯-৯০-এর মধ্যে) দুই সূত্র থেকেই তুলনীয় পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে তাই পরিসংখ্যানগত অতিরঞ্জনের মাত্রা সম্পর্কে খানিকটা আন্দাজ বার করা সম্ভব।

এখানে কতকগুলো সমস্যা আলাদা করা প্রয়োজন।

বৃদ্ধির হার গণনা করতে গেলে কোন সময়সীমার মধ্যে গণনা করা হচ্ছে, এবং তার মধ্যে পরিসংখ্যানের অতিরঞ্জনের সমস্যা থাকলে কী হতে পারে, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। বামফ্রন্টের কৃষিনীতির প্রভাব বিচার করতে গেলে একটা সমস্যা হল, বামফ্রন্ট আসার পরে পরেই কৃষিক্ষেত্রে কিছু সংস্কার যেমন শুরু হয়ে যায়, আবার একই সাথে প্রাকৃতিক কারণে বেশ কয়েক বছর কৃষিতে উৎপাদনশীলতা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটা কম ছিল, কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে (১৯৭৮-এ বন্যা, যার জের ১৯৭৯-তে কৃষি উৎপাদনে দেখা যায়, আবার ১৯৮১ এবং ১৯৮২ সালে খরার কারণে কৃষিতে উৎপাদন প্রত্যাশার তুলনায় কম ছিল)। তার ওপর ১৯৮৬-৮৭ এবং ১৯৯৪-৯৫ সালের মধ্যে পরিসংখ্যান নিয়ে অতিরঞ্জনের অভিযোগ উঠেছে। তাই, বৃদ্ধির হার নিয়ে আগে যে গবেষণা হয়েছে তা নিয়ে খানিক বিতর্ক রয়ে গেছে।

সৌভাগ্যক্রমে নতুন ও পুরনো সিরিজের পরিসংখ্যান ব্যবহার করে এবং গণনার সময়সীমা এগিয়ে ও পিছিয়ে বিভিন্নভাবে বৃদ্ধির হার গণনা করে এই বিতর্কের খানিকটা নিষ্পত্তি করা সম্ভব। আমরা সেটা করে দেখছি যে ১৯৭৭-এর পর থেকে আশির দশক এবং নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গে কৃষির উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধির হার তার আগের ও পরের পর্যায়ের তুলনায় বেশি। শুধু তাই নয়, তা একই সময়সীমার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে কৃষিক্ষেত্রের বৃদ্ধির হার সারা ভারত এবং প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের বৃদ্ধির হারের তুলনায়ও বেশি (যা সারণী ৪ থেকে দেখা যাচ্ছে)। এই একই ছবি উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধির হারের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। এখন কতটা বেশি সেটা, কীভাবে হিসেবে করা হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করবে। কিন্তু আয়ত্তসাধ্য পরিসংখ্যান দিয়ে উল্লিখিত সময়সীমার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে কৃষির উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধির হার রাজ্যের আগের ও পরের পর্যায়ের বা সারা দেশের বা বাংলাদেশের তুলনায় এক বা কম এটা কোনভাবেই দেখা যাচ্ছে না।

আরো বড় কথা, রাজ্যের গ্রামীণ অর্থনীতিতে আশির দশকে উন্নয়নের হার যে চোখে পড়ার মতো বেড়েছে তা কেবল উৎপাদনশীলতাতেই নয়, অন্যান্য নানা মাপকাঠিতেও ধরা পড়েছে, যেমন জাতীয় নমুনা সমীক্ষার (ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে বা এনএসএস) পরিসংখ্যান থেকে প্রাপ্ত দারিদ্রসীমার নিচের জনসংখ্যার অনুপাত হ্রাস পাওয়া, যা এর আগে উল্লেখ করেছি (সারণী ৫ দ্রষ্টব্য)।

২.২ রাজ্যে কৃষির উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধিতে অপারেশন বর্গা বা ভূমিবন্টনের প্রভাব কতটা হওয়া সম্ভব?

১৯৭০-এর শেষভাগ থেকে শুরু করে ১৯৮০-র দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার ভাগচাষের ক্ষেত্রে কিছু সংস্কার করে যা ‘অপারেশন বর্গা’ নামে পরিচিত। এই সংস্কারে ভাগচাষিদের ফসলের ভাগের পরিমাণ বাড়ানো হয় এবং উচ্ছেদের ভয় থেকে নিরাপত্তা দেওয়া হয়। কিছু সমালোচক মনে করেন পশ্চিমবঙ্গে কৃষির গড় উৎপাদনশীলতার উপর অপারেশন বর্গা বা ভূমি বন্টনের খুব একটা বড় প্রভাব পড়ার কথা নয় (যেমন, গজদার-সেনগুপ্ত, ১৯৯৭) তাদের প্রধান যুক্তি, মোট কৃষিজমির খুব অল্প অংশই বর্গা বা ভূমিবন্টনের আওতায় পড়ে। বামফন্টের আমলে মোট কৃষিজমির ৩%-এর বেশিতে ভূমিবন্টন ঘটেনি এবং অপারেশন বর্গার ফলে যে সাড়ে চোদ্দ লক্ষ বর্গাদার নথিভুক্ত হয়েছেন তাঁরা মোট কৃষিজমির মাত্র ৮%-এর কিছু বেশি জমিতে চাষ করেন। এই বিষয়ে কতগুলো কথা মনে রাখা প্রয়োজন।

প্রথমত, যে কোনো উপাদানের ফল বিচার করতে গেলে তার আপেক্ষিক গুরুত্ব এবং বৃদ্ধির হার, দুটোই দেখতে হবে। আপেক্ষিক গুরুত্ব বেশি হলেও, বৃদ্ধির হার কম হলে সেই উপাদানের সার্বিক ভূমিকা বেশি হবে না আর আপেক্ষিক গুরুত্ব কম হলেও, বৃদ্ধির হার বেশি হলে, তার সার্বিক ভূমিকা কম হবে না। ৫০% জমিতে যদি উৎপাদনশীলতা ১০% বাড়ে, তাহলে সার্বিক উৎপাদনশীলতা বাড়বে ৫% আবার ১০% জমিতে যদি উৎপাদনশীলতা ৫০% বাড়ে, তাহলেও সার্বিক উৎপাদনশীলতা একই হারে বাড়বে। মজার কথা হল, যাঁরা মোট কৃষিজমির বেশি অংশে ভাগচাষ হয় না, তাই অপারেশন বর্গার প্রভাব বেশি হতে পারে না বলছেন তাঁরাই সবুজ বিপ্লবের বিলম্বিত আগমনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন (যেমন, গজদার ও সেনগুপ্ত) । মুশকিল হল, ১৯৯৩ সালে মোট কর্ষিত জমির মাত্র ১২% বোরো চাষের আওতায় পড়ত। আর ক্ষুদ্র জলসেচ? রাজ্য সরকারের যে Census of Minor Irrigation Scheme (১৯৮৮) হ্যারিস উল্লেখ করেছেন, তা থেকে জানা যায়, নিট কর্ষিত জমির মাত্র ১৫% ক্ষুদ্র জলসেচের আওতায় পড়ত। এর অর্থ এই নয় যে আমরা উচ্চ ফলনশীল বীজ বা ক্ষুদ্র সেচের প্রভাব অস্বীকার করছি। এদের প্রভাব অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একই যুক্তিতে মোট কৃষিজমির ১১%-এর বেশিতে ভূমি বন্টন ও বর্গা হয়নি বলে রাজ্যে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে এদের প্রভাব একেবারেই নগণ্য হবে সমালোচকদের এ কথাও মেনে নেওয়া যায় না।

দ্বিতীয়ত, অপারেশন বর্গার প্রভাব কেবল নথিভুক্ত বর্গাদারদের ওপরেই হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে অ-নথিভুক্ত বর্গাদারদের মোট সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এই সংখ্যা কেউই নগণ্য বলে উড়িয়ে দেননা। ১৯৯৫ সালে আমরা চারটি জেলার (বর্ধমান, বাঁকুড়া, মালদহ এবং মেদিনীপুর) ৪৮টি গ্রামে গ্রামপ্রতি দশ জন হিসাবে মোট ৪৮০ জন ভাগচাষি নিয়ে এক সমীক্ষা করি। এর থেকে জানা যায় যে অপারেশন বর্গার ফলে অ-নথিভুক্ত বর্গাদারদেরও উচ্ছেদ করা খুবই শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। উচ্ছেদের সম্ভাবনা দেখা দিলে পঞ্চায়েতের সহায়তায় তাঁরা সহজেই নথিভুক্ত হতে পারেন। তা ছাড়া অপারেশন বর্গার ফলে উভয়েরই ফসলের ভাগ গড়ে বেড়েছে যদিও নিঃসন্দেহে নথিভুক্ত বর্গাদারেরা লাভবান হয়েছেন বেশি। তা ছাড়া অপারেশন বর্গার পরে অনেক ক্ষেত্রে জমির মালিক ভাগচাষিকে জমির একটি অংশ দিয়ে দিয়েছেন পুরো জমিতে বর্গা রেকর্ডিং না করার বিনিময়ে (গ্রামে যাকে বলে জমি 'মিউচুয়াল' হয়ে যাওয়া)। অনেক ক্ষেত্রে আবার জমির মালিক (বিশেষত যাঁরা গ্রামে বাস করেন না) বর্গাদারদের অল্প দামে জমি বেচে দিয়েছেন। বিকাশ রাওয়াল (১৯৯৭) বাঁকুড়া জেলার দুটি গ্রামে সমীক্ষা করে দেখেছেন যে ১৯৭৭ সালের পরে এই দুটি গ্রামে মোট কৃষি জমির ৩০%-এর বেশি কেনাবেচা হয়. সমসাময়িককালে ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলির সাথে তুলনা করলে এটি খুবই উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আরো উল্লেখ্য যে, ক্রেতাদের অধিকাংশই হলেন ক্ষুদ্রচাষি ও বর্গাদার; আর বিক্রেতাদের অধিকাংশ হলে বৃহৎ জমির মালিক বা সেইসব জমির মালিক যাঁরা গ্রামে থাকেন না। রাওয়ালের মতে, এ ধরনের জমি হাতবদল প্রধানত সম্ভব হয় অপারেশন বর্গা ও ভূমি বন্টনের ফলে জমির মালিকদের কাছে জমির দাম পড়ে যাওয়ার জন্যে।

তৃতীয়ত, যদি মেনে নেওয়া যায় অপারেশন বর্গা ও ভূমি বন্টনের ফল বিচার করতে গেলে শুধু নথিভুক্ত বর্গাদার বা যাঁরা বন্টিত জমি পেয়েছেন তাঁদের দেখলে চলবে না, তা হলেও প্রশ্ন থেকে যায়, মোট কত জমির কত অংশে এর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়ে থাকতে পারে। এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রধান সমস্যা হল যে, ১৯৭৭ সালের আগে মোট জমির কত শতাংশ ভাগচাষের আওতায় পড়তো (বা, পশ্চিমবঙ্গে মোট কত ভাগচাষি আছেন) তা নিয়েও বিতর্ক আছে। এনএসএস-এর ২৬তম রাউন্ড থেকে জানা যায় ১৯৭১ সালে রাজ্যের মোট জমির ১৮% ভাগচাষের আওতায় পড়ত। কিন্তু গবেষকদের মতে (যেমন, প্রণব বর্ধন, ১৯৭৬; লক্ষীনারায়ণ ও ত্যাগী, ১৯৭৭) ভাগচাষের গুরুত্ব এর থেকে খানিক বেশিই হওয়ার কথা, কারণ ভাগচাষ সংক্রান্ত নানা আইন দেশে চালু হওয়ার পর থেকে অনেক জমিতে ভাগচাষ হলেও তা সমীক্ষকের কাছ থেকে গোপন করা হয়। ধরা যাক ১৯৭১ সালে পশ্চিমবঙ্গের কৃষিজমির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ ভাগচাষের আওতায় পড়ত। জেমস বয়েস তাঁর ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত দুই বাংলার কৃষির উপর লেখা প্রামাণ্য বইতে সিদ্ধান্তে এসেছেন যে এই অঞ্চলের মোট জমির এক-ষষ্ঠাংশ থেকে এই চতুর্থাংশ ভাগচাষের আওতায় পড়ত। তাঁর মতে রাজ্যে ভাগচাষের গুরুত্ব ১৯৩০-এর দশকের শেষে ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্টে উল্লিখিত ২১.১% সংখ্যাটির থেকে খুব বেশি পাল্টায়নি।

গজদার ও সেনগুপ্ত কিন্তু তাঁদের প্রবন্ধে লিখেছেন অপারেশন বর্গা চালু হবার সময় সময় এনএসএস-এর ৩৭তম রাউন্ড (১৯৮২) অনুযায়ী মোট জমির মাত্র ৭% ভাগচাষের আওতায় ছিল। দুটি কারণে এই পরিসংখ্যানটি অপারেশন বর্গার প্রভাব বিচারের জন্যে উপযুক্ত নয়। প্রথমত, গজদার ও সেনগুপ্ত ওই একই প্রবন্ধে লিখেছেন নথিভুক্ত বর্গাদারেরা নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় মোট জমির ৮% চাষ করতেন। তা হলে কি ১৯৮২ সালের পরে ভাগচাষ আবার বেড়েছে? অ-নথিভুক্ত বর্গাদারেরাই বা গেলেন কোথায়? দ্বিতীয়ত, ১৯৮২ সালের পরিসংখ্যানটি অপারেশন বর্গা শুরু হওয়ার প্রায় চার বছর পরের। যেখানে ভারতে ভাগচাষ সম্পর্কিত পরিসংখ্যানের মূল সমস্যাই হল, নানা আইনের কারণে ভাগচাষ গোপন করার প্রবণতা, সেখানে দেশের ভাগচাষ বিষয়ক আইন প্রয়োগের সবচেয়ে বড় প্রচেষ্টা শুরু হওয়ার তিন-চার বছর পরে করা সমীক্ষায় এই সমস্যাটি অনেক বেশি পরিমাণেই হওয়ার কথা।

আর একটি ব্যাপার হল, ভাগচাষ মূলত ধানচাষের ক্ষেত্রে দেখা যায় । মোট কর্ষিত জমির ৭০%-এর কিছু বেশিতে ধানচাষ হয়, আর নানা সমীক্ষায় দেখা গেছে (শঙ্করকুমার ভৌমিক, ১৯৯৩), ভাগচাষের মোট জমির ৯০%-এর কিছু বেশি অংশে ধানচাষ হয়। আমাদের আলোচনায় যেহেতু ধানচাষের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হার নিয়ে, ধানচাষের মোট জমিতে অপারেশন বর্গা শুরুর আগে ভাগচাষের উপস্থিতি এক-পঞ্চমাংশের বেশিই হওয়ার কথা।

জন হ্যারিস (১৯৯৩) বীরভূমের দুটি গ্রামে গবেষণার ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে আশির দশকের পশ্চিমবঙ্গে কৃষির উৎপাদনশীলতা যেটুকু বেড়েছে তা সবুজ বিপ্লবের বিলম্বিত আগমনেরই ফল। এর দুটি মূল উপাদানঃ (১) এই অঞ্চলের আবহাওয়ার পক্ষে বিশেষভাবে উপযুক্ত উচ্চফলনশীল বীজের ব্যবহারের প্রসার, (২) ধানের দামের তুলনায় সারের আপেক্ষিক মূল্যহ্রাস, ও (৩) ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও বিনিয়োগের ফলে ক্ষুদ্র জলসেচের দ্রুত বৃদ্ধি।

কিন্তু এই যুক্তির সমস্যা হল, এটি সারা পূর্বাঞ্চলের (অর্থাৎ, বিহার, উড়িষ্যা ও সর্বোপরি বাংলাদেশ) ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, অথচ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গে কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হার বাকি সারা ভারত এবং বাংলাদেশের থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। তবে এর পেছনে ব্যক্তিগত উদ্যোগ বাদ দিয়েও অনেকগুলো উপাদান কাজ করে থাকতে পারে, যাদের আপেক্ষিক গুরুত্ব নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে - তার মধ্যে আছে, ভূমি-সংক্রান্ত সংস্কার (অপারেশন বর্গা, ভূমিবন্টন), পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা, আর সার, বীজ ও চাষের অন্য উপাদানের সার্বিক বন্টন ব্যবস্থার উন্নতি। হ্যারিস নিজেই বলেছেন কিছু গ্রামযাত্রার ওপর ভিত্তি করে নেওয়া তাঁর সিদ্ধান্তগুলো নিতান্তই প্রাথমিক, আরও বিশদ বিশ্লেষণ দাবি করে।

উচ্চফলনশীল বীজের প্রসারের ভূমিকা দেখতে গেলে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের তুলনা থেকে খানিকটা উত্তর পাওয়া যাবে। প্রথমে ধরা যাক বোরো ধানের কথা, যা প্রায় সম্পূর্ণ উচ্চফলনশীল বীজ এবং সেচের ওপর নির্ভর করে। আবহাওয়া, প্রকৃতি, কৃষিপ্রযুক্তি ও ভূমিব্যবস্থার দিকে দুই বাংলায় মিল আছে প্রচুর, তাই সরকারি নীতির প্রভাব বাদ দিয়ে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ বা প্রযুক্তিগত উন্নতির ফল এই দুই জায়গাতেই তুলনীয় হওয়ার কথা। কিন্তু যদি ১৯৭৯ আর ১৯৯৩-এর মধ্যে ধানচাষের মোট জমিতে বোরো চাষের আপেক্ষিক প্রসার নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যে তুলনা করি, তাহলে পরিসংখ্যানগতভাবে কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই। আমন ধান চাষে কতটা জমি উচ্চফলনশীল বীজের আওতায় পড়ে তা নিয়ে যে সীমিত পরিসংখ্যান পাওয়া যায় তা থেকেও এই একই ছবি পাওয়া যাচ্ছে - অর্থাৎ, ধান চাষে উচ্চফলনশীল বীজের প্রসার পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে তুলনীয় হারেই হয়েছিল, এবং দুই জায়গাতেই এই সময়সীমার মধ্যে আগের বা পরের তুলনায় কৃষিতে উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধির হার বেশি - যা সবুজ বিপ্লবের বিলম্বিত আগমন তত্ত্বকে সমর্থন করে। যেটা করে না, সেটা হল, পশ্চিমবঙ্গে কৃষিতে উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধির হার এই সময়সীমার মধ্যে বাংলাদেশের থেকে বেশি। তাই রাজ্যের কৃষি নীতির কোনো ভূমিকা নেই এ কথা বলা মুশকিল।

২.৩ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে অপারেশন বর্গার প্রভাব কতখানি?

এই প্রশ্নের উত্তরের প্রধান সমস্যা হল, অপারেশন বর্গা বাদ দিয়ে এই সময়ে রাজ্যে আরও অনেক কিছু হচ্ছিল (যেমন, উচ্চফলনশীল বীজ বা সেচের প্রসার)। একটি উপায় হল প্রতিবেশী কোনও অঞ্চলের সঙ্গে তুলনা, যেখানে এ ধরণের সংস্কার হয়নি। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের আবহাওয়া, প্রকৃতি, কৃষিপ্রযুক্তি বা ভূমিব্যবস্থার দিক দিয়ে অনেকটাই একরকম। আগেই বলেছি, আলোচ্য সময়সীমার মধ্যে (১৯৭৯-১৯৯৩) দু'টি অঞ্চলেই উৎপাদনশীলতা উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়লেও পশ্চিমবঙ্গে বৃদ্ধির হার ২০% মাত্রা বেশি (বাংলাদেশে বৃদ্ধির হার ৪৮%, পশ্চিমবঙ্গে ৬৮%), যা এই রাজ্যের মোট বৃদ্ধির এক-তৃতীয়াংশের মতো। এ সময় বাংলাদেশে বোরো চাষের হার ও সরকারি সেচের প্রসার তুলনায় বেশিই হয়েছে, সবুজ বিপ্লবের প্রভাবও পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় বেশি বই কম নয়। এতে অবশ্যই প্রমাণিত হয় না যে পশ্চিমবঙ্গে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির এই পার্থক্য অপারেশন বর্গার ফলেই। কিন্তু বর্গা, ভূমি বন্টন বা পঞ্চায়েতি রাজ্যের প্রসার, এইসব সরকারি নীতি বাদ দিলে আর একভাবেই পশ্চিমবঙ্গের 'অতিরিক্ত' উৎপাদনশীলতা ব্যাখ্যা করা যায় - তা হল, পরিসংখ্যানের অতিরঞ্জন।

মজার ব্যাপার হল, পশ্চিমবঙ্গের জেলাভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, নানা বিষয়ের প্রভাব (যথা সরকারি সেচের প্রসার, বৃষ্টিপাতের তারতম্য, বোরো ধানচাষের প্রসার) বাদ দিলেও যে যে জেলায় বর্গা রেকর্ডিং-এর হার বেশি, সেই সেই জেলায় উৎপাদনশীলতার হারও বেশি। পরিসংখ্যানের অতিরঞ্জন দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা যায় না। পশ্চিমবঙ্গে ধানচাষের উৎপাদনশীলতা বিষয়ক পরিসংখ্যান যদি সব জেলায় একই হারে অতিরঞ্জিত হয়ে থাকে, তা হলে এর ব্যাখ্যা করা যায় না। বিভিন্ন জেলায় যদি বিভিন্ন মাত্রায় অতিরঞ্জন ঘটে থাকে তা হলেও এর ব্যাখ্যা করা যায় না, কারণ তার সাথে বিভিন্ন জেলায় বর্গা রেকর্ডিং হারের সম্পর্ক থাকবে কেন?

এর আগে ফলিত অর্থনীতি ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত পরিসংখ্যান বনাম রাজ্যের কৃষি বিভাগ দ্বারা সংকলিত পরিসংখ্যান নিয়ে বিতর্ক আছে সেটার কথা আলোচনা করেছি। তবে পুরোটা না হলেও একটা পর্যায় (১৯৮৬-৮৭ এবং ১৯৮৯-৯০-এর মধ্যে) দুই সূত্র থেকেই তুলনীয় পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে। কিছু বছর আগে শ্রী সচ্চিদানন্দ দত্ত রায়ের সৌজন্যে ব্যুরোর জেলাভিত্তিক পরিসংখ্যান আমরা হাতে পেয়েছিলাম। সম্প্রতি একটি এখনো অপ্রকাশিত গবেষণাপত্রে সঞ্চারী রায় এবং আমি, বন্দ্যোপাধ্যায়, গার্টলার এবং আমার পূর্ব-প্রকাশিত প্রবন্ধে যে বিশ্লেষণ ছিল তা এই বিকল্প সিরিজ ব্যবহার করে তা আবার করে দেখেছি। আশ্বাসের বিষয় হলো মূল গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল গুণগতভাবে প্রায় একইরকম পাওয়া যাচ্ছে।

নানা দিক থেকে বিচার করে পশ্চিমবঙ্গের কৃষিতে উৎপাদনশীলতা মোট বৃদ্ধিতে আমরা অপারেশন বর্গার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবের পরিমাণ পাচ্ছি ৭ থেকে ২০ শতাংশ। অপারেশন বর্গা শুরু হওয়ার আগে যে জমি ভাগচাষের আওতায় পড়ত, তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে অপারেশন বর্গার গড় প্রভাব হল ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। এখন একটা প্রশ্ন হল, সবুজ বিপ্লবের বিলম্বিত আগমনের প্রভাব সরিয়ে রাখলে অপেরেশন বর্গা বা সীমিত ভূমিসংস্কারের কৃষির ওপর প্রভাব কীভাবে হতে পারে? অর্থাৎ, পরিসংখ্যানের বিশ্লেষণ যা বলছে তার ব্যাখ্যা কী?

মূলধারার উন্নয়ন অর্থনীতিতে কৃষিতে ভাগচাষের ভূমিকা একটি বহুচর্চিত বিষয়। মূল প্রশ্ন হল, ফসলের একটা অংশমাত্র পায় বলে ভাগচাষী কি কম উৎসাহ নিয়ে বর্গার জমি চাষ করে? ঊনবিংশ শতকের শেষে অ্যালফ্রেড মার্শালের লেখায় ভাগচাষ নিয়ে যে আলোচনা আছে তাতে এই যুক্তিটা পাওয়া যাবে। কথাটা সোজা - ভাগচাষ ঠিক আয়করের মতো। ভাগচাষী ফসলের যত বেশি ভাগ পাবে এবং জমি থেকে উচ্ছেদ হবার সম্ভাবনা কমবে, তত সে বেশি উদ্যমের সাথে চাষ করবে। ভাগচাষের কারণে উৎপাদনশীলতা কতটা কম হতে পারে, তা নিয়ে নানা দেশে যে গবেষণা হয়েছে তার ফলাফলের সাথে আমাদের অনুসন্ধানের ফলাফল খুবই তুলনীয়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্র। সবাই জানেন যে ২০১৯ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন অভিজিৎ ব্যানার্জি, এস্থার দুফ্লো এবং মাইকেল ক্রেমার, উন্নয়ন অর্থনীতিতে র‍্যান্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল (আরসিটি) ব্যবহারের জন্য। সম্প্রতি একটি আরসিটি-তে ভাগচাষের ক্ষেত্রে শস্য ভাগের পরিমাণের অনুপাত (চাষির ভাগে) বাড়ালে তার প্রভাব উৎপাদন বৃদ্ধির হারে কী প্রভাব ফেলে তা দেখতে শস্য ভাগের পরিমাণ বিভিন্ন রেখে ‘র‍্যান্ডম’ পদ্ধতিতে তা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় (বুরচারডি ও অন্যান্য, ২০১৯)। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে শস্য ভাগের পরিমাণের অনুপাত বাড়ালে উৎপাদন বৃদ্ধির হার যথেষ্ট বাড়ছে, যা অনুপ্রেরক হিসেবে ফসলের ভাগের গুরুত্বকে ইঙ্গিত করে। মজার ব্যাপার হল, এই গবেষণা নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগে করা আমাদের গৱেষণালব্ধ (যখন এই পদ্ধতির ব্যবহার তো ভুলেই যান, এই কথাটাই অপরিচিত ছিল অর্থনীতির জগতে) বিশ্লেষণকে সঠিক প্রমাণ করছে। এই গবেষণাতে যে ফল পাওয়া যাচ্ছে তাতে জানা যাচ্ছে ৫০% থেকে বেড়ে ৭৫% ভাগ পেলে ভাগচাষিদের উৎপাদনশীলতা প্রায় ৬০% বাড়ে। এই গবেষকেরা যে ভাগের এই অনুপাতগুলোই ব্যবহার করেছেন, তা অপারেশন বর্গা দ্বারা অনুপ্রাণিত। আর তাই অন্য দেশে, অন্য সময়ে এবং অন্য পদ্ধতিলব্ধ তাঁদের ফলাফল আর ‘আরসিটি’-পূর্ব জমানায় করা আমাদের গবেষণার ফলাফল তুলনীয় এবং তাই অপারেশন বর্গার যে রাজ্যে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল, তা নিয়ে আমাদের খানিকটা আশ্বস্ত করে।

তবে মনে রাখতে হবে বর্গা রেজিস্ট্রেশন কোন যান্ত্রিক পদ্ধতিতে হয়নি, আর তাই অপারেশন বর্গার সাফল্যকে বামফ্রন্ট আমলে গ্রামবাংলায় পট-পরিবর্তনের সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করতে হবে। পঞ্চায়েতের মাধ্যমে নানা উপাদানের বন্টন ব্যবস্থার উন্নতিই হোক, তার আগের পর্যায়ের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার অবসানই হোক, বা গ্রামাঞ্চলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার পাল্লা দরিদ্রদের দিকে ঝোঁকার ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে শ্রম, পুঁজি এবং জমির বাজারে কিছু গুণগত পরিবর্তনের ফলই হোক, এগুলো অপারেশন বর্গা ও সীমিত ভূমিবন্টনের পরিপূরক উপাদান এবং এদের সমন্বিত প্রভাব কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সহায়ক ছিল, তা নিয়ে অধিকাংশ গবেষকই একমত।

একথাও সত্যি যে আমাদের গবেষণায় কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সীমিত ভূমিসংস্কারের সদর্থক ভূমিকা থাকলেও আমাদের গবেষণা অনুযায়ী এর প্রভাব সার্বিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির এক-তৃতীয়াংশের বেশি নয়, যার অর্থ হল অন্যান্য নানা উপাদানের ভূমিকা দুই-তৃতীয়াংশ বা এর প্রায় দ্বিগুণ, যার মধ্যে উচ্চফলনশীল বীজের প্রসার ইত্যাদি পড়ে। সীমিত ভূমিসংস্কারের প্রভাব সার্বিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির যে এক-তৃতীয়াংশ মতো আমরা পাচ্ছি, তার মধ্যে অপারেশন বর্গা বাদ দিয়েও অন্যান্য সরকারি কৃষিনীতির (পঞ্চায়েতি রাজ, ভূমি বন্টন ইত্যাদি) প্রভাবও আছে। শুধু অপারেশন বর্গার প্রভাব দেখলে, আমাদের গবেষণায় উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ১০-২৮% তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফল হিসেবে আমরা চিহ্নিত করছি।

অপারেশন বর্গা বা সীমিত ভূমিবন্টন বাদ দিলে এই অন্য উপাদানগুলি কী এবং তাদের আপেক্ষিক গুরুত্ব নিয়ে পরবর্তীকালে কিছু গবেষণা হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রণব বর্ধন এবং দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের (বর্ধন ও মুখোপাধ্যায়, ২০১১) গবেষণা, যাঁরা দেখাচ্ছেন রাজ্য সরকারের 'মিনিকিট বিতরণ প্রকল্প' কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যদিও তাঁরা খামার-ভিত্তিক পরিসংখ্যান ব্যবহার করছেন যা আমাদের ব্যবহৃত জেলা-ভিত্তিক পরিসংখ্যানের থেকে কিছু বিষয় আরো তলিয়ে দেখতে সাহায্য করেছে, তবে তাঁদের বিশ্লেষণের সময়সীমা (যা ১৯৮২ সাল থেকে, অর্থাৎ অপারেশন বর্গার বাস্তবায়ন শুরু হবার বেশ কয়েক বছর পরে শুরু হচ্ছে) এবং নমুনা সংখ্যার সীমাবদ্ধতার কারণে তাঁদের বিশ্লেষণ থেকে অপারেশন বর্গার ফলাফল সম্পর্কে খুব বেশি জানা যাচ্ছে না।

।। ৩ ।।

বামফ্রণ্ট আমলে কৃষিতে রাজ্যের সাফল্য উল্লেখের দাবি রাখে কিন্তু সমস্যা হল, উন্নয়নের ধ্রুপদী তত্ত্ব বলে বিভিন্ন দেশে, অঞ্চলে ও কালে সময়ের সাথে সাথে কৃষির গুরুত্ব কমে, শিল্পের গুরুত্ব বাড়ে, এবং পরিষেবার গুরুত্ব আরও বাড়তে থাকে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন শুধু কোন একটি ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধির মাধ্যমেই শুধু হয় না, তার জন্যে প্রয়োজন মূল যে অর্থনৈতিক উপাদানগুলো - অর্থাৎ, শ্রম, পুঁজি এবং ভূমি - সেগুলো নতুন ধরণের প্রয়োজন মেটাতে নতুনভাবে বিন্যস্ত হয়, অধিক থেকে অধিকতর মূল্যের উৎপাদনে নিয়োগ করার নিরন্তর প্রক্রিয়ায়, যার গতি সচরাচর কৃষি থেকে শিল্প এবং পরিষেবার দিকে। এভাবেই শহরাঞ্চলের প্রসার হয়ে থাকে। বর্তমান দুনিয়ার ধনী দেশগুলো ঐতিহাসিকভাবে এইসব পর্ব উৎরে তবেই আজকের জায়গায় এসে পৌঁছেছে।

এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখলে রাজ্যের অর্থনৈতিক যাত্রাপথ অবশ্যই খানিক বিপরীতমুখী। বামফ্রন্ট আমলের প্রথম অর্ধে দেশের তুলনায় রাজ্যে কৃষিতে বৃদ্ধির হার দেশের গড়ের থেকে বেশি থেকেছে, সার্বিক বৃদ্ধির হার কম হওয়া সত্ত্বেও। কিন্তু আয় এবং কর্মসংস্থানের দিক থেকে দেখলে শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার না বাড়লে সার্বিক বিচারে রাজ্যের অর্থনৈতিক পশ্চাদপসরণ অব্যাহত থাকবে, এটাই প্রত্যাশিত।

রাজ্যের অর্থনীতির সার্বিক অগ্রগতির পথে অনেক অন্তরায় তবে এর একটা বড়ো কাঠামোগত কারণ হল শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যে জমির সমস্যা। বামফ্রণ্টের সীমিত ভূমিসংস্কার শুরু হবার তিন দশক পরে সিঙ্গুরে রাজ্যে শিল্পায়নের পথে মূল প্রতিবন্ধক হিসেবে দাঁড়ালো জমি-অধিগ্রহণের সমস্যা।

সমস্যাটা সারা দেশের জন্যে প্রযোজ্য হলেও জনসংখ্যার তুলনায় ভূমির অপ্রতুলতা এবং জনসংখ্যার চাপের ফলে সময়ের সাথে সাথে ভূমির ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর অংশে বিভাজিত হবার প্রবণতা রাজ্যের ক্ষেত্রে আরও প্রকট। তার ওপর সীমিত ভূমিসংস্কারের ফলে ভূমিহীন কৃষকদের হাতে জমি আসা এবং বর্গা আইনের কারণে অনেকক্ষেত্রে জমির মালিকদের ভাগচাষীদের কাছে জমি বেচে দেওয়ার কারণে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। সাম্প্রতিক কৃষি সেন্সাস থেকে জানা যাচ্ছে যে রাজ্যের কৃষিতে নিয়োজিত জমির গড় পরিমাপ সত্তরের দশকের গোড়ার তুলনায় ২০১৫-১৬ সালে কমেছে প্রায় ৪০%, এবং দেশের বর্তমান গড়ের সাথে তুলনা করলে তা রাজ্যের তুলনায় দেড়গুণ বেশি। একইসাথে কৃষিতে নিযুক্ত জমিতে প্রান্তিক চাষিদের (যাদের জমির আয়তন এক হেক্টর বা তার কম) অনুপাত সত্তরের দশকের গোড়ায় ছিল ৬০%, যা ২০১৫-১৬ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৩% - যেখানে সারাদেশে বর্তমানে প্রান্তিক চাষিদের অনুপাত ৬৮%।

আরেকটা সমস্যা হলো জমির বাজার ঠিক আর পাঁচটা বাজারের মতো নয় যে দাম বাড়লে যোগান বাড়বে এই সরল যুক্তিটা খাটে। জমি শুধু রোজগারের উৎস নয়, জমির মালিকানা একটা বড় ধরনের আর্থিক নিরাপত্তাও দেয়। ক্ষুদ্র জমির মালিকদের কাছে এই দ্বিতীয় কারণটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ তাই জমির দাম বাড়লে তারা বরং বেশি করে জমি আঁকড়ে থাকতে পারেন, তাই বাড়ার বদলে জমির যোগান কমেও যেতে পারে। ধনী চাষির হাতে উদ্বৃত্ত জমি আছে, তাই দাম বাড়লে তাঁদের কাছে থেকে জমির যোগান বাড়বে কিন্তু সার্বিক যোগান নির্ভর করবে জমির বন্টনের ওপর। রাজ্যের সীমিত ভূমিসংস্কার এবং জমিতে জনসংখ্যার চাপ এই দুই কারণের ফলে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের সংখ্যা বেশি, তাই দাম বাড়লে যোগান না বাড়ার সম্ভাবনা বেশি। আমাদের সমীক্ষা থেকে দেখছি যে পরিবারের হাতে জমির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম, এবং যাদের কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা যত বেশি, তাঁরা জমি বেচতে ততই অনিচ্ছুক। এখানে রাজ্যের অর্থনীতিতে একটা বিষচক্র কাজ করেছে - শিল্প হচ্ছে না বলে বিকল্প কম আবার বিকল্প কম বলে জমির ওপর নির্ভরতা প্রবল, আর তাই শিল্প হচ্ছে না।

"কৃষি আমাদের ভিত্তি শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ" স্লোগানটি রাজ্যে কার্যকর হতে পারেনি। বরং এটাকে পাল্টে বলা যেতে পারে কৃষি একই সাথে রাজ্য অর্থনীতির শক্তি এবং দুর্বলতা। আর এর একটি প্রধান কারণ হল, জমি নিয়ে জটিলতা। অদৃষ্টের পরিহাস হল যে আগের জমানায় সীমিত ভূমিসংস্কারের সাফল্য এই প্রবণতাকে আরও প্রকট করে দিয়েছে। আর, এক দশকের বেশি হয়ে গেলেও নতুন জমানা কোনো নতুন দিশা দেখাতে পারেনি।


[এই লেখাটিতে আমার আগের দুটি লেখার কিছু অংশ অপরিবর্তিতভাবে ব্যবহার করা হয়েছেঃ ঘটক (২০২২) এবং বন্দ্যোপাধ্যায় ও ঘটক (২০০০)। আমার বাবা শ্রী মৈত্রেয় ঘটকের নিজস্ব গবেষণার একটি বিষয় ছিল পশ্চিমবঙ্গে ভূমি-সংস্কার এবং তাই এই বিষয়ে কিশোর বয়স থেকেই আমার উৎসাহের জন্যে তিনি দায়ী। শুধু তাই নয়, আমার এই বিষয়ে গবেষণা করার সময়ে সমীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব তিনি নেন। তাঁর মৃত্যু হয় ২০০৩ সালে। তাঁর কথা শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি।]


সূত্রঃ

১. মৈত্রীশ ঘটক (২০২২): "কৃষিই ভিত্তি এবং দুর্বলতা", আনন্দবাজার পত্রিকা শতবার্ষিকী ক্রোড়পত্র, ফেব্রুয়ারী ২৩, ২০২২।
২. অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও মৈত্রীশ ঘটক (২০০০): "পশ্চিমবঙ্গের কৃষি ও বামফ্রন্টের কৃষিনীতি", আনন্দবাজার পত্রিকা, এপ্রিল ২৮, ২০০০।
৩. Abhijit V. Banerjee, Paul J. Gertler, Maitreesh Ghatak (2002): "Empowerment and Efficiency: Tenancy Reform in West Bengal," Journal of Political Economy, Vol. 110, No. 2, 239-280.
৪. Abhijit Sen and Ranja Sengupta (1995): "The Recent Growth in Agricultural Output in Eastern India, with Special Reference to the Case of West Bengal', paper presented at the CSSS, Calcutta workshop on 'Agricultural Growth and Agrarian Structure in Contemporary West Bengal and Bangladesh'.
৫. H. Laxminarayan and S. S. Tyagi (1977): “Tenancy: Extent and Inter-State Variations.” Economic and Political Weekly, vol. 12, no. 22, pp. 880-83.
৬. John Harris (1993): "What is Happening in Rural West Bengal?: Agrarian Reform, Growth and Distribution", Economic and Political Weekly, Issue no. 24, Jun 12-18.
৭. James K. Boyce (1987): Agrarian impasse in Bengal: Institutional constraints to technological change. Oxford: Oxford University Press.
৮. Pranab Bardhan (1976): "Variations in Extent and Forms of Agricultural Tenancy-I: Analysis of Indian Data across Regions and over Time." Economic and Political Weekly 11, no. 37 (1976): 1505-12.
৯. Vikas Rawal (2001): "Agrarian Reforms and Markets: Case Study of Land Transactions in Two Villages in West Bengal, 1977-1995," Economic Development and Cultural Change, April, 2001.
১০. Sankar Kumar Bhaumik (1993): Tenancy Relations and Agrarian Development: A Study of West Bengal, Sage Publications. New Delhi.
১১. Haris Gazdar and Sunil Sengupta (1997): "Agricultural Growth and Recent Trends in Well-Being in Rural West Bengal" in Ben Rogaly, Barbara Harriss-White, and Sugata Bose edited Sonar Bangla? Agricultural Growth and Agrarian Change in West Bengal and Bangladesh. Sage, Delhi.
১২. Konrad Burchardi, Selim Gulesci, Benedetta Lerva and Munshi Sulaiman (2019): "Moral Hazard: Experimental Evidence from Tenancy Contracts", The Quarterly Journal of Economics, 2019, vol. 134, issue 1, 281-347.
১৩. S. Datta Ray (2002) "Agricultural Growth in West Bengal in 1980s", Economic and Political Weekly, September 14.
১৪. Pranab Bardhan and Dilip Mookherjee (2011): "Subsidized Farm Input Programs and Agricultural Performance: A Farm-Level Analysis of West Bengal's Green Revolution, 1982-1995", American Economic Journal: Applied Economics, Vol. 3, No. 4, 186-214.