আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ● ১-১৫ ফাল্গুন, ১৪২৯
সম্পাদকীয়
আদানির ভারত
“আমি একাই লড়ছি সবার বিরুদ্ধে। দেশের কাজ করার জন্য বেরিয়েছি। রাজনীতির কারবারিদের তাই আমাকে পছন্দ হচ্ছে না”। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্প্রতি সংসদে দাঁড়িয়ে বুক ঠুকে এই কথাগুলি বললেন। শুনে ভক্তদের চোখে জল, মুখে স্লোগান, নেট সরগরম, মিডিয়া আপ্লুত। আহা! প্রধানমন্ত্রীর বাচনভঙ্গী, তাঁর আক্রমণাত্মক বক্তব্যের কোনো জুড়ি নেই। দেশের প্রধানমন্ত্রীর মতই বলেছেন মোদীজি। মোদী হ্যায়, তো মুমকিন হ্যায়।
ঠিকই মোদী আছেন তাইতো এত কিছু সম্ভব হচ্ছে। যেমন ধরুন সংসদে দাঁড়িয়ে রাহুল গান্ধী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন, আদানি সংক্রান্ত। তিনি বলার চেষ্টা করেছিলেন যে আদানির বিরুদ্ধে শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়ানোর অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন দেশি-বিদেশি বরাত প্রধানমন্ত্রীর কৃপায় আদানি পেয়েছেন এমন মনে করার কারণ রয়েছে, হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট স্পষ্ট অভিযোগ আনছে যে বেআইনিভাবে ভুয়ো কোম্পানির মাধ্যমে শেয়ার কেনাবেচা করে আদানির শেয়ারের দাম বাড়ানো হয়েছে। তিনি আরো অভিযোগ তোলেন যে নানা ভাবে দেশের বন্দর, বিমানবন্দর, মিলিটারি, ব্যবসা ইত্যাদি আদানির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। তাহলে আদানির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্ক কী? এই পরিপ্রেক্ষিতে রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানান যে আদানির বিষয়ে তিনি মুখ খুলুন, তদন্তের নির্দেশ দিন।
কিন্তু এইসব বিতর্কের উত্তর দেওয়ার মতন গণতান্ত্রিক সৌজন্যবোধ বা পরিস্থিতি ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রে আর নেই। অতএব পরের দিন প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে যা বললেন তা উপরের উক্তি থেকেই স্পষ্ট। গোটা বক্তৃতায় আদানির নাম নিলেন না, শুধু বললেন যে মানুষ তাঁকে ভোট দিয়ে জিতিয়েছে, মানুষের জন্য তিনি অমুক অমুক কাজ করেছেন, এবং বিরোধীরা আর কোনো ইস্যু খুঁজে না পেয়ে তার চরিত্রহনন করতে চাইছে। এই সমস্ত বাগড়ম্বর করে সুচারুভাবে তিনি আসল প্রশ্নটিকে পাশ কাটিয়ে গেলেন। আদানির সঙ্গে তাঁর কী সম্পর্ক? আদানি তাঁর আশীর্বাদে কী কী সুবিধা পেয়েছে? এত বড় কেলেঙ্কারির অভিযোগ, শেয়ার বাজারে আদানির শেয়ারের প্রবল পতনের পরেও কেন কোনো তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে না? এইসব প্রশ্নের উত্তর একটাই - মানুষ আমাদের প্রবলভাবে সমর্থন করছে, তাই আমরা এইসব অবান্তর প্রশ্নের কোনো উত্তর দেব না।
এই যে উত্তর না দিয়ে সমস্তটাই মানুষের নামে, তাদের ভোটের নামে নিজেদের শুদ্ধ প্রমাণ করার নীতি, তা জনপ্রিয়তাবাদ বা পপুলিজম-এর পাঠ্যপুস্তক থেকে তুলে আনা। নেতা শুধু জনগণের কাছে দায়বদ্ধ, আর কারো কাছে নয়। অতএব, জনগণ যখন তাঁকে আশীর্বাদ দিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছে, তখন অন্য কারো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনো প্রয়োজন প্রধানমন্ত্রী বোধ করেন না। এই যে জনসমর্থন তা নিশ্চই আদানির ভাণ্ডার বিপুলভাবে স্ফীত করার জন্য বিজেপি পায়নি। কিন্তু তবু যাই বিরূপ প্রতিক্রিয়া আসুক না কেন, জনগণের দোহাই দিয়ে তাকে পাশ কাটিয়ে দেওয়া যাচ্ছে। দুঃখের বিষয় বিরোধীরা জনগণের মনে কোনো আলোড়ন তুলতে পারছে না। ফলত, প্রধানমন্ত্রীর উত্তর দেওয়ার দায় আরো কমছে।
এই গোটা প্রক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে গণতন্ত্র এবং দেশের সংবিধান। গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন হয়। কিন্তু গণতন্ত্র মানে এই নয় যে সেই দল ক্ষমতাসীন হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার দোহাই দিয়ে যা খুশি তাই করবে, বিরোধীদের কোনো দাবি মানবে না। আসলে গণতন্ত্রে বিরোধী মতের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু বর্তমান পৃথিবী তথা ভারতবর্ষে দেখা যাচ্ছে যে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার স্বৈরাচারী হয়ে উঠছে। তাদের ভাই-বন্ধু পুঁজিপতিদের পকেট ভরার নীতিগ্রহণ করছে। কিন্তু তা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সেই জনগণের দোহাই দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আদানির মতন শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগকে সরকার সম্পূর্ণভাবে অবজ্ঞা করছে। তাই কোনো অন্যায় হয়ে থাকলে তার কোনো সুরাহা করা যাচ্ছে না। প্রতিযোগিতা নয়, ব্যবসা বাড়ানোর জন্য, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা বেশি জরুরি বলে মনে হচ্ছে আদানিকে দেখে। অন্যদিকে, ক্ষমতা এবং পুঁজির এই যোগসাজসে আরো হীনবল হচ্ছে ভারতীয় গণতন্ত্র।
তার উদাহরণগুলি আমাদের হাতের সামনেই আছে। রাহুল গান্ধীর যেই বক্তৃতা নিয়ে এই সম্পাদকীয়তে আলোচনা করা হল, তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ মাননীয় স্পিকারের বদান্যতায় সংসদীয় নথি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ শুধুমাত্র যে আদানি সংক্রান্ত কোনো প্রশ্নের উত্তর সরকার দিল না তা নয়। বরং এই প্রশ্নগুলিকেই বেআইনি ঘোষণা করে তা সংসদীয় বিবরণী থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। দেশের সংসদে এখন সংসদরা খোলাখুলি সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলে তাকে বিবরণী থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু সবাই আদানি নয়। কেউ কেউ আছে যারা এই আকালেও কিছু সত্যি কথা সরকারের সামনে বলার সাহস দেখাচ্ছে। বিবিসি-র তৈরি মোদীকে নিয়ে তথ্যচিত্র সেই সাহসিকতার একটি নিদর্শন। বিবিসি ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যম, অতএব এই তথ্যচিত্রটি বানানোর জন্য তাদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু তথ্যচিত্রটি সম্প্রচার হওয়ার পর থেকে বিবিসিকে একদল বিজেপি সমর্থক দেশদ্রোহী ছাপ লাগানোর চেষ্টা করছে। সমস্ত আইনকে কাঁচকলা দেখিয়ে তথ্যচিত্রটি এদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়েছে। এবং সর্বপরি, আয়কর বিভাগের হঠাৎ মনে পড়েছে যে বিবিসি-র কর প্রদানের হিসেব একবার যাচাই করা দরকার। তাই সদলবলে তারা বিবিসি-র মুম্বাই এবং দিল্লি অফিসে হানা দিয়েছে। দরজা বন্ধ করে তদন্ত চলছে।
এই বহু পরিচিত এবং পরীক্ষিত চিত্রনাট্যটি নিয়ে যদি ফিল্ম বানানো হত, তবে তা বক্স অফিসে ডাহা ফেল হত। কারণ ইডি, ইনকাম ট্যাক্স, সিবিআই ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় সরকারী সংস্থাগুলি আর মানুষের স্বার্থে কাজ করে না। তারা কাজ করে মোদীর স্বার্থে এবং মোদী বিরোধীদের বিরুদ্ধে। তাই যারা মোদী সরকারকে বিগত ৯ বছর ধরে দেখছে, তাদের আগেই অনুমান করা উচিত ছিল যে বিবিসি-র অফিসে এদের মধ্যে কেউ একজন ঢুকবে। এই ক্ষেত্রে আপাতত আয়কর দপ্তর ঢুকেছে। তাতে যদি বিবিসিকে বিব্রত না করা যায়, তাহলে ইডি, সিবিআই-ও লাইনে আছে। বার্তাটি পরিষ্কার। ভারতে থাকলে মোদীর পক্ষে থাকতে হবে। বিপক্ষে থাকলে গব্বর সিংহের মতন ইডি-সিবিআই-আয়কর আপনাকে ভয় দেখাতে আসবেই।
কিন্তু মোদীর বন্ধু হলে অথবা আদানি হলে আপনার কোনো চিন্তা নেই। গভীর এবং গুরুতর অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে থাকলেও ইডি-সিবিআই কেন, পাড়ার হাবিলদারও আপনাকে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে না। আপনি আপনার পুঁজি আহরণের কাজ জারি রাখবেন, আর অন্যদিকে হিন্দুত্বের পাঁচনের সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠবাদের অহমিকা মিলিয়ে মানুষের জন্য থাকবে প্রধানমন্ত্রীর বাণী - তিনিই একমাত্র দেশের জন্য কাজ করছেন, বাকিরা আদানির মতন মানুষদের নিয়ে প্রশ্ন তুলে উন্নয়নের জোয়ারের সামনে খড়কুটো দিয়ে বাঁধ দিতে চাইছে। আপাতত উন্নয়ন চলছে দেশে। আদানি সেই উন্নয়নেরই অংশ। তাই আদানি বলেই রেখেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলা মানে ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলা।
আপনাকে আদানির ভারতে স্বাগত।