আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ● ১৬-২৯ মাঘ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

ব্রান্ড, জেনেরিক ও ব্রান্ডেড জেনেরিক

প্রতীশ ভৌমিক


আধুনিক ওষুধের রাসায়নিক ফর্মুলা পরীক্ষাগারে বিশদ গবেষণার ফলে তৈরি হয়। প্রতিটি ওষুধ আলাদা ফর্মুলার, স্বতন্ত্র চরিত্রের ও বিশেষ বিশেষ নামে তা পরিচিত হয়। কোনো একটি সংস্থার গবেষকরা যখন কোনো একটি নতুন ওষুধ আবিষ্কার করেন তখন ঐ সংস্থাটির আবেদন অনুসারে ওষুধের পেটেন্ট করা হয়। সেটি প্রোপ্রাইটারি ড্রাগ নামে রেজিস্ট্রেশন হয়। এই পেটেন্টের মেয়াদ থাকে ২০ বছর পর্যন্ত। আইনতভাবে এই সময়ের প্রথম ৫ বছর কেবল ঐ কোম্পানিটিই ওষুধটি নিয়ে বাজারজাত করতে পারে। পরবর্তী ১৫ বছর ঐ পেটেন্টেড ঔষধটি কোম্পানীর অনুমোদন সাপেক্ষে রয়্যালটি দিয়ে অন্য কোম্পানিও বিক্রি করতে পারবে। ২০ বছর পেরিয়ে গেলে সরকারিভাবে এই পেটেন্টেড ওষুধটিকে অন্য কোম্পানিকে রয়্যালটি ছাড়াই তৈরি করার ও বাজারে বিক্রি করার অনুমতি দেওয়া যায়।

ব্র্যান্ডনেম ছাড়া এই পেটেন্ট মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধটি হল জেনেরিক আর ব্র্যান্ডনেম যুক্ত করে ওষুধটি ব্র্যান্ডেড জেনেরিক ওষুধ নামে পরিচিত হয়।

একথা অনস্বীকার্য যে তুলনামূলকভাবে পেটেন্টেড ওষুধের দাম অনেকটা বেশি। কিন্তু কেন সেকথা আমাদের অনেকেরই জানা নেই। তথ্য বলছে, যে কোনো ওষুধের আবিষ্কার করার পরে পেটেন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে ঐ ফর্মুলাটির ফার্মাকোলজি সংক্রান্ত বিষয়ে বিস্তারিত বৈজ্ঞানিক তথ্যের প্রয়োজন হয়। ওষুধটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করা থেকে শুরু করে ওষুধের কার্যকারিতার বিভিন্ন পদক্ষেপগুলো রেকর্ড করে এই ওষুধ উৎপাদন সম্পর্কিত তথ্য জমা করা হয়। এমনকি ওষুধের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া, শরীর থেকে রেচন পদ্ধতিতে ওষুধ বের হয়ে যাওয়া, প্রতিদিনের ডোজ, সকল বয়সের মানুষের শারীরিক সমস্যা, ঐ ওষুধের ব্যবহার সম্পর্কে সমস্ত খুঁটিনাটি পরীক্ষার রিপোর্ট ও সাবধানতা সম্পর্কিত তথ্য থাকা বাধ্যতামূলক। রিসার্চ ট্রায়াল, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার রেকর্ডগুলো এবং সবশেষে মানুষের উপর যে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলে সেইসব তথ্য অবশ্যিক হিসাবে জমা দিয়ে তবেই পেটেন্টের জন্যে দাবি করতে হয়।

এইভাবে একটি ওষুধ আবিষ্কারের পদ্ধতিতেই কোটি কোটি ডলার খরচ হয়ে যায়। তারপর ঐ ওষুধের ছাড়পত্র নিয়ে চিকিৎসকদের কাছে ড্রাগস এ্যান্ড কসমেটিকস এ্যাক্ট মোতাবেক কোম্পানি প্রচার করে ওষুধটি বাজারজাত করতে পারে। এই খরচগুলো ওষুধের মূল্যের সঙ্গে একত্রে জুড়ে নেয়, ফলত পেটেন্টেড ওষুধের দাম হয় আকাশ ছোঁয়া। যদিও ঐ মহার্ঘ্য পেটেন্টেড বা ব্র্যান্ডেড ওষুধের পাশাপাশি এদেশে ব্র্যান্ডেড জেনেরিক বা জেনেরিক ওষুধই মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

পেটেন্টেড বা ব্র্যান্ডেডের তুলনায় জেনেরিক বা ব্র্যান্ডেড জেনেরিক ওষুধের কিছু পার্থক্য থাকলেও ওষুধের কার্যকারিতা প্রায় একইরকম। নির্দিষ্ট কোনো ওষুধের পেটেন্ট অধিকারের মেয়াদ শেষ হলে ওষুধটি জেনেরিক বা ব্র্যান্ডেড জেনেরিক হিসেবে কোম্পানি সরকারিভাবে রেজিস্ট্রেশন করে ট্যাবলেট, সিরাপ, ইনজেকশন প্রভৃতি বিভিন্ন ফরমুলেশন বানাতে পারে এবং বাজারজাত করতে পারে। তবে ঐ সংস্থার WHO GMP Certificate অবশ্যই থাকতে হবে। এই ধরনের ওষুধের ফর্মুলাটি নিয়ে তৈরি ওষুধের ক্ষেত্রে বাইন্ডিং এজেন্ট, ওষুধের কোয়ালিটি, সলিউবিলিটি, ওষুধের পোটেন্সি, স্টেবিলিটি, ক্রুডড্রাগ পিওরিটি, ড্রাগ টক্সিসিটি ইত্যাদির উপরে নজর দেওয়া হয়। ড্রাগের অফিস থেকেই এই সমস্ত নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ড্রাগ ইন্সপেক্টরদের সাথে ফুড এ্যান্ড ড্রাগ দপ্তরের যৌথ উদ্যোগে ওষুধ উৎপাদনের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। FDA-এর নিয়মানুযায়ী দাবি করা হয় ওষুধের ২০%-এর কমের মধ্যে গুনমানের হেরফের থাকলেও ঐ ওষুধকে জেনেরিক বা ব্র্যান্ডেড জেনেরিক হিসেবে বিক্রির অনুমতি দেওয়া যেতে পারে।

আমাদের দেশের ওষুধের কোয়ালিটি বা গুনমান সম্পর্কিত কিছু কথা অবশ্যই বলা প্রয়োজন। ভারতীয় জেনেরিক ওষুধের ক্ষেত্রে এই কোয়ালিটি হেরফেরের পরিমাণ খুবই সামান্য। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে লাভের পরিমাণ বাড়াতে গিয়ে কড়া নিয়ন্ত্রণ উপেক্ষিত হওয়ায় কয়েকটি কোম্পানির ক্ষেত্রে দেশে ও বিদেশে নিম্নমানের ওষুধ পাওয়া গেছে। তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ড্রাগ ইন্সপেক্টরদের সংখ্যা প্রায় ১,৫০০-র কাছাকাছি আর সেন্ট্রাল ড্রাগ ইন্সপেক্টরদের সংখ্যা ১৫০-র মতো। বর্তমান সময়ে দেশের ওষুধের সঠিক গুনমান বজায় রাখতে ও ওষুধ শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করতে সারা দেশে প্রায় ২০,০০০ ড্রাগ ইন্সপেক্টরের প্রয়োজন রয়েছে।

এক্ষেত্রে সরকারের আরও শক্তিশালী পরিকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন অন্যথায় ওষুধের গুনমান সহ ওষুধমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে। তথ্য বলছে এই সময়ে সারা দেশে প্রায় ১০,৩০০-এর বেশী ওষুধ উৎপাদনকারী সংস্থা রয়েছে যা পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম ওষুধ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পরিচিত। এই ওষুধগুলো কিছু পাবলিক ও বেশীর ভাগটাই প্রাইভেট সেক্টর কোম্পানির মাধ্যমেই তৈরি হয়। ’৬০-এর দশকে ভারতের বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ব ওষুধ সংস্থাগুলো যেমন IDPL, HAL, BI, BCPL, SSPL ও পরবর্তীতে KAPL প্রভৃতি এ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট (API) সহ ফর্মুলেশন তৈরি করতো। তারা ১৯৭০-এর পেটেন্ট আইন মোতাবেক সস্তায় ওষুধ তৈরিতে সক্ষম ছিল। এই সংস্থাগুলো বিদেশি বহুজাতিকদের বাজারের সঙ্গে মোকাবিলা করতেও সক্ষম ছিল, তাতে ওষুধের দাম কম হত। এ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট নিয়ে আজকের মতো ইটালি বা চিনের উপর নির্ভর করতে হত না। সাধারণ মানুষ হাসপাতালের মাধ্যমে বিনামূল্যে আদর্শ গুনমান সম্পন্ন ওষুধ পেতো। সরকারি হাসপাতাল, আন্ডারটেকিং সংস্থায় Steel Authority, CCL, BCCL-এর মতো বিশাল ইনফ্রাস্ট্রাকচারের কোম্পানির হাসপাতালেও মানুষের কাছে এই রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা থেকে বিনামূল্যের জেনেরিক ওষুধ পৌছাত। রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাওয়ায় ভারতীয় ব্যক্তিগত মালিকানার বড় কোম্পানিগুলোই দেশের বাজারের দখল নিয়েছে।

ভারতের ওষুধের বাজার দখল নিয়েছে বহুজাতিক ও দেশীয় একচেটিয়া পুঁজির কিছু কোম্পানি। বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে নেওয়ার মতো করে গিলে নিয়ে তারা দেশের ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেছে, ওষুধের দামও বাড়িয়েছে।

কেন্দ্রের সরকারের পক্ষ থেকে বহুজাতিকদের ১০০% FDI-এর মাধ্যমে ব্যবসার সুযোগ করে দিয়েছে, তাছাড়াও ব্রাউনফিল্ড ইনভেস্টমেন্ট দ্বারা উৎপাদনের জন্য ব্যবসায়ীদের সবরকম সুবিধা দিয়েছে। অথচ পেটেন্টেড ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করা সরকারের হাতে নেই। দেশের তৈরি ব্রান্ডেড জেনেরিকের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি (NPPA)। তাতে বাজারভিত্তিক গড় মূল্যকে মান্যতা দেয়, তার ওপর বছর বছর ১০% দাম বাড়ানোরও বিধান আছে। এর ওপর আবার গড়ে ১২-১৮% জিএসটি জুড়ে ওষুধের দাম হয় আকাশচুম্বী। কোম্পানি প্রচার, লিফলেট সহ অন্যান্য খরচও জুড়ে নেয়। এভাবে ব্র্যান্ডেড জেনেরিকেরও দাম বেড়ে যায়। তবে পেটেন্টেড ওষুধের তুলনায় দাম অনেক অনেক কম। আর জেনেরিক ওষুধের দাম ব্র্যান্ডেড জেনেরিকের তুলনায় আরও অনেক কম।

সরকারি হাসপাতালগুলোতে কোনো অজ্ঞাত কারণে বিনামূল্যের জেনেরিক ওষুধের বিরাট ঘাটতি থাকে। সেই সংকট মেটাতে হাসপাতালের ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানে ৬০%-৭৫% ছাড়ে ওষুধ কিনতে জনগণকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। ব্যক্তিগত মালিকানায় তৈরি কোম্পানির সস্তার ব্র্যান্ডেড জেনেরিক ওষুধ কেনা কি এক ধরনের প্রতারণা নয়? পশ্চিমবঙ্গের হাসপাতালের ফেয়ারপ্রাইস শপগুলোকে বারবার এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। হাসপাতালগুলোতে জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন করা হয় এবং দোকান থেকে জেনেরিকের বদলে নিজেদের নিম্নমানের সস্তার ব্র্যান্ডেড জেনেরিক বিক্রি করে অথচ দোকানে Bill করা হয় জেনেরিক নামে। হাসপাতাল থেকে জেনেরিক ওষুধের প্রেসক্রিপশনে জেনেরিক ওষুধ বিক্রি না করে একটি বিশেষ চক্রের নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ছাড় দিয়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ব্র্যান্ডেড ওষুধের ব্যবসা চালাচ্ছে। এই ওষুধগুলোর দাম খোলা বাজারে ব্র্যান্ডেড জেনেরিকের থেকেও অনেকটা বেশি। জনঔষধির দোকানে জেনেরিক ওষুধ দেশের গরীব মানুষকে অবশ্যই কিছুটা কম দামে ওষুধ পেতে সাহায্য করে। পাশাপাশি এই ফেয়ারপ্রাইস দোকানেও শুধুমাত্র জেনেরিক ওষুধ বিক্রি হলে মানুষের কাছে সস্তার ওষুধ পৌছাবে।

তবে জেনেরিক নিয়ে সাবধানতা থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। খোলা বাজারে ওষুধের দোকানে জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন ও তার ব্যবসায়িক ও সামাজিক প্রভাব কী হতে পারে সেটা ভাবনার বিষয়। খোলা বাজারে জেনেরিক ওষুধের বিক্রির অর্থই হল চিকিৎসকের লেখা প্রেসক্রিপশনের পেটেন্টেড ওষুধ বা ব্র্যান্ডেড জেনেরিক ওষুধের বিকল্প হিসেবে জেনেরিক ওষুধ নিয়ন্ত্রণ করবে।কেমিস্টের দোকানে ফার্মাসিস্ট থাকে না, তাদের কর্মচারীদের বিভিন্ন ওষুধ, তার প্রভেদ সম্পর্কে কিছুই জানা থাকে না। চিকিৎসকের প্রয়োজনে আপৎকালীন সময়ে আদর্শ ক্ষমতাসম্পন্ন ওষুধ এমনকি শক্তিশালী এ্যান্টিবায়োটিকের জায়গায় বেশি লাভজনক সস্তার জেনেরিক ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা বিভ্রাট ঘটতে পারে, ব্র্যান্ড ও ফর্মুলা চিহ্নিত করে সঠিক ওষুধ পরিবেশন করা দায়িত্বশীল কাজ।

সবশেষে একটা কথা বলা দরকার। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ওষুধ শিল্পের ক্ষেত্রে ওষুধ উৎপাদন থেকে শুরু করে গুনমান নিয়ন্ত্রণ, ওষুধের মূল্য নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ, ওষুধের ডিস্ট্রিবিউশন, রক্ষনাবেক্ষণ ও সঠিক ওষুধ পরিবেশন গুরুত্বপূর্ণভাবে পর্যবেক্ষন করা প্রয়োজন।