আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ● ১৬-২৯ মাঘ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

বোলো তারা রারা

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী


পতাকা উঠল। পতাকায় মোড়া ফুল। সেটা উপরে উঠে যাওয়ার পরে ফুল ঝরে পড়ল নিচে টুলে রাখা গান্ধীজি আর নেতাজির ছবির উপরে। ক্লাবকর্তা বললেন, জয় হিন্দ। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গোটা দশেক লোক সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘জয় হিন্দ।’ লতা মঙ্গেশকরের গলায় জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠল পাশে রাখা স্পিকারে। এক মিনিটের শারীরিক স্তব্ধতার পরে, গান থেমে গেলে ক্লাবকর্তাকে ভালবেসে ঘিরে ধরলেন চার পাঁচ জন। চোখের ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হয়নি বছর পঞ্চাশের কর্তার। বললেন, ‘সব ব্যবস্থা করা আছে। কোল্ড ড্রিংকসটা শুধু নিয়ে আসুন পাশের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে। দুটোর সঙ্গে একটা ফ্রি চলছে। অ্যাসোসিয়েশনের ঘরে মিশিয়ে নিলেই হবে। প্রচুর তুলে রাখা আছে কাল। এখন থেকেই শুরু করে দিতে হবে, গুরু।’ ঘিরে থাকা লোকজনের মুখে ফোয়ারার মতো ফুটে উঠল প্রত্যয়। শুনলাম, ‘একেবারে ঠিক লোককেই প্রেসিডেন্ট করেছিলাম গত বছর।’ আওয়াজ পেলাম, ‘জিও গুরু, জিও।’ লতা মঙ্গেশকরের পরে সাউন্ড ট্র্যাক অবশ্য পাল্টিয়ে দেওয়া হয়েছে তার আগেই। সেখানে তখন বাজছিল দালের মেহেন্দির বোলো তারা রারা। ক্লাবকর্তার প্লে লিস্টে এর পরেই অপেক্ষা করে ছিল বেবি ডল। একটু দেশপ্রেম দেখালে ঝিনচ্যাক সহকারে তা পুষিয়ে নিতে হয়, নিজেদেরই স্বার্থে।

আমাদের নিম্ন মধ্যবিত্ত বাংলা মিডিয়াম স্কুলে বহু বছর আগে বাংলার স্যারের মুখে শোনা কথাগুলো মনে গেঁথে রয়েছে এখনও। সেদিনও প্রজাতন্ত্র দিবস ছিল। সকাল আটটায় আমরা সার বেঁধে স্কুলের সামনে। স্যার বলেছিলেন, ‘২৬শে জানুয়ারির মানে ক্যালেন্ডারের অনেকগুলো কালো ঘরের মধ্যে শুধু লাল অক্ষরে লেখা সংখ্যা নয়। প্রজাতন্ত্র দিবস মানে শুধুমাত্র বছরের একটা দিনে বি. আর. আম্বেদকরের ছবির সামনে স্যালুট ঠুকে দেওয়া নয়। প্রজাতন্ত্র কথার অর্থ হল প্রজার তন্ত্র। সদ্য স্বাধীন দেশের প্রজারা নিজেদের ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্যই বৃহত্তর স্বার্থে মেনে নিয়েছিলেন কিছু নিয়ম। এটাই প্রজাতন্ত্রের সার কথা।’ ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবি পরা স্যার আরও যোগ করেছিলেন, ‘গণতান্ত্রিক ভারতের কাঠামোয় সংবিধান জারি হওয়ার ওই বিশেষ দিনটিকে চক্ষুদান বলে মনে করতে পারো। যত দিন বেঁচে থাকবে, সাংবিধানিকভাবে বাঁচবে, দেশের স্বার্থে, দশের স্বার্থে বাঁচবে।’

২৬শে জানুয়ারির সন্ধেবেলায় এই লেখাটা লিখছি যখন, পাশের পাড়া থেকে ভেসে আসছে, ‘প্রেম জেগেছে আমার মনে বলছি আমি তাই, তোমায় আমি ভালবাসি তোমায় আমি চাই।’ এর আগেই শেষ হয়েছে ‘আমি কলকাতার রসগোল্লা।’ একটু আগে হাঁটতে বেরিয়ে দেখেছি সেখানে মেলা লোক। মাঝখানে আলো করে রয়েছেন বিদ্যার দেবী। দেবীকে ঘিরে মঞ্চ। মঞ্চের উপরে ঝিঙ্গালালা। এ বছরে একই দিনে দু-দুটো মেগা ইভেন্ট। সেলিব্রেশনের পারদ সেই অনুযায়ী মানানসই হয়েছে। হওয়ারই কথা ছিল।

ছোট থেকে বড় হয়েছি যত, দেখেছি প্রজাতন্ত্র দিবস ক্রমশ তার গায়ে পরে নিয়েছে রিপাবলিক ডে ধামাকার চুমকি বসানো চাদর। এই দিনটা হয়ে উঠেছে শপিং-এর মহা কার্নিভাল, ঠিক স্বাধীনতা দিবসের মতো। শপিং মলের কর্তাদের ঘুম উড়েছে ব্যস্ততায়। এক বাহারি মলের ম্যানেজার বলছিলেন, রেকর্ড ফুটফল তাঁরা আশা করছেন ২৬শে জানুয়ারি। মোটা খবরের কাগজ তার প্রতিটা পাতায় অফারের হাতছানি দেয়। ৫৫ ইঞ্চির টিভি বলে, তোমার ঘরে আসি এবারে। ইএমআই মাত্র ২২২২ টাকা। জামাকাপড়ের কোম্পানি বলে ৫০ শতাংশ ছাড়ের সঙ্গে আরও ২৬ শতাংশ ছাড়। কারণ, পেশ করা হচ্ছে ২৬ জানুয়ারি শপিং ধামাকা। ফুল পয়সা উসুল করার আহ্বান জানায় সর্বভারতীয় খুচরো বিপনন সংস্থা। পানমশলার তাবড় কোম্পানি বলে, হৃদয়ে থাক দেশপ্রেম আর মুখে থাক মশলা। রেস্তোরাঁ মালিকরা জানান দেন, এই যে আমাদের রিপাবলিক ডে স্পেশাল মেনু। চারটে মটন বিরিয়ানি পেটে পুরলেই চিকেন চাঁপ - অ্যাবসিলিউটলি ফ্রি। মনে উথলে ওঠা খুশি নিয়ে আমরা ভনভন করি এমন শপিং মল, রেস্তোরাঁয়, মাল্টিপ্লেক্সে। টাকা উড়িয়ে বিলে দেখি, কত টাকা বাঁচালাম। বুদ্ধিমান যাঁরা, শুক্রবারটা ছুটি নিয়ে তাঁরা ইতিমধ্যেই পাড়ি দিয়েছেন কাছাকাছির ডেস্টিনেশনে। এমন লোলুপ উইকএন্ডের মায়া কাটানো এতটা সহজ কথা নয়।

চারদিকে এত নিয়ন আলো দেখে মনে হয়, দিব্যি আছি বুঝি। প্রেম জেগেছে আমার মনে-র পরে এবারে শুরু হল ’না না না, কাছে এসো না, মায়াবী এ'রাতে।’ রাত বাড়ছে। ফেসবুক স্ক্রল করি। আমার একমাত্র বন্ধু তো মোবাইলের স্ক্রিনই। পরিচিতরা, যাদের আমি ফ্রেন্ডস বলে জানি, তারা পাঁচ তারা রেস্তোরাঁ থেকে পোস্ট করেছে ভিকট্রি চিহ্ন। টেবিল সেজে উঠেছে নানা বাহারি খাদ্য আয়োজনে। হাউস পার্টিতে পাঁচ পেগ ডাউনের উচ্ছ্বাস সেলফি ছবিতে মাতিয়ে দিয়েছে কয়েকজন। সবার মুখে চুম্বনচিহ্ন, যাকে পাউট বলা হয়। কারও গালে তিনরঙা পতাকার পেইন্টিং। কেউ ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে পাইলট গাড়ির মতো নিয়ে যাচ্ছে ট্রলিবোঝাই সামগ্রী। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। আঙুল দিয়ে পর্দা স্ক্রল করি। এ আবার কি! একজন লিখেছেন, ‘শববাহী যান না পেয়ে মায়ের দেহ কাঁধে নিয়ে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হল যে ছেলে, তার কাছে আজকের দিনের অর্থ কি বলতে পারেন কেউ?’ পাউট ছবিতে চারশ লাইক। এমন পোস্টে সাতটা।

ন্যাশনাল হাইওয়েতে ঘন্টায় একশ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালানোর সময় হঠাৎ একটা বাম্পার পড়লে যেমন অনুভূতি হয়, ঠিক তেমনই এক ঝাঁকুনি খেলাম এই পোস্টটায়। আজি শুভদিনে এ আবার কেমন কথা! আলাপ থেকে ঝালায় গিয়ে দিব্যি বাজছিল যে বাদ্যযন্ত্র, তার সবকটা তার কি ছিঁড়ে গেল একসঙ্গে? মোবাইলের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে নিতে বাধ্য হলাম ঝটিতি। স্কুলজীবনে শোনা বাংলা স্যারের কথাগুলো অনুরণিত হতে শুরু করল নিজের দু'কানে। নয়েজ ক্যান্সেলেশনওয়ালা ব্লু-টুথ হেডফোন কানে গুঁজে দিয়ে একটা ঝিনচ্যাক গান চালাতে চেষ্টা করলাম। গানে মন দিতে পারলাম না। টেনে ফেলে দিলাম। এদিকে পাশের পাড়ার অনুষ্ঠানে শুরু হয়ে গিয়েছে জুম্মা চুম্মা দে দে।

প্রজার তন্ত্র কেমন আছে এখন? গলির মোড়ে মোড়ে হাত জোড় করা হাসিমুখ কাটআউট বলে, দিব্যি আছো তো তোমরা। এই যে আমি! মাসে দু'দিন হাজির হচ্ছি তোমার মনের কথা শোনার জন্য, নিকটবর্তী পৌরসভায়। এই যে আমি। এই যে তোমার জন্য খাদ্য মেলা - পুষ্প মেলা - আনন্দ মেলা - সংগীত মেলা - পুকুরপাড়ে আরতি। শয়নে স্বপনে আমি শুধু দেখতে চাই তোমার মুখের হাসি। দুখের দিন শেষ। সবার জন্য গ্যাস, সবার জন্য বাড়ি, সবার জন্য জল-বিদ্যুত-শিক্ষা-স্বাস্থ্য পরিষেবা। সবার জন্য রাশি রাশি হাসি। রাস্তায় বেরোলেই দেখি আনন্দের এলাহি আয়োজন। সামনে ডাঁই করে রাখা রয়েছে খববের কাগজ। পাতা ওল্টাতে থাকি। প্রকাশ্যে মদ খাওয়ার বিরোধিতা করার জন্য স্থানীয় ছেলেরা থেঁতলে দিল এক প্রৌঢ়কে। এক তরুণী ধর্ষণের অভিযোগ জানাতে গেলে থানার অফিসার আকাশপানে চেয়েছিলেন। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁর হাতের পরিধি যে বহুদূর। গাড়িতে ঘষটাতে ঘষটাতে কয়েক কিলোমিটার চলে যায় ছেঁচড়ে যাওয়া দেহ। নিয়োগের পরীক্ষা নিয়ে সরকার কলার তুলে বলে, এবার থেকে পরীক্ষা হবে স্বচ্ছ। অন্যদিকে মেট্রো রেলের স্পিকার ক্রমাগত আউড়ে যায়, ‘সরকারি চাকরি বিক্রি হয় না। তার একমাত্র যোগ্যতা শুধু মেধা।’ আর মেধার জোরে বাঁচার আশায় যারা অন্য কোনও সরকারের অন্য কোনও পরীক্ষা দিয়েছিল, তারা কাজ পেল না শুধুমাত্র টাকা দিতে পারেনি বলে। খুচরো দিতে না পারায় অটোচালক যাত্রীর গালে চড় কষান ঠাটিয়ে। মুমূর্ষু রোগী হাসপাতাল চত্ত্বরে পড়ে থাকেন। অন্য বিল্ডিংয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্ট্রেচার নেই। নেই বলা ভুল। শুধু উপরি কিছু না দিতে পারার জন্য চিকিৎসার সুবিধা মেলে না। এ গণতন্ত্রে মৃত্যুও যে বড় ব্যবসা আজকাল। তিন কিলোমিটার যাওয়ার জন্য ছ’হাজার টাকা চেয়ে বসেন শববাহী যানের চালক। জানা যায়, এর ভাগ নাকি আছে হাসপাতালের সবার। কেউ বাধ্য হয়ে মৃতদেহ কাঁধে নিলে তাঁকে ধাওয়া করে টিভি চ্যানেলের বুম। নির্লজ্জ প্রশ্ন ওঠে, ‘কেমন লাগছে?’ আমরা পপকর্ন খেতে খেতে স্মার্ট টিভিতে নিয়ে নিই দেশের খবরের দুরন্ত আপডেট, মাত্র দশ মিনিটে। এর পরেই যে শুরু হয়ে যাবে পছন্দের ওটিটি সিরিজ।

কোটি কোটি প্রজা যাদের রাজা বলে মেনে নিয়েছি, তারা মাচার উপর থেকে হাত নাড়েন। সরকার দুয়ারে আসে। কিন্তু তাতে দরকার মিটল কতটা তা নিয়ে খবর নেয়না কেউ। শীর্ষমন্ত্রীরা কখনও নেমে আসেন ধরায়। গরীবের বাড়িতে মাটিতে বসে ওদের থালায় ডাল ভাত খেয়ে যান। আমরা দেব দর্শন করি। সেই ছবি মুহূর্তে ছড়িয়ে যায় দলের ওয়েবসাইটে-ফেসবুকে-টুইটার হ্যান্ডলে। অনুষ্ঠানের পরে সেই গরীবগুর্বোরা ফ্ল্যাশের আলোর ঝলকানি ভুলে গিয়ে ফের ছেঁড়া গেঞ্জিটা পরে বসেন। একটু জিরিয়ে নেন। দশ মিনিটের খ্যাতির ঘাম মোছেন।

এমনভাবে বেঁচে আছি কেন, তা নিয়ে আমরা কেউ প্রশ্ন করি না। সারাজীবন শুধু উত্তর দিয়ে যাই। অনন্ত ফাইফরমাশ খাটি। নিজেকে নিংড়ে দিয়ে প্রতিদিনের মাইনে জাস্টিফাই করার দৌড়ে নামি। যে লোকটাকে আঁচড়াই, জানি সেও বেঁচে রয়েছে আমারই মতো। আর নিজেদের ভাল রাখার ভার যে লোকগুলোকে দিয়েছি, ঘাড় উঁচু করে, পাউডারের মতো গায়ে মেখে নেই তাঁদের কপ্টারের শব্দ।

প্রজাতন্ত্রের শুভেচ্ছা। আমি মন্ত্র তন্ত্র কিছুই জানি নে মা। শুধু হেরে যেতে জানি প্রতিদিন, কোটি কোটি প্রজার মতো।

বোলো তারা রারা।