আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ● ১৬-২৯ মাঘ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের রাজনীতি

অন্বেষা সেনগুপ্ত


১৯৪৭ সালের ১৫ই অক্টোবর যুগান্তরে কাফী খাঁ’র (আসল নাম প্রফুল্ল চন্দ্র লাহিড়ী) করা একটি কার্টুন প্রকাশিত হয়। কার্টুনে রয়েছেন যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল - পাকিস্তানের তৎকালীন শ্রম ও আইন মন্ত্রী, শিডিউলড কাস্ট ফেডারেশনের নেতা। এছাড়া রয়েছে পাঁচটি শেয়াল। যোগেনবাবু আঙুলের ইশারায় চারটি শেয়ালকে তাঁর দিকে আসতে বলছেন আর পঞ্চম শেয়ালটি তাঁর দিকে তখনই আছে, তাঁর কথায় সায় দিচ্ছে। কার্টুনটির নাম ‘আমাকে অনুসরণ কর’।

‘আমাকে অনুসরণ কর’, যুগান্তর, ১৫ অক্টোবর ১৯৪৭

শিয়ালকে আমরা ধূর্ত প্রাণী হিসাবে দেখি। ইংরেজিতে কথাও আছে - sly fox। এছাড়া বাঙলা আরেকটি প্রবাদ তো সকলেরই জানা - সব শিয়ালের এক রা। এক ধূর্ত শেয়াল যখন যোগেনবাবুর পথাবলম্বী হয়েছে, বাকীরাও হবে এমনটাই বোধহয় এই কার্টুনের ইঙ্গিত। একটা শেয়াল ইতিমধ্যে যে পা বাড়িয়েছে তা ছবিতে স্পষ্ট। কার্টুন স্রষ্টার চোখে যোগেন্দ্রনাথের অনুগামী বা সম্ভাব্য অনুগামীরা যে শেয়ালের মত গুণাগুন সম্পন্ন মানুষ তা নিয়ে সন্দেহ নেই। এই কার্টুন ছাপা হয়েছে যে কাগজে তার সম্পাদক ও পাঠক-পাঠিকার কাছেও এই কার্টুন অর্থবাহী ও গ্রহণযোগ্য ধরে নেওয়া যায়। তা না হলে এমন কার্টুন ছাপা হত না। কেন অর্থবাহী ও গ্রহণযোগ্য এবং কার কাছে অর্থবাহী ও গ্রহণযোগ্য - এই প্রশ্নগুলো নিয়ে একটু তলিয়ে ভাবা যাক। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে হয়তো দেশভাগের প্রেক্ষিতে জাতিবর্ণের রাজনীতি নিয়েও দু-চার কথা জানা যাবে।

যোগেনবাবুর ‘দিক’

যুক্ত বাংলার অন্যতম প্রধান নমঃশুদ্র নেতা ছিলেন যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল (১৯০৪-১৯৬৮)। আদতে বরিশালের বাসিন্দা, যোগেন্দ্রনাথের বাংলা রাজনীতিতে হাতেখড়ি নির্দল প্রার্থী হিসাবে। ১৯৩৭ সালে বাখরগঞ্জ থেকে নির্বাচনে জেতেন যোগেন্দ্রনাথ, হারান কংগ্রেস প্রার্থী সরল কুমার দত্তকে। সরল কুমার ছিলেন কংগ্রেস জেলা কমিটির সভাপতি এবং স্বদেশী নেতা অশ্বিনী দত্তের নিকট আত্মীয়। অন্যদিকে যোগেন্দ্রনাথ একেবারেই ঢাল নেই তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দার। নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেল দত্তমশাই পেয়েছেন ১০,৬৫৩টি ভোট আর যোগেন্দ্রনাথের ঝুলিতে ১২,০৬৯টি ভোট। এমন তাবড় নেতাকে হারাতে পারা কম কথা নয়। সেটা সম্ভব হয়েছিল যোগেনবাবুর স্পষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের ফলে। নমঃশূদ্র যোগেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মঞ্চ হিসাবে রাজনীতিকে বেছে নিয়েছিলেন। সকলের সমর্থন নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা ছিল না। জাতের দোহাই দিয়ে সমাজের একাংশের মানুষকে যুগে যুগে অত্যাচার ও অবমাননা করা, শিক্ষা, চাকরি ও অন্যান্য নানা ক্ষেত্রে বঞ্চিত করা, দৈনন্দিন জীবনে দূরে সরিয়ে রাখার বিরুদ্ধে ছিল তাঁর রাজনীতি। আর সেই রাজনীতিতে আস্থা ছিল সে অঞ্চলের 'ছোট' জাতের সকলেরই। কৈবর্ত্য, জেলে-কৈবর্ত্য, জোলা, মুচি, রবিদাস - সকল 'নীচু' জাতের মানুষের সমর্থনে কংগ্রেস প্রার্থীকে হারাতে পেরেছিলেন নমঃশুদ্র যোগেন্দ্রনাথ।

নির্দল অবশ্য বেশীদিন থাকেননি যোগেনবাবু। সুভাষ বোসের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল, সেই সূত্রে কিছুদিন তিনি কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ১৯৪৩-এ মূলত তাঁর উদ্যোগে আম্বেদকারের শিডিউলড কাস্ট ফেডারেশনের বঙ্গীয় শাখা স্থাপিত হয়। সে বছরই, শ্যামা-হক মন্ত্রীসভার পতনের পর, নাজিমুদ্দিনের প্রধানমন্ত্রীত্বে মণ্ডল নিজে মন্ত্রীও হন। দেশভাগের সময় অবধি যোগেনবাবু ও মুসলিম লীগের ঘনিষ্ঠতা বজায় ছিল। দেশভাগের পরও যোগেন্দ্রনাথ যে লীগের প্রিয়পাত্র ছিলেন, অন্তত প্রথম কয়েক বছর, তা বোঝা যায় পাকিস্তান মন্ত্রীসভায় তাঁর গুরুত্ব দেখে। দেশের প্রথম আইন ও শ্রম মন্ত্রী হিসাবে তাঁকে মনোনীত করেন স্বয়ং জিন্নাহ। শুধু তাই নয়, যোগেন্দ্রনাথকে বেছে নেওয়া হয় পাকিস্তান আইনসভার প্রথম অধিবেশনের সভাপতি হিসাবেও। এমনকি, ১৯৪৯ সালের ১৯ জুন খুব ধুমধাম করে পাকিস্তানে সরকারি নির্দেশে পালিত হয়েছিল ‘মন্ডল দিবস’। যোগেনবাবুকে সম্বর্ধনা, তাঁর গুণগানের নানা আয়োজন করেছিলেন পাকিস্তান সরকার। সিন্ধু প্রদেশের দলিত সম্প্রদায় অধ্যুষিত অঞ্চল সাজানো হয়েছিল আলো দিয়ে, ফুল দিয়ে আর রাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে।

এতসব আয়োজনের মধ্যে দিয়ে লীগ সরকার কি বার্তা দিতে চেয়েছিল? প্রথমত, যোগেন্দ্রনাথের এই গুরুত্বকে বিশ্ব দরবারে পাকিস্তানের উদার ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস হিসাবে দেখা যেতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী দুনিয়ায় ধর্মের ভিত্তিতে তৈরী পাকিস্তানের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর প্রয়োজনে হয়তো যোগেন্দ্রনাথকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন সে দেশের সরকার। দ্বিতীয়ত, যোগেনবাবুকে দলে টেনে পাকিস্তান সরকার দেশের দলিত নাগরিকদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করেছিলেন এমনটাও আমরা ভাবতে পারি। পূর্ব পাকিস্তানে দেশভাগের পরপর দলিতদের মধ্যে নানা কারণে দেশত্যাগের প্রবণতা ছিল লক্ষ্যনীয়ভাবে কম। পশ্চিম পাকিস্তানেও যে অল্পসংখ্যক সংখ্যালঘুরা রয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের সিংহভাগই ছিলেন দলিত। তাঁদের মনে আস্থা যোগাতে ও তাঁদের মন থেকে অভিবাসনের চিন্তা দূর করতে তাঁদের নেতাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন লীগ কর্তৃপক্ষ। দলিতরা দেশত্যাগ করলে পাকিস্তানের কী ক্ষতি? সংক্ষেপে বলি।

দলিতদের প্রয়োজন ছিল পাকিস্তানের ভাবমূর্তির জন্য এবং রাষ্ট্রনির্মাণে প্রয়োজনীয় সস্তা শ্রমের জন্য। এছাড়া পাকিস্তান থেকে দলে দলে সকল হিন্দু - তা তাঁর জাতি-বর্ণ যাই হোক না কেন - ভারতে চলে গেলে, সে দেশ থেকে বিপরীত দিকে বিপুল সংখ্যক মুসলমান অভিবাসন হতে পারে সেই আশঙ্কাও ছিল। তৃতীয়ত, প্রতিটি পদক্ষেপের মধ্যেই বোধহয় ছিল ভারতের প্রতি বার্তাও। পাকিস্তানের পিছনে দলিত সমর্থন রয়েছে এবং যোগেনবাবু ও লীগের সখ্য আসলে দলিত-মুসলমান সখ্যের প্রতিফলন - এমন বার্তাই বোধহয় জিন্নাহ ও তাঁর পরে লিয়াকত আলি পরোক্ষভাবে দিতে চেয়েছিলেন। ঘুরিয়ে বলতে চেয়েছিলেন ভারতবর্ষ ও কংগ্রেস আসলে বর্ণহিন্দুর দেশ ও দল, তাঁদের কাছে মুসলমান ও দলিত দুইই প্রান্তিক, অচ্ছ্যুত। মোদ্দা কথা, যোগেনবাবু তাঁদের লোক একথা বলার পিছনে মুসলিম লীগের নানা সম্ভাব্য হিসাব নিকাশ ছিল। এক কথায় বলতে গেলে দেশভাগের পরপর লীগ ছিল যোগেনবাবুর ‘দিকে’। ১৯৫০ সালের দাঙ্গা লীগ-মন্ডল সম্পর্কে দাঁড়ি টানে। সে কথা খানিক পরে বলছি।

এখানে বলা বাহুল্য যে কাফী খাঁর করা ১৯৪৭ সালের কার্টুনের শেয়ালেরা মুসলিম লীগের নেতা-মন্ত্রী-সমর্থকেরা নন। তাঁরা ‘চাঁদ-তারার’ দিকেই ছিলেন, তাঁদের বোঝানো বা দলে টানার দায়িত্ব, ক্ষমতা বা এক্তিয়ার কোনোটাই যোগেনবাবুর ছিল না। আমার ধারণা কাফী খাঁর মতে শিয়ালরা হল পাকিস্তানে রয়ে যাওয়া দলিত সম্প্রদায়। তাঁদের শিয়াল বলার কারণ কি? যোগেনবাবু তাঁদের দলে টানার চেষ্টা করছেন মানে ধরে নেওয়া যেতে পারে তাঁর বিকল্প/বিরোধী নেতাও আছেন যাঁরা অন্য কথা বলছেন। কে বা কারা তাঁরা এবং তাঁদের কি মত? তাঁদের দিকে যাঁরা তাঁরা কি শিয়ালতুল্য নয়? এসব কথায় একে একে আসা যাক।

যোগেনবাবুর ‘উল্টোদিক’

উপরের আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট যে যোগেনবাবুর ‘উল্টোদিকে’ সবার উপরে ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। যোগেন্দ্রনাথের রাজনৈতিক জীবনের শুরুই কংগ্রেসের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতা দিয়ে। ১৯৪৬-এর দাঙ্গার সময়ে সুরাবর্দী মন্ত্রীসভায় তাঁর উপস্থিতি, দেশভাগের পর লীগ মন্ত্রীসভায় অংশ নেওয়া এবং বারংবার কংগ্রেসকে দলিত সমাজের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করাকে যে কংগ্রেসের নেতারা ভালো চোখে নেবেন না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যোগেন মন্ডল ছিলেন তাঁদের চোখে ধূর্ত, ক্ষমতালোভী, সুবিধাবাদী রাজনীতিবীদ। তাঁকে দলিত সমাজের যোগ্য প্রতিনিধি হিসাবেও মানতে রাজি ছিলেন না কংগ্রেস নেতৃত্ব। ১৯৪৬-এর নির্বাচনে যোগেনবাবুর দলের ভরাডুবি (তিনি নিজে দুটি আসনে লড়েন ও একটিতে জেতেন) এবং কংগ্রেস মনোনীত দলিত প্রার্থীদের বিপুল জয় এই মতকে দৃঢ় করেছিল। ৩০টি সংরক্ষিত আসনের মধ্যে ২৪টি পেয়েছিলেন কংগ্রেসের দলিত প্রার্থীরা। একটি আসনে জয়ী হন কম্যুনিস্ট প্রার্থী রূপনারায়ণ রায়। নির্দল প্রার্থী হিসাবে জেতেন আরো দু'জন, যাঁরা কয়েকদিনের মধ্যেই কংগ্রেসে চলে যান।

এই দুই নির্দল প্রার্থীর একজন ছিলেন ওঁরাকান্দির প্রমথরঞ্জন ঠাকুর। গুরুচাঁদ ঠাকুরের নাতি, পেশায় আইন বিশেষজ্ঞ প্রমথ নাথ নমঃশুদ্রদের বড় অংশের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গুরু ছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে তিনি দীর্ঘ দিন বিধায়ক ছিলেন ও কংগ্রেসের মন্ত্রীও হয়েছিলেন। ১৯৬৪-এর দাঙ্গার পর অবশ্য তিনি দলত্যাগ করেন এবং যোগেনবাবুর ঘনিষ্ঠ হ’ন। সেসব অনেক পরের কথা। আমি যে সময়ের কথা লিখছি তখন যোগেনবাবুর মূল ‘উল্টোদিক’ হল কংগ্রেসী দলিত নেতারা।

নির্বাচনের ফলাফল দেখলে মনে হতে পারে দলিত সমাজে স্বাধীনতার ঠিক আগে আগে যোগেনবাবুর ‘দিক’ বেশ দুর্বল। অতি সম্প্রতি কিছু ইতিহাসবিদ অবশ্য এই নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে সতর্ক করেছেন আমাদের। বলেছেন টাকার জোর, সাংগঠনিক ক্ষমতা, পেশীশক্তি এবং সর্বোপরি যৌথ নির্বাচকমণ্ডলী কংগ্রেসের জয়ের মূল কারণ ছিল। এই ফলাফল থেকে একথা বলা চলে না যে যোগেনবাবু জনসমর্থন হারাচ্ছিলেন। যোগেন্দ্রনাথ নিজেই বলেছিলেন যে দলিত ভোটের হিসাবে তাঁর দল ছিল অনেক এগিয়ে। কংগ্রেসের দলিত প্রার্থীরা পেয়েছিলেন ২৮ শতাংশ দলিত ভোট আর শিডিউল্ড কাস্ট ফেডারেশনের প্রার্থীরা পেয়েছিলেন ৭২ শতাংশ। কিন্তু যৌথ নির্বাচকমণ্ডলী হওয়ায়, উচ্চবর্ণের ভোটে কংগ্রেস এগিয়ে যায়। তবে মণ্ডলবাবুর মুখের কথায় পুরোপুরি বিশ্বাস না করাই ভালো। কিন্তু একথা বলাই যায় বাংলার দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল নানা রাজনৈতিক মতামত।

দেশভাগের পরপরই প্রমথ ঠাকুর পশ্চিমবাংলায় চলে আসেন। তিনি একা নন, কংগ্রেসের বহু দলিত নেতাই দেশত্যাগ করে ভারতে ঠাঁই নেন। অন্যদিকে পাকিস্তানে রয়ে যান যোগেনবাবু, দ্বারকানাথ বাড়োড়ির মত শিডিউল্ড কাস্ট ফেডারেশনের নেতারা। নেতারা নেতা থাকেন ততক্ষণই যতক্ষণ তাঁদের সমর্থকেরা থাকেন। তাই সহজ অঙ্ক - দলিত অভিবাসন হলে ক্ষতি তাঁদেরই যাঁরা পাকিস্তানে তাঁদের রাজনৈতিক জীবন কাটাবেন ঠিক করেছিলেন। অন্যদিকে নিজেদের প্রতিপত্তি বজায় রাখার জন্য পূর্ববঙ্গ থেকে আসা নেতাদেরও সমর্থক দরকার। এ বিষয়ে সবচেয়ে সুষ্ঠু ভাবনা ছিল প্রমথ ঠাকুরের। পূর্ববাংলা থেকে আসা দলিত উদ্বাস্তুদের বসতি তৈরী করার জন্য প্রমথবাবু উত্তর ২৪ পরগণায় জমি কেনেন (ডিসেম্বর, ১৯৪৭)। তিনি বুঝেছিলেন যে তাঁর অনুগামীরা না এলে তাঁর কোনো রাজনৈতিক গুরুত্ব থাকবে না। সেই জমিতেই তৈরী হয় ঠাকুরনগর - আজকের বাংলার রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এই দলিত রাজনীতির দুই ধারার কথা মাথায় রাখলে বোধহয় খানিকটা স্পষ্ট হয় কার্টুনের অর্থ।

দলিত অভিবাসনের ধরণ

১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর থেকে পূর্ব বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। ১৯৫০-এর গোড়ার দিকে তা ছড়িয়ে পরে পূর্ব ভারতের নানা দিকেও। বিপুল দু-মুখী অভিবাসন শুরু হয় ভারত-পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে। এই দাঙ্গায় আক্রান্ত হয়েছিলেন পূর্ব বাংলার বহু দলিত মানুষ। তাঁদের দলিত নয়, হিন্দু পরিচিতি বড় হয়ে উঠেছিল দাঙ্গাকারীদের কাছে। আর তার ফলে এই প্রথম চোখে পড়ার মত সংখ্যায় দলিত উদ্বাস্তুরা আসতে শুরু করেন পশ্চিমবাংলায়। যোগেনবাবুর উপস্থিতি, লীগ সরকারের ভরসা, ভিটেমাটি ছেড়ে আসার জন্য যতটুকু রসদ প্রয়োজন তাও না থাকা এবং মোটের উপর সাম্প্রদায়িক শান্তি - এইসব নানা কারণেই হয়তো এতদিন থেকে গিয়েছিলেন তাঁরা। দাঙ্গার প্রতিবাদে মন্ত্রীত্ব ছাড়েন যোগেন্দ্রনাথও, পাকাপাকিভাবে চলে আসেন ভারতবর্ষে।

দলিত মানুষদের প্রাথমিক থেকে যাওয়াকেই কি ব্যঙ্গ করেছিলেন কাফী খাঁ তাঁর ১৯৪৭ সালে আঁকা কার্টুনে? এই থেকে যাওয়ার মধ্যে হয়তো তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন যোগেনবাবুর প্রতি সমর্থন আর কংগ্রেসের প্রতি দলিত সমাজের বিতৃষ্ণা। থেকে যাওয়ার পিছনে দলিত সমাজের বাধ্যবাধকতা, মতাদর্শ বা অভিজ্ঞতাকে খুঁজতে যাননি তিনি। সুযোগসন্ধানীর তকমা লাগিয়ে দিয়েছিলেন অবলীলায়। শুধু লোভী, সুযোগসন্ধানী নয়, শিয়ালের সঙ্গে তুলনা টেনে নির্বোধও হয়তো বলেছিলেন ভিটে আঁকড়ে থাকা দলিত মানুষকে (সব শিয়ালের এক রা)। আর নিশ্চয়ই এই দৃষ্টিভঙ্গি বাঙালি হিন্দু ‘ভদ্রলোকের’ কাগজ যুগান্তরের পাঠকদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি আর কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি একই ছিল ধরে নেওয়া যেতে পারে। কংগ্রেস নিয়ে তাঁদের মোহভঙ্গ হতে সময় লেগেছিল আরও বেশ কিছু বছর। বাঙালি হিন্দু ‘ভদ্রলোক’ যোগেনবাবুও তাঁর অনুগামীদের সন্দেহের চোখে দেখতেন; চতুর, লোভী ও সুযোগসন্ধানী মনে করতেন। যোগেনবাবুর অনুগামী বা সম্ভাব্য অনুগামীদের শিয়াল হিসাবে দেখে তাদের কোনো অস্বস্তি হয়নি বলেই মনে হয়। কোনো অভিযোগপত্র অন্তত ছাপা হয়নি যুগান্তরের পাতায়; এর পরেও কাফী খাঁর বহু কার্টুন ছাপা হয়েছে এই কাগজে।

শেষের কথা

১৯৫০-এর দাঙ্গার আগে অবধি বাংলায় দলিত রাজনীতির নানা সম্ভাবনা ছিল। যোগেনবাবুর পাকিস্তানে থেকে যাওয়ায় সেই সম্ভাবনাগুলি বেঁচে ছিল। পাকিস্তানের রাজনীতিতে তাঁদের একরকম জোরের জায়গা ছিল। সেই সম্ভাবনা ও জোরের জায়গা বর্ণহিন্দুর মনঃপুত হয়নি তা এতক্ষণের আলোচনায় স্পষ্ট। গোদাভাবে আক্রমণ করেছেন তাঁকে ও তাঁর অনুগামীদের। কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে ঘটা দেশভাগকে একভাবে প্রশ্ন করেছিল যোগেন্দ্রনাথের পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। দাঙ্গায় দলিত-মুসলমান সংহতির সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতির পথ পরিষ্কার হয়েছিল দুই দেশেই।


আরও জানতে দেখুনঃ

১) শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, অনসুয়া বসু রায়চৌধুরী - Caste and Partition in Bengal: The Story of Dalit Refugees, 2023.

২) দ্বৈপায়ন সেন, The Decline of the Caste Question: Jogendranath Mandal and the Defeat of the Dalit Politics in Bengal, 2018.