আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২৩ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

নামকরণের রাজনীতি

প্রস্কণ্ব সিংহরায়




পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে মতুয়া সম্প্রদায় আজ পরিচিত এক জাতিপ্রথা-বিরোধী ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসাবে। গত দু’দশক ধরে নিঃশর্ত নাগরিকত্বের দাবি-সহ একাধিক চাহিদা ঘিরে মতুয়াদের একটানা আন্দোলন অধিকাংশ মানুষেরই নজর কেড়েছে। এই রাজ্য ছাড়াও ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও মতুয়াদের সমষ্টিগত নির্বাচনী আচরণ রাজনৈতিক দলগুলিকে নিয়ে এসেছে মতুয়া নেতৃত্বের কাছাকাছি। নির্বাচনের প্রাক্কালে বিভিন্ন দলগুলিকে যে বিশেষভাবে মতুয়াদের দ্বারস্থ হতে হয় তা আজ কারও অবিদিত নয়। এককথায়, মতুয়াদের গোষ্ঠীগত সংখ্যাবল এবং নানা দাবি-ভিত্তিক নিয়মিত প্রতিবাদ এই রাজ্যে দলিত রাজনীতির এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটিয়েছে।

নাগরিকত্ব আদায়ের আন্দোলন ছাড়াও, বর্তমান মতুয়া রাজনীতির একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি অর্জনের লড়াইঃ নিজেদের ধর্মের স্বীকৃতি, আরাধ্যদের স্বীকৃতি এবং আচার-অনুষ্ঠানের স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি লাভের প্রচেষ্টা ফুটে ওঠে মতুয়াদের নামকরণের রাজনীতিতে। দুটি প্রসঙ্গের কথা উল্লেখ করা যাক। তাহলে নামকরণ ও স্বীকৃতির এই রাজনীতি আমাদের বুঝতে সুবিধে হবে।

প্রথম, দেশভাগের পর ১৯৮৮ সালে ভারতবর্ষে যখন মতুয়া মহাসঙ্ঘ সরকারীভাবে প্রতিষ্ঠা ও নিবন্ধিকৃত হয়, তখন থেকেই তাঁদের একটি মূল দাবি ছিল মতুয়া ধর্মের প্রবর্তক হরিচাঁদ ঠাকুরের নামে একটি জাতীয় ছুটি ঘোষণা করতে হবে। ১৯৯৪ সালে কলকাতা শহরে মতুয়া মহাসঙ্ঘ তাঁদের প্রথম সমাবেশ আয়োজন করেছিল। এই জমায়েতেই সাংগঠনিকভাবে হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথিকে জাতীয় ছুটি ঘোষণা করার দাবিটি মতুয়া নেতৃত্ব তোলে। তারপর প্রায় দু’দশকেরও বেশী সময় ধরে এই দাবিতে মতুয়ারা অনড় থেকেছে। মহাসঙ্ঘের বার্ষিক প্রতিবেদনগুলিতে, নানান প্রচারপত্রে, মতুয়াদের দ্বারা চালিত ও প্রকাশিত পত্র-পত্রিকাতে এবং বিভিন্ন জনসমাবেশে এই দাবি বারবার উঠে এসেছে। দু’দশকেরও বেশি সময় পর ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিশ্রুতি দেন যে হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথিকে রাজ্য সরকার ছুটি ঘোষণা করবে। মতুয়াদের এই পুরোনো দাবি অবশেষে আংশিকরূপে পূরণ হয়েছে।

এবার দ্বিতীয় দৃষ্টান্তে আসি। ২০০৫ সালের কিছু সময় আগে থেকে উত্তর ২৪ পরগণা জেলার অন্তর্ভুক্ত হেলেঞ্চায় স্থানীয় মতুয়া ধর্মাবলম্বী মানুষ একটি কলেজ তৈরির প্রস্তাব রাখেন। তাঁদের দাবি ছিল কলেজটির নামকরণ করা হোক হরিচাঁদ এবং গুরুচাঁদ ঠাকুরের স্মৃতিতে। এই উদ্যোগে মতুয়া মহাসঙ্ঘ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এবং প্রশাসনের সাথে আলোচনায় বসে। ঠিক হয় কলেজ তৈরি করা হবে। শুরুতে হেলেঞ্চা হাইস্কুল থেকেই এই প্রতিষ্ঠান চালু হবে, এবং ক্রমে নিজস্ব ক্যাম্পাস গড়ে উঠবে। কিন্তু বিতর্ক দানা বাঁধে কলেজের নামকরণ নিয়ে। কলেজের নাম কী রাখা হবে সেটা ঠিক করার জন্য তৎকালীন বাগদা বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক কমলাক্ষি বিশ্বাসের নেতৃত্বে একটি কমিটি তৈরি হয়। এই কমিটি নির্দেশ দেয় যে কলেজের নাম দেওয়া হোক ‘ডঃ বি. আর. আম্বেদকার শতবার্ষিকী মহাবিদ্যালয়’। কমিটির এই সিদ্ধান্ত ফলত সে সময় স্থানীয় মতুয়াদের বেজায় ক্ষেপিয়ে তোলে। আমার পরিষ্কার মনে পড়ে এক মতুয়া নেতা আমাকে এই ঘটনার বিবরণ দেওয়ার সময় বলেছিলেন, "এটা ছিল বামফ্রন্টের কৌশল"। ওনার মতে বামফ্রন্ট সরকার চায়নি কলেজটির নাম হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের স্মৃতিতে হোক। হেলেঞ্চা কলেজের নামকরণ ঘিরে এই বিতর্কের প্রতিফলন ঘটে ভোট বাক্সে। বামফ্রন্টের সাথে মতুয়া মহাসংঘ নেতৃত্বের সম্পর্কে চিড় ধরার পেছনে এই ঘটনা অনেকটাই দায়ী বলে অনেকেই মনে করেন। বামেরা অবশ্য কয়েক বছরের মধ্যেই নিজেদের সংশোধন করার চেষ্টা করেছিল। ২০১০ সালে নির্বাচনের আগের বছর বামফ্রন্ট সরকার একটি বার্ষিক পুরস্কার চালু করে। রাজ্যের তফশিলি জাতির মানুষের সার্বিক উন্নতির ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি বা সংগঠন উল্লেখযোগ্য কাজ করলে, সেই ব্যক্তি বা সংগঠনকে এই পুরস্কার প্রদান করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ হল এই পুরস্কারটির নাম দেওয়া হয় ‘ঠাকুর হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ পুরস্কার’। তাছাড়াও মনে রাখা উচিত যে প্রথম বছর এই পুরস্কার পান মতুয়া মহাসঙ্ঘের তৎকালীন সঙ্ঘাধিপতি কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর।

এর পরবর্তীকালে মতুয়াদের আরাধ্য ও নেতৃত্বের নামে অনেক সরকারী প্রতিষ্ঠান যেমন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, রাস্তাঘাট এবং ক্রীড়াঙ্গন তৈরি হয়েছে। ২০০৯ সালে ঠাকুরনগর স্টেশন থেকে ঠাকুরবাড়ি যাওয়ার পাকা রাস্তাটির নামকরণ হয় পি. আর. ঠাকুর সরণী, ২০১৩ সালে পি. আর. ঠাকুরের নামে একটি সরকারী কলেজ ও ২০১৮ সালে ‘হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং ২০২০ সালে তেহট্টে উদ্বোধন হয় ‘হরিচাঁদ গুরুচাঁদ স্টেডিয়াম’। গত কয়েক বছরে এই নামকরণের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে গণপরিসরে গড়ে উঠেছে মতুয়াদের একরকম প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় ও উপস্থিতি।

মতুয়াদের নামকরণের রাজনীতি অবশ্য সরকারী প্রতিষ্ঠান গঠন ও ভোট রাজনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের নানা প্রতিষ্ঠানের নাম মতুয়ারা তাঁদের আরাধ্য ব্যক্তিদের স্মৃতিতে রেখে থাকে। মতুয়াদের দ্বারা চালিত পত্র-পত্রিকার নাম, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাটের নাম, ক্লাবের নাম, লাইব্রেরির নাম, উৎসবের নাম, সংগঠনের বা দলের নাম সাধারণত হরিচাঁদ-শান্তিদেবী, গুরুচাঁদ-সত্যভামাদেবী, অথবা পি. আর. ঠাকুর-বীণাপাণি দেবীর স্মৃতিতে রাখা। মতুয়া অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে ঘোরাফেরা করলেই এঁদের নামে অনেক ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান চোখে পড়ে। যেমন ‘শান্তি-হরি বস্ত্রালয়’, ‘শ্রীশ্রী শান্তি-হরি ঢাকা পিঠে স্টল’, ‘গুরুচাঁদ ভবন’ নামক একটি পাঠাগার, ‘পি. আর. ঠাকুর সমাজ কল্যাণ সমিতি’ নামে একটি সংগঠন, ‘শ্রী হরি যুগদিশা’ শীর্ষক একটি পত্রিকা, ‘শ্রীশ্রী হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ভক্ত মহামিলন উৎসব’ এরকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এই নামকরণের মাধ্যমেই গণপরিসরে মতুয়ারা নিজেদের পৃথক গোষ্ঠীগত পরিচিত জোরালো করে তুলেছে।

যে কোনো ব্যক্তি অথবা সম্প্রদায়ের কাছে নামকরণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। নামের মধ্যে থেকেই ফুটে ওঠে কোনো এলাকা বা প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি। চিহ্নিত করা যায় সেই অঞ্চলের মানুষের সামাজিক অবস্থান, আদর্শ, ইতিহাস ও রাজনীতি। রাষ্ট্রের কাছেও নামকরণের গুরুত্ব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পুরোনো নাম মুছে ফেলে নতুন নাম রাখার রাজনীতি কারো অজানা নয়। মুঘলসরাই জংশন স্টেশনের নাম বদল করে যেমন নতুন নাম রাখা হয়েছে দীনদয়াল উপাধ্যায় জংশন, কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের নামকরণ করা হয় মাদার টেরেসা সরণী, দিল্লীর আওরঙ্গজেব রোডের নাম বদলে রাস্তাটির বর্তমান নাম এ. পি. জে. আব্দুল কালাম রোড - এরকম বহু উদাহরণ আছে।নামকরণের ভিত্তিতেই স্থির করা যায় যে কোনো জাতির পরিচিতি। মুছে ফেলা যায় ইতিহাস। আবার নতুন ইতিহাস গড়াও যায়।

নামকরণের রাজনীতি দলিত আন্দোলনেরও অত্যন্ত জরুরি এক স্তম্ভ। তফশিলি সমাজের মানুষের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় গোটা দেশে ধীরে ধীরে, বিশেষ করে ১৯৯০-এর পর থেকে, আম্বেদকার, ফুলে, রবিদাস, বিরসা মুন্ডা ও অন্যান্য দলিত-আদিবাসী নেতা, আরাধ্যদের নামে অনেক সরকারী প্রতিষ্ঠান এবং অঞ্চল গড়ে উঠেছে। এর ফলে জনসমক্ষে স্বীকৃতি পেয়েছে পৃথক দলিত-আদিবাসী-বহুজন রাজনীতি ও সামাজিক পরিচিতি এবং গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে উঠেছে পিছিয়ে পরা সমাজের মানুষ। মতুয়া রাজনীতিও এর ব্যতিক্রম নয়। গত দু’দশকে মতুয়ারা যে গণপরিসরে নিজেদের আলাদা জায়গা ও পরিচিতি তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছে তার একটি প্রধান কারণ নামকরণ-কেন্দ্রিক তাঁদের দাবিদাওয়া ও সামাজিক অভ্যাস। ‘রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, বীর সুভাষের মহান দেশে’ রাস্তাঘাটে আমরা অধিকাংশ সময়ে যেসব ঠাকুর-দেবতা বা মনীষীদের নাম পড়ি বা ছবি দেখি, তাঁরা মূলত উচ্চবর্ণের মানুষ। দলিত-আদিবাসী সমাজের মানুষ ও তাঁদের নিজস্ব গোষ্ঠী পরিচিতি এই গণস্বীকৃতি থেকে বহুসময় যাবত বঞ্চিত থেকেছে। বাংলার বর্তমান দলিত-আদিবাসী রাজনীতি ইতিহাসের এই নীরবতা ভাঙতে শুরু করেছে গত কয়েক বছরে। এই বদলের যাত্রায় মতুয়া রাজনীতির অবদান অনস্বীকার্য। বিভিন্ন সরকারী ও ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান, অঞ্চল, উৎসব এবং পত্র-পত্রিকার নামকরণের মাধ্যমে একদিকে যেমন মতুয়ারা একজোট হয়ে নিজেদের গণস্বীকৃতি অর্জন করেছে, অন্যদিকে জনসমক্ষে ও রাজ্য-রাজনীতিতে উঠে এসেছে বাংলার দুই দলিত আইকন - হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুর। আগামীদিনে মতুয়ারা নিজেদের এই স্বাধীন রাজনীতি ও গোষ্ঠী পরিচিতি কতটা রক্ষা করে রাখতে সক্ষম হয়, সেটাই এখন দেখার।