আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২৩ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

উত্তরবঙ্গ রাজ্য গঠনের সম্ভাব্যতা ও বাস্তবতা

সুখবিলাস বর্মা


পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ভাগ করে উত্তরবঙ্গে নতুন রাজ্য সৃষ্টির ভাবনা নিয়ে হুজুগ নতুন কিছু নয় - এই ধরনের হুজুগ নিয়ে মাঝে মাঝেই খবরের কাগজ ও বৈদ্যুতিন মাধ্যম সরব হয়ে ওঠে। কিছুদিন আগে এই আওয়াজ নতুন করে সারা রাজ্যে সামান্য হলেও কিছুটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

কলকাতা থেকে বহু দূরে ভাগীরথীর অপর পাড়ে মালদা থেকে শুরু করে উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, দার্জিলিং, কালিম্পং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কুচবিহার - এই আটটি জেলা নিয়ে গঠিত যে জনপদ সেটাই উত্তরবঙ্গ নামে পরিচিত। উত্তরবঙ্গের আলাদা রাজ্যের ধারণায় উক্ত জনপদ নিয়ে গঠিত কোনো রাজ্যকেই বোঝায়। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কেন্দ্রস্থল কলকাতা থেকে বহু দূরে অবস্থিত এই জনপদ নিজ বৈশিষ্ট্যে আকর্ষণীয়।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও কৃষি অর্থনীতি

পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জলপ্রপাত এবং জঙ্গলে ঘেরা নদীগুলির বর্ষাকালীন রুদ্রমূর্তি, গ্রীষ্মশেষে সেই নদীগুলির বিস্তৃত চরভূমি - সব মিলিয়ে সমগ্র এলাকার সৌন্দর্য মন্ত্রমুগ্ধ করে। পাহাড় ও তরাই-দুয়ারের উঁচুনিচু জমিতে ব্রিটিশ আমল থেকে চা বাগান ছিল। হাল আমলে কোচবিহার-জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি-উত্তর দিনাজপুরের সমতল ভূমির বিস্তৃত এলাকা চা বাগানে পরিণত হয়েছে। এই বাগানগুলি থেকে চা পাতা তুলে বাইরের ফ্যাক্টরিতে বিক্রি করা হয়। ফ্যাক্টরির ঝামেলামুক্ত এই বাগানগুলি নানা সমস্যা সত্ত্বেও পুরোনো অনেক বাগানের চেয়ে ভালো চলছে। এলাকার স্নিগ্ধ জলবায়ু, পাহাড়-পর্বত, জল-জঙ্গল, চা বাগানের মনোরম দৃশ্য - এই সবকিছুর সমন্বয়ে এখানে গড়ে উঠেছে পর্যটন শিল্পের উপযুক্ত পরিকাঠামো। এখানকার হোম স্টে তো এখন খুবই জনপ্রিয়।

টি, টিম্বার, ট্যুরিজম - তিন 'T'-কে তাই উত্তরবঙ্গের, বিশেষ করে তরাই-দুয়ারের মানুষের, জীবিকার অন্যতম প্রধান উৎস গণ্য করা হয়। অনেকে এর সঙ্গে আরো একটি T যুক্ত করেন টোব্যাকো, তামাক। পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপকভাবে তামাক চাষ একমাত্র কোচবিহার-জলপাইগুড়ি জেলাতেই হয়।

মিনি-ভারতবর্ষ

জনবিন্যাসের দিক থেকেও এই এলাকা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। অস্ট্রিক, তিব্বতি-বর্মী, দ্রাবিড়, ইন্দো-ইউরোপীয় ভারতের চার ভাষাপরিবারের মানুষই বাস করেন এখানে, যদিও তিব্বতি-বর্মী ভাষাপরিবারভুক্ত মঙ্গোলয়েড গোষ্ঠীর অন্তর্গত রাজবংশীদেরই এখানে একক সংখ্যাধিক্য। অন্যান্য গোষ্ঠীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নেপালি (গোর্খা), ভুটিয়া, তামাং, লেপচা, লিম্বু, মেচ, রাভা, ওঁরাও, মুণ্ডা, সাঁওতাল, মালপাহাড়ি, খরিয়া, খেরিয়া, মধেসিয়া, জুগি, পান, পলিয়া, খেন, দেশী, নস্যসেখ (ধর্মান্তরিত রাজবংশী)। এদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি। তাছাড়াও তরাই-দুয়ারের আদিবাসীদের নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময়ের ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে হিন্দি-রাজবংশী-নেপালি সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে সাদরি বা সাদনি ভাষা। জাতিগত ও ভাষাগত এমন বৈচিত্র্যপূর্ণ উত্তরবঙ্গের তরাই-দুয়ার অঞ্চলকে তাই বলা হয় মিনি-ভারতবর্ষ।

উত্তরবঙ্গের ইতিহাস

রাজনৈতিক ইতিহাসের দিক থেকে উত্তরবঙ্গের কিছু ভিন্নতা আছে। প্রথমেই শুরু করা যাক পূর্বদিক অর্থাৎ কোচবিহার থেকে, এটি ছিল প্রাচীন প্রাগজ্যোতিষপুর ও কামরূপের অংশ। পরবর্তীতে এর পূর্বভাগ আসামের এবং পশ্চিমভাগ কোচবিহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। কামরূপের ছিল নিজস্ব ইতিহাস ও ভাষা বৈশিষ্ট্য। সপ্তম শতাব্দীতে কনৌজের হর্ষবর্ধন এবং বাংলার শশাঙ্কের সমসাময়িক কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মন আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে পশ্চিমে করতোয়া নদী পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় রাজত্ব করেছিলেন। পঞ্চদশ শতাব্দীতে এই অঞ্চলের নাম ছিল 'কামতা' এবং রাজার উপাধি ছিল 'কামতেশ্বর’। বেশ কিছু সময়ের জন্য এই এলাকা ছিল ভূঁইয়াদের দখলে। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে হারিয়া মণ্ডল ও তাঁর পুত্র বিশ্বসিং, ভূঁইয়াদের দখলে থাকা এলাকাগুলিকে নিয়ে এক সমন্বিত রাজ্যের রূপ দেন। হারিয়া মন্ডল-বিশ্বসিং-রা আদিতে ছিলেন কোচ। সংস্কৃতায়ন মাধ্যমে তাঁরা হন রাজবংশী, তাঁদের বংশ হয় কোচ-রাজবংশী। এই রাজবংশের রাজা নরনারায়ণ রায় ছোট ভাই চিলা রায়ের সহায়তায় সম্পূর্ণ জনপদ নিজ দখলে নিয়ে এসে কোচবিহার রাজ্য গঠন করেন। কোচবিহার ছিল সমগ্র পূর্ব ভারতে সবচেয়ে বড় সামন্ত রাজ্য, এই সামন্ত রাজ্য ১১ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪৯ সালে স্বাধীন ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত হয়।

যুক্ত হবার পূর্বকথা

পরাধীন ভারতে ছিল ১৪টি ব্রিটিশ শাসিত প্রদেশ এবং প্রায় ৫৭৫টি রাজন্য শাসিত রাজ্য। স্বাধীনতার সময়ে সেইসব রাজন্য শাসিত রাজ্যকে স্বাধীন ভারতের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত করা যায়, সে সম্পর্কে রাজন্যবর্গের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এবং মন্ত্রকের সচিব ভি. পি. মেননের ওপরে। এঁরা একটি 'Instrument of Accession' এবং একটি 'Standstill Agreement' তৈরি করেন। এই দুটি দলিলে সই করার ব্যাপারে প্রথমদিকে কিছু কিছু রাজা, নবাব, বাদশাহ দ্বিধাগ্রস্ত থাকলেও ১৫ই আগস্টের মধ্যে প্রায় সবাই সই করেন। দেশের বড় বড় রাজা-মহারাজা-নবাব এবং বিশেষ করে আত্মীয় রাজন্যবর্গকে সই করতে দেখার পর কোচবিহার মহারাজা সই করতে দ্বিধা করেননি। তিনি নিজেও বুঝেছিলেন যে এতেই সবার মঙ্গল। ১৯৪৭ সালের ৯ই আগস্ট তিনি 'Instrument of Accession' সই করেন। এর পর 'Merger Agreement' সই হয় ২৮শে আগস্ট, ১৯৪৯। পরে ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১লা জানুয়ারি, ১৯৫০ থেকে কোচবিহারকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করা হয় জেলার মর্যাদা দিয়ে।

আন্দোলনের ইতিহাস

কোচবিহার নিয়ে এই ঘটনাপ্রবাহ যত সহজভাবে লেখা হল বাস্তবে তা গ্রহণ করা কিন্ত অত সহজ ছিল না। যে জনপদের প্রজাগণ প্রাগজ্যোতিষপুর, কামরূপ এবং কোচবিহার নামের সুবিখ্যাত রাজ্যের অধিবাসী হিসেবে গৌরব বোধ করতেন তাঁরা এখন একটি জেলার মানুষ। শুধু তাই নয়, এই এলাকাগুলির সার্বিক উন্নয়নের জন্য তেমন কোনও উদ্যোগও সরকার থেকে গ্রহণ করা হয়নি। সবকিছু মিলিয়ে দেশীয় মানুষজন, যথা রাজবংশী, খেন, যুগী, নস্যসেখ নিজেদেরকে বঞ্চিত, নিপীড়িত, অবহেলিত মনে করতে শুরু করলেন। সঙ্গে যুক্ত হল কলকাতা ভিত্তিক রাজ্য প্রশাসনের মানুষদের এই এলাকার মানুষের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, তাঁদের ভাষা সাহিত্য ইত্যাদির প্রতি তাচ্ছিল্যপূর্ণ মনোভাব।

এর ফলে বিস্তৃত জনপদের দেশীয় জনগণ নিজেদেরকে বঞ্চিত, প্রতারিত, অবিচারের শিকার মনে করেন। সৃষ্টি হয় রাজ্য প্রশাসনের প্রতি চরম বিরূপ মনোভাব। এই মনোভাবের প্রকাশ ও বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৭০-এর দশকে উত্তরখন্ড আন্দোলন রূপে। আন্দোলনের প্রধান বিষয় ছিল উত্তরবঙ্গের অনুন্নয়ন ও রাজ্যে যুক্তফ্রন্ট সরকারের উদাসীনতা, বিশেষ করে তিস্তা প্রোজেক্টের সুষ্ঠু রূপায়ণে ঢিলেঢালা মনোভাব। অধিকন্তু উত্তরবঙ্গের জোতদার প্রমুখ দেশীয় জমির মালিকদের পক্ষে ক্ষতিকর সরকারের ভূমিসংস্কার নীতি। এই আন্দোলন ক্রমে সামাজিক-অর্থনৈতিক বিষয় থেকে রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে। উত্তরখন্ড দল উত্তরবঙ্গের জন্য আলাদা রাজ্য দাবি করে বিধানসভার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কিন্তু ফল হয় খুবই খারাপ - দলের প্রধান কর্মস্থল ময়নাগুড়ি, ধুপগুড়ি, জলপাইগুড়ি এলাকার ৫টি বিধানসভা কেন্দ্রের কোথাও ৮ শতাংশের বেশী ভোট তাঁদের ঝুলিতে আসে না। সাধারণের সমর্থন আদায় করতে না পেরে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে।

উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক রাজনীতিতে একটা বড়সড় ঝাঁকুনি লক্ষ্য করা যায় ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি। ১৯৯৫ সালে কামতাপুর রাজ্যের সরাসরি দাবি নিয়ে গঠিত হল কামতাপুর পিপলস্ পার্টি। আলাদা রাজ্যের সঙ্গে কামতাপুরি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতিও ছিল প্রধান দাবির অন্যতম। তাঁদের দাবি যে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জনগোষ্ঠীর কথ্য ভাষার নাম 'রাজবংশী' নয়, কামতাপুরি। সুতরাং এই ভাষাকে 'কামতাপুরি' নামে স্বীকৃতি দিয়ে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে আসামের গোয়ালপাড়া এলাকা, নেপালের রাজবংশী অধ্যুষিত এলাকা, বিহারের পূর্ণিয়ার কিয়দংশ এবং বাংলাদেশের রাজবংশী অধ্যুষিত রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী এলাকা জুড়ে দিয়ে, অর্থাৎ 'কামতাপুরি' যেসব এলাকার মানুষের কথ্য ভাষা সেই সমগ্র অঞ্চল নিয়ে গঠন করতে হবে 'কামতাপুর' রাজ্য। তাদের বক্তব্য, এই জনপদ কামরূপ-কোচবিহারের গৌরবময় ইতিহাস ভাষা সংস্কৃতি ঐতিহ্যের অধিকারী যেখানে রাজ্য গঠনের সব রকম উপাদানই রয়েছে। তাদের দাবী, কামতাপুরি বাংলা থেকে পৃথক ভাষা এবং রাজবংশীরা বাঙালী নয়।

এইসব দাবি নিয়ে আন্দোলন করার সূত্রে কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন (কেএলও) নাম নিয়ে তারা একটি জঙ্গি আন্দোলন শুরু করে। কেএলও-র সদস্যেরা আসামের আসু, আবসু এবং ভুটানের জঙ্গিদের কাছ থেকে ট্রেনিং নিয়ে ধ্বংসাত্মক জঙ্গি আন্দোলনে সামিল হয়। রাজ্য সরকার কেপিপি-কেএলও আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করে। শুরু হয় পুলিশী দমন। উত্তরখন্ডের মতো এই দলও ধুপগুড়ি-ময়নাগুড়ি সহ কয়েকটি বিধানসভা কেন্দ্রে নির্বাচনে লড়াই করে কিন্তু ফল একইরকম অর্থাৎ ৫%-৭% ভোট। অবশেষে দলের জঙ্গি নেত্রী মিতালি রায় তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করে ২০১৬ সালে ধুপগুড়ি বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন। দলের প্রধান অতুল রায়ও তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে গাঁটছড়া বাঁধেন। কয়েক মাস আগে তাঁর মৃত্যুতে ইতিমধ্যেই স্তিমিত কামতাপুর আন্দোলন এখন প্রায় অস্তিত্বহীন।

ইতিমধ্যে উত্তরবঙ্গের উত্তরাংশে অবস্থিত দার্জিলিং পাহাড়ে সংঘটিত হয়েছিল সুবাস ঘিসিং-এর নেতৃত্বে গোর্খাল্যাণ্ড রাজ্যের দাবিতে গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রণ্ট-এর আন্দোলন। সুবাস ঘিসিং-এর নেতৃত্বে গোর্খাল্যাণ্ড রাজ্যের দাবিতে গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রণ্ট (জীএনএলএফ)-এর আন্দোলন ১৯৮০-র দশকে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। দার্জিলিং-এর ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত নেপাল, ভুটান, সিকিমের ইতিহাস। ১৮১৫ সালে সম্পাদিত সুগৌলি চুক্তিতে নেপালের ৪০০০ বর্গ মাইল জমি ব্রিটিশরা ভারতকে দেয়। ১৮১৭ সালে তিতল্যা চুক্তিতে সেই এলাকা আবার চলে যায় সিকিমের রাজার হাতে। এই চুক্তির দশ বছর পরে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সিকিমের বিবাদের ফলে দার্জিলিং সহ সিকিমকে নেপাল ও ভুটানের মধ্যে ক্ষুদ্র রাজ্যে (buffer state) পরিণত করা হয়। পরে অবশ্য ব্রিটিশরাজ সমগ্র এলাকাটি ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়ে সিকিমকে আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করে।

পৃথক রাজ্যের দাবিতে জীএনএলএফ-এর আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকেনি। হরতাল, বনধ, লাগাতার হরতাল ইত্যাদির ফলে পাহাড়ের পরিবেশ ক্রমেই অশান্ত হয়ে ওঠে। ১৯৮৬-র শরতে আন্দোলনে এল নতুন মোড়। হরতাল, বনধ-এর সঙ্গে চলল লুঠ, অগ্নি সংযোগ, সরকারী সম্পত্তি ধ্বংস ইত্যাদি। পাহাড়ের জীবন প্রায় স্তব্ধ হল। সুবাস ঘিসিং-এর প্রতি, পৃথক রাজ্যের দাবিতে আন্দোলনের প্রতি পাহাড়ের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে আইনশৃঙ্খলার অবস্থা প্রশাসনের আয়ত্তের বাইরে চলে গেল। সেই অবস্থায় প্রশাসনের পক্ষে নমনীয় হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।

চলল বৈঠকের পর বৈঠক। অবশেষে সুবাস ঘিসিঙ্গের সভাপতিত্বে স্বশাসিত সংস্থা 'দার্জিলিং হিল কাউন্সিল' গঠনের সিদ্ধান্তে সমঝোতা হল। এই সংস্থাকে পাহাড়ের প্রশাসনের এবং উন্নয়নের অনেক দায়িত্ব দেওয়া হল। হিল কাউন্সিল পাহাড়ে বহু কাজ করল। কিন্তু ঘিসিংয়ের কাজের ধরনে একনায়কতান্ত্রিকতা দেখা দিলে তাঁর নিকট সঙ্গীরা 'গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা' নামে নতুন দল তৈরি করে। স্বশাসিত সংস্থার নাম পরিবর্তন করে ২০১১ সালে তৈরি হল বিমল গুরুং-এর নেতৃত্বে 'গোর্খাল্যাণ্ড টেরিটরিয়াল এ্যাডমিনিস্ট্রেশন' (জিটিএ)। কিছুদিনের মধ্যেই নেতৃত্বে শুরু হল ঝগড়া বিবাদ। নতুন নেতা হল বিনয় তামাং। পাহাড়ের মানুষের একতায় ভাঙন দেখা দিল। নেতারা এখন রাজ্যের দাবি ছেড়ে দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লেজুড় হয়ে অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত।

১৯৯৮ সালে কোচবিহারে শুরু গ্রেটার কুচবেহার আন্দোলন - মূল দাবি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে কোচবিহার সামন্ত রাজ্যের সংযুক্তি চুক্তির প্রকৃত রূপায়ন। প্রধানত রাজপরিবারের নিকট আত্মীয়দের দ্বারা সৃষ্ট সংস্থা 'গ্রেটার কুচবেহার পিপলস্ এ্যাসোসিয়েশন' (জিসিপিএ) ১৯৯৮-তে জেলাশাসকের কাছে এবং ২০০০ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে দাবীপত্র পেশ করে। জিসিপিএ-র প্রধান বক্তব্য ডঃ বিধান চন্দ্র রায় জোর করে কুচবেহারকে রাজ্যের একটি জেলায় পরিণত করেছেন। ১৯৪৯ সালের ২৮শে আগস্ট ৯টি ধারার 'Merger Agreement' সই করে রাজ্যকে শাসন করার সমস্ত ক্ষমতা কুচবেহারের মহারাজা ভারত সরকারের হাতে তুলে দিয়েছেন এই সত্য জিসিপিএ নেতৃবৃন্দ মানতে নারাজ। তাঁরা এই সত্যও মানতে চান না যে ঐ সংযুক্তি পত্রে রাজ্যের প্রজাদের সম্পর্কে কোন কথাই ছিল না। অযৌক্তিক দাবি নিয়ে তাদের আন্দোলন এক সময়ে জঙ্গি রূপ ধারণ করে। শুরু হয় পুলিশী তৎপরতা। নানা ভাগে বিভক্ত সংস্থার একাংশের নেতা বংশীবদন রায় সহ তার সঙ্গীদের জেলবন্দী করা হয়, অপরাংশের নেতা স্বঘোষিত মহারাজা অনন্ত মহারাজ আসাম পালিয়ে যায়। ২০১১ সালে রাজ্যে পরিবর্তিত তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের বন্দীমুক্তি নীতিতে বংশীবদন ছাড়া পায় এবং কালক্রমে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে। কোচবিহার ও আসামের নানা সভাসমিতিতে প্রচুর টাকা সংগ্রহ করে অনন্ত মহারাজ কোচবিহারে ও আসামে প্রাসাদোপম বাড়ী তৈরি করে। এই হল গ্রেটার কোচবিহার আন্দোলনের ইতিবৃত্ত।

উপরে বর্ণিত আন্দোলন ইতিহাস থেকে পরিষ্কার যে একমাত্র সুবাস ঘিসিঙ্গের জিএনএলএফ আন্দোলন ছাড়া কাজের কাজ কিছু হয়নি; জিএনএলএফ স্বশাসিত সংস্থা আদায় করতে পেরেছে প্রধানত ঘিসিঙ্গের নেতৃত্বগুণে - তাঁর নিষ্ঠা ও সাংগঠনিক ক্ষমতার গুণে। অন্য আন্দোলনগুলি অযৌক্তিকতা ও নেতৃত্বের দুর্বলতায় খুব সামান্যই প্রভাব ফেলতে পেরেছে।

উত্তরবঙ্গ রাজ্য - বাস্তবতা

'উত্তরবঙ্গ রাজ্য' এই ধারণাটা অবাস্তব। উত্তরবঙ্গের যে এলাকা নিয়ে আলোচনা করলাম তার বাইরে তিনটি জেলা রয়েছে। মালদহ অর্থাৎ গৌড়ের ঐতিহ্যের কথা সবার জানা। এক সময়ের বাংলার রাজধানী, পাল বংশ-সেন বংশ-হুসেন শাহের গৌরব আমরা জানি। তাই মালদহের মানুষের ভাবাবেগ তাদের নিজস্ব গৌরবের প্রতি। একইভাবে দুই দিনাজপুরের নিজস্ব ঐতিহ্য পৌণ্ড্রবর্ধন/বরেন্দ্রভূমি বাণগড়। বরিন্দ এলাকার রাজবংশী, পান, পলিয়া নির্বিশেষে সকলের আন্তরিক ভাবাবেগ তাই বরেন্দ্রভুমি-মহাস্থানগড়-গৌড়ের প্রতি যতটা, কামরূপ-কামতা-কোচবিহার গোর্খাল্যাণ্ডের প্রতি ততটা নয়। সেজন্যই উল্লিখিত আন্দোলনগুলি নিয়ে এই তিন জেলার মানুষ নির্বিকার, তারা কোন সমর্থন জানায়নি। তাছাড়া প্রতিটি আন্দোলন হয়েছে প্রত্যেক গোষ্ঠীর নিজস্ব বিষয়সূচি নিয়ে - একে অপরকে কেউই সাহায্য করেনি।

সমূহ বিপদ

এটাই যদি হয় বাস্তব অবস্থা, তবে মাঝে মাঝেই আলাদা রাজ্যের এই ধুয়া ওঠে কেন? উত্তরবঙ্গ নিয়ে সাম্প্রতিককালে খবরে আলিপুরদুয়ারের সাংসদ জন বারলার দাবি কি তবে কোন নতুন ছক? জন বারলা বিজেপি দলের একজন গুরুত্বহীন নেতা। বানারহাটের লখিপাড়া চা বাগানের কর্মী ২০০৯-১০ সালে অখিল ভারতীয় আদিবাসী বিকাশ পরিষদের দুয়ার-তেরাই আঞ্চলিক ইউনিটের সভাপতি জন বারলা ২০১১ সালে আদিবাসী স্বার্থবিরোধী কাজের জন্য সংস্থার সভাপতি পদ ও প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে অপসারিত হন। এমন নেতা, যিনি তার সমাজের জনগণের স্বার্থ পরিপন্থী কাজের জন্য শাস্তি পেয়েছেন, তিনি আজ উত্তরবঙ্গ রাজ্য গঠন নিয়ে কাঁদুনি গাইছেন। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে আদিবাসী এক সাংসদের এমন ব্যক্তিত্বকে কাজে লাগিয়ে বিজেপির নতুন ছক কষা, হাওয়া গরম রাখার প্রচেষ্টা।

২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে পর্যুদস্ত হলেও উত্তরবঙ্গের মানুষকে ধোঁকা দিয়ে, তাদের জন্য নানা প্রকল্পের ফাঁকা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেশ কয়েকটি আসন তার দল দখল করেছে প্রধানত মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সৌজন্যে। তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের আগে পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে জনসংঘ, স্বতন্ত্র বা বিজেপি দলের ভূমিকা ছিল অতিশয় নগণ্য - মুষ্টিমেয় দু’চারজন এমএলএ, এমপি ছিল এই প্রতিক্রিয়াশীল দলটির। মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকারের দুর্নীতি, সন্ত্রাস, সিণ্ডিকেটবাজি, কর্মসংস্থানে ব্যর্থতা, সুস্থ স্বচ্ছ প্রশাসন দানে অক্ষমতা এবং বিজেপির অর্থশক্তি মানুষকে স্বল্পকালীন হলেও বিজেপি-মুখী করেছে। রাজ্যে মমতার চিরশত্রু কংগ্রেস ও বাম শক্তিকে প্রতিহত করার জন্য তৃণমূল বিস্তৃত জায়গা ছেড়ে দিয়েছে বিজেপিকে। উত্তরবঙ্গেও বিজেপি বেশ কিছু আসন দখল করেছে।

সুতরাং উত্তরবঙ্গ নিয়ে হাওয়া গরম রাখতে হবে। এই দল বেশ ছক কেটেই এগোচ্ছে। ইতিমধ্যে অতুল রায়ের ২০২১-এর জুন মাসে মৃত্যুর পর কামতাপুরি সমর্থকের কিছু মানুষ বিজেপিতে যোগদান করেছে এবং তাদের আর এক অংশ আবার আসাম থেকে কলকাঠি নাড়ছে। কেএলও নেতা জীবন সিংহ সম্প্রতি ভিডিও সিডি প্রকাশ করে যে ধরনের বক্তব্য রেখেছে তাতে বিজেপির নতুন ছক অনেকটা পরিষ্কার। বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে নির্বাচনী কর্মসূচির ফাঁকে আসামের কোনো একস্থানে পুলিশের ভয়ে পালিয়ে থাকা গ্রেটার কুচবেহার আন্দোলনের নেতা অনন্ত মহারাজের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের সাক্ষাৎকার এই অশুভ আঁতাতের ইঙ্গিত দেয়।

সব কিছুর মধ্যে এটা তো সত্যি যে উত্তরবঙ্গের সর্বশ্রেণির মানুষের মধ্যে রয়েছে নানা দুঃখ যন্ত্রণার অনুভূতি। এই অনুভূতি বিশেষ করে তপশিলী ও আদিবাসীদের মধ্যে ছড়িয়ে আছে। রাজ্যের কোনো সরকারই এদের সর্বাত্মক উন্নয়নের জন্য সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বর্তমান সরকারও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য শুধু কয়েকটি উন্নয়ন বোর্ড তৈরি করে বছরে কিছু পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেছে। ক'জনের উন্নয়ন হয়েছে এইসব বোর্ডের কাজে? সরকারের নীতি পর্যালোচনার প্রয়োজনীয়তা খতিয়ে দেখা দরকার। বিভিন্ন রাজ্যের তপশিলী ও আদিবাসী বিভাগের বাৎসরিক বাজেট বরাদ্দ ও খরচের সঙ্গে এই রাজ্যের বরাদ্দ ও খরচের তুলনা করলেই পরিষ্কার বোঝা যাবে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে এবং কী আমাদের করনীয়।

রাজ্য সরকার কি সে পথে হাঁটবে?