আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২৩ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

সঞ্জয় উবাচ


গান্ধার কন্যারা

সঞ্জয় বললেন, মহারাজ সেদিন আপনাকে আমি চিন ও পারস্যের গণতন্ত্র প্রতিবাদ ও গণবিক্ষোভের কথা বলেছিলাম। আমি যখন পারস্যের মহিলাদের হিজাব বিক্ষোভের বর্ণনা দিচ্ছিলাম তখনই আপনার চোখে এক মেদুর ঔৎসুক্যের ঝিলিক খেলে যেতে দেখেছিলাম। আমার দেখায় যদি ভুল হয়ে থাকে, তাহলে মার্জনা করবেন, মহারাজ।

তোমার দেখার ভুল হল কি ঠিক হল সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। তবে যে-ভৌগোলিক ইঙ্গিত তুমি করছ তার সারবত্তা আমি মোটের উপরে অস্বীকার করি না। যে-গান্ধার কন্যার দ্যুতিতে হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে একদিন প্রাণ সঞ্জীবিত হয়েছিল, আমার অন্ধত্বের মধ্যেও এক রকমের দৃষ্টি সঞ্চারিত হতে পেরেছিল, সেই গান্ধার দেশ সম্বন্ধে আমার এইটুকু কৌতূহল কি অস্বাভাবিক?

না, আমি কখনোই তা মনে করি না। উপরন্তু, আমি আরো বলি যে, যে-ধর্মরাজ্যে ন্যায়ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য আপনি রাজদায়িত্বপ্রাপ্ত সেখানে গান্ধার দেশের যোগও প্রায় অঙ্গাঙ্গী।

দ্যাখ সঞ্জয়, সত্যি কথা বলতে গেলে কুরুকুলগৌরব গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম যখন আমার পত্নীসন্ধানে গান্ধার রাজ সুবলের কাছে প্রস্তাব নিয়ে যান তখন তাঁর বোধে এই দুই জনপদের ব্যবধান কি তেমন দুস্তর মনে হয়েছিল? নাকি এদের মধ্যে কোনো অন্তর্লীন সাংস্কৃতিক সাযুজ্যই তাঁকে এই বৈবাহিক সম্ভাবনার পথে নিয়ে গিয়েছিল?

আমার মনে হয় হস্তিনাপুরের গান্ধার-বোধ ভারত-বোধের খুব বাইরে ছিল না। এবং দেবী গান্ধারী কোনো অর্থেই হস্তিনাপুরের রাজপুরীতে বিদেশিনী বধূ নন। সেখানকার অন্দরে তাঁর গ্রহণের কথা ভাবলেও এই বিদেশিনী ভাবনায় আমাদের বেশি মন দেবার কোনো অবকাশ নেই।

আবারও বলি সঞ্জয়, দেশি-বিদেশির অত ভেদাভেদের কি কোনো মানে আছে? কোনো কালেই কি তার খুব তাৎপর্য ছিল। জাতিতে জাতিতে ভেদ-ভাবনার ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে এই জাতীয়তার ভেদাভেদ। সেই জাতিবোধ যখন প্রকাশিত হয়েছে সংগঠিত রাষ্ট্রের চেহারায় তখনই তা জন্ম দিয়েছে মারাত্মক ক্ষমতালিপ্সা ও দ্বন্দ্ব বিরোধের।

একটা কথা মনে আসছে, বলি মহারাজ। আজকাল প্রায়ই নানা কথা প্রসঙ্গে আপনার গলায় কেমন যেন হতাশা ক্ষোভ ও বিষাদের সুর লাগে। আসন্ন যুদ্ধের পরিণতি নিয়ে কি আপনি শঙ্কিত। কোথায় যেন আপনার সুর কেটেছে বলে মনে হয় কেন মহারাজ।

থাক সে কথা। তুমি রানী গান্ধারীর দেশের কথা কি বলতে চেয়েছিলে বলো।

রানীর দেশের খবর আপনাকে জানানো আমার পক্ষে অকর্তব্য নয় নিশ্চয়।

না, কোনো খবর জানানোই তোমার অকর্তব্য নয়। আর সব ব্যাপারে সব খবরের জন্যই আমাদের সকলেরই মন সব সময়ে উৎসুক থাকা কর্তব্য। সব কথা তা সত্বেও আমরা সব সময়ে হয়তো জানতে পারি না। বলো, তুমি গান্ধার-কথা বলো।

কোথা থেকে শুরু করব তাই ভাবছি। আধুনিককালের কথায় শুরুটা ১৯৭৯ কিংবা ১৯৯৪ থেকে আরম্ভ করা যায়।

তুমি এরকম দুটো তারিখের কথা বলছ কেন?

বলছি এই কারণে যে এখনকার যে-সমস্যায় সকলেই উদ্‌বিগ্ন তা হল তালিবান সমস্যা। এই তালিবানের প্রতিষ্ঠার সময় ১৯৯৪। আমি আপনার পরিচিত গান্ধার দেশের বর্তমান পরিচয়ের কথা বলছি। সে পরিচয় হল একালের আফগানিস্তান। আপাতত তালিবান বলতে আমি আফগান তালিবানের কথাই বলছি।

তুমি যেভাবে বলছ তাতে মনে হচ্ছে আফগান তালিবান ছাড়াও অন্য জাতের তালিবান আছে।

হ্যাঁ মহারাজ। আফগান তালিবান, পাক তালিবান, তাজিক তালিবান ইত্যাদি বিভিন্ন জাতি-সম্প্রদায়ের তালিবান সত্তা আছে। 'তালিবান' শব্দের অর্থ ছাত্র, ছাত্রগোষ্ঠী। তালিবান শব্দটা বহুবচন, এক বচনে তালিব। আফগান তালিবান দেওবন্দী ইসলামের আদর্শে বিশ্বাসী। দেওবন্দী ইসলামের উদ্‌ভব, মহারাজ, আপনার এই ধর্মরাজ্যে, ভারতবর্ষে।

আমি তো এ সবের কিছুই জানি না, সঞ্জয়। আমার পুত্রদের বিবাদ কলহে আমি এতদূর বিব্রত যে এক এক সময়ে আমার অন্ধত্বকেও সৌভাগ্য বলে মনে হয়। আমার চর্মচক্ষুতে অন্তত আমাকে কিছু দেখতে হচ্ছে না। তবে একই সঙ্গে এ কথাও আমি স্বীকার করব যে তোমার ভাষ্য কথনে আমি যেন মনে হয় একেবারে চক্ষুষ্মানের মতোই দেখছি সব কিছু।

আপনি যে প্রত্যক্ষদর্শনের কথা বলছেন মহারাজ, তার মধ্যে আমার ভাষ্যের কোনো ভূমিকা নেই। আমি সামান্য আভাসে ইঙ্গিতে যেটুকু তথ্য আপনাকে পরিবেশন করি আপনার জীবন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ভূয়োদর্শন তার মধ্যে থেকে সার সত্যটুকু তুলে নেয়।

তুমি আফগান তালিবান প্রতিষ্ঠার যে-কাহিনী শোনাচ্ছিলে তাই বলো।

১৯৯৪ সালে এর প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ ওমর। কিন্তু মহারাজ, আফগানিস্তানের একালের ইতিহাসের সূত্রপাত হিসেবে আমি দুটো সময়ের কথা বলেছিলাম। ১৯৯৪ ছাড়াও ১৯৭৯-র কথা বলেছিলাম, মহারাজ।

হ্যাঁ বলেছিলে, এবং কেন দুটো তারিখের কথা বলছ, আমি সে প্রশ্নও তুলেছিলাম।

আমার মনে আছে, মহারাজ। ১৯৭৯-তে তখনো প্রতাপান্বিত সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করে এবং তাদের সহায়তায় সেখানে বামপন্থী সরকার ক্ষমতাসীন থাকে।

সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রকে তুমি ‘তখনো প্রতাপান্বিত’, এরকমভাবে বলছ কেন?

কারণ এই যে, তার বছর দশ-এগারো বাদেই এই রাষ্ট্র একেবারে ভেঙে যায়। মহারাজ, বর্তমান পৃথিবীতে সোভিয়েত রাষ্ট্র বলে কোনো রাষ্ট্র নেই। তখনকার সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলি বর্তমানে সবাই নিজেদের মতো স্বাধীন প্রজাতন্ত্র। সোভিয়েতের অস্তিত্ব আজ বিলুপ্ত। তারই সূত্র ধরে দুনিয়া পৌঁছে গেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর্বে। এ যুদ্ধের কথা আমি আপনাকে আগেই বর্ণনা করেছি মহারাজ। এখন আমরা সে প্রসঙ্গে যাব না।

না, এখন সেখানে যাবার অবকাশও নেই। তুমি ১৯৭৯-র সোভিয়েত আক্রমণের কথা বলেছ, আবার বলেছ ১৯৯৪-এ তালিবান প্রতিষ্ঠিত হল। এ দুয়ের মধ্যে কোনোরকম যোগ আছে কিনা সে কথা তাহলে বুঝতে হবে।

মহারাজ, যথার্থ কথাই বলেছেন আপনি। ১৯৭৯-এর সঙ্গে ১৯৯৪-এর যোগ দেখতে না পেলে অনেক কিছুই অস্পষ্ট থেকে যাবে। সোভিয়েত প্রভাবাধীন বাম জমানায় দেশের মধ্যে নানা টানাপোড়েন, বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিরোধ, ক্ষমতা দখলের লড়াই চলতেই থাকে। এক দিকে তখন সোভিয়েত প্রভাবাধীন আধুনিক প্রগতিশীল সমাজচিন্তা, অন্যদিকে বিভিন্ন জাতি-উপজাতিভিত্তিক গোষ্ঠীর রাজনৈতিক সামাজিক ভাবনায় ইসলামের শরিয়া প্রথার প্রবর্তনের প্রচেষ্টা। এই জটিল পরিস্থিতির মধ্যে থেকে শাসন ক্ষমতায় উঠে এল ওই দেওবন্দী তালিবান গোষ্ঠী। সেই সরকারের সামাজিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি পশ্চিম বিরোধী, সোভিয়েত বিরোধী, শরিয়তি ইসলাম পন্থী। সেই অর্থে খানিকটা মধ্যযুগীয় সামাজিক প্রথার অনুবর্তী। এই তালিবানি শাসন প্রতিষ্ঠিত হল ১৯৯৬-এ। তাই বলছিলাম আধুনিক আফগানিস্তানের কথা ভাবতে গেলে ১৯৭৯ এবং ১৯৯৪ - দু'য়ের কথাই ভাবতে হবে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১, এই হল আফগানিস্তানের প্রথম তালিবানি শাসনপর্ব।

প্রথম বলছ, তার মানে কি দ্বিতীয় একটা পর্বও আছে? তা ছাড়াও তুমি যে বলছ সোভিয়েত আক্রমণের কথা, এখানে প্রশ্ন উঠবে সোভিয়েত হঠাৎ আক্রমণ করল কেন।

আপনি বিচক্ষণ কূটনীতিকের মতো প্রশ্ন করেছেন মহারাজ। আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলি আছে। বর্তমানেও সেখানে চলছে তালিবানি শাসন। সেটাই এই দ্বিতীয় পর্ব। তবে এটাও ঠিক যে, আধুনিক আফগানিস্তানের কথায় ১৯৭৯ থেকেও আরো একটু পিছিয়ে না গেলে চলবে না। অন্তত ১৯৫৩ পর্যন্ত। ওই সময়ে তদানীন্তন রাজার তুতো ভাই মহম্মদ দাউদ দেশের প্রধানমন্ত্রী হন এবং তিনি অনেক আধুনিক সমাজ সংস্কারের সূত্রপাত করেন। আফগান সমাজে জন পরিসরে নারী উপস্থিতি তখন থেকে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে, মহারাজ। ১৯৫৬ সালে নিকিতা ক্রুশ্চফের সোভিয়েতের সঙ্গে তাঁর মিত্রতার সম্পর্ক তৈরি হয়। তখন থেকেই আফগানিস্তানে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা এবং কমিউনিস্ট প্রভাব বিস্তার লাভ করে। পরে নূর মহম্মদ তারাকি এবং হাফিজুল্লা আমিনের নেতৃত্বাধীন সাউর (SAUR) বিপ্লবের সময়ে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। পরবর্তী ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও সোভিয়েত পন্থী এবং সোভিয়েত বিরোধী দুই পক্ষের টানাপোড়েনের পরিণতি সরাসরি সোভিয়েত হস্তক্ষেপ।

বুঝলাম, তুমি যে তালিবানি দুই পর্বের কথা বলছিলে সেই দুই পর্বের মাঝের অবস্থা কেমন ছিল?

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অতীব জটিল। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি জটিলতর। তার একটা মাত্রা তালিবানি শাসন ও মানবাধিকার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক বিরোধিতা। তালিবানের রক্তচক্ষুতে আধুনিক চিন্তাসম্মত ব্যক্তির স্বাধিকার নিতান্ত ক্ষুণ্ণ। বিশেষত নারীর সামাজিক অবস্থা ও মানমর্যাদার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক মহল এতদূর উদ্‌বিগ্ন যে পরিস্থিতিটা দাঁড়িয়ে যায় যেন একেবারে পাশ্চাত্য আধুনিকতা বনাম ইসলামি রক্ষণশীলতা। স্বাভাবিকভাবে তালিবানি চিন্তাধারার সঙ্গে সহজেই জড়িয়ে যায় আফগান জাতীয়তাবোধ। আফগান জাতীয়তার ক্ষেত্রে নানা গোষ্ঠী ও জাতি-উপজাতির জটিলতায় সামগ্রিক রাজনীতি দারুণ জট পাকিয়ে যায়। এরই মধ্যে শাসক গোষ্ঠী হিসেবে তালিবান এক রকমের প্রাধান্য বিস্তারের অবস্থায় চলে যায়।

দ্যাখ সঞ্জয়, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া মাত্রই জটিল। এর ফলভোগ আমার এই একটা জীবনেই আমি যা করেছি। করেছিই বা বলছি কেন। আমি জানি আমার সে ফলভোগ এখনো পূর্ণ হয়নি। আমার নিজের মনে ভাবতে বসলে কি মনে হয় জানো।

আপনার মনের গূঢ কোনো চিন্তার ভাগ পেলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব, মহারাজ। তা আমার পরম প্রাপ্তি।

আমার মনে হয় আমাদের মনের নীচতলায় যত সব দ্বন্দ্ব বিরোধ সংক্ষোভ কুটিলতা, এমনকি আমাদের উদারতা ও মহত্ত্ব, চাপা পড়ে থাকে, তারাই কোনোভাবে পথ খুঁজে নিয়ে প্রকাশিত হয় সমাজের দ্বন্দ্ব বিরোধের রূপে। দ্যাখ সঞ্জয়, আমার মনে হয় তুমি বুঝবে কথাটা। আমরা কেউই শুধু ভালো বা শুধু মন্দ নই। সব মিলেমিশে একরকম একটা কিছু হয়। পাণ্ডুপুত্রদের প্রতি আমার স্নেহে কোনো ঘাটতি নেই। আমাদের এই মহান বংশের ভাগ্যবিড়ম্বিত এই সন্তানেরা আর তাদেরই সঙ্গে দুর্ভাগ্যে জড়িয়ে যাওয়া বধূ দ্রৌপদী। কিন্তু এই একই সঙ্গে আমার অন্ধত্বের প্রতীক আমার অন্ধ পুত্রস্নেহ - আমি কি বুঝি না কেন আমি সেই মুহূর্তের সংকটচূড়ায় দাঁড়িয়ে সম্মতি দিয়ে ফেলেছিলাম দ্বিতীয় দ্যূতক্রীড়ায়। এই বিরোধ তাপ অনুতাপ, এই নিয়েই সংসার, সঞ্জয় আর তাই তা এত তীব্র রস সঞ্চার করে জীবনে। আমার সামনের আকাশে ললাট লিখনের মতো আমার পরিণতি দীপ্যমান আমি দেখতে পাই।

(দু-জনেই কিছুক্ষণ চুপ। তারপরে...)

বলো, তোমার মধ্যবর্তী পর্বের কাহিনী বলো।

মহারাজ, মধ্যবর্তী পর্বের কাহিনী মোটামুটি বিশ শতকের পার্থিব রাজনীতির চেনা চিত্রনাট্যের অনুরূপ। আপনার প্রিয় গান্ধার দেশে কমিউনিস্ট পদধ্বনি, সোভিয়েতের প্রভাব বৃত্তের লক্ষণ, এসব থাকবে আর মার্কিন মুলুকের টনক নড়বে না তা হয় না। একুশ শতকের শুরুতে দারুণ কাণ্ড ঘটল মার্কিন দেশে। আত্মঘাতী বিমানের পরিকল্পিত ধাক্কায় নিউ ইয়র্ক শহরের বিখ্যাত টুইন টাওয়ার ধংস হল। ৯/১১। তিন হাজার মতো মানুষ নিহত। ভগ্নাংশের আকারে লেখা এই সংখ্যাটি তখন থেকে সন্ত্রাসের প্রতীক হয়ে দাঁড়াল। বলা ভালো ইসলামি সন্ত্রাসের প্রতীক, অন্তত প্রত্যক্ষত।

আত্মঘাতী বিমান মানে কি?

সে বিমানের চালক সমেত সবাই নিশ্চিত মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত। কিন্তু যে-উদ্দেশ্য সাধনে তাঁদের এই ব্রতপালন সেই ব্রতের উদ্‌যাপনই তাঁদের সেই মুহূর্তের চরম লক্ষ্য। সেপ্টেম্বর মাসের এগারো তারিখে ঘটনাটা ঘটেছিল, তাই বর্ণনা ৯/১১।

এ কোন পৃথিবীর কথা শোনাচ্ছ, সঞ্জয়। আমরা কি তবে সবাই আত্মঘাতী যানে চলেছি। কবিকথিত ইতিহাসযান, তা কি তবে এই।

আপনাকে এই বেদনা আমি দিতে চাইনি, মহারাজ। আমার কর্তব্য আমাকে নিষ্ঠুর হতে বাধ্য করছে।

তোমার কোনো দোষ নেই। বলো তোমার কাহিনী।

দ্বিতীয় পর্বে তালিবান ক্ষমতায় এল ২০২১-এ। তার আগে মার্কিন সৈন্যবাহিনী মোতায়েন ছিল গান্ধার দেশে। ৯/১১-র কথিত অভিযুক্ত ওসামা বিন লাদেন নাকি সেখানেই পলাতক। প্রয়োজনে আফগানিস্তানে কার্পেট বম্বিং করার হুমকি ছিল, করা হয়েও ছিল নিতান্ত কম না। বিন লাদেনকে দরকার হলে পাহাড়ের খাঁজ থেকেও খুঁজে বের করা হবে। কোথা থেকে পাওয়া গিয়েছিল পরিষ্কার না, তবে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়েছিল এবং পৃথিবী যেন সন্ত্রাসমুক্ত হল এইরকম বড়ো রকমের দীর্ঘশ্বাস ফেলা হয়েছিল।

(স্বগতোক্তি) ভারত যুদ্ধেরই প্রতিবর্ণনা শুনছি যেন।

২০২১-এ মার্কিন সৈন্য অপসারণের পরে তালিবান ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হল দ্বিতীয়বারের জন্যে। শুরুতে মনে হচ্ছিল এবারের তালিবান চেহারা বোধহয় একটু আলাদা হবে। তাঁরা বলছিলেনও সেরকম কথা। আন্তর্জাতিক মহলও একটু আশার আলো দেখছিল যেন। আর পাঁচটা দেশের মতোই হয়তো হবে এবার। না, সে আশাভঙ্গ হতে দেরি হয়নি। ২০২২-এর ২০ ডিসেম্বরে ফতোয়া জারি হয়েছে মেয়েরা উচ্চশিক্ষার দরজা পেরোতে পারবেন না। পোশাকবিধি পালন করতে হবে। পুরুষ সঙ্গী ছাড়া প্রকাশ্যে বেরোতে পারবেন না ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রতিবাদ হচ্ছে। দেশের মধ্যেও হচ্ছে। মেয়েরাও নিজেরা প্রতিবাদ করছেন। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক শবনম নাসিমি প্রকাশ্য টিভি চ্যানেলে আলোচনায় এসে তাঁর নিজের ডিগ্রি শংসাপত্র ইত্যাদি সব ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। বলেছেন, ’আমার মা বোনেরা যদি এদেশে থেকে পড়াশোনা না করতে পারেন, তা হলে এই শিক্ষা অর্থহীন’।

হায় গান্ধারী, হায় গান্ধার কন্যারা!


[সৌরীন ভট্টাচার্য]