আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২৩ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪২৯

সমসাময়িক

উপরাষ্ট্রপতির প্রগলভতা?


জগদীপ ধনকর পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল এবং বর্তমানে উপরাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে একজন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি ছিলেন। অতএব আইন তিনি জানেন না, এই কথা বলার বা ভাবার কোনো কারণ নেই। লাগাতার তিনি যেইভাবে দেশের সুপ্রিম কোর্ট তথা বিচারব্যবস্থাকে আক্রমণ করে চলেছেন তার তাৎপর্য খুঁজতে হলে তাই তার অজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর। বরং প্রশ্ন তুলতে হবে তাঁর উদ্দেশ্য নিয়ে।

সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে ধনকর সাহেবের করা সাম্প্রতিক মন্তব্যের দিকে তাকানো যাক। তিনি বলেছেন যে সুপ্রিম কোর্ট বড্ড বেশি সংসদের উপর মাতব্বরি করছে। ১৯৭৩ সালে কেশবানন্দ ভারতী মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে ভারতের সংবিধানের কিছু মৌলিক কাঠামো রয়েছে। সেই কাঠামোকে আইন করেও বদলানো সম্ভব নয়। যদি সরকার বা সংসদ সেই আইন পাশও করে, সুপ্রিম কোর্টের শুধুমাত্র অধিকার নয়, বরং দায়িত্ব সেই আইনকে সংবিধানের কষ্টিপাথরে যাচাই করা। যদি সুপ্রিম কোর্ট মনে করে যে আইনটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তাহলে সেই আইনকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করতে পারে সুপ্রিম কোর্ট। অর্থাৎ কাল সম্পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও, বিজেপি দেশটিকে হিন্দু রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করতে পারবে না কারণ ধর্মনিরপেক্ষতা দেশের সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি।

জগদীপ সাহেবের আপত্তি এইখানে। তিনি মনে করছেন যে সংসদে যেই আইন পাশ হবে তার উপরে বিচারবিভাগের কথা বলার কোনো এক্তিয়ারই নেই। কারণ বিচারবিভাগ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত নয়। কিন্তু সংসদ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত। অতএব যেই আইন সংসদ পাশ করেছে, যেমন বিচারপতি নিয়োগ কমিশন আইন, সেই আইনকে অসাংবিধানিক বলার অধিকার সুপ্রিম কোর্টের নেই। সুপ্রিম কোর্ট কেশবানন্দ ভারতী মামলায় প্রথম সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্যের কথা বলে। অতএব জগদীপ সাহেব এই মামলার রায়কেই চ্যালেঞ্জ করছেন।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে মাননীয় উপরাষ্ট্রপতি সঠিক কথাই বলছেন। সংসদ সার্বভৌম সংস্থা কারণ জনগণ সার্বভৌমত্বের আধার। তাই সংসদের উপরে কথা বলার অধিকার কারও নেই। জগদীপ সাহেব নিজেকে অতি-গণতান্ত্রিক প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন। গণতন্ত্রে জনগণই যেহেতু শেষ কথা বলে, অতএব জনগণ দ্বারা নির্বাচিত সংসদ তথা সরকারই শেষ কথা বলবে। কিন্তু এমনটা হলে খুব সহজেই গণতন্ত্র পর্যবসিত হবে সংখ্যাগুরুবাদ-এ। সংখ্যাগুরুরা যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, তাই দেশের আইনে পর্যবসিত হবে, কারণ সংসদের উপর কথা বলাই বারণ হয়ে যাবে।

আমাদের সৌভাগ্য যে জগদীপ সাহেবের সাধ এখনও অবধি ভারতীয় সংবিধান মেটায়নি। সংবিধান প্রণেতারা এবং সুপ্রিম কোর্ট বুঝেছিলেন যে সংসদে সরকার আসবে যাবে, কিন্তু সংবিধানে বর্ণিত কিছু মৌলিক সিদ্ধান্তসমূহকে রক্ষাকবচ পরানো জরুরি। নয়ত সংবিধানের কোনো মানে থাকে না। যেকোনো সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতার দোহাই দিয়ে দেশের মানুষের জন্য সংবিধান স্বীকৃত অধিকারগুলিকে রাতারাতি কেড়ে নিতে পারে। মোদ্দা কথাটি হল এই যে সংসদ নির্বাচিত হয় ভারতের সংবিধান মেনে। সেই সংসদ নিশ্চিতভাবেই সংবিধান সংশোধন করতে পারে, আইন প্রণয়ন করতে পারে। কিন্তু সংবিধান সংশোধন বা আইন প্রণয়ন সেই সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্যকে পালটে দিতে পারে না, যেই সংবিধান মেনেই প্রথমত সংসদ চলার কথা। এই কথাটির মধ্যে বিশেষ কোনো গূঢ় তত্ত্ব নেই। কথাটি সোজা এবং যুক্তিযুক্ত।

তাহলে ধনকর সাহেবের মতন দুঁদে আইনজীবি তথা রাজনীতিবিদ বুঝতে পারছেন না কেন? আসলে তিনি বুঝতে পারছেন না, কথাটি ভুল। তিনি একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে এই কথাগুলি বলছেন। তিনি সরকারের তরফে, গণতন্ত্রের অছিলায় বিচারব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে জল মাপছেন। যদি আমরা মনে করি যে সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য সংক্রান্ত বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য ভ্রান্ত, তাহলে সংসদে আইন পাশ করে দেশকে হিন্দু রাষ্ট্রও ঘোষণা করা যায়, অথবা নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়া যায়, অথবা ‘ক’ ব্যক্তিকে আজীবন প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন রেখে দেওয়া যায়। কোনো দলের কবজায় ১০০ শতাংশ আসন থাকলেও তারা এই আইনগুলি পাশ করাতে পারবে না, কারণ এহেন প্রত্যেকটি আইন সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্যের বিরুদ্ধে যায়। হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণা করা হলে তা ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী, নির্বাচন বন্ধ করে দিলে তা দেশের প্রজাতান্ত্রিক সত্তার বিরোধী, ‘ক’-কে আজীবন প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করা হলে আইনটি সংসদীয় গণতন্ত্রের বিরোধী হয়ে যায়।

আসলে ধনকর সাহেবরা চান তাদের সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এমন কিছু আইন পাশ করাতে যা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আপাতত, অমিত শাহ এবং নরেন্দ্র মোদী ধনকর সাহেবকে এই রাগে বাঁশী বাজানোর দায়িত্ব দিয়েছেন। কতটা বাঁশি বাজল, মানুষ কতটা মোহিত হল, সুপ্রিম কোর্ট কতটা সহ্য করল এই সব বিষয় পর্যালোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক হবে। আপাতত ধনকর সাহেবের মনিবরা তাকে বলেছেন সুপ্রিম কোর্টের নাম শুনলেই ‘তফাত যাও’ বলতে। তিনি মনিবদের আদেশ মানছেন, যেমন তিনি মেনে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হওয়ার পরে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে যথাযত বিব্রত করা এবং কারণে অকারণে বিতর্কের জন্ম দেওয়ার আদেশ মেনে পুরস্কার হিসেবে তিনি পেয়েছেন উপরাষ্ট্রপতির দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পাওয়ার পরে বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে কোন কলাটা-মুলোটা তিনি লাভ করবেন সেই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে।

শেষে এইটুকুই বলার যে যারা ধনকর সাহেবকে নিয়ে মশকরা করেন, দয়া করে করবেন না। ধনকর সাহেব ভারতের সাংবিধানিক চেতনার মূলে আঘাত করার কথা বলছেন, ভাবছেন। একে প্রগলভতা ভাবার বোকামো করবেন না।