আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২৩ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪২৯

সমসাময়িক

ভারতে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়


বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বা ইউজিসি গত ৫ই জানুয়ারি ঘোষণা করেছে যে বিশ্বের অন্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, যাদের স্থান আন্তর্জাতিক ৫০০ ক্রমতালিকার মধ্যে বা যারা নিজের দেশে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য তারা মঞ্জুরী কমিশনের কাছে আবেদন জানাতে পারেন, ভারতে তাদের প্রতিষ্ঠানের শাখা খোলার জন্য। এটাও জানানো হচ্ছে যে এইসব প্রতিষ্ঠানে পঠনপাঠন তাদের নিজস্বতা অনুযায়ী হবে। আপাতদৃষ্টিতে এটি অত্যন্ত সুখবর। সবাই ভাবছেন এবার আমাদের দেশে বসেই হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, বার্কলে প্রভৃতি ভুবনখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পাওয়া যাবে। তাহলে আর আমাদের পায় কে? দেশের ছাত্রসমাজ একেবারে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে হুড়মুড় করে এগিয়ে যাবে। সাথে সাথে এ দেশের নাম উজ্জ্বল হবে। অন্তত বিজেপি এবং সংঘ পরিবারের সমর্থকরা বিষয়টিকে এইভাবেই দেখাতে চাইছেন। তবু, কিছু প্রশ্ন তোলা আমাদের কর্তব্য। আশা করতে বাধা নেই যে দেশের সরকার বাহাদুর এসব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেবেন।

প্রথমত একথা জানিয়ে রাখা ভালো যে বর্তমান কেন্দ্র সরকার যে এমনটি প্রথমবার ভাবলেন তা নয়। ২০১৩ সালে, তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার আমলেই প্রথমবার এদেশে বিদেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আইন পাশ হয়। সেখানে ঠিক এই কথাগুলিই বলা হয়েছিল। সেসময় যে প্রশ্ন বামপন্থী শিক্ষাসংগঠন, ছাত্র সংগঠনগুলি তুলেছিলেন আজও সেই প্রশ্নগুলি সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, এই দেশে কোন বিদেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আসবে তাদের শাখা খুলতে? ২০১৩ থেকে ২০২২ অবধি এই নয় বছরে একবারও কি বিশ্বের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এদেশে তাদের শাখা খোলার আগ্রহ দেখিয়েছে? ইউজিসি যদিও বলছে বিশ্ব ক্রমতালিকায় প্রথম ৫০০-র ভেতর থাকলে তবেই এই সুযোগ মিলবে, এটিও একটি আদ্যন্ত ভ্রান্ত দাবী। প্রথমত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নয় একাধিক আন্তর্জাতিক ক্রমতালিকা আছে। একেকটি তালিকা নির্দিষ্ট কিছু বিষয়কে নির্ভর করে এবং এই তালিকাগুলির ভেতর খুব সাযুজ্য নেই। গোটা বিশ্বে মোটের ওপর গ্রহণযোগ্য যে ৩টি সংস্থার সমীক্ষাকে মান্যতা দেওয়া হয় তাদের ভিতরেও স্ববিরোধিতা আছে। এমনকি এই তালিকাগুলি নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। অনেক ক্ষেত্রেই কেবলমাত্র গবেষণা বা প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তনীদের সাফল্যকে মাপকাঠি ধরা হচ্ছে। ফলে শিক্ষার প্রাথমিক ধাপ যেমন, পঠনপাঠনের পদ্ধতি এগুলি উপেক্ষিত থাকছে। ফলে প্রশ্ন আসবেই যে কোন আন্তর্জাতিক ক্রমতালিকাকে ইউজিসি মান্যতা দেবে? তাহলে কোন ভিত্তিতে আমরা বিদেশী কোনো প্রতিষ্ঠানের গুণমান যাচাই করব? এই প্রশ্নের নিরসন ছাড়া ইউজিসির পক্ষে এটা নিশ্চিত করা সম্ভব নয় যে কেবল উৎকৃষ্ট বিদেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোই এদেশে তাদের শাখা খুলতে পারবে।

দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ তা হল খুব ঝাড়াইবাছাই করে যদি কেবল উন্নত গুণমানের বিদেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বেছে নেওয়াও হয়, তাদের ভারতীয় শাখায় শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগে গুনগত মান বজায় রাখা হচ্ছে কিনা ইউজিসি কীভাবে তা নিরীক্ষণ করবে? দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যখনই শিক্ষক নিয়োগ করা হয় তা ইউজিসি বা উচ্চশিক্ষা মন্ত্রকের নির্ধারিত নিয়ম মেনে করা হয়, যাতে নিযুক্ত শিক্ষকদের একটি ন্যূনতম গুণমান বজায় থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের সময় এরকম কোন নির্দেশিকা মানা হয় না। এ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ ওঠে। এমনকি খোদ সরকার অবধি বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুণমান যাতে একটা নির্দিষ্ট মানে বজায় থাকে তার জন্য সময় সময়ে নানা নির্দেশিকা জারি করেন। কিন্তু তাও যে বহুক্ষেত্রেই সেসব মানা হয় না এবং উচ্চশিক্ষায় এখনও যে আমজনতা সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই অগ্রাধিকার দেন তা সর্বজনবিদিত। তাহলে এই একই ঘটনা যে এদেশে স্থাপিত বিদেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শাখাতে ঘটবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? বিশেষত যখন এইসব ক্ষেত্রে সরকারের কোন নির্দেশিকা মানার দায় এইসব প্রতিষ্ঠানগুলোর থাকবে না। তাহলে এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যে এদেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই বিদেশী সংস্করণ হবে না তার নিশ্চয়তা থাকছে কোথায়?

একথা সহজেই অনুমেয় যে যেই সমস্ত প্রতিষ্ঠান এদেশে শাখা খুলতে আসবে, তাদের মূল লক্ষ্য উন্নতমানের শিক্ষাদানের চেয়ে নিজেদের আর্থিক সংস্থান পোক্ত করা। এ প্রসঙ্গে বিতর্কের নিরসন সহজেই হয় যদি আমরা বিশ্বের উন্নত দেশের সরকারগুলি তাদের দেশের শিক্ষায় কতটা অর্থব্যয় করে তার হিসাব করা যায়। ইউরোপ বা আমেরিকায় দেশের অভ্যন্তরীণ আয়ের ৫-৬% ব্যয় হয় শিক্ষাখাতে। তার কারণ উন্নত গুণমানের জনশিক্ষা ব্যবস্থা তৈরী করতে প্রয়োজন বিপুল অর্থ ও সাহায্য যা সরকারি অনুদান ব্যতীত সম্ভব নয়। ফলে উন্নত দেশগুলোতে সরকারি উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি যথেষ্ট মাত্রায় সরকারি অনুদানের উপর নির্ভরশীল। এহেন কোন প্রতিষ্ঠান অন্তত তাদের সংস্থান ব্যয় করে অন্য দেশের মানব সম্পদ উন্নয়নে ব্রতী যে হবে না তা সহজেই অনুমেয়। তাহলে এর একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের নাম বিক্রি করে কিছু বাড়তি উপার্জন করবে যা তারা নিজেদের মূল প্রতিষ্ঠানের পরিকাঠামো বৃদ্ধিতে ব্যবহার করবে। আর আমাদের দেশের সরকার এদেশের ছাত্রসমাজকে তাদের ক্রেতায় পরিণত করতে চাইছে এই অনুমতি প্রদান করে।

এই তর্কের বাইরেও একটি জনস্বার্থের প্রশ্ন এবং একইসাথে একটি দর্শনগত প্রশ্নও থেকে যায়। আমরা সেই প্রশ্নটিকেই সামনে আনতে চাই। যদি তর্কের খাতিরে আমরা ধরেও নিই যে ইউজিসি একটি নিবিড় আইন প্রণয়ন করে বিদেশী প্রতিস্থানগুলিকে বাছাই করলেন এবং এদেশে তাদের গুণমান যাতে বজায় থাকে তার ব্যবস্থা করলেন, তাহলেও এই গোটা প্রক্রিয়ার যৌক্তিকতা কি? প্রথমত প্রতিটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সে দেশের মানব সম্পদের গুণমান ও দেশের চাহিদা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ যে দেশে শিক্ষার হার কমে সেখানে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব বেশী হবে এবং সেই অনুপাতে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি গুরুত্ব পাবে। ভারতে সাক্ষরতার হার ৭৩%। এটি কেবল সাক্ষরতার হার। কার্যকরী শিক্ষায় শিক্ষিতের হার এর চাইতে ঢের কম। ফলে এদেশে অন্তত স্কুলশিক্ষার ক্ষেত্রে আরও বেশী সরকারি উদ্যোগ থাকা উচিত। প্রযুক্তি উদ্ভাবনে এদেশের স্থান পিছনের দিকে। দেশের অধিকাংশ বড় শিল্পক্ষেত্রগুলি তাদের প্রযুক্তি বিদেশ থেকে আমদানি করে। মোদি সরকার যতই ঢাকঢোল পিটিয়ে 'মেক ইন ইন্ডিয়ার' প্রচার করুন বস্তুত সেই প্রকল্প যে আমাদের প্রযুক্তিতে স্বনির্ভর করেনি তা সকলেই প্রায় দেখছেন। তাহলে আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষায় এমন উপাদান যুক্ত করা দরকার বা সরকারের উদ্যোগ এমন হতে হবে যাতে আমরা প্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারি। কিন্তু যখন এদেশে কোনো বিদেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আসবে এবং তারা নিজেদের ইচ্ছামত পাঠক্রম নির্ধারণ করবে তখন এদেশের জন্য তা উপযুক্ত কিনা তার নিশ্চয়তা কে ঠিক করবে। তাহলে এদেশের মানব সম্পদ ও স্থাবর অস্থাবর সম্পদ এই বিদেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শাখা তৈরীতে নিয়োগ করে দেশের কোন হিত্সাধনটি হবে? যদি সরকারের মনে হয় এদেশের এগিয়ে থাকা ছাত্রদের উন্নত দেশের শিক্ষার সাথে পরিচিত হওয়া জরুরি তাহলে তা সহজেই করা যায় ছাত্র ও শিক্ষকদের দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে আদান প্রদান করে বা বিদেশে গিয়ে কিছু সময় কাটিয়ে আসার জন্য বৃত্তি প্রদান করে। এরকম বহু অনুদান আগে ছিল যেখানে ভারত ও অন্যদেশের কোন দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজেদের ভেতর শিক্ষক বা ছাত্র আদান প্রদান করতে পারত। বর্তমানে এইসব অনুদানগুলি প্রায় তুলে দেওয়া হয়েছে। ছাত্রদের বিদেশের কোন নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে পড়াশোনা করার জন্য সরকার কোন বৃত্তি দেয়না। এই পদক্ষেপগুলি অনেক সহজেই করা যায় এবং তা দেশের সামগ্রিক উচ্চশিক্ষার পরিবেশকে উন্নত করে। তার বদলে সরকার কিছু চটকদারী ঘোষণা করেছে যাতে তাদের কোন দায় নেই, কেবল প্রচারের ঢাক বাজানো চলে।

বামপন্থীরা এর আগেও এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু আজকে সময় এসেছে কেবল সরকারি নির্দেশের প্রতিবাদেই নয় বরং দেশ জুড়ে একটি সংহত, সুপরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে এক নিরন্তর শিক্ষা আন্দোলন গড়ে তোলা। শিক্ষক সমাজকে কেবল নিজেদের ন্যায্য পাওনার দাবিতে নয় বরং শিক্ষাকে সমাজের সকল অংশের কাছে পৌঁছে দিতে ও দেশ গঠনের হাতিয়ার হিসাবে তৈরী করার দাবিতেও রাস্তায় নামতে হবে, আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তবেই দেশের বুকে স্বৈরাচারের উত্থানকে প্রতিহত করা যাবে।