আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২৩ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বিকাশ অথবা বিনাশ


মহেশ চাঁদ মিশ্র তেমন কোনো স্বনামখ্যাত ব্যক্তি নন যাঁকে এককথায় চেনা যায়। ১৯৭৬-এ তখনকার উত্তরপ্রদেশের গাঢ়ওয়াল জেলার জেলাশাসক ছিলেন মহেশ চাঁদ মিশ্র। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানান গাঢ়ওয়াল জেলা ও সংলগ্ন এলাকায় একটি ভূতাত্বিক ও ভূপ্রাকৃতিক (ভূগর্ভস্থ পাথর, জলের স্তরবিন্যাস, ভূমিকম্প প্রবণতা ইত্যাদি) বিষয়ে সমীক্ষার প্রয়োজন। ভারত সরকার মহেশ চাঁদ মিশ্রের নেতৃত্বে ১৮ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে দায়িত্ব পালন করে। মহেশ চাঁদ মিশ্র কমিটি বিস্তারিত অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করে একটি সমীক্ষা পত্র তৈরি করে।

সেই সমীক্ষার ফলাফল কেউ দেখেছিল কি না বলা মুশকিল। তারপর রাজ্য এবং জেলা ভাগ হয়ে গেল। উত্তরপ্রদেশ ভেঙে তৈরি হল উত্তরাখন্ড। গাঢ়ওয়াল কেটে চামোলি জেলা জন্ম নিল। এবং মহেশ চাঁদ মিশ্রও প্রশাসনিক নিয়মে অন্যত্র বদলি হয়ে গেলেন।

অনেকদিন পর এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের সূচনা লগ্নে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণাধীন বর্ডার রোডস্ অর্গানাইজেশন (বিআরও) একটি সড়ক প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ভারত সরকারের অনুমোদন চায়। তারা উত্তরাখন্ডের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার প্রস্থ বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়। হৃষিকেশ থেকে টানা ২৮১ কিলোমিটার, হৃষিকেশ থেকে গঙ্গোত্রী ২৩১ কিলোমিটার, টনকপুর থেকে পিথোরাগড় পর্যন্ত ১৬২ কিলোমিটার রাস্তার প্রস্থ সম্প্রসারণ করে ১০ মিটার করার প্রস্তাব। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রকের বিচার-বিশ্লেষণের পর আধিকারিকদের আনুষ্ঠানিক বৈঠকে প্ল্যানিং কমিশন জানতে চায় মহেশ চাঁদ মিশ্র কমিটির পর্যবেক্ষণ কতখানি কার্যায়িত হয়েছে। বৈঠকের হিরন্ময় নীরবতা বুঝিয়ে দিয়েছিল কিছুই করা হয়নি। অনেকেই হয়তো সেই সমীক্ষা সম্পর্কে জানেনই না। কাজেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে ওই এলাকার ভূতাত্বিক ও ভূপ্রাকৃতিক বিষয়ে বিস্তারিত সমীক্ষার পর যেন নতুন করে প্রস্তাবটি বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য মহেশ চাঁদ মিশ্র কমিটির প্রতিবেদনের নির্যাস ছিল ভূতাত্বিক ও ভূপ্রাকৃতিক বিষয়ে বিস্তারিত সমীক্ষা না করে উত্তরাখন্ডে অগোছালো নগরায়নের ফল মারাত্মক হতে পারে। পৃথিবীর অন্যান্য পর্বতমালার তুলনায় হিমালয় পর্বতমালার বয়স অনেক কম। এর অভ্যন্তরে পাথর ও ভূমি গঠনের কাজ ধারাবাহিক ভাবে ক্রমাগত হয়ে চলেছে।

দিন গড়িয়ে বছর পেরিয়ে ভারতের শাসন ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। ২০১৬-য় তিনি চার ধাম প্রকল্পের বাস্তবায়নের কথা ঘোষণা করে দিলেন। অন্য সব প্রকল্পের মতোই চার ধাম সড়ক প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর ২০১৬-তেই স্থাপন করলেন প্রধানমন্ত্রী। এই প্রকল্পের মধ্যে উত্তরাখণ্ডে প্রায় ১২,০০০ কোটি টাকা ব্যয়ে জাতীয় সড়কগুলি চওড়া করার প্রস্তাব আছে যা নাকি উত্তরাখণ্ডের বিকাশের জন্য অপরিহার্য। এখন প্ল্যানিং কমিশন নেই। স্বাভাবিকভাবেই খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করার সুযোগ অন্তর্হিত। তার উপরে এখন তো আবার প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাই যে কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।

চার ধাম প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উন্নয়নের সঙ্গে রাজনীতিও নিশ্চিত ভাবে জড়িয়ে ছিল। ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের কাছে যে চারটি তীর্থের মর্যাদা অনস্বীকার্য, সেগুলো হল উত্তরাখন্ডের বদ্রিনাথধাম, গুজরাটের দ্বারকা, ওডিশার পুরী ও তামিলনাড়ুর রামেশ্বরম। সর্বভারতীয় এই চার ধামের পাশাপাশি উত্তরাখন্ডের চারটি তীর্থস্থান কেদারনাথ, বদ্রিনাথ, গঙ্গার উৎপত্তিস্থল গঙ্গোত্রী ও যমুনার উৎপত্তি যেখানে সেই যমুনোত্রী ‘ছোট চার ধাম’ বলে সুপরিচিত। স্বাভাবিকভাবেই প্রধানমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় উত্তরাখন্ডের এই চার ধাম সড়কপথে সংযুক্ত করার ও রাস্তা চওড়া করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

কর্মযজ্ঞ শুরুর আগেই হোঁচট। পরিবেশবিদরা তো বটেই, স্থানীয় সচেতন জনতাও উত্তরাখন্ডে পাহাড় কেটে নির্মাণ কাজের প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলেন। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। স্থানীয় মানুষ ও পরিবেশ সচেতন আন্দোলনকর্মীরা হিমালয়ে এই ধরনের ব্যাপক কর্মযজ্ঞের তীব্র বিরোধিতা করেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, উন্নয়নের নামে পাহাড় ভাঙা ও প্রকৃতির সামঞ্জস্য নষ্ট করা অর্থহীন ও যুক্তিহীন। যথেচ্ছ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরিরও প্রবল বিরোধিতা করে তাঁরা বলেছিলেন, এখনই রাশ না টানলে প্রকৃতি একদিন ঠিক শোধ নেবে।

বিকাশের ঝড় বইয়ে দেওয়ার জন্য সরকার কিন্তু সেই হুঁশিয়ারি মানেনি। সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রীয় সরকারের যুক্তি ছিল, চিন সীমান্ত সুরক্ষিত করতে ওই এলাকার রাস্তা চওড়া করা প্রয়োজন। রাস্তা চওড়া না হলে চিন সীমান্তে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করা সম্ভব হবে না। ২০২১-এর ডিসেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট সরকারের ‘প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত যুক্তি’ মেনে প্রকল্পের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে কি না দেখার জন্য এক বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনেরও নির্দেশ দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে পরিবেশগত কাজগুলি সম্পাদন করা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য প্রাক্তন বিচারপতি এ কে সিক্রির নেতৃত্বে একটি তদারকি কমিটি গঠনেরও নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত।

সুপ্রিম কোর্ট নিয়োজিত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি জানিয়ে দেয় হৃষিকেশ থেকে চাম্বা যাওয়ার পথে এক-দুই জায়গায় ধস আগেও নেমেছে, কিন্তু বর্তমানে তার মাত্রা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাস্তা চওড়া করতে গিয়ে কুঞ্জপুরী স্থায়ী ধসপ্রবণ এলাকায় পরিণত হয়েছে। অলকানন্দা উপত্যকায় এমনই আর এক নতুন স্থায়ী ধসপ্রবণ অঞ্চলে রূপান্তরিত হয়েছে সাকনিধর। উপত্যকার যত উপরে ওঠা যায়, ততই বাড়ে ধসের মাত্রা।

সেই সময়ে সুপ্রিম কোর্টের যে বেঞ্চ প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয়তা মেনে চার ধাম প্রকল্পের অধীন রাস্তা ১০ মিটার চওড়া করার যুক্তি মেনে নিয়েছিলেন, তার নেতৃত্বে ছিলেন এখনকার প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। অন্য দুই বিচারপতি ছিলেন সূর্যকান্ত ও বিক্রম নাথ। তিন বিচারপতির সুপ্রিম কোর্টের এই বেঞ্চ ওই বছরের সেপ্টেম্বরে দেওয়া অন্য তিন বিচারপতির বেঞ্চের আদেশ সংশোধন করে এই রায় ঘোষণা করে। আগে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল উত্তরাখণ্ডে চার ধাম সড়ক সংযুক্তির অংশ হিসাবে যে তিনটি জাতীয় সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে, তা ৫.৫ মিটার চওড়া করতে হবে। সরকারের নতুন আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট সংশোধিত আদেশ দিয়ে জানায় যে রাস্তাগুলি ১০ মিটার চওড়া করা যেতে পারে।

প্রকৃতপক্ষে এ যেন অন্তহীন হোঁচট খাওয়ার গল্প। উত্তরাখণ্ডের গাঢ়ওয়াল পাহাড়ের কোলে ছোট্ট জনপদ জোশিমঠ। ১৯৩৯-এ প্রথমবার এই জনপদের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন ওঠে। তার পর কেটে গিয়েছে ৮৪ বছর। বিকাশের পালতোলা নৌকায় সওয়ার হয়ে সে দিনের ছোট্ট জনপদ আজ রীতিমতো বড় শহর। কিন্তু বিপদের ঘণ্টা বেজেছিল ২০০৯-এ। ২০০৪-০৫ নাগাদ এনটিপিসি (হাইড্রো) ৫২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তপোবন-বিষ্ণুগড় জলবিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র তৈরির কাজ শুরু করে। কিন্তু ২৪ ডিসেম্বর, ২০০৯ জোশিমঠের কাছেই এক পাহাড়ের ভিতরে আচমকা থমকে গেল একটি সুড়ঙ্গ খোঁড়ার যন্ত্র, পরিভাষায় যার নাম ‘টানেল বোরিং মেশিন’ (টিবিএম)। কারণ, সামনে হাজার হাজার গ্যালন জল। মাসের পর মাস কেটে যায়, জলের স্রোত কমে না। দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞরা এলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। জলধারার বিরাম নেই। পরে কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, মানুষের তৈরি যন্ত্র প্রকৃতির তৈরি একটি বিরাট জলভান্ডারে ছিদ্র করে দিয়েছে। সেই ছিদ্র দিয়ে বেরোচ্ছে হাজার হাজার গ্যালন জল। একটি হিসাব অনুযায়ী, দীর্ঘ সময় ধরে দৈনিক ৬ থেকে ৭ কোটি লিটার জল সেখান দিয়ে বেরিয়ে যেতে থাকে। একটা সময় নিঃশেষ হয়ে যায় সেই বিপুল জলভান্ডার। এর ফলে এলাকার যত ছোটখাটো ঝরনা ছিল সবই শুকিয়ে যায়। জলের বিভিন্ন উৎসেরও একই অবস্থা হয়। আর একেই জোশিমঠের কফিনে শেষ পেরেক হিসাবে অভিহিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের দাবি, ওই বিপুল জলভান্ডার শেষ হয়ে যাওয়ার ফলে এলাকার মাটি শুকিয়ে যায়। তা হয়ে যায় ঝুরঝুরে, ফাঁপা। ফলে পাহাড় ভাঙার ধ্বংসাবশেষের উপর দাঁড়িয়ে থাকা জোশিমঠের ধ্বংসও কার্যত সময়ের অপেক্ষা। স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ হয়ে যায় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ। এই বিপর্যয়ের জন্য জোশিমঠ এলাকায় ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহারের সুযোগ হারিয়ে যাওয়ায় শুরু হয় তীব্র জলসংকট। পাশাপাশি যথাযথ নিকাশি ব্যবস্থা গড়ে না তোলার ফলে পাহাড়ের যে কোনো ফাটল বা ফাঁক-ফোকর গলে বর্জ্য জল গড়িয়ে পড়ে। তার ফলে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয় সমগ্র পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র।

কিন্তু বিকাশের জমানায় কাজে গতি বাড়ানোর জন্য তপোবন-বিষ্ণুগড় জলবিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নির্মাণের কাজ নতুন উদ্যমে শুরু হয়ে গেল। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য চামোলি থেকে জোশিমঠ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিশেষ পরিচিত। গত কয়েক দশক ধরে সেই পরিচয় পাওয়া গেছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে চামোলির তুষারধস ঋষিগঙ্গা ও ধৌলাগঙ্গা নদীতে বান ডেকে এনেছিল। তাতে মারা গিয়েছিলেন দুই শতাধিক মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তপোবন-বিষ্ণুগড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পও। ২০১৩ সালে কেদারনাথে ভয়াবহ বন্যায় মারা গিয়েছিলেন ৩ হাজারের বেশি মানুষ।

২০২২ সালের অক্টোবরেও ঘটেছিল তেমনই এক বিপর্যয়। পাহাড়ের ধসে শতাধিক নিহত ও নিখোঁজ হয়েছিলেন। শুধু ২০২১ সালেই উত্তরাখন্ডে ছোট-মাঝারি দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ২৩টি, যাতে প্রাণ হারান ৩ শতাধিক মানুষ, অগণিত গৃহপালিত পশু, ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৬ হাজার ঘরবাড়ি, নষ্ট হয় কয়েক হাজার বিঘা জমির ফসল। এত তথ্য সত্ত্বেও আদালতের নির্দেশে চার ধাম প্রকল্পের কাজ স্বীকৃতি পেয়েছে।

নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহে জোশিমঠে ২ জানুয়ারি থেকে শুরু করে বিগত কয়েক দিনে জোশিমঠের ৭৬০-এরও বেশি বাড়িতে বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। চওড়া ফাটল দেখা গিয়েছে সেই শহরের রাস্তা-মন্দির-জমিতে। জোশিমঠ ধসে পড়ায় বদ্রীনাথ ও হেমকুণ্ড সাহিব, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স-সহ একাধিক স্থান কার্যতঃ বিচ্ছিন্ন। জোশিমঠকে ‘বসবাসের অযোগ্য’ বলেও ঘোষণা করেছে উত্তরাখণ্ড সরকার। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে তপোবন-বিষ্ণুগড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ও হেলাং পাসে নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে সরকারি ঘোষণার পরেও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার অদূরে ৮ থেকে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত জোশিমঠ-দিল্লি ৭ নম্বর জাতীয় সড়কের কাজ চলেছে। রীতিমতো পাথর ভাঙার মেশিন দিয়ে ভাঙা হয়েছে পাহাড়! কার্যত সরকারের নাকের ডগায় এই কাজ চললেও এখনও অবধি কাজ বন্ধ রাখার কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।

এখন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় শুরু হয়েছে বিপর্যয় মোকাবিলার কাজ। পরিবেশবিদেরা সহমত যে জোশিমঠের ব্যাপক ফাটল ও আতঙ্ক আগামী দিনের অশনি সংকেত। ন্যাশনাল রিমোট সেন্সিং সেন্টারের (এনআরএসসি) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত উপগ্রহ থেকে সংগৃহীত ছবি সমেত একটি প্রতিবেদন ১২ই জানুয়ারি প্রকাশিত হয়। শুক্রবার ১৩ই জানুয়ারি তা নিয়ে সর্বত্র উদ্বেগ-আশঙ্কার আবহ তৈরি হয়। ১১ জানুয়ারি, বুধবারের তারিখ দেওয়া কার্টোস্যাট-২এস উপগ্রহের পাঠানো ছবি প্রকাশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, জোশিমঠ-আউলি রাস্তায় ভূমিধসের পরিচিত রূপ শনাক্ত হয়েছে। উপগ্রহচিত্রে জোশিমঠ শহরের কেন্দ্রে ধসের সেই এলাকার মধ্যে সেনার হেলিপ্যাড এবং নরসিংহ মন্দির স্পষ্ট চেনা যাচ্ছিল। এনআরএসসি-র প্রতিবেদনটিতে বলা ছিল, গত এপ্রিল থেকে সাত মাস ধরে জোশিমঠের মাটি বসেছিল ৯ সেন্টিমিটার। গত ২৭ ডিসেম্বরের পর থেকে ১২ দিনের মধ্যে হঠাৎই ৫.৪ সেন্টিমিটার বসে গিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীর উদ্ধৃতিতে প্রতিবেদনে বলা ছিল, ২ জানুয়ারি আচমকা বড় ধস টের পাওয়া গিয়েছিল।

এর পরেই বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কাছে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা কর্তৃপক্ষের চিঠি যায়। তাতে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ১২ই জানুয়ারি বৃহস্পতিবার একটি বৈঠক হয়। সেখানে এই বিষয়ে আলোচনা করে জোশিমঠের ধসের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে যে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠিত হয়েছে, তা উল্লেখ করে মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো-সহ বিভিন্ন সংস্থাকে বলা হয়েছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ‘‘সংবেদনশীলতা’’ গড়ে তুলতে। যত দিন না জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা কর্তৃপক্ষ বিশেষজ্ঞদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন, বিভিন্ন সংস্থা যেন সমাজ মাধ্যমে এই সংক্রান্ত কিছু প্রকাশে বিরত থাকে। এবং তার পর থেকেই এনআরএসসি-র ওয়েবসাইট থেকে প্রতিবেদনটি উধাও হয়ে গেছে। তথ্যভিত্তিক সত্যকে গোপন করার নিদারুণ প্রচেষ্টা। এরপর অন্যান্য দেশের উপগ্রহ থেকে তোলা ছবি যখন প্রকাশিত হবে তাতে কি দেশের সম্মান বৃদ্ধি পাবে?

জোশিমঠ-বদ্রিনাথধাম ভূমিকম্পপ্রবণ স্থান। হিমালয়ের সর্বত্র লাগামহীনভাবে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি হচ্ছে। বিকাশের নামে হিমালয়ের গভীরে যা হচ্ছে, তাতে এই ধরনের বিপর্যয় ঠেকানো অসম্ভব। জোশিমঠে যা হয়েছে, অন্যত্রও বারবার তেমন ঘটবে। প্রকৃতিকে শাসন করতে গেলে প্রকৃতি এভাবেই শোধ নেয়। দুঃখের কথা, অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণে আমরা অপারগ। বাড়ির ভিতের তলায় ডিনামাইট ফাটালে ভিত নড়ে যাওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক।

এসব যে আরও কী ধরনের বিপর্যয় ঘটাবে তা কারো পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন। চার ধামের রাস্তা এত চওড়া করার বিষয়ে নতুন করে প্ৰশ্ন উঠেছে। প্রকৃতিরও সহ্যের সীমা রয়েছে এটা ভুললে চলে না। সব কিছু সাময়িক লাভ লোকসানের নিরিখে অথবা ভোট সংগ্রহের উপকরণ হিসেবে চালানো ঠিক নয়। জোশিমঠের বিপর্যয়ের মাত্রা আরও বেড়ে না গেলে তার অভিঘাত কতদিন টিকে থাকবে বলা মুশকিল। আর কোনোরকমে একটু সামলে নিতে পারলেই আবার নতুন করে যথেচ্ছাচার শুরু হবে না তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। আশঙ্কা থেকেই যায়। প্রকৃতি বনাম বিকাশের লড়াইয়ে সব সময় প্রকৃতিরই যে হার হয়। তবে মানুষের সমবেত প্রতিরোধ কিন্তু প্রকৃতি পরিবেশকে রক্ষা করতে পারে। অন্যান্য দেশে তো বটেই ভারতবর্ষে এমনকি উত্তরাখন্ডেও তার দৃষ্টান্ত রয়েছে।