আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ চতুর্বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২৩ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

নিয়ন্ত্রণকারী পরিবারের প্রকৃতি

শ্রীদীপ


নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সৰ্বাধিক ক্ষমতা কার বা কোন শক্তির? ধর্মের? রাষ্ট্রের? ন্যায়ালয়ের? পুলিশের? মস্তানের? উচ্চপদস্থ অফিসারের? উচ্চ জাতি বা উচ্চ শ্রেণির? পুরুষের? আন্তর্জাতিক মঞ্চে গা-জোয়ারি করতে পারা দেশের? নাকি অন্য কারো, বা অন্য কোনো শক্তির যার অবস্থান আমাদের অনেক নিকটে। যার মান্যতা ও আধিপত্য আমরা অনেক সময়ই নিঃশব্দে বিনা সমালোচনায় মেনে নিই। আমাদের ছোটো থেকে বোঝানো হয়, তাতেই নাকি আমাদের মঙ্গল। সেই মঙ্গলসাধনের সামনে নিজের শখ আহ্লাদ সুখ নাকি নগন্য।

মুখে কথা ফোটার আগে, পায়ে হাঁটা শেখার আগে, বোধশক্তি প্রখর হওয়ারও অনেক পূর্বে - তার শাসন ও নির্দেশ আমাদের মজ্জাগত হয়ে যায়। হাবে, ভাবে, শব্দে, নিঃশব্দে, কোমলস্বরে, উচ্চস্বরে আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যে সেই শক্তির রোষ অপ্রতিরোধ্য। তাকে অমান্য করে এ সমাজে বাঁচা অসম্ভব। সেই বৃহদাকার সামাজিক শক্তির নাম 'পরিবার'। যার নিয়ন্ত্রণের কীর্তিকলাপ আমাদের শরীরের ও মননের অনেক গভীরে। রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় শাখা-প্রশাখার তুলনায় অনেক ঘনিষ্ঠ পারিবারিক আরোপ, আচরণ ও বিচরণ। অনেক সাবলীলভাবে সে দমনকারী। অনেক শক্তিশালী তার বিদ্ধ করার প্রবৃত্তি ও প্রক্রিয়া।

নিয়মিত কুচকাওয়াজ করে পরিবারকে নিজের অস্থিত্ব জানান দিতে হয় না। সবসময় মাইক বাজিয়ে পরিবারকে নিজের আধিপত্য জানান দিতে হয় না। সব ক্ষেত্রে ঢাক ঢোল পিটিয়ে জনসম্মুখে পরিবারকে পদযাত্রায় বেরোতে হয় না। অসম্মতির চোখ রাঙানিতেই অনেক নিয়ন্ত্রণ নিঃশব্দে হয়। অবলীলায় মাথা নেড়ে আদেশ নিক্ষেপ সম্ভব। আক্ষরিক অর্থে আঙ্গুল না তুলেও আঙ্গুল তোলে পরিবার। কু-কথা না বলেও মানহানি করে। মর্যাদা কেড়ে সহজেই কাউকে বঞ্চিত করতে পারে পরিবার। ইচ্ছাকৃত উপেক্ষা ও ঔদাসীন্যের মিশ্রণে বহু দূরে ঠেলে দিতে পারে পরিবার। নির্যাতন করতে পারে গায়ে হাত না তুলেও।

নিয়ন্ত্রণকারী পরিবারের হাতে সেই আবেগ-অস্ত্র রয়েছে যা রাষ্ট্র-ধর্ম-জাত-শ্রেণির হাতে নেই - তা হলোঃ ব্যাক্তিগত পরিসরে চরম অধিকার জ্ঞাপন করার একচেটিয়া মান্যতা। দেশ, ধর্ম, জাত, শ্রেণি, লিঙ্গ ত্যাগ বা পরিবর্তন করা সম্ভব। অন্য দেশের নাগরিক হওয়া যায়। ধর্মান্তর স্বাভাবিক। শ্রেণিগত বা জাতিগত উত্থান-পতন হয়েই থাকে। লিঙ্গ পালটাবার বৈজ্ঞানিক কৌশল ব্যয়সাধ্য হলেও, এখন তা অনেকের হাতের নাগালে। কিন্তু পরিবার পরিত্যাগী মানুষের সংখ্যা চিরকালই অতি নগন্য আধুনিক মানব ইতিহাসে। গৃহত্যাগী সন্নাসীদের নিয়ে সংসারের তেমন কোনও মাথাব্যথা নেই বা ছিল না। সেই না থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। সংসার তাদের নিয়েই ভাবিত যারা সংসারের মান্যতা স্বীকার করে তার ধারণ, পোষণ ও পরিচর্যা করে থাকে। যারা পরিবার মানে না, পরিবারও তাদের মান্যতা দেয় না। গোটা ব্যবস্থাটাই দেওয়া নেওয়ার খেলা। সেখানে নিঃস্বার্থ বলে কিছু হয় না।

একটি শিশু বা কিশোর, কী করবে না করবে; কোথায় কীভাবে হাত রাখবে বা না রাখবে; কী বলবে এবং কীভাবে; কার সাথে কেমন ব্যবহার করবে, না করবে - সবই পরিবারের আদেশ মাফিক। এটা কোরো না, সেটা ঘেঁটো না; এটা খেও না, সেটাতে মুখ দিও না; এর সাথে মিশো না, তার সাথে কথা বোলো না; এভাবে বোসো না, ওভাবে শুয়ো না; ও কথা বোলো না, ওভাবে বোলো না; চুল দাড়ি বাড়িও না; কলার তুলো না; ডান হাতে ঘড়ি পোরো না, ডান দিকে সিঁথি কোরো না; বুকের বোতাম একটা বেশি খোলা রেখো না, ছেঁড়া-কাটা জিন্স পোরো না; খোলামেলা কাপড় পোরো না; শরীর উন্মোচন কোরো না; পড়াশোনা করো, গাড়িঘোড়া চড়ো; ডিগ্রি-চাকরি-পদোন্নতিতেই জীবনের সার্থকতা ভাবো; বড়োদের মুখে মুখে তর্ক কোরো না; কঠিন প্রশ্ন কোরো না স্থিতি-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে; বিশৃঙ্খল, বেহিসেবি বাউন্ডুলে হয়ো না বরং বাধ্য হও। প্রেম করলে তা বিয়েতে পরিণত করো; প্রেম, পরকীয়া, যৌনতার ক্ষেত্রে কামনা-বাসনায় লাগাম দাও, বহুগামী হয়ে কলঙ্ক এঁকো না; ধর্ম-শ্রেণি-জাত টপকে ওসব তো কোরোই না; প্রত্যাশিত বৈবাহিক সঙ্গম ভোগ করো, উত্তেজনাময় অভিসার তাড়া করার ঝুঁকি নিও না। সামাজিকতা করতে হয় করো, কিন্তু নিজের সামাজিক পরিসরের গন্ডির মধ্যে থেকে, নিয়মাবলী মেনে - ইত্যাদি এমন সহস্র নিষেধাজ্ঞা ঠুসে, জুড়ে, চাপিয়ে 'পরিবার' আমাদের 'মানুষ' করে। অজ্ঞকে বিজ্ঞ করার সাধনায় নির্লিপ্ত হয়। সে সব বিধিনিষেধ মেনে আমরা বড়ো হওয়ার চেষ্টা করি। আবার সেই মানুষকে মাধ্যম করেই, পরিবার তার মূল্যবোধ পুনর্গঠন করে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলতে থাকে এই বিন্যাস-লিপি। চলে শৃঙ্খলার আয়োজন। তাকেই বলে সমাজিকীকরণ। অন্যভাবে দেখলে, তার আরেক নাম বশ্যতা।

এভাবেই শিশু পরিণত হয় বয়ঃপ্রাপ্ততে। অবাধ্যকে মেরে-ধরে-শুধরে করা হয় বাধ্য - অসভ্যকে সভ্য। নির্ভরশীল, অপ্রাপ্ত ও সিদ্ধান্ত-নিতে-অক্ষমকে করা হয় যোগ্য ও সময়োপযোগী। আর এই ছকে ধরা দিতে না চাইলে, সমাজ তাকে তিরস্কার জানায়, খেপায়। বলে বাচ্চা, ছেলেমানুষ। অর্থাৎ সে অপরিণত এবং অসম্পূর্ণ। বৃহত্তর স্বার্থে, তাকে পরিণত হতেই হবে, নচেৎ সে সাবধানবাণী শুনেই যাবেঃ গ্রো-আপ। সেই গ্রোথ বা বিকাশ না হলে মহা সমস্যা। রয়ে যাবে অবিকশিত অসমান, নিকৃষ্ট ও দায়িত্বহীন, বাকিদের তুলনায় - একটা সমস্যা। পরিবারের এই মানুষ করার প্রজেক্ট বা পরিকল্পনাটি আদতে একটি সমাজ-অনূদিত, সমাজ-স্বীকৃত এবং সুপরিকল্পিত বিশ্বব্যাপী কর্মকান্ড। এই কাণ্ডে শিশুর নিরীহতার মূল্য স্বল্পমেয়াদি। শিশুসুলভ মোড়ক ভেঙে তাকে বড়োদের মতো হয়ে উঠতেই হবে। বাচ্চার মতো আচরণ করার কোনো বিকল্প, পরিবার তাকে দেবে না - পরিবারের মঙ্গলের স্বার্থে। আর এই না দেওয়াকে বা এই বঞ্চনাকে, সমাজ স্বীকার করে, কারণ স্বতঃস্ফূর্ত খেলাচ্ছল বর্জন করিয়ে মানুষকে উৎপাদনশীল ও প্রতিযোগিতামূলক করে তোলার গঠনমূলক নির্ধারিত গতিপথই - সামাজিকীকরণ। এই সামাজিকীকরণই সমাজকে বাঁচিয়ে রাখে, টিকিয়ে রাখে - প্রথা-রীতি-পরম্পরা বজায় রেখে। সেটাই সভ্যতার মাপকাঠি ও সেটাও পরিবারেরই মঙ্গলের স্বার্থে। এই গোটা প্রণালীর মধ্যে নিহিত যে হিংসার অস্থিত্য বিদ্যমান, তাও পরিবাবের মঙ্গলের স্বার্থে বা তারই রক্ষার্থে।

এভাবেই যেকোনো ব্যক্তির খোলনোলচে পালটে দেওয়ার, একমাত্র অধিকার পরিবারের এবং পরিবার অনুমোদিত বাকি সকল সামাজিক সংস্থার। প্রয়োজনে পরিবারের হাতে প্রচুর অস্ত্র-কৌশল - কোমল থেকে কড়াঃ হাত বুলিয়ে বোঝানো, উপদেশ বিতরণ, হস্তক্ষেপ করা, সমর্থন না করা, পাশে না দাঁড়ানো, শাসন করা, শাসানো, অত্যাচার বা উৎপীড়ন, অস্বীকার করা, আতঙ্কিত করা ইত্যাদি। আর কিছুতেই কাজ না হলে বহিষ্কার। প্রয়োজনে নিধন। অন্তিম শাস্তি। চরম দমন। হিংসাত্মক। যথেচ্ছ মানবাধিকার উল্লঙ্ঘনের যাবতীয় টুল-কিট ঘরে ঘরে।

বিশ্বব্যাপী এই মঙ্গলসাধনের নামে যে উল্লঙ্ঘন-ক্রিয়া চলছে, তা সমালোচনা করার প্ৰশিক্ষণ আমরা কখনওই পরিবার থেকে পেতে পারি না। পরিবারের নিয়ন্ত্রণকারী স্বভাবের নিন্দা, তার স্বচালিত গতিবিধির পক্ষে হানিকারক। পরিবার-বিরোধী মতবাদ যা নির্মাণ করতে পারে পরিবার-বিরোধী যুক্তিনির্ভর সমালোচনা, তা পরিবার কখনওই বরদাস্ত করবে না। বরং প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে কান্নার জোয়ারে, আবেগের বন্যায় ও অতিনাটকীয়তার আতিশয্যে - পরিবার নিমিষে উপরে ফেলবে পরিবার-বিরূপ ভাবনা চিন্তা, একদম তার শিকড় থেকে। কারণ, ইংরেজিতে যাকে বলেঃ দি স্টেক্স আর টু হাই। তাই পারিবারিক স্হিতি-ব্যবস্থার কোনো ওলটপালট চলবে না।

বাপ-মায়ের প্রচুর অসাধিত ইচ্ছেপূরণের দায়ভার বইতে হবে সন্তানকে। সেটাকেই স্বাভাবিক সাব্যস্ত করা হবে। ও সেটার স্বাভাবিকীকরণের মধ্যে দিয়েই পারিবারিক মাহাত্ম্য অটুট থাকবে। অনেক অপূর্ণ ও অতৃপ্ত বস্তুবাদী সাধ যা প্রাজ্ঞদের দ্বারা সম্ভব হয়নি, সেগুলোও বাস্তবায়িত হবে প্রজনন-মাধ্যমে। সেখানেই পারিবারিক জয়। পূর্ব প্রজন্মের রক্ষণশীল বা প্রগতিশীল চিন্তাধারার ধারক-বাহক হয়ে উঠবে তাদের উত্তরসূরি, সেটাই চূড়ান্ত পারিবারিক সাফল্যের মানদণ্ড। কে কত ভালো নিজেদের জেরক্স বানাতে পারে আর কি! প্রয়োজনে, পরিবারের স্বার্থের জন্য আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়েই পারিবারিক গৌরব। পরিবার কতটা করেছে ও তার পরিবর্তে সন্তান কতটা প্রতিদান দিতে পারে বা দিচ্ছে, সেই সাংসারিক হিসেবের মধ্যেই নিহিত পারিবারিক আদান-প্রদানের অন্তর্নিহিত সত্য ও শর্ত। সন্তান যেন জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ জীবনবীমার মাসিক প্রিমিয়াম। বদান্যতা ও পরম হিতকারী হওয়ার ভাবমূর্তি - এক সম্বলিত পারিবারিক প্রয়াস মাত্র। তার আড়ালে গোটাটাই বিনিময় - অর্থের, সুযোগ-সুবিধের, সেবার, সমর্থনের। এবং সর্বোপরি, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, উত্তরাধিকার সূত্রে হস্তান্তরের নিরাপদ ফর্মুলাই - পরিবারের চালনা শক্তি।