আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ চতুর্বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২৩ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

পাঁচ রাজ্যে ভোট শেষ, এবার লোকসভা নির্বাচন

প্রস্কণ্ব সিংহরায়


সাম্প্রতিক পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচনের ফলাফল বেশ শোরগোল ফেলেছে রাজনৈতিক মহলে। অনেকেই অবাক, অনেকে আবার হতাশ, অনেকে চিন্তিত কিন্তু আশাবাদী, এবং বাকিরা হয় উৎফুল্ল বা উদাসীন। বেশির ভাগ বিশ্লেষক বা সমীক্ষাই এই পাঁচটি ভোটের পরিণাম ঠিকঠিক আন্দাজ করতে পারেনি। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তিশগড়ে মুখ্যমন্ত্রী চয়নও সকলকে বিস্মিত করেছে। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে যে এই পাঁচ রাজ্যের ভোটের ফলাফল দেশের দলীয় রাজনীতির গতিপথ আগামীদিনে প্রভাবিত করবে সেটা অবশ্য নিঃসন্দেহে বলা যায়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মতে তিনটি রাজ্যে বিজেপির জয়লাভ স্পষ্ট করে দিল যে ২০২৪-এ কেন্দ্রে বিজেপির হ্যাট্রিক হতে চলেছে। ফলত দেখা জরুরি ঠিক কী কী ইঙ্গিত দিল এই ফলাফল?

প্রথম প্রশ্ন নেতৃত্বের। আরও একবার দেখা গেল যে উত্তর ভারতে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বের উপর মানুষ সম্পূর্ণ আস্থাশীল। যেই তিনটে রাজ্যে বিজেপি জিতেছে সেখানে কোথাও কোনো আঞ্চলিক নেতা বিশেষ প্রাধান্য পায়নি। প্রচারে ছিল একজনই তারকা - প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, এবং প্রধান স্লোগান - মোদী কি গ্যারান্টি। অধিকাংশ ভোটার তাতে সায় দিয়েছে। ২০২৪-এর আগে বিজেপি আবার যদি ‘মোদী বনাম কে’ প্রশ্নটি মানুষের মাথায় গেঁথে দিতে সক্ষম হয়, তাহলেই অন্তত উত্তর ভারতে তাঁরা নিশ্চিন্ত। জয়লাভের পর মুখ্যমন্ত্রী চয়নেও চমক বিজেপির। কেউ হয়ত অনুমান করেনি যে রাজস্থানে ভজনলাল শর্মা, মধ্যপ্রদেশে মোহন যাদব আর ছত্তিশগড়ে বিষ্ণুদেও সাই মুখ্যমন্ত্রী হবেন। এখানে বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পরিষ্কার কয়েকটি ইঙ্গিত দিল। এক, দলীয় সিদ্ধান্তে তাঁদের মতামতই শেষ কথা, রাজ্য নেতৃত্বের নয়। দুই, একজন ব্রাহ্মণ, একজন ওবিসি এবং একজন আদিবাসী নেতাকে মুখ্য আসনে বসিয়ে জাতি সমীকরণের দিকেও খেয়াল রেখেছে তাঁরা। তিন, সাধারণ পরিবারের তিন জনকে মুখ্যমন্ত্রী বেছে নেওয়াতে বিজেপির এটাও তুলে ধরার চেষ্টা যে তাঁরা পরিবারবাদী রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে পারে। এবারে প্রশ্ন হল বসুন্ধরা রাজে, শিবরাজ সিং চৌহান, রমন সিং-এর মত পুরোনো দাপুটে নেতৃবৃন্দ ও তাঁদের সমর্থকরা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের রাজ্য রাজনীতির উপর এই ভীষণ নিয়ন্ত্রণ এবং হস্তক্ষেপ আগামীদিনে কীভাবে দেখবে? সেটা অবশ্য সময় বলবে। অন্যদিকে তেলেঙ্গানা ও মিজোরাম এই দুই রাজ্যে অ্যান্টি-ইনকামবেন্সির সুযোগ নিতে সক্ষম হয়েছে কংগ্রেস ও জোরাম পিপলস মুভমেন্ট। উঠে এসেছে দুই আঞ্চলিক নেতা রেভন্ত রেড্ডি ও লালদুহোমা। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে রাজ্য স্তরে দলমত নির্বিশেষে একদল নতুন মুখ উঠে এলেও কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে মোদীর নেতৃত্ব জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে তুলনাহীন। এই মুহূর্তে তাই পরিষ্কার যে নেতৃত্ব প্রশ্নে বিরোধীদলগুলি এবং ইন্ডিয়া জোট বর্তমানে বেশ দিশাহীন।

দ্বিতীয়, সংগঠনের প্রশ্নে আসা যাক। কোন কোন বর্গের ভোট কার কার দিকে গেছে সেটা দেখলে অনেকটাই বোঝা যাবে বিভিন্ন দলের সাংগঠনিক প্রতিপত্তি। মিজোরামের একটি লোকসভা আসন, সেটি সংরক্ষিত। বাকি চারটি রাজ্য যদি দেখা হয়, তাহলেও বিজেপির সংগঠনের বিস্তার লক্ষণীয়। রাজস্থানে উচ্চবর্ণ ও ওবিসি ভোটারদের অধিকাংশই বিজেপিকে সমর্থন করেছে। তাছাড়া দলিত ও আদিবাসী ভোটারদের এক তৃতীয়াংশ তাঁদের সাথে। কংগ্রেসকে সমর্থন করেছে মূলত দলিত, আদিবাসী ও মুসলমান ভোটার। মধ্যেপ্রদেশেও ছবিটা প্রায় একইরকম। উচ্চবর্ণ ও ওবিসি ভোটারদের অধিকাংশই বিজেপি সমর্থক, কংগ্রেসের দিকে বেশিরভাগ দলিত ও আদিবাসী ভোটাররা। ছত্তিশগড়ে দলিত ভোটারদের অধিকাংশ কংগ্রেসের সমর্থনে থাকলেও, আদিবাসী ভোট বেশিরভাগ বিজেপির পক্ষে। তাছাড়া এই ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যুব ও মহিলাদের ভোট বেশিরভাগ বিজেপির পক্ষে। তেলেঙ্গানায় জাতি সমীকরণের নিরিখে বিচার করলে দেখা যায় যে কংগ্রেস ও বিআরএস কাঁটায় কাঁটায় টক্কর দিয়েছে কিন্তু কংগ্রেসের পাল্লা ভারী। তার একটা কারণ তেলেঙ্গানায় বিজেপির প্রবেশ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সঞ্জয় কুমারের মতে এই পাঁচটি রাজ্যের ফলাফল দেখায় যে মানুষ কংগ্রেস বিরোধিতা হয়ত করেনি, তবে বিজেপির প্রতি তুলনামূলকভাবে বেশি সমর্থনে দাঁড়িয়েছে। কংগ্রেস এই চার রাজ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট পাওয়া সত্ত্বেও বিজেপির সাংগঠনিক প্রতিপত্তির তুলনায় পিছিয়ে আছে।

বিজেপির সাংগঠনিক কৌশলের একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। তেলেঙ্গানার শিরপুর বিধানসভা এবং ছত্তিশগড়েও পশ্চিমবঙ্গের এক বাঙালি বিজেপি নেতাকে প্রচারে দেখা গেছে এবার। তিনি মতুয়া নেতা শান্তনু ঠাকুর। এই দুই রাজ্যে কিছু মতুয়া ভোটার আছে। সেইসব ভোটার যেন বিজেপিকেই সমর্থন করে তার জন্য মতুয়া অধ্যুষিত অঞ্চলে মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতিকে প্রচারের পাঠানো হয় বিজেপির পক্ষ থেকে। হিন্দু পরিচিতির এই রাজনীতিকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য বিরোধী দলগুলির একটি হাতিয়ার জাতি গণনার প্রতিশ্রুতি। ওবিসি ভোট নিজেদের সমর্থনে আনতে মরিয়া বিরোধী দলগুলি। কিন্তু বিরোধীদের এই প্রতিশ্রুতিতে মানুষ যে সাড়া দিচ্ছে না সেটা অন্তত এইবারের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া ইন্ডিয়া জোট নিজেরাই কি এই প্রশ্নে একমত সেটাও বর্তমানে বিবেচ্য।

অবশেষে সরকারের কাজের প্রশ্নে আসা যাক। বিভিন্ন দলগুলি তাঁদের জনকল্যাণমূলক কাজের হিসেব এবং প্রতিশ্রুতির উপর জোর দিয়েছে। ফলাফল অনুয়ায়ী পাঁচটির মধ্যে চারটি রাজ্যে সরকার বদল হয়েছে। অর্থাৎ অ্যান্টি-ইনকামবেন্সির একটা প্রভাব পরিষ্কার। মিজোরাম ও তেলেঙ্গানায় সরকার বদল হওয়ার একটি প্রধান কারণ দুর্নীতি। ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রশ্নে মানুষের অসন্তোষ থাকলেও, ভূপেশ বাঘেলের বিরাট জনপ্রিয়তা সমস্ত সমীক্ষায় ফুটে উঠেছে। রাজস্থানেও অনেকটা একই পরিস্থিতি ছিল। অশোক গেহলটের জনপ্রিয়তা ও কাজের প্রশংসা মানুষ করলেও বিজেপির প্রতি তাঁদের আনুগত্য বেশি। ছত্তিশগড় ও রাজস্থানে কংগ্রেস সরকার একাধিক জনকল্যাণমূলক যোজনা এনেছিল গত কয়েক বছরে। যেমন রাজস্থানে গিগ অর্থনীতি অন্তর্ভুক্ত কর্মীদের সামাজিক সুরক্ষা বিল। কিন্তু দেখা গেল সেই নিয়ে বেশির ভাগ মানুষ সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হয়ত নয়। অন্যদিকে বিজেপি নিজেদের গড় মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। লাডলি লক্ষ্মী বা লাডলি বেহেনার মত যোজনা বিজেপিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছে। অ্যান্টি-ইনকামবেন্সির কোন প্রভাবই মধ্যপ্রদেশে তাই টেকেনি। ফলে কী কায়দায় নিজেদের জনকল্যাণমূলক কাজের হিসেব এবং সেই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি মানুষের কাছে তুলে ধরতে বা পৌঁছে দিতে হয় সেটা বিরোধীদলগুলির গভীরভাবে ভাবা প্রয়োজন। আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। বিজেপির সাথে হিন্দুত্ব প্রশ্নে টেক্কা দিয়ে যে বিরোধীদলগুলি পেরে উঠবে না সেটা এবারের ফলাফলে আরও একবার প্রমাণ হল।

আর মাত্র কয়েকটা মাস বাকি, তারপরেই লোকসভা নির্বাচন। এই পাঁচটি রাজ্যের ভোটের পর বিজেপি নিঃসন্দেহে লড়াই-এ এগিয়ে ও মানসিকভাবে বেশ চাঙ্গা। তাঁদের লক্ষ্য হ্যাট্রিক। বিরোধীরা অন্যদিকে এখন বিভাজিত। ফলাফল ঘোষণার পর ইন্ডিয়া জোটের মিটিং-এ মমতা ব্যানার্জি অখিলেশ যাদবের মত গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব অনেকে অংশগ্রহণ করেনি। বিজেপিকে ভোটে হারাতে হলে বিরোধীদের চাই সবল নেতৃত্ব, সাংগঠনিক শক্তির ভিত্তিতে আসন বণ্টন এবং জনকল্যাণমুখী নীতির প্রতিশ্রুতি। আগামীদিনে তাঁরা কী পদক্ষেপ নেয় সেটাই এখন দেখার।