আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ চতুর্বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২৩ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

অরণ্য অধিকার আইনঃ গণতান্ত্রিক সম্ভাবনা ও আমলাতান্ত্রিক নাশকতার কাহিনী

অশোক সরকার


কখনও শুনেছেন ৫১ ঘরের একটি গ্রাম সভা গত ৫ বছরে ২৪ লক্ষ টাকা সরকারকে জিএসটি দিয়েছে। শুনতে অবিশ্বাস্য হলেও মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুর জেলার পঞ্চগাও গ্রামসভা লঘু বনজ সম্পদ বিক্রি করে আয় করেছে প্রায় ৪ কোটি টাকা, তারই অংশ এই জিএসটি। তা সম্ভব হয়েছে ২০০৬ সালের বন অধিকার আইনের ভিত্তিতে। ভূমি সংস্কারের মতই বন অধিকার আইনও বনসম্পদের অধিকার পুনর্বন্টনের কথা বলে, যার প্রস্তাবনায় লেখা আছে বনবাসীদের উপর দীর্ঘকালব্যাপী ঐতিহাসিক অন্যায়ের প্রতিকার করতে এই আইন। বনসম্পদের উপর গ্রাম সভার কৌম অধিকার, বাস্তু ও চাষের জমির উপর পারিবারিক অধিকার, আদিম জনজাতি যারা এখনও জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে খাবার সংগ্রহ করেন, তাঁদের সেই বাস্তুতান্ত্রিক অধিকার (habitat rights), যাযাবর সম্প্রদায়ের মানুষ যাঁদের জীবিকাক্ষেত্র একাধিক জেলা বা রাজ্যে বিস্তৃত, তাদের সেই জীবিকা ক্ষেত্রের উপর অধিকার এই আইনে স্বীকৃত। দেশের প্রায় ৬.৫ লক্ষ গ্রামের মধ্যে ১ লক্ষ ৭৫ হাজার গ্রাম ও তার প্রায় ১৫ কোটি মানুষ এই আইনের বলে তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। এ ছাড়া ৪৫০০ স্বীকৃত বনগ্রামের অধিবাসীরাও এই আইনের আওতায় আসেন।

পঞ্চগাওয়ের অধিবাসীরা মূলত গোন্ড আদিবাসী, তাছাড়া আছেন কিছু কুরবী মারহার সম্প্রদায় যারা ওবিসি বলে পরিচিত, আর কাপেহার ও লাহার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ যারা যাযাবর। তিন বছরের লড়াইয়ের পর ২০১২ সালে তাঁরা ১০০৬ হেক্টর জঙ্গলের উপরে বন অধিকার পাট্টা পেয়েছিলেন। কৌম বন অধিকার পেলে সমস্ত লঘু বনজ সম্পদের উপর পূর্ণ অধিকার জন্মায় গ্রাম সভার। শর্ত একটাই - জীবন ও জীবিকার উন্নয়নের পাশাপাশি বন সংরক্ষণ করতে হবে। পঞ্চগাওয়ের অধিবাসীরা তাই করে দেখিয়েছেন। গ্রাম সভার নিয়ন্ত্রণে ৪৬ হেক্টরের একটি অভয়ারণ্য আছে। বন সংরক্ষণ ও জীবিকার উপর নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০-২২টি নিয়ম আছে। ওঁদের জীবিকার প্রধান উপায় বাঁশ কাটা ও বিক্রি করা। সেই বাঁশ বিক্রি করেই ওঁদের এই রোজগার। পাশাপাশি প্রশাসন তামাক (তেন্ডু) পাতা সংগ্রহ সম্পূর্ণ আটকে দিয়েছে কারণ তামাকজাত দ্রব্য স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। গ্রাম সভার নিজস্ব গ্রাম কোষ আছে, নিজস্ব জীব বৈচিত্র্যের রেজিস্টার আছে, সমস্ত ধরনের উদ্ভিদের তালিকা আছে, নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করা আছে। এই গ্রাম থেকে গত ৫ বছরে একজনও গ্রাম ছাড়েননি।

পঞ্চগাওয়ের গ্রাম সভা মাসে তিন কি চারবার বসে। সেখানেই সব সিদ্ধান্ত খোলামেলাভাবে নেওয়া হয়। গ্রাম সভার উদ্যোগে সেখানে একটা স্কুল হয়েছে, রাস্তায় বিজলী বাতি এসেছে, জলের ট্যাঙ্ক হয়েছে এবং পানীয় জলের জন্য কয়েকটি জলের কল বসানো হয়েছে। বাঁশ কাটা, বাঁশ বিক্রির দাম, বাঁশ কাটার জন্য মজুরি সবই গ্রাম সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাঁশ বিক্রির লাভ কতটা বিতরণ হবে কতটা গ্রাম কোষে থাকবে তাও খোলামেলাভাবেই সিদ্ধান্ত হয়। কোনো নিয়ম ভাঙলে কত ফাইন, তাও গ্রাম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নোটিশ বোর্ডে টাঙানো আছে।

কিন্তু দেশের সিংহভাগ বনবাসী ও বন নির্ভর গ্রামবাসীরা বনজ সম্পদের উপর অধিকার থেকে এখনও অনেক দূরে। বন অধিকার আইন দেশের সব জায়গাতেই আছে। আইন পাস হবার ১৭ বছর বাদে বাস্তবে মহারাষ্ট্র, উড়িষ্যা ও ছত্তিসগড় ছাড়া অন্য রাজ্যগুলিতে আইন রুপায়নের কাহিনি নিতান্তই করুণ। কিন্তু কেন?

ভূমি সংস্কারের প্রধান বিরোধী ছিল যাদের জমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে তারা, তার সঙ্গে সেই সময়কার মুখ্য রাজনৈতিক দলগুলির স্থানীয় নেতারা যাদের সামাজিক ভিত্তি ছিল জমিদারি বা মহাজনী কারবার এবং আমলাতন্ত্র। ভূমি সংস্কার হলে এরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতো। সেই তুলনায় বনবাসীরা বন অধিকার পেলে ক্ষতি একমাত্র বন বিভাগের আমলা ও বাবুদের, যারা ১৫০ বছর ধরে অরণ্যের একচ্ছত্র অধিপতি। ১৮৬৪ সালে এই বিভাগের স্থাপনা। তখন নাম ছিল রাজকীয় বন দপ্তর। ১৮৬৮ সালে প্রথম ভারতীয় অরণ্য আইন তৈরি হয়। সেই আইন বলে অরণ্য জাতীয়করণ হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হল। ক্রমশ সরকারি অরণ্যের এলাকা বাড়তে থাকে। ১৯২৭-এ গিয়ে সেই আইন পরিণতি লাভ করে যার দৌলতে সরকার সংরক্ষিত বনের নামে ভারতের অরণ্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশকে জাতীয়করণ করে। জাতীয়করণের প্রধান প্রভাব পড়ল বনবাসী ও বন নির্ভর গ্রামবাসীদের উপর। তারা হয়ে গেল বেআইনি দখলকারি। যে অরণ্যকে ঘিরে তাদের জীবন ও জীবিকা গড়ে উঠেছিল, সেই অরণ্যেই তাদের বে-আইনি দখলকারী (Encroacher) ঘোষণা করা হল। অরণ্যের জাতীয়করণ শুধু আমাদের দেশে নয়, জার্মানি ব্রিটেন সহ ইউরোপের একাধিক দেশে হতে থাকে। তার মূল কারণ ছিল রেলওয়ে ও জাহাজ শিল্পের সম্প্রসারণের জন্য কাঠের প্রয়োজন। তাই কাঠ তথা টিম্বারকে 'জাতীয় সম্পদ' বলে ঘোষণা করা হয়, বাকি সব কিছু হয়ে যায় লঘু বনজ সম্পদ। অরণ্যের জাতীয়করণের ফলে বনবাসী ও জঙ্গল নির্ভর গ্রামবাসীদের জঙ্গলে যাওয়া নিষিদ্ধ হল, জঙ্গল থেকে পশুখাদ্য, জ্বালানি, খাদ্য ও ঔষধি সংগ্রহ নিষিদ্ধ হল।

অরণ্য থেকে বনবাসী ও বন নির্ভর গ্রামবাসীদের বঞ্চিত করার কাহিনি স্বাধীনতার পরেও বজায় থেকেছে। ১৯২৭-এর ভারতীয় অরণ্য আইন দেশ স্বাধীন হবার পরেও বজায় রইল, ফলে জঙ্গলের অধিবাসীরা বেআইনি দখলদারই রয়ে গেল। তারপর ১৯৭২ সালে এল বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন, ১৯৮০-তে বন সংরক্ষণ আইন। এই আইনগুলি বনবাসীদের বঞ্চনা আরও বাড়িয়ে দিল। ইতিমধ্যে ইউরোপ আমেরিকার মতো আমাদের দেশেও সংরক্ষণের ধারণা জোরালো হয়েছে। সংরক্ষণবাদীদের একাংশ মনে করেন মানুষই সংরক্ষণের আসল বিরোধী; প্রকৃতি ও অরণ্যকে মানুষমুক্ত করলেই সংরক্ষণ হবে। তাঁদের কথায় যে যুক্তি নেই তা নয়। বাঘের চামড়া, হাতীর দাঁত, চন্দন কাঠ ইত্যাদি নিয়ে ব্যবসা তো মানুষেরই কারবার। কিন্তু কিছু চোরাগোপ্তা শিকারিদের আটকাতে গিয়ে জঙ্গলে অধিবাসী ও জঙ্গল নির্ভর মানুষগুলিকেই মনে করা হল জঙ্গলের শত্রু।

জঙ্গলের অধিবাসীরা জঙ্গলের শত্রু এই ধারণা ৯০-এর দশকে এসে বদলাতে শুরু করে। ১৯৯০ সালে এল যৌথ বন ব্যবস্থাপনা। বলা হল জঙ্গল ও বন্যপ্রাণীদের বাঁচাতে গেলে জঙ্গল নির্ভর মানুষগুলির সাহায্য চাই। যৌথ 'বন ব্যবস্থাপনা কমিটি' তৈরি হল। অনেক জায়গাতেই তার নাম হল 'বন সুরক্ষা সমিতি'। সেখানে বন দপ্তরের কর্মীদেরই প্রাধান্য। বন পাহারা দেওয়া এবং কিছু সাফ সাফাইয়ের কাজ এল এই সব কমিটির জঙ্গলবাসী সদস্যদের হাতে, কিছু টাকা পয়সাও এল, কিন্তু জঙ্গলের অধিবাসীরা বন বিভাগের তাঁবেদার হয়েই রইলেন, তাঁদের কোনো অধিকার তৈরি হল না। অল্প কিছু ক্ষেত্রে যৌথ ব্যবস্থাপনা কিছুটা সাফল্য পেলেও সামগ্রিকভাবে সারা দেশে বনবাসী ও জঙ্গল নির্ভর গ্রামবাসীদের উপর অন্যায়ের ইতিহাসের ইতি ঘটল না।

ইতিমধ্যে ১৯৯৫ সালে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। টি. এন. গোদাবর্মণ নামে তামিলনাড়ুর এক পরিবেশপ্রেমী সুপ্রিম কোর্টে নীলগিরি অরণ্য ধ্বংস রুখতে একটা মামলা করলেন। মামলা চলাকালীন সুপ্রিম কোর্ট অনেকগুলো নির্দেশ দিল, যার মধ্যে ২০০২ সালে একটা নির্দেশ ছিল রাজ্য সরকারগুলিকে সব বে-দখলকারীদের জঙ্গল থেকে হঠিয়ে দিতে হবে। ১৯২৭-এর আইন বলে সব বনবাসী ও জঙ্গল নির্ভর গ্রামবাসী বেদখলকারি বলে চিহ্নিত ছিল ফলে রাজ সরকারগুলির সুবিধাই হল। এক বিশাল উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়ে গেল। এই উচ্ছেদ অভিযানের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী এক ব্যাপক জনমত তৈরি হয়। সেই জনমতের চাপে শেষপর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার ভারতীয় বনধিকার আইন ২০০৬ পাশ করে, বলা যায় কিছুটা বাধ্য হয়।

স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে গরিবমুখি আইন ও নীতিগুলি নানা অন্তর্ঘাতে দুর্বল ও ধ্বংস করার অনেক কাহিনি আছে। ভূমি সংস্কার থেকে তার শুরু, অরণ্য অধিকার আইনও সেই ধারবাহিকতা বজায় রেখেছে। লেখার বাকি অংশে সেই নাশকতার কাহিনিই বলব।

অরণ্যের অধিকারের বিরুদ্ধে কে বা কারা? মূলত রাজ্য সরকারের আমলাতন্ত্র আর বনজ সামগ্রী নিয়ে ব্যবসা করা কনট্রাক্টরেরা। অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে অরণ্য অধিকারের ব্যাপারে কনট্রাক্টরদের ভূমিকা গৌণ। আমলাতান্ত্রিক নাশকতাই প্রধান অন্তরায়। আমলাতন্ত্রের নাশকতার একটা সুস্পষ্ট নকশা আছে। প্রথমত আইনের ভাষা ও সুর দুটিকেই অস্বীকার করা। যেমন অরণ্য আইনে গ্রাম সভার ধারণা রাজস্ব গ্রাম দিয়ে তৈরি নয়, সামাজিক পরম্পরাগত সীমা দিয়ে তৈরি, পশ্চিমবঙ্গ তা অস্বীকার করল। আবার ঝাড়খণ্ডে, মধ্যপ্রদেশে গ্রাম সভার সচিব করে দেওয়া হল গ্রাম পঞ্চায়েতের সচিবকে যে কিনা সরকারি কর্মচারী এবং সে গ্রাম সভার সদস্যই নয়। গ্রাম সভার সংজ্ঞার সঙ্গেই বিরোধ তৈরি করে দিল আমলাতন্ত্র। ছত্তিসগড়েও তাই হয়েছিল, কিছুদিন আগে তা শুধরেছে। গ্রামের পারম্পরিক সীমা দিয়ে তৈরি হয় কৌম বন অধিকার, কিন্তু একাধিক রাজ্যে বন বিভাগের তৈরি অরণ্যের ম্যাপে যে কম্পারটমেন্ট ভাগ করা আছে, সেই ভাগে ভাগ করে সামুদায়িক বন অধিকার দেওয়া হতে লাগল। এমনকী স্কুল অঙ্গনওয়াড়ি বানানোর জন্য জমি নেবার যে ব্যবস্থা অরণ্য আইনে আছে, তাকেই কৌম বন অধিকার বলে চালিয়ে দেওয়া হল। যে এলাকায় বন বিভাগ গাছ লাগিয়েছে, সেই এলাকা কৌম বন অধিকারের বাইরে রাখা হল। এ ধরণের উদাহরণ অসংখ্য।

আমলাতান্ত্রিক নাশকতার নকশার দ্বিতীয় অঙ্গ হল গা-জোয়ারি। ব্যক্তিগত বা কৌম অধিকারের আবেদন কারণ না দেখিয়েই খারিজ করা। আবেদন মাসের পর মাস বছরের পর বছর ফেলে রাখা, আবেদন গ্রহণ না করা, বা করলেও রসিদ না দেওয়া, যে সাক্ষ্য প্রমাণের দরকার নেই, তা চেয়ে আবেদন ফেরত পাঠানো, কোনো কারণ না দেখিয়েই আবেদনের চেয়ে কম জমির পাট্টা দেওয়া, এমনকী আবেদন হারিয়ে ফেলা, জমির মাপের জন্য বন অধিকার সমিতি ও বন বিভাগ বা রাজস্ব বিভাগের যৌথ ইন্সপেকশনে হাজির না থাকা। এছাড়া ঘুষ চাওয়ার ঘটনা তো আছেই। সারা দেশ থেকে এ সবের অসংখ্য উদাহরণ উঠে আসছে।

তবে আমলাতান্ত্রিক নাশকতার নকশার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল আইন তৈরি করে আইন রূপায়ণের কোনো প্রশাসনিক কাঠামো ও প্রশাসনিক দায়িত্ব তৈরি না করা। অরণ্য অধিকার আইন এনেছে কেন্দ্রীয় সরকারের আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রক। কিন্তু আইন রূপায়ণের জন্য কোনো প্রশাসনিক বাজেট নেই, প্রশাসনিক কাঠামো নেই। আইন রূপায়ণ করতে যে আমলাতন্ত্রকে প্রয়োজন তার প্রশিক্ষণের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেই, তার জন্যও কোনো বাজেট নেই। আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রক মাঝে মাঝে দরকারি গাইডলাইন প্রকাশ করেছে, তার বেশি কিছু নয়। মানে ‘আমরা আইন করে অধিকার দিয়েছি, এবার তোমরা বুঝে নাও’। আদিবাসী এবং পরম্পরাগত বনবাসীরা যারা সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অংশের মধ্যে পড়ে, তারা নাকি আপনা থেকেই আইন ও তার নিয়মাবলী বুঝে, সব রকম অধিকার ও তার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কী লাগবে তা জেনে সেই সব জোগাড়যন্ত্র করে সঠিক ফর্মে সঠিকভাবে আবেদন করবে, ‘আমরা শুধুই সঠিক বেঠিক বিচার করব’।

অরণ্য অধিকার আইনের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক নাশকতার আরও দুটি বিশেষ ছক আছে। ৯০-এর দশকে যে যৌথ ব্যবস্থাপনা সমিতিগুলি গড়ে উঠেছিল, সেগুলি এখনও অনেক জায়গাতেই রয়ে গেছে। এগুলি সবই বন বিভাগের বীট গার্ড ও রেঞ্জারের নিয়ন্ত্রণে। এই সমিতিগুলির কোনো আইনগত ভিত্তি নেই, এবং এগুলির সঙ্গে গ্রাম ও গ্রাম সভার কোনো সম্পর্ক নেই। তুলনায় বন অধিকার সমিতি ও সামুদায়িক বন অধিকার পাট্টা পাবার পর বনজ সম্পদ ব্যবস্থাপনা সমিতিগুলি আইনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত, গ্রাম সভাও তাই। কিন্তু বন বিভাগ গায়ের জোরে যৌথ ব্যবস্থাপনা সমিতিগুলিকেই মান্যতা দিয়েছে - এর প্রমাণ সারা দেশে ভুরি ভুরি। এর ফলে যৌথ ব্যবস্থাপনা সমিতি আর গ্রাম সভার মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে, যার পিছনে রয়েছে বনবিভাগ।

দ্বিতীয় বিশেষ ছকটি হল ব্যক্তিগত বন অধিকার কিছুটা পরিমাণে স্বীকার করা কিন্তু সামুদায়িক বন অধিকার স্বীকার না করা। পশ্চিমবঙ্গ সহ প্রায় ১১টি রাজ্যে এই বিশেষ ঘটনা দেখা যাচ্ছে। কৌম বন অধিকার স্বীকার না করার বিশেষ কারণ, তাতে বন বিভাগের একচেটিয়া আধিপত্যের অবসান ঘটবে। তাই মূলত বন বিভাগের আপত্তিতে সামুদায়িক বন অধিকারের আবেদন গ্রহণ করা হচ্ছে না, অথবা নাকচ করা হচ্ছে।

আমলাতান্ত্রিক নাশকতার যে কাহিনি এখানে তুলে ধরলাম তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম হল মহারাষ্ট্রের পঞ্চগাও, মেন্ধালেখা, মেলঘাট, কোরচি ইত্যাদি গ্রামের কাহিনি। ব্যতিক্রম আরও আছে। ছত্তিসগড়ের ধমতেরি জেলায় দেশের প্রথম শহরি অরণ্যের উপর কৌম বন অধিকার পাট্টা দেওয়া হয়েছে। ছত্তিসগড়েরই জিপিএম জেলায় বাইগা সম্প্রদায়ের মানুষেরা কৃষিপূর্ব জমানার মানুষ, তাঁরা বিভিন্ন দিকে ঘুরে ঘুরে খাবার সংগ্রহ করেন, সেটাই জীবিকা। সেই সমস্ত অঞ্চলগুলির উপর তাঁদের বাস্তুতান্ত্রিক অধিকার (Habitat Rights) স্বীকৃত হয়েছে। মধ্যপ্রদেশেও ভারিয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরাও তাঁদের বাস্তুতান্ত্রিক অধিকার পেয়েছেন। উড়িষ্যার সরকার নিজেদের উদ্যোগে বন অধিকার রুপায়ণের উদ্দেশ্যে একটি রাজ্য সরকারের যোজনা ঘোষণা করেছে, তাতে ৩৯ কোটি টাকা এই বছর বরাদ্দ করেছে। যদিও এই উড়িষ্যাতেই সিমলিপাল টাইগার রিজার্ভ-এ ২০১৮ থেকে মাঙ্কিড়িয়া আদিম জনজাতির বাস্তুতান্ত্রিক অধিকার স্বীকৃত হয়ে এখনো কাগজ পাবার অপেক্ষায়।

সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে ১৭ সাল বাদে, ১০ কোটি একর অরণ্যের উপর অধিকারের মধ্যে মাত্র ১ কোটি ৩০ লক্ষ একর স্বীকৃত হয়েছে, যদিও এই তথ্যের মধ্যেও প্রায় ২০ ভাগ ভেজাল আছে, কারণ স্কুল অঙ্গনওয়াড়ি, মোবাইল টাওয়ার ইত্যাদির জন্য দেওয়া জমিকেও কৌম অধিকার বলে চালানো হয়েছে। অন্য দিকে ব্যক্তিগত বন অধিকার পেয়েছেন ৩ কোটি পরিবারের মধ্যে মাত্র ৪৩ লক্ষ পরিবার। দেশের ৭৫টি আদিম জনজাতির মধ্যে মাত্র দুটি সম্প্রদায়ের ভাগ্যে বাস্তুতান্ত্রিক অধিকার জুটেছে।

পঞ্চগাওতেই ফিরে আসি। সেখানকার অধিবাসীরা দেখিয়েছেন কী করে জীবন ও জীবিকার সম্পদের উপর স্থানীয় মানুষ গণতান্ত্রিক উপায়ে শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, রাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়াই। আর অরণ্য অধিকার আইনের ১৭ বছরের রূপায়ণের অভিজ্ঞতা দেখাচ্ছে, কী করে আমলাতন্ত্র পরিকল্পিত নাশকতায় সেই গণতান্ত্রিক সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করতে পারে।