আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ চতুর্বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২৩ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন


নভেম্বর মাসে ভারতের ৫টি রাজ্য রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গানা ও মিজোরামের বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই নির্বাচনকে ২০২৪-এর আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের সেমিফাইনাল বলে রাজনৈতিক মহল দাবি করছিল। দেশের শাসক থেকে বিরোধী দল সবাই এই পাঁচ রাজ্যের ফলাফলকে খুব গুরুত্ব নিয়ে দেখছিল। মনে করা হচ্ছিল যে এই পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল আগামী লোকসভা নির্বাচনে কোন পক্ষ জয়ী হবে তার একটা দিকনির্দেশ হবে। একদিকে বিজেপি অন্যদিকে বিরোধীদের তথাকথিত জোট ইন্ডিয়ার সম্মুখ লড়াই হিসাবে এই নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে ইন্ডিয়া জোট এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি, তবুও এই জোটের বৃহত্তম শরিক জাতীয় কংগ্রেস এই নির্বাচনে বিজেপির মুখ্য প্রতিপক্ষ ছিল। নির্বাচনী ফলাফল জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষে গেলে অবশ্যই লোকসভা ভোটের আগে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের ভিতর তাদের স্বর মুখ্য হতো এবং তাদের নেতৃত্ব আরও পোক্ত হত। কিন্তু নির্বাচনী ফলাফলে ৩টি রাজ্যে বিজেপির কাছে কংগ্রেসের পরাজয় অনেক প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।

পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফলে দেখা যাচ্ছে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে বিজেপি সরাসরি জাতীয় কংগ্রেসকে পরাজিত করে বিধানসভায় জয়লাভ করেছে। এর মধ্যে রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ের ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। অন্যদিকে মধ্যপ্রদেশে ২০১৮-তে নির্বাচনে কংগ্রেস জয়লাভ করে সরকার গঠন করলেও পরে বিজেপি বিধায়ক কেনাবেচার মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা দখল করে। তেলেঙ্গানায় কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকা 'ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সমিতি'কে হারিয়ে ক্ষমতা দখল করতে পেরেছে। মিজোরামে কংগ্রেসের ভোট শতাংশ কমেছে এবং 'জোরাম পিপলস মুভমেন্ট' ক্ষমতায় এসেছে এমএনএফ-কে হারিয়ে। মোদ্দা হিসাবে জাতীয় কংগ্রেস মুখোমুখি লড়াইয়ে বিজেপির কাছে পরাজিত হয়েছে। হিন্দী বলয়ের রাজ্যে নির্বাচনী লড়াইয়ে কংগ্রেস এখনও বিজেপির থেকে পিছিয়ে। এই প্রেক্ষিতেই বিজেপি শিবির দাবি করছে যে এই তিন রাজ্যের জয় আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির লাগাতার তৃতীয় জয়ের সূচক। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একে 'মোদীর নেতৃত্বের জয়' বলে আখ্যা দিচ্ছেন। কিন্তু নির্বাচনী ফলাফলের সংখ্যাতত্ত্ব এই সরলীকরণকে সমর্থন করছে?

জাতীয় নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত ফল অনুযায়ী ২০২৩-এর বিধানসভা নির্বাচনে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট যথাক্রমে ৪৮.৬৯%, ৪১.৬৯% এবং ৪৬.৩%। অন্যদিকে এই তিন রাজ্যে কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোট যথাক্রমে ৪০.০৪%, ৩৯.৫৩% ও ৪২.২%। অন্যদিকে ২০১৮-র বিধানসভা নির্বাচনে এই তিন রাজ্যে বিজেপির ভোট ছিল যথাক্রমে ৪১.০২%, ৩৮.৭৭% এবং ৩২.৯৭% আর কংগ্রেসের ছিল যথাক্রমে ৪০.৮৯%, ৩৯.৩% এবং ৪৩.০৪%। রাজ্য ও স্থানীয় দল এবং নির্দল মিলিয়ে এই তিন রাজ্যে ২০১৮ সালে ভোট ছিল যথাক্রমে ১৬.৬৬%, ২০.৬৩% এবং ২২.০২% যা ২০২৩-এ কমে হয়েছে ১১.১%, ১৮.৮% এবং ১১.৫%। মধ্যপ্রদেশে ২০১৮-তে বিজেপি জিতেছিল ১০৯টি আসনে যা এবার বেড়ে হয়েছে ১৬৩। রাজস্থানে ২০১৮-তে বিজেপি জিতেছিল ৭৩টি আসনে যা এবার বেড়ে হয়েছে ১১৫টি আর ছত্তিশগড়ে বিজেপির আসন ১৫ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৪। কংগ্রেসের মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে আসন কমেছে যথাক্রমে ১১৪ থেকে ৬৬, ১০০ থেকে ৬৯ এবং ৬৮ থেকে ৩৫। তেলেঙ্গানার কংগ্রেসের ভোট বেড়েছে প্রায় ১১% যার ফলে এখানে কংগ্রেসের আসন বেড়েছে ৪৯টি।

ফলাফলের বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ আর ছত্তিশগড়ে কংগ্রেসের ভোট শতাংশের পরিবর্তন ১%-এরও কম। অন্যদিকে এই তিন রাজ্যে বিজেপির ভোট শতাংশ বেড়েছে প্রায় যথাক্রমে ২.৯২%, ৭.৫৮% এবং ১৩.৩৩%। এই বাড়তি ভোট বিজেপির এসেছে প্রায় পুরোটাই ছোট ছোট রাজ্যভিত্তিক দল ও নির্দলদের থেকে। এই অংশের ভোট প্রায় পুরোটাই বিজেপি নিজের দিকে টেনে নিতে পেরেছে। তার বিপরীতে কংগ্রেস নিজের ভোট ২০১৮-র তুলনায় ধরে রাখতে পারলেও অন্য দলগুলোর বা দোদুল্যমান ভোটারদের নিজেদের দিকে আনতে পারেনি। তেলেঙ্গানায় কংগ্রেসের ভোট বেড়েছে ভারতীয় রাষ্ট্র সমিতির ভোটের বিনিময়ে। উল্লেখযোগ্য এখানে বিজেপি ক্ষমতা দখলের দাবিদার না হওয়া সত্ত্বেও তাদের ভোট বেড়ে প্রায় ৭%-এ পৌঁছেছে। ফলে দক্ষিণাত্যে বিজেপি জমি পাচ্ছে না বললেও তাদের ভোট কিন্তু বাড়ছে।

ইতিমধ্যেই বহু বিশেষজ্ঞ হিন্দী বলয়ের তিন রাজ্যে বিজেপি ও কংগ্রেসের ভোট কেন এরকম হল তার নানারকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। একথা অনস্বীকার্য যে কোনো একটি বা দুটি নয়, একাধিক কারণেই কংগ্রেসের পক্ষে নির্বাচনী ফলাফল হয়নি। অতিরিক্ত খুটিনাটিতে না ঢুকে এটা বলা যায়, কংগ্রেসের এই বিপর্যয়ের মূল কারণ হল তাদের রাজনৈতিক অস্বচ্ছতা। একদিকে যখন গোটা দেশে কংগ্রেসের নেতৃত্ব, রাহুল গান্ধী জাতিভিত্তিক জনগণনা করতে হবে বলে দাবি তুলছেন তখন রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে বিগত পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকেও তারা এসব করেননি। কেবল ভোটের আগে এসে এই দাবি তুললে তাকে সহজেই ভোট কুড়ানোর কৌশল বলে মানুষ চিহ্নিত করেছে এবং নরেন্দ্র মোদী বারবার ভোট প্রচারে ঠিক এই কথাটাই বলে গেছেন। এছাড়াও মধ্যপ্রদেশ বা ছত্তিশগড়ে কংগ্রেসের স্থানীয় নেতৃত্ব একদিকে নরম হিন্দুত্ব এবং অন্যদিকে জনগণের জন্য কিছু অনুদান ঘোষণা, এই কৌশলেই প্রচার চালিয়েছেন। বিজেপি তাদের প্রচারে এইগুলোকেই আরও বেশি মাত্রায় ঘোষণা করেছে ফলে মানুষ কংগ্রেস এবং বিজেপিকে আলাদা করতে পারেনি। যেখানে সুবিধা বেশী পাওয়া যাবে সেখানেই ভোট দিয়েছেন।

কিন্তু প্রশ্ন হল এই নির্বাচনী ফলাফল কি ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলকেই ইঙ্গিত করছে। এমনটা ভেবে মুষড়ে পড়ার কোনো কারণ নেই। এই তিন রাজ্যে জিতলেই যে লোকসভার নিয়ন্ত্রণ হাতে এসে পড়বে এমন কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। কিন্তু যে কথাটি কংগ্রেস সহ বিরোধী জোট তথা ইন্ডিয়ার বোঝা উচিত যে তাদের রাজনৈতিক কৌশল যদি এমন ধারাই হয়ে থাকে তাহলে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির জয় শুধু সময়ের অপেক্ষা। এই নির্বাচন যে শিক্ষা দিয়ে গেল তা হল বিরোধীদের নিজেদের ভেতর এখনো অবধি কোন নির্বাচনী সমঝোতার কৌশল নেই। তারা বড় বড় সাংবাদিক বৈঠক করলেও বাস্তবের মাটিতে তারা আদতে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং এককভাবে বিজেপিকে ঠেকানোর রাজনৈতিক ক্ষমতা তাদের নেই। এই তিন রাজ্যে যদি কংগ্রেস তাদের ইন্ডিয়া জোটের শরিকদের সাথে সমঝোতায় আসত তাহলে হয়ত তাদের নিজস্ব ভোট ধরে রাখতে পারত যা আদতে বিজেপির ভোট বৃদ্ধিকে রুখতে পারত। কিন্তু কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এর উল্টো বার্তাই দেওয়া হয়েছে গোটা নির্বাচনে।

আবার এটাও সত্যি যে কংগ্রেসের এই বিপর্যয়ে ইন্ডিয়ার বাকি দলগুলির ভেতর যারা নিজেদের রাজ্যে যথেষ্ট শক্তিশালী, বিশেষত এ রাজ্যে তৃণমূল তারা খানিক খুশি। তারা ভাবছেন এই সুযোগে জোটের ভেতর তাদের নেতৃত্বর একটু দর বাড়বে। ঠিক এটাই এই বিরোধী জোটের সবচাইতে বড় সমস্যা। সামনে এই জোটের সব নেতৃত্বই বলেন তাদের বিজেপিকে হারানো ছাড়া আর কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। অথচ নিজেদের রাজ্যে তারা অন্য শরিকদের এতটুকু জায়গা ছাড়তে রাজি নন। ফলে এই বিজেপি বিরোধী জোট আদতে একটি সোনার পাথরবাটি ভিন্ন কিছু নয়। এই পরিস্থিতিতে একটি কার্যকরী বিজেপি বিরোধী জোট যদি সত্যিই গড়ে তুলতে হয় তাহলে আগে একটি নীতিগত ঐক্য তাদের তৈরী করতে হবে। আসন সমঝোতার একটি নির্দিষ্ট ভিত্তি তাদের প্রস্তুত করতে হবে এবং তার প্রতি সৎ থাকতে হবে। বিজেপি বিরোধী সমস্ত রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনকে এই জোটের অন্তর্ভুক্ত করে এর প্রসারকে আরও ব্যাপক করতে হবে এবং সর্বোপরি বিজেপির রাজনীতির বিরূদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ভাষ্য নির্মাণ করতে হবে। তবেই তারা আসন্ন লড়াইতে বিজেপিকে হারাতে পারবেন। ভাবের ঘরে চুরি করে এই লড়াই জেতা যাবেনা।