আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ চতুর্বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২৩ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

সুপ্রিম কোর্ট, সংবিধান ও ৩৭০ ধারা


২০১৯ সালের ৫ই আগস্ট ভারত সরকার সংসদে কাশ্মীরের জন্য প্রযোজ্য সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে। স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একাধিক ব্যক্তি তথা সংগঠন সুপ্রিম কোর্টের কাছে আর্জি জানান যে সরকারের এই সিদ্ধান্ত অসাংবিধানিক। বিশেষ করে যে প্রক্রিয়ায়  এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং যেভাবে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে রাতারাতি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পর্যবসিত করা হয়েছে তা অগণতান্ত্রিক এবং অসাংবিধানিক এই দাবি জানানো হয় মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে। আদালত এই সমস্ত মামলাগুলিকে বাতিল করেছে এবং জানিয়েছে যে সরকার যা করেছে তা সাংবিধানিকভাবেই করেছে।

অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে এবং মহামান্য বিচারপতিদের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখে আমরা বলতে চাই যে সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে এই সম্পাদকীয় একমত নয়। শুধু তাই নয়, আমরা মনে করি এই রায় দেশের সাংবিধানিক কাঠামোকে দুর্বল করবে।

এই অসহমত প্রকাশ করার নানা কারণ রয়েছে। প্রথমত, সংবিধানের ৩৭০ ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিজেই ৩৭০ ধারাকে রদ করতে পারেন যদি জম্মু ও কাশ্মীরের সংবিধান পরিষদ রাষ্ট্রপতিকে সেই সুপারিশ করে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে বহুবছর আগেই এই সংবিধান পরিষদের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। তাহলে কি ৩৭০ ধারা সংবিধানের একটি স্থায়ী ধারা হিসেবে স্বীকৃতি পাবে? সুপ্রিম কোর্টের মতে না। অনেকের মতে এই মতটি সঠিক। সংবিধানের যেকোনো ধারাকেই পরিবর্তন বা সংশোধন করা যেতে পারে, সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে। বিজেপির সেই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। অতএব কেন্দ্রীয় সরকার একটি জটিল প্রক্রিয়ার অবলম্বন নেয়। একটি সরকারি আদেশনামার মাধ্যমে প্রথমে ৩৭০ ধারায় বর্ণিত জম্মু ও কাশ্মীরের সংবিধান পরিষদের পরিবর্তে জম্মু ও কাশ্মীরের 'বিধানসভা' শব্দটি প্রতিস্থাপন করা হয়। কিন্তু সেই সময় জম্মু ও কাশ্মীরে কোনো বিধানসভা ছিল না, কারণ রাজ্যটি রাষ্ট্রপতি শাসনাধীন ছিল। অতএব বিধানসভার সুপারিশ করার প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে কী করণীয়? এখানে কেন্দ্রীয় সরকার এক মারাত্মক নীতি গ্রহণ করে। যেহেতু রাজ্যটি রাষ্ট্রপতি শাসনাধীন রয়েছে, অতএব সংসদই রাজ্য বিধানসভার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যপাল ৩৭০ ধারা রদের সুপারিশ করেন এবং সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তা পাশ হয়ে যায়। 

মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট এই প্রশ্নে মূলত দুটি কথা বলেছেন। প্রথমত বলা হয়েছে যে সরকারি আদেশনামা ব্যবহার করে জম্মু ও কাশ্মীর সংবিধান পরিষদের পরিবর্তে 'বিধানসভা' শব্দটি সংযোজন করার প্রক্রিয়াটি ভুল ছিল। কিন্তু তাই বলে ৩৭০ ধারার রদ করার বিষয়টি অসাংবিধানিক হয়ে যায় না। কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তরে সুপ্রিম কোর্ট  জানিয়েছে যে কোন রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন চলাকালীন সংসদ সেই রাজ্য সংক্রান্ত যেকোনো আইন পাশ করতে পারে। এমনকি রাজ্যটির মৌলিক চরিত্রে স্থায়ী পরিবর্তন হতে পারে এমন আইন অথবা নীতি গ্রহণ করার অধিকার সংসদের রয়েছে। অতএব জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা না থাকলেও কেন্দ্রীয় সরকার একচেটিয়াভাবে রাজ্য সংক্রান্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে, তাই ৩৭০ ধারার মতো বিশেষ আইনও বাতিল করতে পারে, এর জন্য কেন্দ্র সরকারকে রাজ্যের মানুষ বা তাদের প্রতিনিধির মতামত জানার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। 

মুশকিল হচ্ছে যে ভারতের সংবিধানে দেশটিকে একটি যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট এর আগে এই কথাও বলেছেন যে ভারতের সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্যের একটি স্তম্ভ হল যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। সুপ্রিম কোর্ট বহু বছর আগেই এই রায় দিয়েছে যে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন করা যাবে না, এমনকি সংবিধান সংশোধন করেও নয়। কিন্তু এই রায় কেন্দ্রীয় সরকারকে এই অধিকার দিচ্ছে যেকোনো রাজ্যে ৩৫৬ ধারা জারি করে বিধানসভা ভঙ্গ করে তারপরে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সেই রাজ্যের চরিত্রকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করার। ভারতের সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিতরেও কেন্দ্রীয় সরকারকে অধিক ক্ষমতা দেওয়া আছে। কিন্তু এই রায় সেই ক্ষমতার ভরকেন্দ্রকে কেন্দ্র সরকারের দিকে এতটাই ঠেলে দিল যে এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান রায় কি সেই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপরেই আঘাত হানছে না? 

এই প্রশ্নটি আরও বেশি করে ওঠে কারণ জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যটিকে সরকার দুটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত করেছে। এর আগে বহু কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলকে রাজ্যে রূপান্তরিত করা হয়েছে। কিন্তু কোনো রাজ্যকে ভেঙ্গে টুকরো করে সেই টুকরোগুলিকে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত করা হল প্রথম জম্মু ও কাশ্মীরে। ভারতের সংবিধানে রাজ্যের সীমানা পরিবর্তন বা রাজ্য ভেঙ্গে অন্য রাজ্য করার প্রক্রিয়া বর্ণিত রয়েছে সংবিধানের ৩ নম্বর ধারায়। জম্মু ও কাশ্মীরকে যেভাবে ভাগ করা হয়েছে এবং কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পর্যবসিত করা হয়েছে তা সংবিধান সম্মত কি না, এই প্রশ্ন রাখা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের সামনে। কিন্তু খুব অদ্ভুতভাবে মাননীয় বিচারপতিরা এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজেননি। তাঁরা জানিয়েছেন যে কেন্দ্রীয় সরকার আদালতে জানিয়েছে যে জম্মু ও কাশ্মীরকে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল হিসেবে রাখা সাময়িক। সরকার তার রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেবে। শুধুমাত্র এই আশ্বাসের উপরে ভরসা রেখেছেন মাননীয় বিচারপতিরা। তাই রাজ্য ভাগ্যের প্রক্রিয়াটি সংবিধান সম্মত ছিল কি না, সেই প্রশ্নের বিচার করেননি। কিন্তু এই নীরবতা প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। একটি প্রক্রিয়া সাংবিধানিক না অসাংবিধানিক তা নির্ধারণ না করে, শুধুমাত্র যারা প্রক্রিয়াটি ঘটালো, তাদের কথায় ভরসা রাখা যায়? রাজ্য ভাগ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের এই অবস্থান অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। যদি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রশ্নে দেশের সর্বোচ্চ আদালত মৌনতা অবলম্বন করে, তাহলে সংবিধান বর্ণিত যেই দায়িত্ব কোর্টকে দেওয়া আছে তাকে অমান্য করা হয় না কি? 

সুপ্রিম কোর্ট তথা ভারতের সংবিধানের বিশেষজ্ঞরা তাদের পর্যবেক্ষণে এবং বহু আলোচনায় দেখিয়েছেন যে যখন ভারতে একটি কোনো দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সংসদে থাকে তখন সুপ্রিম কোর্ট সাধারণত সরকারের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্নে বিরূপ রায় দেয় না। তাই বর্তমান ভারতে যেখানে বিজেপি-র জয়ের রথ থামছেই না, সেখানে সুপ্রিম কোর্ট যে ৩৭০ ধারা বাতিলের বিরুদ্ধে রায় দেবে না সেকথা মোটামুটি জানাই ছিল। কিন্তু নিজেদের অবস্থানকে ব্যাখ্যা করতে এবং তাকে ন্যায়ের যুক্তি দিয়ে দাঁড় করাতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উপর একটি আঘাত হানল এই কথা অনেক সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও বলছেন। 

বর্তমানে বিজেপির বিভিন্ন নেতা এবং প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি বারবার বলে চলেছেন যে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে পরিবর্তন করা যাবে না বলে সুপ্রিম কোর্টের যেই রায় রয়েছে, তা ঠিক নয়। এদের মতে দেশের সংসদ শেষ কথা বলবে, এবং তা যদি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর বিরুদ্ধে যায় তাহলেও সুপ্রিম কোর্ট সহ সবাইকেই তা মানতে হবে কারণ সংসদে আইন পাশ হয়েছে। 

সুপ্রিম কোর্ট এখন অবধি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে রক্ষা করার যেই রায় তার বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান নেয়নি। কিন্তু ২০১৯ সালে যেখানে বাবরি মসজিদের জমি হিন্দুদের দিয়ে দেওয়া হল রাম মন্দির তৈরি করার জন্য, যেখানে সুপ্রিম কোর্ট নিজে মানছে যে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা অন্যায় হয়েছিল, তা কি ভারতের যে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ, তার বিরুদ্ধে যায় না? ধর্মনিরপেক্ষতা যেখানে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ সেখানে সুপ্রিম কোর্ট মসজিদের ধ্বংসস্তুপের ওপর মন্দির তৈরি করার অনুমতি দিলেন কী করে? তেমনি, কাশ্মীরকে ভেঙ্গে টুকরো করা এবং কাশ্মীরের মানুষের রায়কে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ৩৭০ ধারা বাতিল করা কি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা যা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ তার বিরুদ্ধে যায় না? তাহলে কি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে সংবিধান সংশোধন না করে, অন্য উপায়ে বদলিয়ে ফেলার যে রাজনীতি, সুপ্রিম কোর্ট কি তাকেই মান্যতা দিচ্ছেন না? 

এই প্রশ্নগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুপ্রিম কোর্টের ৩৭০ ধারা সম্পর্কিত রায় দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করার দরজা খুলে দিচ্ছে। বিজেপি-সরকার তথা তাদের সমর্থকরা এই রায়ের ফলে স্বাভাবিকভাবেই খুশি। কিন্তু দেশের সাংবিধানিক মৌলিক কাঠামো এই রায়ের ফলে যে দুর্বল হল তার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব থাকবে। দেশে কেন্দ্রিকতার প্রবণতাকে সীলমোহর দিলেন মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট। এই কেন্দ্রিকতা গণতন্ত্রকে দুর্বল করবে। ফলত, গণতান্ত্রিক তথা প্রগতিশীল শক্তিসমূহের কাজ আরও কঠিন হয়ে পড়ল।