আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২৩ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

ভারতীয় ন্যায় সংহিতাঃ একনায়কতন্ত্রের পথে আর একটি পদক্ষেপ

প্রণব কান্তি বসু


ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো আজ বিপন্ন। হিন্দুত্ববাদের আবেদন এবং এই মৌলবাদী পুরুষতন্ত্রের প্রতিভূ হিসাবে মোদীর জনমোহিনী (পপুলিস্ট) আবেদনে ভর করে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর থেকে, বিশেষ করে ২০১৯ থেকে, গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ক্রমশ একনায়কতন্ত্রে রূপান্তরিত করার চেষ্টা চলছে। এর বিষদ আলোচনা আমি অন্যত্র করেছি (‘নাগরিকত্ব ও হিন্দুত্ব’, 'অনীক', ডিসেম্বর, ২০২০; ‘বর্তমান শাসন ব্যবস্থা কি ফ্যাসিবাদী?’, 'অনীক', মার্চ, ২০২১; ‘উত্তর উপনিবেশিক ভারত ও হিন্দুত্ব’, 'অনীক', অক্টোবর, ২০২৩)। এখানে আমরা বোঝার চেষ্টা করব গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের ক্ষেত্রে সংসদের অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করছে যে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (সংক্ষেপে বিএনএস) তার কি তাৎপর্য।

বিএনএস বিল, ২০২৩, অনেক ক্ষেত্রেই ভারতীয় দণ্ডবিধি (ইন্ডিয়ান পীনাল কোড) ১৮৬০-এর ধারাগুলিকে প্রায় হুবহু অনুসরণ করেছে। কিন্তু, বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে দণ্ডবিধির গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, যৌন অপরাধ, গণপিটুনি ইত্যাদি এগারোটি ক্ষেত্রে বিএনএস আইন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার প্রস্তাব করেছে। এগুলির মধ্যে আমরা আলোচনা করব তিনটি আইনি ক্ষেত্র নিয়ে: নাশকতা বা সন্ত্রাসমূলক কাজ; ভারতের সার্বভৌমত্ব, ঐক্য ও অখণ্ডতা বিপন্নকারী কাজ আর ভারতের সার্বভৌমত্ব, ঐক্য আর অখণ্ডতা বিপন্ন করে এমন ভুয়ো এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন।

বিএনএস-এর ১১১ ধারা আনলফুল অ্যাকটিভিটিস প্রিভেনশন অ্যাক্ট (সংক্ষেপে ইউএপিএ)-এর কতগুলি ধারার পরিবর্ত হিসাবে প্রস্তাব করা হয়েছে। ইউএপিএ-এর ঘোষিত লক্ষ্য হল সন্ত্রাসবাদী কাজ বা সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিশেষ সাজার ব্যবস্থা করা। ইউএপিএ-এর সংজ্ঞা অনুসারে 'সন্ত্রাসবাদী কাজ' বলে কোন কাজকে চিহ্নিত করা যায় যদি তার উদ্দেশ্য হয় ‘রাষ্ট্রের একতা, সুরক্ষা, অর্থনৈতিক সুরক্ষা অথবা সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করা অথবা জনমানসে আতঙ্ক সৃষ্টি করা’। বিএনএস-এর ১১১ ধারা অনুসারে সন্ত্রাসবাদী কাজের উদ্দেশ্য ‘ভারতের একতা, অখণ্ডতা এবং সুরক্ষাকে বিপন্ন করা, সাধারণ জনতাকে ভীতি প্রদর্শন করা অথবা সাধারণ জনজীবনে অস্থিরতা সৃষ্টি করা’। অর্থাৎ, সন্ত্রাসবাদী কাজের পরিধিতে এখন এমন অনেক আন্দোলন অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব যা ইউএপিএ-এর সংজ্ঞায় সম্ভব ছিল না। স্ট্রাইক, ধর্না, বনধ ইত্যাদি, অবশ্যই কোনো না কোনোভাবে জনজীবনে অস্থিরতা আনে। আর ‘ভীতি প্রদর্শন’ ‘আতঙ্ক সৃষ্টির’ থেকে অনেক জোলো। আইনে পরিণত হলে, ক্ষমতাসীন দল খুশি মতো এই ধারার অপপ্রয়োগ করে যে কোনো বিরোধী আন্দোলনকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে দেগে দিতে পারে।

নতুন ধারায় ‘সাধারণের ব্যবহার্য ফ্যাসিলিটি (বা সম্পদ) অথবা ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিনষ্ট করা’ সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, ইউএপিএ-র তুলনীয় ধারায় শুধুমাত্র সরকারের ব্যবহার্য সম্পত্তি ধ্বংসকে সন্ত্রাসবাদী কাজ বলে ধরা হয়। ফলে, নতুন ধারা লাগু হলে সাধারণ জনতার মিছিল যদি প্ররোচিত করা যায় ঢিল ছুঁড়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তিহানি করতে, তাহলে আন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিয়ে দমন করা সম্ভব। ‘রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অথবা সামাজিক কাঠামোতে অস্থিরতা আনে অথবা ধ্বংস করে’ এমন কাজও এই ধারার আওতায় আনা হয়েছে। এই সংযোজনের অর্থ অস্পষ্ট কারণ সামাজিক অস্থিরতা বিষয়টি সাবজেটিভ বা ব্যক্তিগত বিচার বিবেচনা সাপেক্ষ। আশঙ্কা করা যায় যে এই ধারা প্রয়োগ করে, প্রতিবাদের নানা প্রচলিত অহিংস আঙ্গিক সন্ত্রাসবাদী বলে দণ্ডনীয় অপরাধের তকমা লাগিয়ে দমন করা হবে।

‘সন্ত্রাসবাদী সংগঠন’-এর সংজ্ঞা যেহেতু ‘সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ’-এর সংজ্ঞার সঙ্গে যুক্ত, সেহেতু সন্ত্রাসবাদী কাজের ব্যাপ্তি বাড়ানোর ফলে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের আওতায় অনেক বেশী সংখ্যক সংগঠনকে আনা সম্ভব হবে। শ্রমিক সংগঠন, কৃষক সংগঠন - এ সমস্ত সংগঠনকেই সরকার 'সন্ত্রাসবাদী' বলে ঘোষণা করতে পারে। এছাড়া ইউএপিএ-র অধীনে কোন সংস্থাকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে চিহ্নিত করার ক্ষমতা ন্যস্ত ছিল শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর এবং এর পুনর্বিবেচনা ও প্রত্যাহারেরও ব্যবস্থা ছিল। বিএনএসের ধারাতে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন চিহ্নিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পুলিসকে এবং এর পুনর্বিবেচনা কোনো ব্যবস্থা নেই।

অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে 'সন্ত্রাসবাদী' কাজ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে সে সমস্ত কাজ যা ‘অস্ত্র, বিস্ফোরক ব্যবহার করে, অথবা যার ফলে পারমাণবিক অথবা অন্য বিপজ্জনক পদার্থ নির্গত হয়, অথবা অগ্নিকাণ্ড, বন্যা বা বিস্ফোরণ ঘটায়’। এখানে উদ্দেশ্যের কোন উল্লেখ নেই। অর্থাৎ, ভুল বা যান্ত্রিক ত্রুটির জন্যও এমন ঘটলে ঘটনাটি 'সন্ত্রাসবাদী' বলে চিহ্নিত হবে। এমন অযৌক্তিকভাবে ধারাটির সম্প্রসারণের গূঢ় মতলব বোঝা কঠিন, তবে এটুকু স্পষ্ট যে একটি আতঙ্কের বাতাবরণ সৃষ্টি হবে, যার ফলে সাধারণ কর্মীকে সরকারের বশংবদ করে রাখা যাবে।

সন্ত্রাসবাদী কাজ চিহ্নিত করার প্রক্রিয়ায় যে সমস্ত রক্ষাকবচ ছিল সেগুলি বিএসএন-এ অনুপস্থিত। প্রথমত, পুরোনো আইন মতো সন্ত্রাসবাদী কাজ অনুসন্ধান করার দায়িত্ব শুধুমাত্র বরিষ্ঠ পুলিস আধিকারিককে দেওয়া যেত, এবং তদন্ত রিপোর্ট কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার পর্যালোচনা করে ঠিক করত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার কি না। এ সমস্ত নিয়মাবলী বিএনএস-এ অনুপস্থিত।

সেডিশন বা 'রাষ্ট্রদ্রোহিতা'র সংজ্ঞা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ও সুপ্রিম কোর্ট-এর মধ্যে দীর্ঘদিন টানা-পোড়েন চলছে। একটি মামলায়, যেমন, সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট বলে যে ‘খালিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দেওয়া সিডিশন বলে গণ্য হবে না (বলওয়ান্ত সিং বনাম পঞ্জাব সরকার) যদি না এর ফলে জনজীবন ব্যাহত হয়েছে এবং হিংসায় প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে প্রমাণ করা যায়। 'রাষ্ট্রদ্রোহী' বলে যে সমস্ত কাজ আগে চিহ্নিত হতো সে সব কাজকেই বিএসএন ১৫০ ধারায় বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ শব্দটি ব্যবহার না করেই। অর্থাৎ, আদালত কোনো কাজ বা আন্দোলনকে রাষ্ট্রদ্রোহী মনে না করলেও তা এখন, বকলমে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসাবেই দণ্ডনীয় হবে। বর্তমান আইন অনুসারে রাষ্ট্রদ্রোহিতার নিশানা সরকার; বিএনএস-এর ১৫০ ধারায় সরকারের বদলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার নিশানা হিসাবে দেশ (নেশন)-কে চিহ্নিত করা হয়েছে। নেশন একটি ধারণা যার কার্যকারী ব্যাখ্যা অসম্ভব। সুতরাং, নেশন-এর বিরোধিতার অর্থের কোন স্বচ্ছ ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। আমরা স্মরণ করতে পারি যে নেশন একটি পাশ্চাত্য ধারণা যার অস্তিত্ব আমাদের সামাজিক মানসে অনুপস্থিত বলে রবীন্দ্রনাথ দাবি করেছিলেন। তাহলে এই পরিবর্তনের তাৎপর্য কি? নেশনের তুলনায় সরকার অনেক বাস্তব সত্তা, কিন্তু তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইনের পরিপ্রেক্ষিতে (আইপিসি-এর ১২৪এ) সরকারের সংজ্ঞা নিয়ে বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আদালতের বিস্তর বাকবিতণ্ডা হয়েছে। এর থেকেই অনুমান করা যায় যে বিএনএস-এ সরকারের বদলে নেশনের ধারণা এনে মোদী সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইন স্বচ্ছ বা সহজবোধ্য করতে মোটেই আগ্রহী নয়, বরঞ্চ এর ব্যাখ্যার জটিলতা আরও বাড়িয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে সমস্ত আন্দোলনকে সে প্রতিহত করতে চায় দেশদ্রোহিতার আইনের অপপ্রয়োগের খাড়া মাথার ওপর ঝুলিয়ে রেখে। রাষ্ট্রের পরিবর্তে নেশন-এর উল্লেখ করার আড়ালে আরও গভীর অভিসন্ধি থাকতে পারে। মোদী ক্ষমতায় এসেছে এবং শত অপশাসন, বেকারত্ব বৃদ্ধি, সাধারণের আর্থিক দুর্গতি, মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি সত্ত্বেও ক্ষমতায় টিকে আছে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে। ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির বহুত্ববাদকে মান্যতা দিয়েই স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্র কাঠামো, তার সংবিধান গঠিত হয়। কংগ্রেস পার্টিও কোনো নির্দিষ্ট একমাত্রিক জাতিবোধ বা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিল না। কংগ্রেস নানা মতের স্বাধীনতাকামী জনসমষ্টির মিলনক্ষেত্র ছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় হিন্দুত্ববাদের জন্ম - যা সাভারকারের মতে হিন্দুধর্মের রাজনৈতিক প্রকাশ। তার গোলমেলে ভুল তথ্যে ভরা 'এসেনশিয়ালস অফ হিন্দুত্ব'-র সমালোচনার এটা জায়গা নয়, শুধু উল্লেখ করা দরকার যে এই একমাত্রিক জাতীয়তাবাদ স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশেষ দাগ কাটতে পারেনি। এর মূল কারণ হিন্দুত্ববাদীদের নিশানা ছিল গান্ধীবাদ, ইংরেজ শাসন নয়। তাই তো এখন দেশভক্তির প্রতীক হিসাবে আবির্ভূত শ্যামাপ্রসাদ মুখুজ্জে ১৯৪২ সালে কংগ্রেসের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন কিভাবে বাংলায় প্রতিহত করা যায় সে ব্যাপারে তৎকালীন গভর্নরকে লিখিত পরামর্শ দেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে একমাত্রিক হিন্দু জাতীয়তাবাদ পরিত্যক্ত হয়ে স্বাধীন ভারতের সংবিধানে বহু ধর্ম, বহু ভাষা সমাদৃত হল। ফলে আমাদের দেশে পাশ্চাত্য আধুনিকতা বা ধর্মীয় মৌলবাদ বিশিষ্ট 'নেশন' বা 'ন্যাশনালিজম' প্রতিষ্ঠা হল না। সমস্ত বাস্তবিক ভুল ত্রুটি সত্ত্বেও আইনত এক সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম হল। হিন্দুত্ববাদের প্রচারের মূল স্তম্ভ সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মনে এক ধরণের অবান্তর একমাত্রিক, ইতিহাস বিরোধী হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতি ভক্তি উৎপাদন। যারা এই একমাত্রিক নেশন-এর ধারণা মানবে না, হিন্দুত্ববাদের নিদান অনুসারে, তাদের দেশে ঠাঁই নেই। বিএনএস-এ ‘সরকার’-এর বদলে ‘নেশন’-এর উল্লেখ এই ষড়যন্ত্রেরই অঙ্গ।

বিএনএস ১৯৫(১)(ডি) ধারা অনুসারে ভুল এবং বিভ্রান্তিকারী তথ্য প্রস্তুত ও পরিবেশন যদি ভারতের সার্বভৌমত্ব, ঐক্য ও অখণ্ডতা বিপন্ন করে তবে তা ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে দণ্ডনীয়। এই ধারা আমাদের সংবিধানের ১৯(২) ধারার সম্প্রসারণ। ১৯(১) ধারা, ভারতের নাগরিকদের, অন্যান্য স্বাধীনতার সঙ্গে স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার সুরক্ষার অঙ্গিকার করে। ১৯(২) ধারা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এই স্বাধীনতা খর্ব করে। এই ধারায় অভিযুক্তদের (রমেশ থাপার, অনুরাধা ভাসিন, বৃজ ভূষণ, শ্রেয়া সাইগল প্রমুখ) আবেদনে সারা দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন সময় ১৯(১) ধারায় প্রতিশ্রুত অধিকারে অহেতুক হস্তক্ষেপ বলে ১৯(২) ধারার প্রয়োগ রদ করেছে। কোর্টের মত অনুসারে ‘ধারা ১৯(২) শুধুমাত্র সেই সমস্ত মত প্রকাশ নিষিদ্ধ করতে পারে যা ক্ষতি, বিশৃঙ্খলা, হিংসা প্ররোচিত করে এবং যার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে হিংসার সঙ্গে’। কোনো বক্তব্য, সরকারের মতে, সার্বভৌমত্ব বা অখণ্ডতা বিপন্ন করতেই পারে সরাসরি হিংসার সঙ্গে যোগ না থাকা সত্ত্বেও। সেক্ষেত্রে, নতুন আইনি ধারা অনুসারে তা ফৌজদারি বিধিতে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে। আরও খেয়াল করুন, সরকারের মতে ক্ষতিকারক ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রস্তুত (তা প্রকাশ না করলেও) দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্তে আত্মপক্ষ সমর্থন করা অনেক কঠিন হবে। কোনো তথ্য প্রকাশিত হয়েছে কি না তার প্রমাণ জনসমক্ষে থাকে; কিন্তু তথ্য প্রস্তুত করা হয়েছে, যদিও প্রকাশ করা হয়নি এমন অভিযোগের তথ্য প্রমাণ সরকার সহজেই সাজিয়ে অভিযুক্তকে ফাঁসাতে পারে। অভিযোগ অপ্রমাণ করা কঠিন ও ব্যয় সাপেক্ষ হবে।

প্রশ্ন জাগে ১৯(২) ধারার অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের কড়া মনোভাব সত্ত্বেও বিকল্প ধারাকে আরও প্রসারিত এবং অপরাধের সংজ্ঞা আরও অস্পষ্ট করার কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে? উদ্দেশ্য, সম্ভবত, নিরপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত পুলিসি হেনস্তার ভয় দেখিয়ে স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠ রোধ করা। বস্তুত, বিজেপি এবং আরএসএস-এর পক্ষে মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর তথ্য এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ক্ষুণ্ণ করার মতো মিথ্যা তথ্য ক্রোনি ক্যাপিটাল-এর নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যমে এবং সমাজ মাধ্যমে সংগঠিতভাবে ছড়ানো সত্ত্বেও সরকার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। তাই আন্দাজ করা যায় যে বিএনএস-এর এই বিশেষ ধারা স্বাধীন সাংবাদিকতা স্তব্ধ করার জন্যই প্রণীত হতে চলেছে।

স্বাধীনতার পর ভারতীয় পুঁজি নানাভাবে রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ভারী শিল্প গড়ার মতো তাদের হাতে যথেষ্ট পুঁজি ছিল না। ম্যানেজার, ইঞ্জিনিয়ারদের শিক্ষণের জন্য আইআইএম, আইআইটি প্রতিষ্ঠার জন্যও সরকারের দরকার ছিল। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ বাজার সংরক্ষণ, অর্থনৈতিক ও আর্থিক পরিকাঠামো গঠন ইত্যাদি সাহায্যের জন্যে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের তদারকিতে বড় পুঁজির স্বার্থের পরিপন্থী ছিল না। ৮০-র দশক পর্যন্ত ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশে রাষ্ট্রের বড় ভূমিকা ছিল। শুধুমাত্র শিল্প বিকাশে তার অর্থনৈতিক ভূমিকা সীমিত ছিল না, কৃষি উৎপাদন, কৃষি পণ্য বণ্টন, এ সমস্ত ক্ষেত্রেও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ক্রমশ ভারতীয় বৃহৎ পুঁজি যত স্বাবলম্বী হতে থাকে, ততই অর্থব্যবস্থায় সরকারের উপস্থিতি তাদের কাছে সুবিধার চেয়ে বেশী বিড়ম্বনা হয়ে ওঠে। ৮০-র দশক থেকে ভারতীয় অর্থনীতির উদারীকরণ শুরু হয়। রাষ্ট্রতন্ত্র বা স্টেটিজম-এর অবসানের সঙ্গে কংগ্রেসের ক্রম পতন ও বিজেপির উত্থান যুক্ত, কারণ এই রাষ্ট্রতন্ত্রের প্রবক্তা ছিল কংগেস। উদারীকরণ কংগ্রেস সূচনা করলেও তার পক্ষে আগ্রাসীভাবে বেসরকারিকরণ এবং অনিয়ন্ত্রিত বাজারের দিকে এগোনো সম্ভব ছিল না। এর কারণ ছিল কংগ্রেসের জনসমর্থন খোয়াবার ভয়। ফলে এক দিকে যেমন বিলগ্নিকরণের লক্ষ্যপূরণ হয়নি তেমনই পুঁজির কাঙ্ক্ষিত শ্রম বাজারের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ শিথিল করাও সম্ভব হয়নি। এমনকি বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের পক্ষে একাজ সম্ভব ছিল না। হিন্দুত্ববাদের আর তার প্রতীক মোদীর বলশালী আবেদনে ভর করে ক্ষমতায় আসীন বর্তমান জনমোহিনী সরকারের পক্ষেই শুধু সম্ভব সমস্ত জনবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তার অর্থনৈতিক বা জনস্বার্থমুখী নীতির সাফল্যের ওপর তার জনপ্রিয়তা নির্ভর করে না। সে কারণেই এখন নির্বাচনী প্রচারে মোদী সাহেব আর আর্থিক উন্নতির কথা উল্লেখ করেন না, রাম লালার কথাই বলেন। তাঁর এই হেজেমনিক অবস্থান আরও পোক্ত করার জন্যই সমস্ত বিরোধ স্তব্ধ করা দরকার। বিএনএস বোধহয় সে পথেই আর একটা পদক্ষেপ। আর এ সমস্ত অগণতান্ত্রিক নীতি গ্রহণে বৃহৎ পুঁজির সমর্থন স্বাভাবিক কারণ। এই একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা বলেই বর্তমান সরকার বৃহৎ পুঁজির স্বার্থে শ্রমিক বিরোধী, পরিবেশ ধ্বংসকারী নীতি অবলম্বন করতে সক্ষম।