আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২৩ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০

সমসাময়িক

রাষ্ট্রের নজরদারি


বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে বহুল প্রচারিত ভারতবর্ষের প্রশাসন কি শেষ পর্যন্ত নাগরিকদের ব্যক্তিগত জীবনের পাহারাদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চলেছে? সম্প্রতি বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা এবং সাংবাদিকের মোবাইল ফোনে একই সঙ্গে 'অ্যাপেল' কর্তৃপক্ষ থেকে একটি সতর্কবার্তা বা ‘অ্যালার্ট নোটিফিকেশন’ আসার পরই প্রশ্নটি নতুন করে চিন্তার উদ্রেক করেছে। কংগ্রেসের মল্লিকার্জুন খাড়গে, শশী তারুর, সিপিআই(এম)-এর সীতারাম ইয়েচুরি, সমাজবাদী পার্টি প্রধান অখিলেশ যাদব, তৃণমূল কংগ্রেসের মহুয়া মৈত্র, শিবসেনার প্রিয়ঙ্কা চতুর্বেদী, আপ-এর রাঘব চড্ডা সকলেই একই সময়ে ‘অ্যালার্ট নোটিফিকেশন’ পেলেন। সতর্কবার্তা পেলেন এমন কয়েকজন সাংবাদিক যাঁদের তথ্য সংগ্ৰহ, বিশ্লেষণ ও চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ সংবাদমাধ্যমে সমাদৃত। এবং পাঠক-দর্শকের আলোচনার বিষয়। অন্যান্য আর কাদের কাছে এমন সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে তার হদিশ এখনও মেলেনি। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে শাসকদলের কোনো সদস্য বা ঘনিষ্ঠর কাছে এমন সতর্কবার্তা পৌঁছয়নি। পৌঁছলে এতদিনে সরকারি ও দলীয় প্রচার ব্যবস্থার মাধ্যমে সারা দেশে সেই খবর ছড়িয়ে দেওয়া হতো।

এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন করে চিঠি পাঠিয়েছেন সীতারাম ইয়েচুরি। কোনো উত্তর এসেছে বলে জানা যায়নি। অন্যান্য নেতারাও সরকারের কাছে এই ব্যাপারে জানতে চেয়েছেন। সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন সরকারের কাছে অভিযোগের সারবত্তা প্রকাশ্যে আনার দাবি করেছে। সরকার যথারীতি নীরব।

পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়ে যাচ্ছে দেখে কেন্দ্রীয় তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী জানিয়েছেন যে, এই ঘটনার উপযুক্ত তদন্ত নিশ্চয়ই করা হবে। মন্ত্রীর কথায় ভরসা রাখতে ‌পারলে স্বস্তি পাওয়া যেত। তবে বিগত নানা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সে স্বস্তিবোধ লাভ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষত ২০২১-এ বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের মোবাইল ফোনে নজরদারির জন্য 'পেগাসাস স্পাইওয়্যার' হানার পর শুধুমাত্র মন্ত্রী নয়, পুরো মন্ত্রীসভার বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।

এক বছর আগে, গত অক্টোবরে, 'পেগাসাস স্পাইওয়্যার' হানার অভিযোগের ভিত্তিতে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত একটি তদন্তের নির্দেশ দেয়ঃ বিরোধী রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, সমাজকর্মীদের বিরুদ্ধে 'পেগাসাস' সফটওয়্যারের সাহায্যে কেন্দ্রীয় সরকার বেআইনি নজরদারি করছে কি না খতিয়ে দেখার জন্য। অনেকগুলি মামলার প্রেক্ষিতে এসেছিল আদালতের সেই কঠিন নির্দেশ। গত বছরে সুপ্রিম কোর্টের ওই নির্দেশের পর আদালত নিযুক্ত কমিটি শেষ পর্যন্ত কোনও নিশ্চিত সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতে পারেনি। তবে কমিটি-রিপোর্টে উঠে এসেছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য যে, সরকারি তরফ থেকে এই তদন্তে যৎপরোনাস্তি অসহযোগিতা করা হয়েছে। সন্দেহ নিরসনের পদ্ধতিতে এত অনীহা কেন? তবে কি তদন্তে গোলমেলে কিছু বেরিয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে?

'পেগাসাস' সফটওয়্যারের নির্মাতা সংস্থা ইজরাইলে অবস্থিত। 'পেগাসাস' কর্তৃপক্ষর তরফে সেই সময় একটি সাদামাটা বিবৃতিতে জানানো হয়েছিল যে তারা পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রে এই সফটওয়্যার সরবরাহ করে থাকে। এবং বিবৃতির সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে 'পেগাসাস' তাদের সফটওয়্যার সরবরাহের জন্য শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সঙ্গেই চুক্তি করে। কোনো ব্যক্তিবিশেষ বা বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রীর প্রথম বারের জন্য ইজরায়েলে সরকারি সফরের পরই 'পেগাসাস' স্পাইওয়্যারের নজরদারির খবর প্রকাশিত হয়।

এক বছর পর আবারও একই অভিযোগ নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক স্পাইওয়্যারকে নজরদারির অস্ত্রে পরিণত করা হয়েছে দেশের বাছাই-করা নাগরিকদের কার্যকলাপের উপর চোখ রাখার লক্ষ্যে। অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেছে সরকার, যদিও মৌখিক অস্বীকার দিয়ে বেশি দূর এগোনো মুশকিল। যে-হেতু বারংবার একই মর্মে অভিযোগ উঠছে, একই ধরনের সন্দেহজনক স্পাইওয়্যারের সন্ধান মিলছে, কিছু যে একটা ঘটছে কিংবা ঘটানো হচ্ছে, তা এখন আর নিছক সংশয়ের পর্যায়ে থাকতে পারে না। প্রসঙ্গত, উপর্যুপরি অভিযোগ এলে নাগরিক কীভাবে সরকার-প্রতিশ্রুত ‘উপযুক্ত তদন্ত’-র উপর আস্থা রাখবেন? এত জন গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয়ের ফোনে একই দিনে একই সঙ্গে এমন অ্যালার্ট আসার ঘটনাটি কি কাকতালীয় হতে পারে?

'অ্যাপেল' কর্তৃপক্ষর সতর্কবার্তা এমন সময়ে এসেছে যখন সামনে অনেকগুলি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন, এবং অদূরেই সংসদের নির্বাচন। অনুমান করা যায়, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এঁদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত গতিবিধির উপর নজর রাখা এবং সেই মর্মে ‘হুমকি’ পাঠানোর ঘটনায় কোন পক্ষের স্বার্থ কীভাবে পূরণ হতে পারে? বিশ্বের অন্যতম প্রধান গণতন্ত্রে বসে দেশের সরকারের বিষয়ে উপর্যুপরি এই অভিযোগ বলে দেয়, গণতন্ত্র বস্তুটি নরেন্দ্র মোদী সরকারের সাড়ে নয় বছরের শাসনে কোন তলানিতে অবনমিত হয়েছে।

‘পেগাসাস’ সফটওয়্যারের অবৈধ ব্যবহারের মামলায় সুপ্রিম কোর্ট ২০২১-এ যেমন বলেছিল, সেই ধারাবাহিকতায় সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলার শুনানিতে সম্প্রতি বিচারপতি বলেছেন, “...গোপনীয়তার অধিকার কিন্তু মৌলিক অধিকার...”। অর্থাৎ তাঁর পর্যবেক্ষণে গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার বিবেচিত হয়েছে সাংবাদিকের মৌলিক অধিকারের প্রেক্ষিতে।

সুপ্রিম কোর্ট মনে করিয়েছে, রাষ্ট্র তদন্তকারী সংস্থার দ্বারা চালিত হতে পারে না। এই সতর্কবার্তায় কেন্দ্র কান দেবে, তার আশা কম। বিরোধীর প্রতি সরকারের ভীতিপ্রদর্শন, হয়রানি, অসার মামলায় অভিযুক্ত করে কারাবন্দি - এ সবই বহু দশক ধরে চলছে। তবে নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালে সমালোচকদের উপর উৎপীড়ন এক অন্য পর্যায়ে চলে গিয়েছে। শতাধিক সাংবাদিকের ফোন, ল্যাপটপ বাজেয়াপ্ত করা বস্তুত দেশবাসীর প্রতি এক প্রচ্ছন্ন হুমকি। স্বচ্ছতা ও ন্যায়ের প্রতি দায়বদ্ধ নাগরিক সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হতে চাইলে, নিজের বিবেক অনুসারে কাজ করলে, বিকল্প চিন্তা প্রকাশ ও প্রচার করতে চাইলে সহজেই তাকে চিহ্নিত করতে উদ্যত পুলিশ-প্রশাসন। রাজনীতিক, সাংবাদিকের ফোনে আড়ি পেতে, না হলে ফোন বাজেয়াপ্ত করে, নানাভাবে মৌলিক অধিকারের সুরক্ষার প্রশ্নটি বিপর্যস্ত করে সেই পথেই এগিয়ে চলেছে রাষ্ট্র। নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকারের প্রতি রাষ্ট্র যে সন্দিহান, শ্রদ্ধাশীল নয়, তা এক দুর্লক্ষণ। স্বৈরতন্ত্রেই এমন হয়, গণতন্ত্রে নয়।

আজকের ভারতের নেতামন্ত্রীরাও হয়তো ভুলে যাচ্ছেন যে, যত বেশি এই ধরনের নজরদারির তথ্য প্রকাশিত হবে, বিরোধিতা তলে তলে ততই গভীর ও ব্যাপ্ত হয়ে উঠবে। এবং বৃহত্তর অর্থে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্যের প্রতি আস্থাও এর ফলে অনেকখানি লুপ্ত হবে। সেই ক্ষতি - গভীরতর, ব্যাপ্ততর।

ফোনে নজরদারির বিষয়টি নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা-আন্দোলনের প্রয়োজন। কারণ, বিষয়টি গণতন্ত্র রক্ষার সঙ্গে জড়িত। সাদামাটা একটা 'প্রতিবাদ পত্র' পাঠিয়ে থেমে যাওয়া কোনোমতেই সঙ্গত নয়। আবার শুধুমাত্র আদালতের মুখাপেক্ষী হয়ে থেমে থাকলেও চলবে না। অন্যান্য অনেক দাবিদাওয়া নিয়ে সংগঠিত আন্দোলনের সঙ্গে শুরু হোক ব্যক্তি পরিসরে নজরদারির বিরুদ্ধে জন আলোড়ন।