আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২৩ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০
সমসাময়িক
সীমাহীন দুর্নীতি
গ্রিক পুরাণের জলদানব 'লার্নিয়ান হাইড্রা'র কথা মনে আছে? তার ছিল অনেকগুলো মাথা। কোনো একটা মাথা কাটা গেলে তার জায়গায় আরও দুটো মাথা গজিয়ে উঠত। আপাতত পশ্চিমবঙ্গের বনমন্ত্রী তথা প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী শ্রীযুক্ত জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের দুর্নীতির কটা মাথা তার হিসেব রাখতে রাজ্যবাসী হিমশিম খাচ্ছেন। অবশ্য এই রাজ্যে বিগত বারো বছর ধরে শুধুমাত্র মন্ত্রী-সান্ত্রীদের যত দুর্নীতির খোঁজ পাওয়া গেছে তার সংখ্যা ‘লার্নিয়ান হাইড্রা'র মাথাকেও ছাড়িয়ে যাবে। চিট ফান্ডগুলো থেকে গরিব মানুষের কত টাকা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে তার হিসেব কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি বা সিবিআই অথবা রাজ্যের সংস্থা সিআইডি কেউ দেয়নি; সব মিলিয়ে কত টাকার স্ক্যাম ছিল তা জানেন একমাত্র মা সারদা। এছাড়াও আছে আরও অসংখ্য নাম জানা ও না জানা দুর্নীতি - শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, স্কুলে বদলিতে দুর্নীতি, পুরসভায় নিয়োগে দুর্নীতি, সমবায় লোনের নামে দুর্নীতি থেকে শুরু করে গরু পাচার, কয়লা পাচার, বালি পাচার ইত্যাদি হল গত এক দশকের বঙ্গীয় মন্ত্রী-সান্ত্রীদের দুর্নীতির ভাসমান হিমশৈলের চূড়া।
আপাতত তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট-এর হেফাজতে আছেন। ২০১১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত টানা ১০ বছর খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক তথা আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর বালু। তাঁর বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ হল, বিভিন্ন রেশন ডিলার ও ডিস্ট্রিবিউটরদের সঙ্গে সিন্ডিকেট তৈরি করে কেন্দ্রের পাঠানো ন্যায্য মূল্যের রেশনসামগ্রী বেআইনিভাবে খোলা বাজারে বিক্রি করা। ইডি দাবি করেছে, সরকারি নিয়মে রেশন বণ্টনের পাশাপাশি, সমান্তরালভাবে চলেছিল অবৈধ কারবার। গণবণ্টন ব্যবস্থার ভর্তুকি দেওয়া আটা, ময়দা বৈধ লাইসেন্স ছাড়াই সঞ্চয় এবং বিক্রি করছে বেশ কিছু চালকলের মালিক যাদের সঙ্গে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। গণবণ্টন ব্যবস্থার অন্তর্গত অন্তত ৩০ শতাংশ রেশন খোলা বাজারে বিক্রি করা হয়েছে। এই দুর্নীতির লাভ পেতেন চালকলের মালিক এবং গণবণ্টন ব্যবস্থার বণ্টনকারীরা। পাশাপাশি, তারা কৃষকদের নামে ভুয়ো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে ধানচাষীদের জন্য বরাদ্দ 'ন্যূনতম সহায়ক মূল্য'ও আত্মস্যাৎ করতেন।
ইডির দাবি, মিল মালিকেরা সরকারি অর্থ মিলিয়ে নিতেন কড়ায়-গণ্ডায়। কিন্তু তার বিনিময়ে সরবরাহকৃত রেশনের হিসাব মিলত না। প্রতি ১ কেজি আটার দামে অন্তত ২০০ গ্রাম থেকে ৪০০ গ্রাম কম আটা দিতেন আটাকলের মালিকেরা। এই গরমিলের পুরোটাই চলত মিল মালিক এবং সরকারি সরবরাহকারীদের বোঝাপড়ায়। ইডি বলেছে, চালকলের মালিকের থেকে ‘কমিশন’ বাবদ সম্পত্তি নিয়েছিলেন প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী। রেশন দুর্নীতির কালো টাকা সাদা করার জন্য জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক মোট তিনটি সংস্থা তৈরি করেছিলেন। আপ্ত সহায়ক অমিত দে-র নামে কেনা ফ্ল্যাটের ঠিকানায় ওই কোম্পানিগুলি রেজিস্টার করানো হয়েছিল। ওই সংস্থাগুলির ডিরেক্টর করা হয়েছিল মন্ত্রীর মেয়ে এবং স্ত্রীকে। শুধু তা-ই নয়, একটি সংস্থার ডিরেক্টর পদ দেওয়া হয়েছিল বাড়ির পরিচারককেও। সব মিলিয়ে কত টাকার দুর্নীতি চলেছে? তার হিসেবে করতে ইডি অফিসাররা হাবুডুবু খাচ্ছেন। আশা করি চিটফান্ডের মতো এবার আর তাঁরা জলের তলায় ডুবে গিয়ে 'লার্নিয়ান হাইড্রা'র হাতে নিহত হবেন না।
এখানেই শেষ নয়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক যেখানেই গেছেন সেখানেই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে - তিনি বনমন্ত্রী হওয়ার পরেই বন বিভাগে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। বিভিন্ন এলাকায় গাছ কাটা ও বনসৃজনের কাজ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন জঙ্গল লাগোয়া এলাকায় গত দেড় বছরে বন দফতরের বিভিন্ন জমি একাধিক বেসরকারি সংস্থাকে ব্যবহার করার অনুমতি ও নির্মাণের ছাড়পত্র দেওয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে বন দফতরের নির্দেশ রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সম্পূর্ণ দুর্নীতির লেজ এখনও অবশ্য ধরা যায়নি। রাজ্যের বিভিন্ন পুরসভাতে হওয়া নিয়োগ দুর্নীতিতেও গ্রেফতার হওয়া মন্ত্রীর নাম জড়িয়ে গেছে! এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট এখন তদন্ত করে দেখছে যে, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক রেশন বন্টন দুর্নীতি মামলায় জড়িত থাকার পাশাপাশি পুরসভার নিয়োগ দুর্নীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন কিনা।
পুরসভার নিয়োগ দুর্নীতি মামলার ধরন, পুরসভাগুলির ভৌগলিক অবস্থান এবং অনিয়মের সময় খতিয়ে দেখার পরে ইডি ১০টি পৌরসভা চিহ্নিত করেছে যেখানে নিয়োগ সংক্রান্ত অনিয়ম সর্বাধিক ছিল। এর মধ্যে সাতটি উত্তর ২৪ পরগনা জেলায়। নিয়োগের অনিয়মের প্যাটার্ন অনুসারে দেখা যাচ্ছে যে, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক মন্ত্রী থাকার পাশাপাশি উত্তর ২৪ পরগনা জেলার তৃণমূল সভাপতি যখন ছিলেন তখনই নিয়োগগুলি হয়েছিল। প্রাথমিক অনুসন্ধান অনুসারে, পুরসভার নিয়োগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুমোদিত পদের চেয়ে নিয়োগের সংখ্যা বেশি ছিল এবং এই অতিরিক্ত নিয়োগে বিপুল পরিমাণ অর্থ জড়িত ছিল।
ইডির আধিকারিকদের মতে, পশ্চিমবঙ্গে অর্থ পাচারের পুরো শৃঙ্খলটি একটি গোলকধাঁধার মতো যেখানে একটি মামলার তদন্ত অন্য ক্ষেত্রে অনিয়মের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। স্কুলের চাকরির জন্য বহু কোটি টাকার দুর্নীতিতে ইডি-র তদন্তের ফলে পুরসভার নিয়োগের মামলাটি সামনে এসেছে। আবার রেশন বণ্টন মামলার প্রধান অভিযুক্তের পুরসভায় নিয়োগের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র ছিল কিনা তা খুঁজে বের করার জন্য এখন নতুন করে তদন্ত করা হবে।
ইডির কাছে যা গোলকধাঁধা মনে হচ্ছে রাজ্যের সাধারণ মানুষ তার খেই কীভাবে ধরবেন!
তবে আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর বরাভয় আছে বন তথা প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রীর ওপরে। তিনি বলেছেন, ‘‘আমি শুনেছি, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ইডির গোয়েন্দারা তল্লাশির নামে চিনির কৌটো উল্টে দেয়। ঘিয়ের শিশি উল্টে দেয়। বাড়ির মেয়েদের কত রকম পোশাক-আশাক থাকে, তাদের ক’টা শাড়ি আছে, তারও তল্লাশি নেয়। এইসব আমরা সহ্য করব না। বালু সুগারের রোগী। ওর যদি কিছু হয়, তা হলে আমি বিজেপি এবং ইডির বিরুদ্ধে এফআইআর করব।’’
বরাভয় হস্ত এখনও আছে - সেই অনুগ্রহ কতদিন থাকবে তা রাজ্যবাসী জানেন না। মুকুল রায়, পার্থ চ্যাটার্জি, অনুব্রত মণ্ডল তথা কেষ্টরা বাংলার রাজনীতি থেকে আজ হারিয়ে গেছেন। আবার কুনাল ঘোষ ও মদন মিত্র ভেসে উঠেছেন। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ভবিষ্যৎ কোথায় লুকিয়ে আছে, বুঝতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন।