আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২৩ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০
সম্পাদকীয়
প্যালেস্তাইন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
গাজার সর্ববৃহৎ হাসপাতাল আল-শিফা। আক্ষরিক অর্থ, সুস্থ হয়ে ওঠার ভবন। ইজরায়েল রাষ্ট্রর জন্মের আগে, ব্রিটিশ শাসনাধীন প্যালেস্তাইনে ১৯৪৬ সালে স্থাপিত হয়েছিল এই হাসপাতাল। বর্তমানে এই হাসপাতাল ইজরায়েলের সৈন্যবাহিনীর দখলে। লাগাতার বোমাবর্ষণ, ট্যাংক আক্রমণ এবং ইজরায়েলি পদাতিক বাহিনীর আক্রমণে গাজার বিধ্বস্ত মানুষের একমাত্র আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল এই হাসপাতাল। হাজারো রোগীর সঙ্গে সাধারণ মানুষ হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছিলেন এই আশায় যে আর যাই হোক ইজরায়েলী সেনাবাহিনী হাসপাতাল আক্রমণ করবে না। সেই আশা ব্যর্থ হয়েছে। ইজরায়েলী সেনাবাহিনী দখল করেছে হাসপাতাল।
নাহ! তথাকথিত বর্বর মধ্যযুগ নয়। এই ঘটনা ঘটে চলেছে একবিংশ শতাব্দীতে। সবার চোখের সামনে। এমন নয় যে ইজরায়েল হঠাৎ করে আল-শিফা হাসপাতাল আক্রমণ করেছে। এর আগে তারা বোমা মেরে ধ্বংস করেছে আল-আহলি আরব হাসপাতাল যেখানে মৃত্যু হয়েছে বহু মানুষের। রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিবৃতি দিয়ে ইজরায়েলের এই বর্বরোচিত আক্রমণের প্রতিবাদ করেছে। তারা জানিয়েছে যে হাসপাতাল কখনও যুদ্ধক্ষেত্র হতে পারে না। বহু বছর ধরে যুদ্ধের যে নিয়মকানুন আন্তর্জাতিক মঞ্চে তৈরি হয়েছে সেখানে হাসপাতালের উপর আক্রমণ বা তাকে ধ্বংস করা যুদ্ধাপরাধ বলে গন্য হওয়ার কথা। কিন্তু ইজরায়েল এইসব আইনকানুনকে পাত্তা দেয় না। তারা তাদের ইচ্ছে মতো গাজার মানুষের উপর তীব্র আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। ১১,০০০-এর বেশি মানুষ ইতিমধ্যে মৃত। কিন্তু হামাস হাসপাতালে ঘাঁটি গেড়েছে এই অভিযোগে আল-শিফা হাসপাতালকে বিধ্বস্ত করে দিতে ইজরায়েলের বিন্দুমাত্র হাত কাঁপেনি।
হাসপাতালে হামাসের ঘাঁটি আছে এই কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। নরওয়ের ডাক্তার ম্যাডস গিলবার্ট দীর্ঘ বহু বছর গাজায় চিকিৎসা করেছেন, আল-শিফা হাসপাতালের সঙ্গেও তিনি যুক্ত। মানবাধিকার আন্দোলন এবং চিকিৎসা আন্দোলনের অগ্রণী কর্মী ডাক্তার গিলবার্ট দ্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে ইজরায়েল হাসপাতাল নিয়ে মিথ্যাচার করছে। সেখানে হামাসের কোনো ঘাঁটি নেই। কিন্তু তাতে কী আসে যায়! শক্তিশালীর অস্ত্র তার ইচ্ছে মতো দুর্বল মানুষের উপর আক্রমণ হানবে, এটাই তো বর্তমান দুনিয়ার দস্তুর হয়ে গেছে।
৭ অক্টোবর হামাস নিরস্ত্র ও নিরীহ ইজরায়েলী নাগরিকদের উপর যে আক্রমণ চালায় তা নিন্দনীয়। কিন্তু ইজরায়েল বর্তমানে যা করছে তার আগ্রাসন গণহত্যায় পর্যবসিত হয়েছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে ইজরায়েল গাজা থেকে প্যালেস্তিনি মানুষদের উৎখাত করতে চায়, যেমন তারা ১৯৪৮ সালে প্যালেস্তিনিদের তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিল। তারপরে লাগাতার প্যালেস্তিনিদের উপর আক্রমণ চলছে, তাদের দেশ, মানবাধিকার সবই কেড়ে নেওয়া হয়েছে। অস্ত্র ত্যাগ করেও যারা ইজরায়েলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, তাদের জন্যেও জুটেছে লাঞ্ছনা, হত্যা এবং আরো বেশি করে প্যালেস্তিনি জমি দখল। ভোটের মাধ্যমে হামাস ২০০৬ সালে জেতার পরে তাদের উপর অবরোধ চালানো হয়। নিরন্তর ইজরায়েলের আক্রমণের নিশানায় রয়েছে সাধারণ প্যালেস্তিনি মানুষ।
কিন্তু প্রশ্ন হল ইজরায়েল এই ভয়াবহ অত্যাচার জনসমক্ষে ঘোষণা করে লাগাতার চালিয়ে যাচ্ছে কী করে? বিশ্বের যারা মাথা, যারা বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে গণতন্ত্র স্থাপনের জন্য সেনাবাহিনী পাঠাতে সিদ্ধহস্ত সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ভৃত্য ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের আশীর্বাদ নিয়েই ইজরায়েল এই ভয়াবহ হত্যালীলা চালাচ্ছে। আমেরিকা তার নিউক্লিয়ার সাবমেরিন ভূমধ্য সাগরে পাঠিয়েছে, সিরিয়ার বিভিন্ন জায়গায় বোমাবর্ষণ করছে, ইরান এবং অন্যান্য মুসলমান প্রধান দেশগুলিকে ধমকে রেখেছে যে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে কোনোরকম আক্রমণ করা হলে আমেরিকার সৈন্যবাহিনী এই যুদ্ধে নামতে পিছপা হবে না। অতএব, ইজরায়েল একতরফাভাবে প্যালেস্তাইনের অধিবাসীদের উপর যে গণহত্যা চালাচ্ছে তার নেপথ্যে পাহারাদারের কাজ করছেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন।
রাষ্ট্রপুঞ্জে একের পর এক প্রস্তাব পাশ হচ্ছে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে। অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করা উচিত এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে আমেরিকা। সিকিউরিটি কাউন্সিলে যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করেছে আমেরিকা। ১৯৬৭ সাল থেকে লাগাতার ইজরায়েলের প্যালেস্তাইন দখলদারি এবং নির্বিচারে প্যালেস্তাইনের মানুষকে হত্যা এবং ওয়েস্ট ব্যাংকে বর্ণবৈষম্যমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষে ভোট দিয়েছে আমেরিকা। অথচ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ ইজরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে। এমনকি ভারত সরকার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকলেও, প্যালেস্তাইনে ইজরায়েলের বেআইনি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপুঞ্জে ভোট দিয়েছে। এই প্রস্তাবেও আমেরিকা ইজরায়েলের পক্ষে ভোট দিয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত বড় শহর, যেমন ওয়াশিংটন ডিসি, নিউ-ইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন, ইস্তানবুল ইত্যাদিতে লাখো মানুষ মিছিল করেছে প্যালেস্তাইনের পক্ষে এবং ইজরায়েলের বিরুদ্ধে, তবু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে টলানো যায়নি। তারা ইজরায়েলের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে রেখেছে। কিন্তু কেন?
এর প্রধান কারণ দুটি। প্রথমত, মধ্য এশিয়ার দেশগুলির উপর মার্কিন প্রতিপত্তি বজায় রাখা তাদের একটি মুখ্য রণনীতি। এর কারণ একদিকে মধ্য এশিয়ার বিপুল তেলের ভাণ্ডার। অন্যদিকে রাশিয়া, চিন এবং ইরানের বাড়তে থাকা শক্তি। অতএব মধ্য এশিয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সেখানে তাদের একটি মিত্রশক্তি প্রয়োজন। সেই মিত্রশক্তির নাম ইজরায়েল। ইজরায়েল আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি উপগ্রহ, যা মধ্য এশিয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ঝাণ্ডা উঁচু রাখার কাজে নিয়োজিত। তাই ইজরায়েলের ক্ষতি মানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ক্ষতি। সেই ক্ষতি হতে দেওয়া যায় না। অতএব বিশ্ব জনমত কোনদিকে রয়েছে, যুদ্ধাপরাধ হচ্ছে কী না, গণহত্যা হচ্ছে কী না, এই সমস্ত প্রশ্ন আমেরিকার কাছে গৌণ। আসল প্রশ্ন হল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দুর্বল হচ্ছে না শক্তিশালী হচ্ছে? মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে শক্তিশালী করতে যদি হাজারো প্যালেস্তাইনের মানুষকে বলি দিতে হয়, তাতে জো বাইডেনের হাত কাঁপবে না। দ্বিতীয় কারণটি আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আমেরিকায় একটি প্রবল প্রভাবশালী ইহুদী লবি রয়েছে যারা দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল, রিপাবলিকান এবং ডেমোক্রাট উভয়কেই মোটা অংকের চাঁদা দেয়। এর বিনিময়ে তাদের বিভিন্ন দাবি রয়েছে, যার প্রধান হল ইজরায়েলের প্রতি প্রশ্নহীন সমর্থন। তাই আমেরিকার রাস্তায় হাজারো লাখো মানুষ ইজরায়েলের বিরুদ্ধে সমবেত হলেও সেখানে প্রায় কোনো রাজনীতিবিদ ইজরায়েলের গণহত্যার বিরুদ্ধে কোনো বিবৃতি দেয়নি বা অবস্থান গ্রহণ করেনি। বড়জোর মিনমিন করে যুদ্ধবিরতির দাবি তুলেছেন কেউ কেউ। তাতে মার্কিন শাসনব্যবস্থার কিছু যায় আসে না।
আসলে প্যালেস্তাইনের মানুষের স্বাধীনতার পথে প্রধান বাধা, ইজরায়েল শুধু নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৫৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিদেশমন্ত্রী মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে বলেছিলেন গোটা বিশ্বের সমস্ত দেশ এবং জনমত দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না যতক্ষণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সমর্থন করছে আমাদের শাসনব্যবস্থা টিঁকে থাকবে। ইতিহাস বলছে এই সমর্থন অটুট ছিল আরো ৩০ বছর। ১৯৮৮-৮৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদের হাত উঠে যায় দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষবাদের মাথার উপর থেকেই। এর পরেই নেলশন ম্যাণ্ডেলার মুক্তি এবং বর্ণবিদ্বেষের পতন।
এই ইতিহাসের মধ্যে নিহিত রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব এবং তার শক্তি সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা। ইজরায়েলের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যেতে পারে। গোটা পৃথিবীর দেশগুলির বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ইজরায়েলের দখলদারি এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল সংখ্যক মানুষ ইজরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। কিন্তু মার্কিন শাসনব্যবস্থা যতক্ষণ ইজরায়েলকে সমর্থন জানাবে ততক্ষণ ইজরায়েলের গণহত্যা বন্ধ হবে না বা প্যালেস্তাইন মুক্ত হবে না। অতএব প্যালেস্তাইনকে মুক্ত করার লড়াই বর্তমান পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ লড়াই। প্যালেস্তাইনের মুক্তি হতে পারে একমাত্র মার্কিন সাম্রজ্যবাদের পরাজয়ের মাধ্যমে।
প্যালেস্তাইনের মানুষের লড়াই তাই শুধুমাত্র তাদের নিজেদের মুক্তি এবং স্বাধীনতার লড়াই নয়। একই সঙ্গে এই লড়াই গোটা বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অতএব সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মানুষের প্রধান কর্তব্য বর্তমানে ইজরায়েল-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অক্ষের বিরুদ্ধে নিরন্তর আন্দোলন সংঘটিত করা।
এই ক্ষেত্রে ভারতের গুরুত্ব অপরিসীম। প্যালেস্তাইনের মুক্তির পক্ষে ভারত স্বাধীনতার আগে থেকে অবস্থান গ্রহণ করেছে। মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু সহ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান নেতৃত্ব দ্যর্থহীন ভাষায় প্যালেস্তাইনের মুক্তির পক্ষে সওয়াল করেছেন। ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন গোটা পৃথিবীর মুক্তিকামী আন্দোলনকে প্রেরণা জোগায়। আজও সরকারীভাবে ভারত সরকার প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতার প্রশ্নে পুরোনো অবস্থান থেকে সরে আসতে পারেনি। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে বর্তমানে ভারতে যারা শাসনক্ষমতায় রয়েছে তাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনো ভূমিকা ছিল না। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা নয়, তাদের মূল রাজনৈতিক ভিত্তি বরাবর ছিল ফ্যাসিবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা। প্যালেস্তাইনের মুক্তির প্রশ্নে ভারত সরকারীভাবে অবস্থান পরিবর্তন না করলেও, লাগাতার তারা ইজরায়েল-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অক্ষের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তাই ইজরায়েলের গণহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে না ভারত। অন্যদিকে দেশের ভিতরে হামাসের আক্রমণকে অজুহাত করে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের সমস্যাকে ক্ষুদ্রভাবে সাম্প্রদায়িকতার আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদীরা বিশ্বের সামনে ভারতের সুপ্রাচীন অবস্থানকে লঘু করছে, ভারতের সম্মানহানী হচ্ছে।
ভারতে অবস্থিত প্রগতিশীল স্বাধীনতাকামী শক্তিদের ভারত সরকারের উপর চাপ বাড়াতে হবে যাতে ভারত সরকার দ্যর্থহীন ভাষায় যুদ্ধবিরতির দাবি জানায় আন্তর্জাতিক মঞ্চে। একই সঙ্গে প্যালেস্তাইনের মুক্তি তথা ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সমস্যার সমাধানের উদ্দশ্যে দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সংগঠিত করার জন্য ভারত সরকারকে বাধ্য করতে হবে।