আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ একবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২৩ ● ১৬-৩০ কার্তিক, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

অঘোষিত জরুরি অবস্থা


প্রবীর পুরকায়স্থ, সাংবাদিক প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানকর্মী, এখন কারাগারে। সঙ্গী তাঁর সংস্থা 'নিউজক্লিক'-এর মানব সম্পদ দপ্তরের অধিকর্তা। প্রবীর পুরকায়স্থ জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন জরুরি অবস্থা চলাকালীন। আজ প্রায় ৪৮ বছর পরে তিনি আবার জেলে। একই মানুষকে ঘিরে এই দুটি ঘটনা ভিন্ন মনে হলেও আসলে তা গভীর সূত্রে গাঁথা। ১৯৭৫ সালে দেশে ঘোষিতভাবে জরুরি অবস্থা জারি ছিল। এখন দেশে চলছে অঘোষিত জরুরি অবস্থা। তাই জরুরি অবস্থার প্রতিবাদকারী প্রবীর, বর্তমান সরকারের বিভিন্ন জনবিরোধী নীতির বিরোধী প্রবীরের ঠাঁই হয়েছে জেলে।

কী অভিযোগ রয়েছে প্রবীর পুরকায়স্থ তথা নিউজক্লিক-এর বিরুদ্ধে? এর আগে ইডি, আয়কর দপ্তরের মতো সংস্থা বিদেশ থেকে টাকা নেওয়া এবং তার ব্যবহার নিয়ে নানা অভিযোগে তদন্ত চালিয়েছে নিউজক্লিক-এর বিরুদ্ধে। ২০২১ সালে দিল্লি হাইকোর্ট ইডিকে নির্দেশ দেয় যে প্রবীরের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। বারংবার চেষ্টা করেও ইডি হাইকোর্টের এই নির্দেশকে বদলাতে পারেনি। দিল্লি পুলিশের বর্তমান গতিবিধির আগে প্রবীরকে গ্রেপ্তার করা যাবে না, এই প্রশ্নে হাইকোর্ট অটল ছিল। কারণ ইডি বা দিল্লি পুলিশের অর্থনৈতিক অপরাধ সংক্রান্ত শাখা নিউজক্লিক-এর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ বা চার্জশিট দাখিল করতে পারেনি।

তাই অক্টোবরের ৩ তারিখে নিউজক্লিক তথা প্রবীরকে আক্রমণ করার নতুন পন্থা আবিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ইএপিএ-র মতন আতঙ্কবাদ বিরোধী আইনের আওতায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭৬ বছরের প্রবীর এবং শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার অমিত চক্রবর্তীকে। দিল্লি পুলিশের দাখিল করা এফআইআর-এ কোনো নির্দিষ্ট আতঙ্কবাদী অপরাধের কথা লেখা নেই। অভিযোগ করা হয়েছে যে দেশের সুরক্ষাকে বিঘ্ন করার জন্য নাকি ষড়যন্ত্র করা হয়েছে, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনকে নাকি বিঘ্নিত করার চক্রান্ত করা হয়েছে ইত্যাদি। অভিযোগগুলি শুনলেই বোঝা যায় যে এর কোনো সারবত্তা নেই। এবং ইএপিএ-র আইন পরিবর্তন করার ফলে এই ধরনের ধোঁয়াশাপূর্ণ অভিযোগের ভিত্তিতে বয়স্ক এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের জেলে পোরা হচ্ছে।

আসল কারণ অন্য। বিভিন্ন ইস্যুতে এবং বিশেষ করে কৃষক আন্দোলনের সময় প্রবীর পুরকায়স্থ এবং নিউজক্লিক আপসহীন সাংবাদিকতা করে আসল সত্য জনগণের সামনে তুলে আনার চেষ্টা করেছে। সরকার তথা ‘গোদী মিডিয়া’-র বানানো ভুয়ো এবং পক্ষপাতদুষ্ট খবর নয়, তথ্য ও তত্ত্ব এবং সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে নির্ভীক সংবাদমাধ্যমের কী ভূমিকা হওয়া উচিত তার উদাহরণ তৈরি করেছেন প্রবীর পুরকায়স্থ এবং তাঁর সহকর্মীরা। বাকিদের টাকা দিয়ে কিনে নেওয়া যায়, কাউকে ভয় দেখিয়ে চুপ করানো যায়। কিন্তু নিউজক্লিককে যখন কিছুতেই কাবু করা যাচ্ছে না তখন কর্ণধারকে উগ্রপন্থার অভিযোগে জেলে পুরে এবং অর্থ তছনছের অভিযোগ এনে বিজেপি সরকার দেশে স্বাধীন গণমাধ্যমের অন্তর্জলি যাত্রা ঘটাতে চাইছে।

আমাদের দেশে ২০১৪ সাল থেকে কর্পোরেট মদতপুষ্ট সংবাদমাধ্যম যেইভাবে মোদী সরকারের লাগাতার প্রশস্তি করে চলেছে, ভুয়ো খবর এবং সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে সর্বদা সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে চলেছে এবং সর্বপরি বিরোধী রাজনীতিবিদ তথা বুদ্ধিজীবিদের দেশবিরোধী প্রমাণ করতে লেগে পড়েছে তার তুলনা এই দুনিয়ায় বিরল। তেমনই আজকের দিনে নিউজক্লিক-এর মতো স্বাধীন সংবাদমাধ্যম যা দেশের প্রকৃত তথ্য জনসমক্ষে তুলে ধরতে চায়, তাও বিরল। অতএব মোদীর দেশে সবাইকে যেহেতু এক সুরেই মোদী ভজনা করতে হবে, তাই যারা করবে না তাদের চুপ করিয়ে দেওয়া আবশ্যিক। চুপ না করলে কী হবে তার উদাহরণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে প্রবীর পুরকায়স্থকে। বাকিরাও যেন নিউজক্লিক-এর অবস্থা দেখে ভয় পায়।

ভারতীয় গণতন্ত্রের মতন উদাহরণ পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। গণতন্ত্রের মানে যদি হয় দেশের সরকার তথা নেতা নির্বাচন, তাহলে তা করতে হলে সঠিক তথ্য যদি জনগণের কাছে না থাকে তাহলে গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। দেশের মূলধারার মিডিয়া আজকের দিনে সঠিক তথ্য বা বিশ্লেষণ জনগণের সামনে হাজির করে না। তাই জনগণের প্রকৃত তথ্য জানার যে অধিকার, যার ভিত্তিতে সঠিক গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ সম্ভব, তা প্রতি পদে হোঁচট খাচ্ছে। অতএব গণতন্ত্রকে দেশে পোক্ত করার জন্য এবং সঠিক তথ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য নিউজক্লিক-এর মতন মিডিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। তাই সমস্ত গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের নিউজক্লিক-এর মতন সংবাদমাধ্যমের পাশে দাঁড়ানো উচিত। প্রবীর পুরকায়স্থরা ঘোষিত জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে যেই সংগ্রাম করেছিলেন সেই সংগ্রামই বর্তমানে আরো দৃঢ় করতে হবে অঘোষিত জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে।