আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২৩ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

আম্বেদকর ও হিন্দুত্ব

শুভনীল চৌধুরী


কোনদিক সাথি কোনদিক বল
কোনদিক বেছে নিবি তুই

বিগত ৬ ডিসেম্বর, আমার এক বন্ধু ফেসবুকে একটি পোস্টার পোস্ট করেন। পোস্টারে দুটি ছবি - একটি বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকরের, এবং অন্যটি বাবরি মসজিদ ধ্বংসের। সঙ্গে একটি ক্যাপশন যাতে লেখা “ডিসেম্বর ৬: আপনি কোন দিকে?”। অর্থাৎ, ছবিটির মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক এবং মতাদর্শগত প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। আম্বেদকর এবং বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে দুটি ভিন্ন মেরুর রাজনৈতিক অবস্থান হিসেবে উপস্থিত করা হচ্ছে। আম্বেদকরের রাজনীতি এবং হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে দুটি ভিন্ন মেরুর অবস্থান হিসেবে দেখিয়ে জনগণকে একটি পক্ষকে চয়ন করতে বলা হচ্ছে। পোস্টারটি অত্যন্ত ব্যঞ্জনাময়। সেই ব্যঞ্জনার সূত্র ধরেই কিছু কথা বলার লক্ষ্যে এই প্রবন্ধটির অবতারণা।

৬ ডিসেম্বর দিনটিতে আম্বেদকরকে স্মরণ করা স্বাভাবিক, কারণ ওই দিনটি তাঁর মৃত্যুদিন। ১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। আজও তাঁর সমাধিক্ষেত্রে হাজার হাজার দলিত মানুষ সমবেত হন তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে। আবার ৬ ডিসেম্বর ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত দিন যেদিন হিন্দুত্ববাদের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় বাবরি মসজিদকে ধ্বংস করে সংঘ পরিবারের কর্মীরা। আম্বেদকরের মৃত্যুদিনেই বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়ার ঘটনাটি নেহাত কাকতালীয় না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। দলিত আন্দোলনের অনেকেই মনে করেন যে আম্বেদকরের মৃত্যুদিনে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে সংঘ পরিবার দিনটির গায়ে কলঙ্কের দাগ লাগাতে সক্ষম হয়েছে, যেখানে আম্বেদকর নয়, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কারণেই দিনটি পরিচিত হয়ে গেছে।

শুধুমাত্র দিনটি আম্বেদকর এবং বাবরি মসজিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলেই পোস্টারটি বানানো হয়ে থাকলে তা নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন এখানেই ফুরোয়। আসলে পোস্টারটি যেই দ্বন্দ্বকে তুলে ধরতে চাইছে তা ভারতের বর্তমান রাজনীতি এবং আম্বেদকরের মতাদর্শের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। প্রথমত, আম্বেদকর ভারতের সংবিধানের রচয়িতা, তার প্রাণপুরুষ। যেই সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতার বুনিয়াদে ভারতকে গড়ে তুলেছে, সেই সংবিধানের রচয়িতা হিসেবে আম্বেদকর নিশ্চিতভাবে সংবিধান তথা ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে। অতএব ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে ধ্বংস করার প্রধান কাণ্ডটির বিরুদ্ধে যে আম্বেদকর অবস্থান নেবেন তা বলাই বাহুল্য। এই দিক দিয়ে দেখতে গেলে পোস্টারটি যেই দ্বন্দ্ব এবং চয়নের কথা বলছে তা অত্যন্ত সহজ এবং সংশয়াতীত। ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে হলে আপনি আম্বেদকরের পক্ষে নয়ত বাবরি মসজিদ ভাঙার পক্ষে।

কিন্তু আম্বেদকর শুধুমাত্র ধর্মনিরপেক্ষতার সমর্থক থাকলে তাঁকে কংগ্রেসের অন্য কোনো শীর্ষ নেতার সঙ্গে তফাৎ করা যেত না। আম্বেদকর ছিলেন দলিত সমাজের নেতা। কিন্তু তিনি শুধুমাত্র সংকীর্ণ পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীতির ময়দানে নেতৃত্ব দেননি। বরং তিনি দলিতদের উৎপত্তি কীভাবে হল, হিন্দুধর্মের সঙ্গে তাদের কী সম্পর্ক, কংগ্রেস এবং গান্ধী দলিতদের জন্য কী করেছে, দলিতদের উন্নতি কোন পথে হবে, এই সমস্ত বিষয়ে সুচিন্তিত অসংখ্য বই এবং প্রবন্ধ লিখেছেন। দুর্ভাগ্য আমাদের যে পশ্চিমবঙ্গে আম্বেদকরকে নিয়ে বিশেষ আলোচনা চোখে পড়ে না। কিন্তু তাঁর বই এবং প্রবন্ধ পড়লেই বোঝা যায় তিনি কতটা তীব্রভাবে হিন্দুত্ববাদ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধী ছিলেন। আজ বিজেপিও তাঁকে নিজেদের মতাদর্শের লোক বলে প্রচার করতে চায়। কিন্তু এর থেকে বড় মিথ্যা আর কিছু হতে পারে না। প্রবন্ধের বাকি অংশে আম্বেদকরের কিছু প্রবন্ধ তথা বইয়ের ভিত্তিতে হিন্দু ধর্ম এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর তীব্র সমালোচনার একটি ছবি আমরা তুলে ধরতে চেষ্টা করব।

হিন্দুধর্মের ধাঁধা

আম্বেদকদরের মৃত্যুর পর তাঁর বহু অপ্রকাশিত বই তথা প্রবন্ধের সন্ধান পাওয়া যায়, যা একত্রিত করে মহারাষ্ট্র সরকার আম্বেদকরের রচনা সমগ্রের মোট ১৭টি খণ্ড (প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত রচনা মিলিয়ে) প্রকাশ করে। এই রচনা সমগ্রের চতুর্থ খণ্ডে প্রকাশিত হয় হিন্দুধর্ম সম্পর্কিত ধাঁধাগুলি (মোট ২১টি)। ২০২০ সালে নবযান প্রকাশনা এই ধাঁধাগুলি বইয়ের আকারে প্রকাশিত করে 'Riddles in Hinduism' নাম দিয়ে।

বইটিতে আম্বেদকর হিন্দুধর্ম সংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেন এবং বোঝাতে চান যে দার্শনিক, তাত্ত্বিক এবং তথ্যের দিক দিয়ে দেখলে হিন্দুধর্মের মৌলিক বক্তব্য অসঙ্গতিপূর্ণ। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

আম্বেদকর বলছেন, কী করে বোঝা যাবে কে হিন্দু? মুসলমান তারা যারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত, যারা কোরান, আল্লাহ এবং নবী মহম্মদের উপর বিশ্বাস রাখে। খ্রিষ্টান তারা যারা যীশু খ্রীষ্টে বিশ্বাসী। কিন্তু হিন্দু কারা? হিন্দুরা একেশ্বরবাদীও হয়। আবার বিভিন্ন হিন্দু বিভিন্ন ঈশ্বরের পূজা করে - কেউ কালী ভক্ত, কেউ শিব, কেউ বিষ্ণু ইত্যাদি। এমনকি জাতি প্রথারও প্রভেদ রয়েছে বিভিন্ন অঞ্চল এবং গোষ্ঠীর মধ্যে। অতএব, বিভিন্ন ধরনের বিশ্বাস এবং মতের সংমিশ্রণে হিন্দুধর্ম তৈরি এই কথা বলা যেতে পারে। আম্বেদকরের ভাষায়,
A complex congeries of creeds and doctrines is Hinduism. It shelters within its portals monotheists, polytheists and pantheists; worshippers of the great gods Shiva and Vishnu or of their female counterparts, as well as worshippers of the divine mothers or the spirits of trees, rocks and streams and the tutelary village deities; persons who propitiate their deity by all manner of bloody scarifices, and persons who will not kill no living creature. ...and a host of more or less heterodox sectaries, many of whom deny the supremacy of the Brahmans, or at least have non-Brahmanical religious leaders.- Riddles in Hinduism, B. R. Ambedkar, Navayana Publications, Page 63.

তার মানে আম্বেদকর হিন্দুধর্মের মধ্যেই যে বিবিধ ধর্মীয় পরম্পরা ও রীতি-নীতি রয়েছে তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। অথচ, বর্তমান হিন্দুধর্মের স্বঘোষিত ঠেকাদার আরএসএস-বিজেপি হিন্দু বলতে যেই জনগোষ্ঠীর কল্পনা করে তাতে এই বিবিধতা নেই। তাই তারা রামকে ভগবান বলে মনে করলেও পশ্চিমবঙ্গ অথবা তামিলনাড়ুতে রামের সেই স্থান নেই, যদিও তাদের অধিকাংশ মানুষই হিন্দু। তবু জোর করে রামকে পশ্চিমবঙ্গ অথবা তামিল মানুষের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য আরএসএস বদ্ধপরিকর। এই একমুখী হিন্দুধর্মের ধারণার কারণেই উত্তরপ্রদেশের মত রাজ্যে দুর্গাপুজোর সময় আমিষ খাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, যেখানে পশ্চিমবঙ্গে সেইসময় আমিষ খাওয়াই রীতি।

আমিষের প্রসঙ্গ যখন এসেই গেল, তখন উল্লিখিত বইটিতে হিংসা এবং অহিংসা বিষয়ক পরিচ্ছেদে আম্বেদকর যেই আলোচনা করেছেন, তার দিকে নজর দেওয়া যাক। গোটা দেশজুড়ে গো-মাতা রক্ষার নামে হিন্দুত্ববাদীরা আখলাখ-জুনেইদ-পেহলু খানের মতন বহু মুসলমানকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। অথচ আম্বেদকর হিন্দু পুরাণ, মহাকাব্য ও বেদের থেকে উদাহরণ দিয়ে দেখাচ্ছেন যে আমিষ খাওয়া, মাংস ভক্ষণ হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। আবার আম্বেদকরের ভাষায়,
Flesh-eating was thus quite common. From the Brahmans to the Shudras everybody ate meat. In the Dharmasutras numerous rules are given about the flesh of beasts and birds and about fishes.- Riddles in Hinduism, B. R. Ambedkar, Navayana Publications, Page 97.

অন্যত্র আম্বেদকর আরও স্পষ্টভাবে বলছেন যে ঋকবেদের আর্যরা গো-বধ করত এবং গো-মাংস ভক্ষণ করত। গো-হত্যা করে অতিথি আপ্যায়নের রীতি এতটাই প্রসারলাভ করেছিল যে অতিথিকে সংস্কৃত ভাষায় 'গোঘ্ন' বলে সম্বোধন করা হয়, যার অর্থ গো-হত্যাকারী। আম্বেদকরের ভাষায়,
That the Aryans of the Rig Veda did kill cows for purposes of food and ate beef is abundantly clear from the Rig Veda itself. In Rig Veda (X.86.14) Indra says, ‘They cook for one 15 plus twenty oxen’...

“The killing of the cow for the guest had grown to such an extent that the guest came to be called ‘Go-ghna’, which means the killer of cows.- Untouchability and the Dead Cow, B. R. Ambedkar, included in The Myth of the Holy Cow (D. N. Jha). Page: 188.

এই প্রবন্ধেই আম্বেদকর বলছেন যে আদিম যুগে হিন্দু তথা ব্রাহ্মণরাও গো-মাংস ভক্ষণ করলেও পরে তা কমে এসে প্রায় অবলুপ্ত হয়। কিন্তু তবু দলিত সম্প্রদায়ের মানুষরা এখনও মৃত গরুর মাংস ভক্ষণ করে। আম্বেদকর এই বিষয়টিকে এতটাই গুরুত্ব দেন যে তিনি মনে করেন যে গো-মাংস ভক্ষণকারী মানুষরাই পরবর্তীকালে দলিত হিসেবে চিহ্নিত হয়।

এই প্রসঙ্গ থেকেই চলে আসা যেতে পারে বর্ণপ্রথার উৎপত্তির তত্ত্বে। আম্বেদকর 'Riddles in Hinduism' বইতে দেখাচ্ছেন যে বর্ণপ্রথার উৎপত্তিকে কেন্দ্র করেও হিন্দু গ্রন্থগুলিতে প্রচুর মতের অমিল রয়েছে। অধিকাংশ মানুষ মনে করেন যে ঋকবেদের পুরুষসূক্তে বর্ণব্যবস্থার উৎপত্তির কথা বলা আছে, যেখানে আদি পুরুষকে খণ্ডিত করে একেকটি খণ্ডের থেকে একেকটি বর্ণের জন্ম। পুরুষের মুখ থেকে উৎপত্তি ব্রাহ্মণের, বাহু থেকে জন্ম ক্ষত্রিয়ের, থাই থেকে জন্ম বৈশ্যের এবং পা থেকে জন্ম শূদ্রের। অথচ, আম্বেদকর দেখাচ্ছেন শতপথ ব্রাহ্মণ, মনুস্মৃতি ইত্যাদি ভাষ্যে এই উৎপত্তির তত্ত্বের প্রকারভেদ ঘটছে। যদিও ব্রাহ্মণদের উচ্চ আসন এবং শূদ্রদের সর্বনিম্ন আসনের অবস্থানটি একই থাকছে। তবু, বর্ণব্যবস্থার উৎপত্তির তত্ত্বে এই প্রভেদ কেন, এই প্রশ্ন আম্বেদকর তুলছেন। অর্থাৎ, আম্বেদকর মানুষের যে শুভবুদ্ধি এবং যুক্তিবাদী মন তাকে জাগাতে চাইছেন। বলতে চাইছেন যে যেই তত্ত্বে আপনারা বিশ্বাস করছেন তার নিজস্ব প্রচুর অসঙ্গতি রয়েছে। এই অসঙ্গতিপূর্ণ যুক্তিহীন তত্ত্বের বশবর্তী হয়ে কেন আপনারা অন্যদের উপর অত্যাচার করছেন?

'Riddles in Hinduism'-এর সূচনাতে আম্বেদকর বলছেন,
This book is an exposition of the beliefs propounded by what might be called Brahmanic theology. It is intended for the common mass of Hindus who need to be awakened to know in what quagmire the Brahmans have placed them and to lead them on to the road of rational thinking.

উপরোক্ত বিষয়গুলি বাদ দিয়েও আম্বেদকর বহু নিবন্ধে হিন্দুধর্মের তাত্ত্বিক সমালোচনা করেছেন। রাম এবং কৃষ্ণকে নিয়ে তাঁর মূল্যায়ন আজকের দিনে কেউ সাহস করে স্বনামে ছাপলে তার জেল হওয়া প্রায় অবধারিত। 'Riddles in Hinduism' বইতে আম্বেদকর রামের তীব্র সমালোচনা করছেন বিভিন্ন বিন্দুতে - বালিকে লুকিয়ে হত্যা করা, রাবণ বধের পরে সীতার প্রতি রামের আচরণ, অযোধ্যায় ফিরে এসে আবার সীতাকে বনবাসে পাঠানো, এবং সর্বশেষে সীতাকে আবার অগ্নিপরীক্ষা দিতে বলা। একইরকম ভাবে মহাভারতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি কৃষ্ণের তীব্র সমালোচনা করেন।

আবার অন্য একটি লেখায়, আম্বেদকর ভগবদগীতার তাত্ত্বিক সমালোচনা করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে গীতা একটি বুদ্ধযুগ পরবর্তী ভাষ্য যার প্রধান উপযোগিতা বৌদ্ধধর্মের প্রধান মতগুলির বিরোধিতা করা আবার একইসঙ্গে বৌদ্ধধর্মের গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপাদানকে হিন্দুধর্মের আওতায় নিয়ে আসা (Krishna and His Gita, B. R. Ambedkar in Essential Writings of B. R. Ambedkar, Edited by Valeaian Rodrigues)। এই সমস্ত আলোচনা এই ছোট নিবন্ধের পরিসরে করা সম্ভব নয়।

কিন্তু দুটি প্রশ্ন এই প্রেক্ষিতে তুলতে চাই। প্রথমত, আম্বেদকর কেন হিন্দুধর্মের এত তীব্র সমালোচনা করলেন? আমার মনে হয় এর কয়েকটি কারণ রয়েছে। আম্বেদকর বুঝতে পেরেছিলেন যে হিন্দুধর্মের সংস্কারের মাধ্যমে জাতিপ্রথা এবং অস্পৃশ্যতার বিলোপ সম্ভব নয়। তাঁর বিখ্যাত 'Annihilation of Caste' বক্তৃতায় আম্বেদকর পরিষ্কার বলছেন যে জাতি বিলোপের জন্য শ্রুতি এবং স্মৃতির ধর্ম ধ্বংস করতে হবে, এছাড়া কিছু হবে না। এই কথার যুক্তি হিসেবে আম্বেদকর বলছেন যে বেদ, শাস্ত্র ইত্যাদিতে কোনো যুক্তি বা নৈতিকতা (morality) নেই। অথচ এই যুক্তিহীনতাই জাতিপ্রথার ভিত্তি যা উপরে ইতিমধ্যেই বলা হয়েছে। অতএব, জাতপ্রথার বিলোপ চাইলে যুক্তির ভিত্তিতে করতে হবে যা বেদ অথবা শাস্ত্রে নেই। অথচ বেদ বা শাস্ত্রই হিন্দুধর্মের নীতি নির্ধারক। অতএব যুক্তিকে প্রতিষ্ঠা করতে যুক্তিহীনকে বর্জন করতে হবে। আম্বেদকরের ভাষায়,
Reason and morality are the two most powerful weapons in the armoury of a reformer... . How are you to break up caste, if people are not free to consider whether it accords with reason? How are you going to break up caste if people are not free to consider whether it accords to morality? ...if you wish to bring about a breach in the system then you have got to apply the dynamite to the Vedas and the Shastras, which deny any part to reason, to Vedas and Shastras, which deny any part to morality. You must destroy the religion of the Shrutis and Smiritis. Nothing else will avail.- Annihilation of Caste, in Essential Writings of B. R. Ambedkar, Edited by Valerian Rodrigues, Page: 297-298.

অর্থাৎ, আম্বেদকরের যা মূল লক্ষ্য, অর্থাৎ জাতিহীন সমাজের গঠন, তার পথে প্রধান বাধা কুযুক্তি এবং নৈতিকতা, যার ধারক-বাহক, আম্বেদকরের মতে হিন্দু শাস্ত্র ও বেদ। অতএব তিনি বলতে চাইছেন যে এই মতাদর্শের বাইরে মানুষকে আসতে হলে যুক্তি ও নৈতিকতার পক্ষে মানুষকে থাকতে হলে বেদ-স্মৃতি-শ্রুতি বর্ণিত ধর্মীয় আচারের বাইরে আসতে হবে। অতএব বোঝাই যাচ্ছে হিন্দুধর্মের প্রধান ভাষ্যকেই যেখানে আম্বেদকর তীব্র আক্রমণ করছেন সেখানে হিন্দুত্ববাদীদের কুযুক্তির বিরুদ্ধে তাঁর বক্তব্য কতটা ধারালো হত।

কিন্তু অনেকেই মনে করেন যে দলিতরাও তো হিন্দু সমাজেরই অঙ্গ। গোটা দেশে হিন্দুত্বকে প্রসারিত করতে হলে শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের সমর্থন নিয়ে সরকার গড়া যায় না। অতএব, দলিতদেরকেও হিন্দুত্বের সঙ্গে জুড়তে চাওয়া অবশ্যম্ভাবী। বিভিন্নভাবে হিন্দুত্ববাদীরা দলিতদের মধ্যে সমর্থন বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন। কীভাবে তা সম্ভব হয়েছে তা অন্য কোনো প্রবন্ধের বিষয়। আপাতত আমাদের প্রশ্ন, তাত্ত্বিক দিক দিয়ে দেখলে দলিতদের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদ কি সামঞ্জস্যপূর্ণ? আম্বেদকর কী মনে করতেন যে হিন্দুধর্মের মধ্যেই দলিতদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত থাকছে?

তা যে তিনি মনে করতেন না তার সব থেকে বড় প্রমাণ বৌদ্ধধর্মে তার দীক্ষিত হওয়া। বৌদ্ধধর্মে তিনি দীক্ষিত হয়েছেন ১৯৫৬ সালে। কিন্তু তার থেকেও ২০ বছর আগে ১৯৩৬ সালের মাহার জাতির সম্মেলনেই এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ হিন্দুধর্মকে পরিত্যাগ করবেন। ধর্মান্তকরণ করে কেন আম্বেদকর বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তার নেপথ্যেও প্রচুর তাত্ত্বিক আলোচনা তিনি করেছেন। কিন্তু আপাতত আমাদের নিবন্ধের জন্য এটা বোঝাই জরুরি যে আম্বেদকর শেষ অবধি এটা মনে করেননি যে হিন্দুধর্মের মধ্যে থেকে দলিত সম্প্রদায়ের উন্নতি করা সম্ভব। ১৯৩৫ সালেই তিনি বলেছিলেন, “Even though I was born in the Hindu religion, I will not die in the Hindu religion”।

দলিত জাতির ধর্মান্তকরণ প্রসঙ্গে আম্বেদকর বলছেন যে তাদের বিরুদ্ধে যুগ যুগ ধরে যে অন্যায় হয়ে এসেছে তাকে মান্যতা দিয়েছে হিন্দুধর্ম। তাহলে কীভাবে হিন্দুরা দলিতদের হিন্দুধর্মের আওতায় থাকতে বলছেন, কেনই বা দলিতরা হিন্দুধর্মের আওতায় থাকবেন যেখানে তাদের পশ্চাদপদতা এবং অবিচারের জন্য প্রধানত হিন্দুধর্মই দায়ী। আম্বেদকরের ভাষায়,
...the wrongs to which the Untouchables are subjected to by the Hindus are acts which are sanctioned by the Hindu religion. They are done in the name of Hinduism and are justified in the name of Hinduism... . How can the Hindu ask the Untouchable to accept Hinduism and stay in Hinduism? Why should the Untouchables adhere to Hinduism which is solely responsible for their degradation? How can the Untouchables stay in Hinduism?- Conversion, B. R. Ambedkar in Essential writings of B. R. Ambedkar. Page: 228-229.

অতএব, আম্বেদকর মনে করেননি যে হিন্দুধর্মের নবজাগরণ করে, মুসলমান সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করে, ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তিদের সঙ্গে আপোস করে দলিতদের মুক্তি সম্ভব। হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে অথবা হিন্দুধর্মের অন্তর্দ্বন্দ্ব, অসঙ্গতিপূর্ণ তাত্ত্বিক কাঠামোকে মানুষের সামনে তুলে ধরে আম্বেদকর মানুষের যুক্তিবাদী মনের উপরে ভরসা রেখেছিলেন যে তারা এই যুক্তিহীন তত্ত্বকে বর্জন করে সার্বিক মানবমুক্তির পথে এগিয়ে যাবে। তিনি মনে করেছিলেন যে হিন্দুধর্মের মৌলিক বক্তব্য এবং আচারের সঙ্গে দলিতদের বিরোধ রয়েছে, কারণ হিন্দুধর্মেরই রীতি মেনে তাদের উপর যুগ যুগ ধরে অত্যাচার করা হয়েছে।

‘কোনদিক বেছে নিবি তুই?’

এবারে ফেরা যাক প্রবন্ধের শুরুর ছবিতে। আম্বেদকর বনাম বাবরি মসজিদ ধ্বংস - ‘কোনদিক বেছে নিবি তুই’। বাবরি মসজিদ যারা ধ্বংস করেছে তারা করেছে কুযুক্তিকে ভর করে, হিন্দুধর্মের একটি সংকীর্ণ ধারণাকে সামনে রেখে। অন্যদিকে আম্বেদকর মনে করতেন হিন্দুধর্মের তাত্ত্বিক কাঠামোটি অসঙ্গতিপূর্ণ এবং অযৌক্তিক। তিনি মনে করতেন দলিত মানুষের মুক্তি হিন্দুধর্মের নেতাদের ধামা ধরে থাকলে সম্ভব হবে না। বরং জাতি বিলোপের রাজনীতি তথা মতাদর্শের জন্য প্রয়োজন হিন্দুধর্মের তীব্র সমালোচনা, যার মাধ্যমে দলিত মানুষ নিজেদের অধিকার বুঝতে পারবেন, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন বর্ণহিন্দুরা এই অযৌক্তিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে জাতিপ্রথার বিরুদ্ধে মতামত সংগঠিত করবেন জাতি বিলোপের লক্ষ্যে।

অতএব, ভারতের সামনে দুটি পথ খোলা রয়েছে। প্রথমত, বাবরি মসজিদ যেই পথে ধ্বংস হয়েছিল, যেই পথ আজ রাজপথে পরিণত হয়েছে, সেই পথে আরো বেশি করে সর্বনাশের দিকে এগিয়ে যাওয়া। অথবা আম্বেদকরের পথে দলিত-নিপীড়িত মানুষের পক্ষে আন্দোলন সংগঠিত করা যার একটি প্রধান শর্ত হিন্দুত্ববাদী শক্তির বিরুদ্ধে মতাদর্শগত এবং রাজনৈতিক লড়াই। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, প্রগতিশীল, বাম, গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে বর্তমান ভারতে আম্বেদকরের শরনাপন্ন হতে হবে। আম্বেদকরের মননে যে বৈপ্লবিক উপাদান রয়েছে তাকে জনপ্রিয় করে তুলে আরএসএস-বিজেপি যে একমাত্রিক হিন্দু রাষ্ট্রের গঠন করতে চায়, তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এই প্রতিরোধে আরো বহু মনীষীর কাছে আমাদের হাত পাততে হবে, কিন্তু আম্বেদকর অবশ্যই অপরিহার্য।


সূত্রঃ

● Ambedkar, B. R. (2020). Riddles in Hinduism, Navayana Press.
● Ambedkar, B. R. (2002). The Essential Writings of B. R. Ambedkar (Edited by Valerian Rodrigues), Oxford University Press.
● Jha, D. N. (2010). The Myth of the Holy Cow, Navayana Press.