আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২৩ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টিনার সামনে ভয়ঙ্কর সময়

গৌতম হোড়


আর্জেন্টিনা যেদিন বিশ্বকাপ জেতে, সেদিনই আমার এক বিদেশি সহকর্মী ব্রাজিল থেকে বুয়েনস আয়ার্সে গিয়েছিলেন। খেলায় জেতার পর আর্জেন্টিনার মানুষ খুব স্বাভাবিকভাবেই নেমে এসেছিলেন রাস্তায়। আমার ওই সহকর্মী যখন রাস্তার সেই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করছিলেন, তখন এক আশ্চর্য ছবি দেখেন। একজন দৃষ্টিহীন মানুষ এসে দাঁড়িয়েছেন দোতলার বারান্দায়। জয়ের উল্লাস আরও ভালো করে শুনবেন বলে। তাঁকে দেখে সেই বারান্দার সামনে থেমে গেল জনতা। মানুষের সংখ্যা বাড়তে শুরু করল। একটা সময় প্রচুর মানুষ নিচে দাঁড়িয়ে তাঁকে শোনাতে লাগল তাদের আনন্দের কোলাহল। আর দৃষ্টিহীন বৃদ্ধও উজ্জ্বল মুখে শুনতে লাগলেন সেই রব। সেই দৃশ্য টিকটকে দেওয়ার পরই খুব কম সময়ের মধ্যে ৪৫ লাখ মানুষ তা দেখে ফেললেন।

বিশ্বকাপ জয়ের পর দুইদিন ধরে আর্জেন্টিনার মানুষ সারারাত রাস্তায় কাটিয়েছেন। আনন্দ করেছেন। উল্লসিত হয়েছেন। বিশ্বের যেখানে যত আর্জেন্টিনার সমর্থক আছেন, তারাও উন্মুখ হয়েছিলেন এই জয়ের জন্য। ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ জয় তাদের আনন্দে উতরোল করবে, জানাই কথা। আর্জেন্টিনা বাদ দিয়ে দু‘টি দেশে এই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ সবচেয়ে বেশি ছিল। এই দুটি দেশই প্রতিবেশী। ভারত ও বাংলাদেশ। তবে ভারত মানে পুরো ভারত নয়। মূলত পশ্চিমবঙ্গ। এপার-ওপার দুই বাংলা। দুই অর্ধেই অর্জেন্টিনাকে ঘিরে পাগলামি সম্ভবত আগের সব মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

ম্যাচ শেষ হতেই রাত বারোটার পর আর্জেন্টিনার ছোট-বড় পতাকা নিয়ে কলকাতার রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন কাতারে কাতারে মানুষ। হইহই, চিৎকার, পতাকার আন্দোলন, মেসির নামে জয়ধ্বনি, উদ্দাম নাচ-সহ বাঁধনহারা এই আনন্দের প্রকাশ দেখে মনে হতে পারে, ভারতই বুঝি বিশ্বকাপ জিতে গেছে। ওপারের ছবিটা এর থেকে আলাদা কিছু ছিল না। বাংলাদেশে তো বিশ্বকাপ নিয়ে গোলমালের জেরে মানুষ পর্যন্ত মারা গেছেন। পশ্চিমবঙ্গে অন্তত আবেগ ওই জায়গায় পৌঁছায়নি, তাতেই নিজেদের ভাগ্যবান ভাবা যেতে পারে।

২০২২-এর জনগণনা অনুসারে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখেরও বেশি। আর পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা হলো নয় কোটি। তাহলে দুই বাংলার জনসংখ্যা হলো অন্ততপক্ষে ২৫ কোটি। আমরা ধরে নিলাম, এর মধ্যে ৫০ শতাংশ মানুষের সঙ্গে ফুটবলের কোনও যোগ নেই। তাহলে সাড়ে বারো কোটি মানুষকে বিশ্বকাপ ফুটবল আন্দোলিত করে। আরও আড়াই কোটিকেও নাহয় ছেঁটে দেওয়া হলো। তাহলে ১০ কোটি বাঙালি ফুটবল নিয়ে পাগলামি করেন বা আবেগে ভাসেন। এবার যেরকম উন্মাদনার ছবি সামনে এসেছে, তাতে ব্রাজিল, পর্তুগাল বিদায় নেওয়ার পর সেমিফাইনাল ও ফাইনালে অন্তত আট কোটি বাঙালি আর্জেন্টিনার হয়ে গলা ফাটালে অবাক হওয়ার কিছু নেই।সংখ্যাটা একটু কমবেশি হলেও অসুবিধা নেই।

এর পাশাপাশি আর্জেন্টিনার অবস্থাটা একবার দেখা যাক। ওয়ার্ল্ডোমিটার বলছে, আর্জেন্টিনার এখন জনসংখ্যা চার কোটি ৬০ লাখের মতো। তার মানে আর্জেন্টিনার গোটা দেশ যদি ফুটবলে এই সাফল্যে আলোড়িত হয়, তাহলেও তার থেকে অনেক অনেক বেশি বঙ্গসন্তান সাদা-নীলের বিশ্বকাপ জয়ে আনন্দে ফেটে পড়ে মনে করছেন, তারাই জিতলেন। যেভাবে বিশ্বকাপের আগে দুই বাংলায় একের পর এক এলাকা আর্জেন্টিনার পতাকায় সজ্জিত হয়েছে, মেসি, মারাদোনার ছবিতে হাল ফিরেছে দেওয়ালের, পতাকায় ছেয়ে গেছে চারদিক, ততটা উন্মাদনা জয়ের আগে বুয়েনস আয়ার্সেও হয়েছে কি না সন্দেহ।

পলিটিকো তার রিপোর্টে জানাচ্ছে, এই বছর আর্জেন্টিনায় মুদ্রাস্ফীাতি প্রায় একশ শতাংশ ছুঁয়েছে। আর্জেন্টিনার মধ্যবিত্তদের সঞ্চয় দ্রুত কমছে। পেসোর দাম কমেই চলেছে। আর্জেন্টিনার রাস্তায় গৃহহীনদের সংখ্যা বাড়ছে। গরিব মানুষ যেভাবে পারে দিন গুজরানের চেষ্টা করছে। এই বিশ্বকাপ জয়ে সার্বিক হতাশা সাময়িকভাবে কিছুটা কমবে, কিন্তু তারপর এই উন্মাদনা চলে গেলে আবার দিনযাপনের যন্ত্রণা তাদের গ্রাস করতে বাধ্য।। সেই কথায় পরে আসছি, তার আগে বলে নেওয়া ভালো, বিশ্বকাপের গ্রুপ লিগে আর্জেন্টিনার খেলা যেদিনই ছিল, সেদিনই, সেদেশের টিভি চ্যানেল ও রেডিওগুলি অবধারিতভাবে ভারত থেকে জানতে চেয়েছে, কলকাতায় কী করে এত সমর্থক তাদের দেশকে সমর্থন করছে। এই উন্মাদনায় আক্রান্ত হচ্ছে।

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় বা জেএনইউ-র স্প্যানিশ ভাষার অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অপরাজিত চট্টোপাধ্যায় গোটা বিশ্বকাপজুড়ে ব্যস্ত থেকেছেন আর্জেন্টিনার একের পর এক টিভি ও রেডিও চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দিতে। তাঁকে এটা বোঝাতে রীতিমতো বেগ পেতে হয়েছে যে, প্রথমে মারাদোনা ও পরে মেসির জন্য কোটি কোটি বাঙালি আর্জেন্টিনার কট্টর সমর্থক হয়ে গেছে। তারপর অবধারিতভাবে শেষ যে প্রশ্নটা অপরাজিতের কাছে এসেছে, তা হলো, যে দেশে এরকম ফুটবলপাগল সমর্থক আছে, ভালো ফুটবল যাদের আলোড়িত করে, সেই দেশ বিশ্ব ফুটবল মানচিত্রে এত তলায় কেন? এশিয়ার ভালো ফুটবল খেলিয়ে দেশের তালিকাতেও তারা এত পিছনে কেন? অধিকাংশ দেশ তো জানেই না ভারতে ফুটবলও খেলা হয়। তারা জানে ভারত শুধু ক্রিকেট খেলে। এটা বোঝাতেও অপরাজিতের প্রচুর অসুবিধা হয়েছে যে, ভারতে পরিকাঠামো নেই, উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই, সরকারি সাহায্য নেই, পরিকল্পনা নেই। এখন ভারত ফুটবলে শুধু সাফ গেমসে সোনা পেলেই অভিনন্দনের ঢল নামে। বিশ্বকাপ জয়ের দুইদিন পরেও আর্জেন্টিনার রেডিও ও টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন অপরাজিত।

আর্জেন্টিনার টিভি-রেডিওকে অপরাজিত বলেছেন, বিশ্বকাপে মারাদোনার খেলা দেখার পরই তাঁর প্রেমে পড়ে যান ফুটবলপাগল বাঙালির একটা বড় অংশ। পরে মারাদোনা কলকাতায় এসেছেন। মেসিও এসেছেন। তাই তাদের নিয়ে উন্মাদনা আরও বেড়েছে। তবে যে কথাটা তিনি বলেননি, সেটা হলো, বাঙালিদের একজন আইকন চাই। সেই আইকনকে ধরেই তারা বাঁচে। সেই আইকনকে ধরেই তারা তাদের সমস্যা, ব্যর্থতা, অসাফল্য সবকিছু ভুলে থাকতে চায়। নিজেরা ক্ষুদ্রতা থেকে উপরে উঠতে চায় না বা পারেও না। বরং অন্যের সাফল্যে তারা আলোকিত হয়ে থাকতে চায়। নিজের হাতের কাছে আইকন না থাকলে তারা তখন অন্য দেশের দিকে তাকায়। সে কারণেই মারাদোনা, মেসি, নেইমার, রোনাল্ডোকে নিয়ে এতটা উন্মাদনা। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির শেষ বড় আইকন হলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। তবে ইদানিং তাঁর সময় খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। আর বিশ্বকাপে ফুটবল উন্মাদনার সময়ে তাঁকে নয়, মেসি, নেইমার, রোনাল্ডোকে নিয়ে মাতামাতি বেশি হবে, সেটাই স্বাভাবিক। তার উপর টিভি আছে। তাদের চাহিদা আছে। সেখানে মুখ দেখানোর সুযোগ আছে। ফলে বাঙালিকে আর পায় কে! উন্মাদনা, মিছিল, পতাকা আন্দোলিত করা, আইকনের নামে জয়ধ্বনি দেওয়া, সবচেয়ে বড় কথা, হুজুগে ভেসে যাওয়া তো বাঙালির কতদিনের পুরোনো রোগ। ফলে নিজেরা কিছু করতে পারি বা নাই পারি, অন্য দেশের আইকনকে নিয়ে নাচানাচি তো করতেই পারি। তাতেই সবকিছু ভুলে থাকা যায়। পানশালা থেকে শুরু করে চায়ের আড্ডায় তুফান তোলা যায়, তর্ক করা যায়, বিপক্ষকে গালগাল দেয়া যায়, ব্যঙ্গ করা যায়, কয়েকটা দিন অন্য সব সমস্যার বাইরে গিয়ে থাকা যায়। মার্ক্স সাহেব এই সময় জন্মালে আফিম খুঁজে খুঁজে পাগল হয়ে যেতেন। এত আফিম চারদিকে যে বলার নয়।

শাসকরাও তো চায়, সবসময় একটা হুজুগ থাকুক। ফুটবলের পর পার্ক স্ট্রিটের ক্রিসমাস বা নিউ ইয়ার, সেটা গেলে বইমেলা, খাদ্যমেলা, বস্ত্রমেলার মতো হাজারো মেলা, খেলার স্রোতে গা ভাসিয়ে দাও। সমস্যা, দুর্নীতি, বেনিয়ম, মস্তানদের দাদাগিরি, সিন্ডিকেট এ সব তো থাকেই, যারা লঙ্কায় যায়, তারাই রাবণ হয়। ফলে সেসব দিকে তাকানোর সময় নেই। বরং বিশ্বকাপ, সেন্ট্রাল পার্ক, পার্ক স্ট্রিট নিয়ে থাকা ভালো। ৪জির পর ৫জি এসে গেল। ফলে মোবাইল এখন আরও আকর্ষণীয়, আরো দ্রুতগতির, আরও চমকপ্রদ। ফলে বিনোদনের সব আয়োজন সম্পূর্ণ। সেই কবে রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন, কোন খেলা যে খেলব কখন, ভাবি বসে সেই কথাটাই। আমরা ভাবি, কোন খেলা যে দেখব কখন! ইউরো কাপ, বুন্দেশলিগা, লালিগা, কোপা অ্যামেরিকা, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, আইপিএল, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, টি-টোয়েন্টি সিরিজ, কবাডি লিগ। বঙ্কিমের কথাগুলো একটু বদল করে বলাই যায়, খেলার সুবাতাস বহিতেছে দেখিয়া তাহাতে জাতীয় পতাকা উড়াইয়া দাও, তাহাতে নাম লেখ মেসি, মেরাদোনা। আর জাতীয় পতাকাটাও আর্জেন্টিনার হতে হবে। আর বাঙালি তো আন্তর্জাতিকতাবাদের পথিক। ফলে সেই পথ নিলে আপত্তি কীসের!

আর্জেন্টিনার কথায় আবার আসা যাক। ৩৬ বছর পরে বিশ্বকাপ জেতার আনন্দ কতদিন স্থায়ী হবে? এক সপ্তাহ, এক মাস, তারপর? তারপর তো সেই কষ্ট, ক্ষোভ, যন্ত্রণা ও দিনযাপনের কঠিন সংগ্রামের কাহিনি। 'ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস' একটা সুন্দর হেডিং করেছে, ‘দ্য মেসি ইকনমি অফ লিওনেল মেসিস আর্জেন্টিনা’। গত নভেম্বরে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ছিল ৯২ শতাংশ। এক বছর আগে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৫০ শতাংশ। আইএমএফ-সহ অন্যরা বলছে, ২০২৩ সালে মুদ্রাস্ফীতির হার হবে ৮৩ শতাংশ। আর্থিক বৃদ্ধির হারও দুই শতাংশ হতে পারে। মাথাপিছু আয় ১৫ বছর আগের অবস্থায় চলে গেছে। বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার কমে দাঁড়িয়েছে তিন বিলিয়ন ডলারে। ফলে নতুন বছরেও খুব বেশি আশার কথা শোনা যাচ্ছে না। আর্জেন্টিনার অর্থনীতি সামলাবার জন্য একজন মেসিকে তাদের খুব বেশি করে দরকার। না হলে, তারা আরও খারাপ জায়গায় পৌঁছে যেতে পারে। তবে আজ যারা আর্জেন্টিনার পতাকা নিয়ে লাফালাফি করছে, তারা তখন আর সেসব খোঁজ রাখবে না বা তাতে আন্দোলিত হবে না। তাদের কাছে তখন অন্য ইভেন্ট এসে গেছে। কোনও কিছুই তো থেমে থাকে না। ফলে চলমান বিনোদনের আসরে ডুবে থাকতে অসুবিধা কোথায়?