আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২৩ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

বর্তমান সময়ে ভারতবর্ষের ওষুধের বাজার ও কর্পোরেট আধিপত্য

প্রতীশ ভৌমিক


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০০৪ সালের ওয়ার্ল্ড মেডিসিন সিচুয়েশন রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের ৬৫% (তখনকার ৯৮.৮ কোটি মানুষের মধ্যে ৬৪.৯ কোটি) মানুষ আধুনিক ওষুধ ব্যবহার করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। হু (WHO)-র তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে এই অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে। ওষুধের একচেটিয়া অস্বাভাবিক মুল্যবৃদ্ধি সহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম বেড়ে যাওয়াই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার প্রধান কারন।

(১)

বর্তমানে ভারতীয় ওষুধ শিল্প আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম, যার মোট আর্থিক পরিমান ৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি। বিশ্বের ২০০-র বেশী দেশে ভারতবর্ষ থেকে ওষুধ রপ্তানি করা হয়, বিশেষ করে উল্লেখ করা দরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রভৃতি দেশের নাম। বিশ্বে সর্ববৃহৎ জেনেরিক ওষুধের উৎপাদন হয় আমাদের দেশে এবং সারা বিশ্বের প্রায় ২০% বাজারই ভারতের দখলে। আশ্চর্যের বিষয় হল যে, আমাদের সরকার নিজের দেশের বাজারকে উন্মুক্ত করেছে বিদেশি বহুজাতিকদের জন্য। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে ওষুধ শিল্পের জন্য ২০২২-২৩ অর্থবর্ষ থেকে ২০২৭-২৮ অর্থবর্ষে বিক্রির পরিমাণ অভ্যন্তরীণ বাজার বৃদ্ধির জন্য ২,৯৪,০০০ কোটি টাকার উৎসাহদায়ক প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।

বিদেশি সংস্থাগুলোকে ১০০% বিদেশি বিনিয়োগ (Foreign Direct Investment) মারফত স্বাধীন ব্যবসা করার সুযোগ ছাড়াও বেশি পরিমাণে আর্থিক বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতেই উৎসাহদায়ক প্রকল্পের প্রস্তাবনা করা হয়েছে। এপ্রিল ২০২০-২১ সালে প্রায় ১৯.৯০ বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে গ্রীনফিল্ড ইনভেস্টমেন্ট ও ব্রাউনফিল্ড ইনভেস্টমেন্ট মারফত। মূলত সরকারই চাইছে ব্রাউনফিল্ড ইনভেস্টমেন্টের দ্বারা ন্যাশনাল মানিটাইজেশন পাইপলাইন (NMP) প্রকল্পের সদ্ব্যবহার করতে। যেভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রায়ত্ত লাভজনক সংস্থার সম্পত্তি জলের দরে দেশী-বিদেশী সংস্থার কাছে বিক্রি বা লিজ দিয়ে থাকে সেভাবেই এই প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়েছে।

(২)

১৯৯১ সালের পরবর্তী সময় থেকে ওষুধ শিল্প প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের জন্যে উন্মুক্ত হয়েছিল। ২০০০ সাল পরবর্তী সময়ে সরকার উদারনীতির প্রকোপে বাধাহীনভাবে বিনিয়োগের বন্দোবস্ত করে। একচেটিয়া বাজার দখলের জন্য ২০০৬ সালের পরে ওষুধের বিভিন্ন ব্র্যান্ড কেনাবেচা, অধিগ্রহণ করা হয়। ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশীয় ও বহুজাতিক কর্পোরেট, ফলত ভারতীয় বহুসংখ্যক সংস্থা বিক্রি হয়ে যায়। পুঁজি বাজারের বড় কোম্পানি, বিদেশি কোম্পানি তাদের দখলে চলে আসার ফলে VRS, ছাঁটাই ইত্যাদি হয়েছে। আবার বিভিন্ন কোম্পানি চলতি ব্র্যান্ডগুলো কিনে নিয়ে একলাফে অনেকটাই ওষুধের দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল। তখন একচেটিয়া ভাবেই ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছিল। বহুসংখ্যক কোম্পানির মধ্যে যে প্রতিযোগিতা ছিল সেই স্বাস্থ্যকর অবস্থান এক ঝটকায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

(৩)

এবার আসা যাক করোনা পরিস্থিতিতে। তামিলনাড়ুর চেঙ্গালপাট্টুতে আছে ইন্টিগ্রেটেড ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট কমপ্লেক্স', যা কিনা ন্যাশনাল হেল্থ পলিসি ২০০২-এ ‘ইউনিভার্সাল ইমিউনাইজেশন প্রাগ্রাম এগেনস্ট প্রিভেন্টবল ডিসিজ’ প্রকল্পের জন্য তৈরি হয়েছিল। সেই সংস্থার ভ্যাক্সিন তৈরির ক্ষমতা ছিল যথেষ্ট। এদের দিয়ে ভ্যাক্সিন তৈরি করালে এরা একাই করোনা মহামারির সময়ে ভ্যাক্সিন তৈরি করতে পারত। ভারত বায়োটেক বা সিরাম ইনস্টিটিউটের উৎপাদন ক্ষমতার সমকক্ষ এদের ক্ষমতা। এছাড়াও পাস্তুর ইনস্টিটিউট, সেন্ট্রাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট তো ছিলই। সরকারের উদ্যোগে ভ্যাক্সিন উৎপাদন হলে সরকারের কোষাগার ভরে উঠতো। বিদেশেও সেই ভ্যাক্সিন রপ্তানি করা যেতো। জনগনের ভ্যাক্সিনের খরচ বেঁচে যেতো। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সবটাই বেসরকারি বা কর্পোরেট-এর দখলে চলে গেল।

(৪)

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ওষুধ ছিল মহার্ঘ্য। তখন ছিল গুটিকয়েক দেশীয় কোম্পানি আর ছিল একচেটিয়া বহুজাতিকদের দাপাদাপি। ভারতীয় পেটেন্ট আইন ১৯৭০ জারি হবার পরে ‘এক্সক্লুসিভ মার্কেটিং রাইটস’ নিয়ে ভয় ছিল না। IDPL, HAL, BCPL, BI, SMITH Stanistreet প্রভৃতি কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে যেমন মৌল ওষুধ তৈরি হয়েছিল তেমনই আবার জেনেরিক, ব্র্যান্ডেড জেনেরিক ওষুধও তৈরি হয়েছিল। প্রতিযোগিতায় ধাক্কা খেয়ে বহুজাতিকদেরকেও ওষুধের দাম কমাতে বাধ্য করা হয়েছিল। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা থেকে মৌল (API) নিয়ে ব্যক্তিগত মালিকানার দেশীয় কোম্পানি স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছিল। পাশাপাশি ‘ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণ আদেশ’ (Drug Price Control Order) অনুযায়ী ৩৭৮টি ওষুধের মূল্য বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। জনসাধারণ কম দামে ওষুধ কিনতে পারতো। সরকারের বদান্যতায় তালিকায় থাকা ঐ ৩৭৮ সংখ্যা মাত্র ৭৪-তে এসে পৌঁছালো, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে দুর্বল করে দেওয়া হলো, অনেকটা BSNL-এর মতো। এরপরে ২০১১ সালে অত্যাবশ্যক ওষুধের NLEM মূল্য তালিকা তৈরি করলো সরকার।

আগে সরকারের নির্দেশে ওষুধের মূল্য নির্ধারণ হতো উৎপাদন মূল্যের উপর লভ্যাংশ ১০০-১৫০% কে যুক্ত করে। ইচ্ছে করলেই ওষুধের দাম বাড়ানো যেতো না। এখন ওষুধ মূল্য একটি সংস্থা তথ্য সংগ্রহ করে বাজার ভিত্তিক ওষুধের গড় মূল্যকে নির্ধারণ করে। এই দেশে ওষুধের মূল্য আগেই বেড়ে রয়েছে তার আবার গড় মূল্যই বা কি হবে! IMS 'Health' নামে একটি বেসরকারি সংস্থাকে দায়িত্ব দিয়েছে এই ওষুধ মূল্য নির্ধারণ করতে। সরকারের নিয়মেই প্রতি বছর ১০% করে মূল্যবৃদ্ধি পায়। করোনা আবহে মানুষকে খাবার যোগাড় করতে হিমসিম খেতে হয়েছে, অথচ ওষুধের দাম ৩০%- ৫০% বৃদ্ধি হয়েছিল। গত এপ্রিল মাসে ৮০০ ওষুধের উপর আরও ১০% মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। একথা বলতে দ্বিধা নেই যে এদেশের সরকার সরকারী সংস্থার পর্যাপ্ত পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও ওষুধের মৌল উৎপাদন ও মূল্য নির্ধারণে বেসরকারি বা বহুজাতিকদের উপর নির্ভরশীল আর সেই কারনেই সরকারি নিয়ন্ত্রণ ছাড়া বেসরকারিকরণের ছোঁয়ায় আবারও ওষুধ হয়ে উঠেছে মহার্ঘ্য।